আইপোয়া’র উদ্যোগে সাবিত্রী-ফাতিমা-রোকেয়া স্মরণে আলোচনা সভা
initiative of AIPWA

সাবিত্রী বাই ফুলে আর ফাতিমা শেখের জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে, ভারতবর্ষে নারী শিক্ষা বিস্তারে তাঁদের বিপ্লবী ভুমিকাকে স্মরণে রেখে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির উদ্যোগে ৩-৯ জানুয়ারি ২০২৩ ‘জাত ধর্মেভাগ হবো না শিক্ষা ও সাম্যের জন্য লড়ে যাবো’ — এই স্লোগানকে সামনে রেখে সারা দেশে শিক্ষা- অধিকার অভিযান চালানো হয়। পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলাতেও এই কর্মসুচি পালিত হয়।

কলকাতা

৯ জানুয়ারী কলকাতার রাজাবাজার অঞ্চলে আইসিডিএস কর্মীদের পক্ষ থেকে সাবিত্রী বাঈ ফুলে এবং ফতেমা শেখের স্মরণে এক আলোচনা সভা পালন করা হল। এই দুই মহিয়সী নারী সারাজীবন ধরে সমাজের পিতৃতন্ত্র এবং জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। এখানে উপস্থিত ছিলেন ২৫ জন মেয়ে। পার্টির তরফ থেকে উপস্থিত ছিলেন শাহিদা বেগম, রমা রায়, ছন্দিতা ব্যানার্জী, সোনি খাতুন, শবনম এজাজ প্রমুখ। সাবিত্রী বাঈ ফুলে এবং ফতেমা শেখের জীবন নিয়ে আলোচনা করেন শীলা দে সরকার।

একই দিনে সার্ভে পার্কের অম্বুজাতে ফাতিমা শেখ ও সাবিত্রী বাঈ ফুলের জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে বিস্তর আলোচনা সভা হল। সভায় মোট ২০ জন মহিলা সদস্য উপস্থিত ছিলেন, প্রত্যেক মহিলা আলোচনায় অংশ নেন। আলোচনা ৩টে থেকে ৬টা পর্যন্ত চলে। শুরুতে এক মিনিট নীরবতা দিয়ে আলোচনা এগোতে থাকলে তনুশ্রী বিশ্বাস, সুমিত্রা রায়, সাবিত্রী নাইয়া, সুজাতা জানা, শ্যামলী, শিখা, তিথি বক্তব্য রাখেন। সবশেষে ৫ জনের কমিটি তৈরি হল। কিছু কর্মসূচিও ঠিক হয়। এরপর গান, নাচের মধ্যে দিয়ে সভা শেষ হয়।

হাওড়া

হাওড়া জেলার কামারডাঙ্গায় সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির উদ্যোগে নারী শিক্ষার পথিকৃৎ সাবিত্রী বাই ফুলে এবং ফাতিমা শেখের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়। সভার শুরুতে মহিলা সমিতির মাল্যদান ও মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জানান জেলা কমিটির সদস্যা সবিতা কোলে। উপস্থিত সকল কমরেড মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সঙ্গীত পরিবেশন করেন সুষমা মুখার্জী, অন্নেষা দলুই এবং আমাদের ছোট্ট সাথী শ্রাবনী শেখ। নারী শিক্ষার পথিকৃৎ সাবিত্রী বাই ফুলে এবং ফাতিমা শেখ জীবন মরণপণ করে মহিলাদের মধ্যে স্থায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন সেই সম্পর্কে আলোকপাত করে মূল্যবান বক্তব্য রাখেন জেলা কমিটির সম্পাদিকা কল্যাণী গোস্বামী।

উত্তর ২৪ পরগণা

আইপোয়ার উদ্যোগে হালিশহর সাংস্কৃতিক সংস্থার ঘরে ৪০ জন মহিলাদের উপস্থিতে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন কার্মিকিস্কু, রেবা সর্দার এবং অর্চনা ঘটক। সভায় সংগীত পরিবেশন করেন কার্মী কিস্কু, সুনিতা সরেন, মমতা টুডু, মেহুলী চক্রবর্তী ও রীনা মিস্ত্রী।

সভাটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে যখন সভায় উপস্থিত অনেকেই ছোটবেলা থেকে তাঁদের নিজেদের জাত বা ধর্ম বা অর্থনৈতিক কারণে সমাজে যে যে বৈষম্যের সন্মুখীন হয়েছে সেই নিয়ে বক্তব্য রাখেন। কার্মী কিস্কু, রেজিয়া, রীনা মিস্ত্রী ও জেলা কমিটির সদস্য মিঠু চক্রবর্তী নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। এমনকি সুদুর বকখালি থেকে বেড়াতে আসা রমা মন্ডল তার গ্রামে সমুদ্রের উপর বেঁচে থাকা পরিবারগুলোর যুবক-যুবতীদের কোনো কাজ নেই, কাজ করলেও মজুরি নেই, গরিবদের কর্মসংস্থানের কথা কেউ ভাবে না সেই নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন। রন্ধনকর্মী নমিতা ভদ্র রন্ধন কর্মীদের মজুরি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যে টালবাহানা এবং তারা যে অবহেলার শিকার সেই নিয়ে আলোকপাত করেন এবং বলেন লাল পতাকার তলাতেই মহিলাদের আন্দোলনকে সংগঠিত করতে হবে।

সভার মূল বক্তা ছিলেন আইপোয়া রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত। তিনি প্রাচীন কাল থেকে মেয়েদের অবস্থান, মনুবাদী মতাদর্শের বিরুদ্ধে মেয়েদের অধিকারের লড়াই এবং বর্তমানে বিজেপি আরএসএস কিভাবে মেয়েদের, বিশেষ করে দলিত নারীদের অধিকারেরের উপর হামলা নামিয়ে আনছে সেই নিয়ে এক শিক্ষামূলক বক্তব্য রাখেন। জেলা সভাপতি অর্চনা ঘটক সাবিত্রী বাই ফুলে ও ফাতিমা শেখের জীবনী এবং এই ফ্যাসিবাদী আক্রমণের সময়ে তাদের বিপ্লবী ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কেন দরকার সেই নিয়ে বলেন।

সভা পরিচালনা করতে করতে জেলা সম্পাদিকা মিতালি বিশ্বাস তুলে ধরেন ইতিহাসের বিভিন্ন মহিয়সী নারীদের কথা, যারা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নানা বাধা ভেঙে এগিয়ে এসেছেন এবং সাবিত্রী-ফাতিমা-রোকেয়ার মত সাহসী নারীরা জাত ধর্মের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে মেয়েদের শিক্ষার যে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, আজ জাত ধর্মের বিভাজন করে সেই শিক্ষার অধিকারকে কেড়ে নিতে চাইছে বিজেপি সরকার। এর বিরুদ্ধে শিক্ষা ও সাম্যের অধিকারের জন্য এক সংঘবদ্ধ লড়াই গড়ে তুলতে আইপোয়ার সদস্যপদ বাড়াতে হবে এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে সেই বার্তা সভা থেকে উঠে আসে। হালিশহর অঞ্চলের পার্টির কর্মীদের সহযোগিতায় ও আয়োজনে আলোচনা সভাটি হয়।

দক্ষিণ ২৪ পরগণা

মহিলা সমিতির বজবজ শাখা কমিটির নেতৃত্বে বজবজ জেলা অফিসে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ফাতিমা সেখ ও সাবিত্রী বাই ফুলের জন্ম শতবার্ষিকী নিয়ে। নারী শিক্ষার পথিকৃৎ এবং, মহিলাদের মধ্যে স্থায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার সাথে এখনকার ফ্যাসিবাদী সরকারের চিন্তায় মহিলাদের ঘর বন্দী করার চেষ্টা চালাচ্ছে সেটাও ব্যাখ্যা করা হয়। এই আলোচনায় অংশ নেন দেবযানী, অঞ্জনা মাল, মমতাজ বেগম, কল্পনা মন্ডল ও ছাত্রী অনিন্দিতা।

