বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ অতিমারী শুরু হওয়ার তিনবছর পরও দুনিয়া তার বিপর্যয়কর পরিণাম থেকে মুক্ত হতে পারেনি। প্রসঙ্গত, অন্য কোথাও নয়, যেখানে এই অতিমারীর উৎপত্তি হয়েছিল সেই চিনই এই ভাইরাসঘটিত অতিমারীর প্রাদুর্ভাবের প্রতিক্রিয়া ভোগ করে চলেছে; এবং অতিমারী নিয়ন্ত্রণের নামে রাষ্ট্রের দমনমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্যাপকবিস্তৃত সামাজিক প্রতিবাদও সেখানে দেখা গেছে। দুনিয়ার বাকি অংশে কোভিড-১৯ এখন পিছনে চলে গেলেও জনগণের ব্যাপক অংশ অতিমারী সৃষ্ট অর্থনৈতিক অবনতি, বিশেষভাবে কাজের বিপুল অবলুপ্তি এবং মজুরি হ্রাসের আঘাতে টলমল করছে। এবং রাশিয়ার গর্হিত ইউক্রেন আক্রমণের পরিণামে ইউরোপ এক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যাওয়ায় ঐ অর্থনৈতিক ধাক্কা প্রবলতর হয়ে উঠেছে।
যুদ্ধ দশ মাস চলার পরও তার শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভিত্তিক আগেকার শীতল যুদ্ধের পরিমণ্ডলের পুনরুজ্জীবন আমরা দেখতে পাচ্ছি, এবং দুনিয়াকে আরও একবার পারমাণবিক ফয়সালার কিনারে নিয়ে আসা হচ্ছে। দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক সংকট ও অধোগতির মধ্যে ইউরোপের রাজনীতি বড় আকারে দক্ষিণ মুখে ঘুরেছে যেখানে বেশকিছু দেশে নয়া-ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলোর দ্রুত উদ্বেগজনক উত্থান দেখা গেছে। লাতিন আমেরিকায় অবশ্য সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বেশকিছু নির্বাচনে দক্ষিণপন্থী সরকারগুলোকে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে, যারমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ব্রাজিলে স্বৈরাচারী বোলসোনারোর পরাজয়।
এশিয়ায় আমাদের ঘরের কাছে এক শক্তিশালী গণঅভ্যুত্থান শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষে জমানাকে ক্ষমতাচ্যুত করে, আর ইরানে পোশাক বিধির লঙ্ঘনের অভিযোগে তথাকথিত ‘নীতি পুলিশের’ হাতে মাহসা আমিনির হত্যার পর মহিলাদের নেতৃত্বাধীন সাহসী প্রতিরোধ অব্যাহত রয়েছে। ইরানের নারীদের শক্তিশালী প্রতিবাদ ইরানের ধর্মতান্ত্রিক শাসকদের নামানো নিপীড়নকে অগ্ৰাহ্য করে এক দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলনে বিকাশ লাভ করেছে। ইমরান খান সরকারের পতনের পর পাকিস্তান আরও একবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কবলে পড়েছে, যে পতনের কারণ অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সম্ভবত ছিল ইমরান খানের মার্কিন-বিরোধী বুলিতে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সামরিক কর্তাদের অসন্তোষ।
ভারতে ২০২২ সাল গভীরতর অর্থনৈতিক সংকট এবং ফ্যাসিবাদী আক্রমণের ক্রমবিস্তারের বছর হয়েই দেখা দিয়েছে। পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড নির্বাচনের আগে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সুনিশ্চিত করার যে প্রতিশ্রুতি আন্দোলনরত কৃষকদের দেওয়া হয়েছিল, সরকার নির্লজ্জভাবে তার খেলাপ করেছে। সরকার প্রথমে শ্রম আইনগুলোকে আরও ফলদায়ী করার নামে শ্রমিকদের অধিকারগুলোকে অস্বীকার করে এবং প্রতারণাময় নতুন পেনশন প্রকল্পের মাধ্যমে শ্রমিক ও কর্মচারীদের সামাজিক নিরাপত্তাকে প্রহসনে পরিণত করে; এরপর সেনাবাহিনীতে যোগদান করা যুবকদের পঁচাত্তর শতাংশের সেনাবাহিনীর কাজকে চার বছরের চুক্তি কাজে পরিণত করে কাজের নিরাপত্তার ধারণায় চরম আঘাত হানে। এখন আবার বেশি করে শোনা যাচ্ছে স্থায়ী কাজগুলোকে সরিয়ে সেগুলোর স্থানে ব্যাপক আকারে অস্থায়ী চুক্তির কাজ নিয়ে এসে এই অগ্নিবীর মডেলেরই ঢালাও পুনরাবৃত্তির কথা।
