রাজ্য শিক্ষা দপ্তর এক বিবৃতি মারফত ঘোষণা করেছে নতুন বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এ’রাজ্যের মিড-ডে-মিলে পুষ্টি বাড়াতে নিয়মিত ডিম, মুরগির মাংস বা মরসুমি ফল দেওয়া হবে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তারজন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হচ্ছে ৩৭১ কোটি ৯০ লক্ষ ৭৮ হাজার ৪০০ টাকা, অর্থাৎ সপ্তাহে বরাদ্দ পড়ুয়া পিছু ২০ টাকা। আর, দৈনিক পড়ুয়া পিছু বরাদ্দ বাড়ল ৩ টাকা ৩৩ পয়সা। প্রশ্ন উঠেছে, এই সামান্য টাকা বাড়ালে প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত ডিম, মুরগির মাংস বা মরসুমি ফল দেওয়া সম্ভব হবে কি?
এরাজ্যে যে বিপুল সংখ্যক মিড-ডে-মিল কর্মী বছরের পর বছর কাজ চালিয়ে আসছেন, যাঁদের বাদ দিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড চলতেই পারে না, তাঁদের ভাতা বৃদ্ধির জন্য কিন্তু বরাদ্দ হল না এক কানাকড়িও। পুজোর সময় রাজ্যের সমস্ত ক্লাবগুলো, পুজো কমিটিগুলোকে দরাজ হাতে তৃণমূল নেতৃ আর্থিক অনুদান বিতরণ করে থাকেন, কিন্তু মিড-ডে-মিল কর্মীদের জন্য নেই কোনো পুজো অনুদান, আজ পর্যন্ত একমাত্র এই রাজ্যে তাঁদের ভাতার বৃদ্ধি করা হলনা। কিন্তু, চারমাসের পুষ্টিকর খাদ্য জোগাতে এই বিপুল সংখ্যক কর্মীদের যে বাড়তি শ্রম দিতে হবে, সেই শ্রমের মূল্যের কোন দাম নেই রাজ্য সরকারের কাছে। অথচ, পঞ্চায়েত ভোটের আগে চারমাসের জন্য এই খুদকুঁড়ো বিতরণের ক্ষেত্রে রন্ধন কর্মীদের যে বড়ই প্রয়োজন! একইভাবে, আশা কর্মীদের গ্রামে গ্রামে নামানো হয়েছে আবাস যোজনার উপভোক্তাদের যাচাই করার কাজে। তাঁদের উপর হামলার খবরও সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। গ্রামীণ কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে, নানা ঝুঁকি নিয়ে এমন এক কাজে নামানো হল, যা তাঁদের বিধিবদ্ধ কাজ বা কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না। এই সমস্ত কাজে আশা কর্মীদেরও বাড়তি কোন আর্থিক অনুদান দেওয়া হচ্ছে না। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সমস্ত কাজের সাথে অহরহ যারা যুক্ত, যাঁদের ছাড়া স্তব্ধ হয়ে যাবে ওই সমস্ত পরিষেবা, তাঁদের শ্রমের কোনো মূল্য কোনো সরকারই দিচ্ছে না — না কেন্দ্র না রাজ্য। এটা রীতিমতো একটা অপরাধ!
এদিকে, শিক্ষা দপ্তরের নিয়োগ সংক্রান্ত যে দুর্নীতি বেশ কয়েক মাস ধরে রাজ্য রাজনীতিকে নাড়িয়ে দেয়, এবার যেন তারই হাত ধরে আবাস প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ রাজ্য রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। পঞ্চায়েত ভোট যত এগিয়ে আসছে, ততই তুঙ্গে উঠছে রাজনৈতিক তৎপরতা। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার সংশোধিত তালিকা প্রকাশ হতেই ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ল — দেখা গেল চোদ্দ লক্ষ এমন প্রাপকের খোঁজ রাজ্য সরকার পেয়েছে যারা অযোগ্য, আর যা মোট প্রাপকের এক-চতুর্থাংশ! ২০১৫ থেকে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা শুরু হওয়ার পর থেকে এই প্রকল্প বাবদ বিস্তর দুর্নীতির রিপোর্ট বারবার বন্যা বেগে আছড়ে পড়তে শুরু করে। হতদরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য বরাদ্দ সরকারি অর্থনিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। প্রকৃত প্রাপকদের কপালে শিকে ছিঁড়ল না, সেই অর্থে গ্রাম বাংলায় গজিয়ে উঠল চোখ ধাঁধানো বিরাট বিরাট অট্টালিকা, দোকান, ক্লাব আর যারা শাসকদলের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে রয়েছেন, তাঁরাই গরিব মানুষের জন্য বরাদ্দ অর্থ নিয়ে এই লুঠতরাজ চালিয়েছে।
এর দায়ভার রাজ্য প্রশাসন ও তৃণমূলের সর্বময়ী নেতৃ কেন নেবেন না — যার অনুপ্রেরণা ছাড়া একটা শৌচালয়ও এই রাজ্যে গড়ে ওঠে না? চরম দুর্নীতির যে খাল কেটে রেখেছেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান, তার মধ্যে দিয়েই কখনো কেন্দ্রীয় এজেন্সির কুমির, কখনো বা কেন্দ্রীয় দল এই রাজ্যে বাড়াবাড়ি রকমের হস্তক্ষেপ ঘটানোর নৈতিক বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে, চরম ফ্যাসিস্ট বিজেপি দলটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেন প্রধান কাণ্ডারি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। আবাস যোজনার কাজে কতটা অগ্রগতি ঘটল তা সরেজমিনে দেখতে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের একটি দল রাজ্যে পা রেখেছে। বিভিন্ন জেলায় গ্রামে গ্রামে তারা পরিদর্শন শুরু করে দিয়েছেন। শুনছেন সরাসরি বঞ্চিত প্রতারিত মানুষের অভিযোগ। এমনকি কোথাও কোথাও বিরোধী দলের সাথেও দেখা করছে এই কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকদের দলটি।
কী কেন্দ্র কী রাজ্য — উভয় সরকারগুলো আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের সংকীর্ণ স্বার্থে চালিত। তাই, ঠিক ভোটের মুখে আবাস সমস্যা, বা মিড-ডে-মিলে পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ নিয়ে তড়িঘড়ি পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হচ্ছে। আর, মিড-ডে-মিলে পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজনীতা যেন মাত্র চারমাস! নির্বাচনের পরই তা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। কী নিলর্জ্জভাবেই না রাজ্য সরকার এই কর্মসূচি ফেরি করতে নেমেছে।
চারমাসের এই খুদকুঁড়ো পঞ্চায়েত ভোটের বৈতরণী পার করতে কতটা সহায় হবে, তার জবাব মিলবে আগামীদিনে।