হুগলি

সাবিত্রী ও ফতিমার সঙ্গে বাংলায় নারী শিক্ষার আরেক পথিকৃৎ রোকেয়ার ছবিও রাখা হয়েছিল। সভায় উপস্থিত অধিকাংশই ছিলেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য ও রন্ধনকর্মী।

সভার শুরুতে সাবিত্রী, ফাতিমা, রোকেয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, তাঁদের অবদানের কথা উল্লেখ করে চৈতালি সেন বলেন, আজীবন মেয়েরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বৈষম্য, অপমান, নিপীড়নের শিকার। আবার কর্মসূত্রে তাঁদের অনেকেই শ্রমিক। সেখানে মালিক এবং সরকারের বঞ্চনা ও শোষণের শিকার হতে হয় তাঁদেরই। এই দুটো সত্তাই তো সমান সত্য, দুয়ে মিলেই নারী শ্রমিক। তাই নারী আন্দোলন এবং শ্রমজীবী আন্দোলন দু’টোকে সমন্বয় করে এগিয়ে চালতে হবে আমাদের।

জেলা সম্পাদিকা শিপ্রা চ্যাটাজী, মনুবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের সঙ্গে সঙ্গে আজ নারীবিদ্বেষী ফ্যাসিস্ট বিজেপি আরএসএস’এর বিরুদ্ধে কেন লড়াই জোরদার করতে হবে তা বুঝিয়ে বলেন।

সাবিত্রী, ফাতিমার জাত, ধর্মবিরোধিতার রেশ টেনে সাবিয়া খাতুন বলেন, আমি মুসলিম পরিবারের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে বাইরে বেরিয়ে উপার্জন করি। হিন্দুদের সঙ্গে আমার মেলামেশা ভালোই আছে। সেই পরিবারের ছেলেদের ভাইফোঁটা দিই, তাঁরাও খুশি মনে তা গ্রহণ করেন। আমি জাত ধর্ম মানি না, শুধু জানি সব মানুষের রক্তের রং লাল।

রুমা আহিরী নিজের জীবনযুদ্ধের কথা বলেন। কম বয়সে বিয়ের পর তিনি শ্বশুরবাড়ির বন্ধন অগ্রাহ্য করে মাধ্যমিক পাস করেছেন। আগে ছিলেন মিড-ডে-মিল কর্মী এখন আইসিডিএস পরীক্ষায় পাশ করে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী (সহায়িকা) হয়েছেন। এখনও তাঁর প্রতিদিনের লড়াই অব্যাহত। এই প্রেরণাদায়ক কাহিনী মন দিয়ে সকলে শোনেন। আদিবাসীদের প্রতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে এবং নিজের এলাকায় মেয়েদের সম্মান রক্ষার্থে প্রতিবাদে মুখর হন ময়না কিস্কু।

বেলুন গ্রামের সংগঠক কল্পনা মালিক ও চাঁপা মালিক সভা পরিচালনা করেন। তাঁরা বলেন, আমরা সবে মহিলা সমিতিতে যোগ দিয়েছি। সমিতি আমাদের সমস্যা আমাদের অধিকারের কথা সবার সামনে জোর গলায় বলার সুযোগ করে দিয়েছে, আন্দোলনের পথ দেখিয়েছে। সভাস্থলেই গঠিত হলো সমিতির বেলুন শাখা। সকলেই নিজের নিজের এলাকায় ফিরলেন উৎসাহ নিয়ে।

একই দিনে বলাগড়ের সায়রা গ্রামে স্মরণ দিবস পালিত হয়। সাবিত্রী ও ফাতিমার শিক্ষা আজও কেন প্রাসঙ্গিক সে বিষয়ে আলোচনা করেন জেলা সভানেত্রী শোভা ব্যানার্জী ও জেলা সদস্যা হেনা সুলতানা।

খণ্ড-30
সংখ্যা-2