সাধারণ জনগণ যখন মূল্যস্ফীতি, কাজের বিলোপ ঘটা এবং আয় হ্রাসের পরিণামে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে, সরকার তখন এই জ্বলন্ত ইস্যুগুলোকে সাধারণের আলোচনা থেকে নির্বাসিত করতে পণ করেছে। সংঘ বাহিনীর কর্নাটক পরীক্ষাগার সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারকে তীব্রতর করে তুলতে হিজাব পরিধানকে নিষিদ্ধ করে। ‘কাশ্মীরী ফাইলস’ ছবিটিকে কেন্দ্র করে সরকার চালিত সুপরিকল্পিত প্রচারের ওপর ভর করে কাশ্মীরী পণ্ডিতদের দুরবস্থাকে চরম বিদ্বেষময় ও আবেগতাড়িত সাম্প্রদায়িক সমাবেশ ঘটানোর আরো একটা সম্ভাবনাময় অস্ত্রে পরিণত করা হয়। বিধ্বংস করা বাবরি মসজিদ স্থলে রাম মন্দির নির্মাণের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে স্পর্ধিত হয়ে — যে বিধ্বংসকে সুপ্রিম কোর্ট ঐ একই রায়ে আইনের শাসনের সাংবিধানিক কাঠামোর শোচনীয় লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছিল — বিজেপি এখন ১৯৯১ সালের আইনকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে, যে আইন ধর্মীয় উপাসনাস্থলগুলোর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের সময়কার চরিত্রকে অলঙ্ঘনীয় ও চূড়ান্ত বলে গণ্য করার মধ্যে দিয়ে সেগুলো নিয়ে বিবাদে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল।
বিরোধী মতে লাগাম পরানোর সরকারি প্রচেষ্টায় তাল মেলাতে ভারতের ধনীতম কর্পোরেট গোষ্ঠী এখন বিশিষ্ট টিভি চ্যানেল অধিগ্ৰহণ করেছে, যে চ্যানেল ‘গোদি মিডিয়া’র বাঁধাধরা কাজের তোয়াক্কা না করে ভারতীয় জনগণের সামনে থাকা জ্বলন্ত ইস্যুগুলোকে তুলে ধরত। মূলধারার মিডিয়া এইভাবে মোটামুটি বশংবদ মিডিয়ায় পরিণত হয়েছে যা সরকারের পাইকারি হারে বিকৃত তথ্যের প্রচার ও মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করার অভিযানের দোসর হয়ে উঠেছে। যে রভিশ কুমার ছিলেন ভারতের হিন্দি টেলিভিশনের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাংবাদিক, যিনি জীবিকা ও স্বাধীনতার কেন্দ্রীয় ইস্যুগুলোকে তুলে ধরে ঘৃণা ও মিথ্যাচারের ফ্যাসিবাদী প্রচারের মোকাবিলায় নামতেন, সেই রভিশ কুমার মূলধারার টেলিভিশন মাধ্যমকে বিদায় জানাতে বাধ্য হয়েছেন। ভয় এবং জোরজবরদস্তি কণ্ঠ স্তব্ধ করার এই সর্বগ্ৰাসী পরিমণ্ডল সত্ত্বেও নির্বাচনী ক্ষেত্রে জনগণের কণ্ঠস্বরের অনুরণন এখনও শোনা যায়, যেমনটা অতিসম্প্রতি আমরা দেখলাম হিমাচলের নির্বাচনে; বিচার বিভাগও মাঝেমধ্যে সরকারকে তিরস্কার করে ও তার বুলডোজারকে থামিয়ে দেয়, যেমনটা আমরা দেখলাম আনন্দ তেলতুম্বডের জামিন মঞ্জুরির ক্ষেত্রে এবং নির্বাচন কমিশনের নিয়োগের শুনানির সময় মন্তব্যের মধ্যে। সরকার এখন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী এমনকি সংসদ ভবনের মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনাও করলেন জামিনের আবেদনের শুনানি গ্ৰহণ এবং জনস্বার্থ মামলাগুলি শোনার জন্য।
লড়াইয়ের সীমারেখা অত্যন্ত সুস্পষ্ট রূপে টানা হয়ে গেছে। ভারত যখন ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ৭৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর জন্য প্রস্তুত হবে, ভারতের জনগণকে তখন তাদের সমস্ত শক্তি ও সাহসিকতাকে সংহত করে স্বাধীনতা, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়ের সাংবিধানিক ঘোষণার তাৎপর্যের অনুসারী প্রজাতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ঘটাতে হবে। ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি আমাদের আধুনিক গণতান্ত্রিক ভারতের সিংহদুয়ার রূপে সংবিধানকে দিয়েছিল, এখন স্বাধীনতার দ্বিতীয় লড়াইয়ে বিজয়ী হয়ে — ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত হয়ে — আমাদের একে রক্ষা করতে হবে।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২)