সম্পাদকীয়
ধ্বংস বিপর্যয় কড়া নাড়ছে দুয়ারে
Destruction

বম্ব সাইক্লোন!

হঠাৎ ভেসে ওঠা এই শব্দবন্ধ বিরাট এক বিভীষিকার হাড় হিম করা চিত্রকল্প সামনে তুলে ধরল। ২০১৯-এ শেষবার এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেখা মেলে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে আবার ২০২২’র বর্ষশেষে আমেরিকা ও কানাডার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ত্রাস সৃষ্টি করে যেভাবে আছড়ে পড়ল এই তুষার ঝড় তা চোখে আঙুল তুলে দেখাল বিশ্ব উষ্ণায়ন আজ কত বড় বিপদ হয়ে আমাদের দোরগোড়ায় নাড়া দিচ্ছে, জলবায়ু সংকটের মাত্রা ও গভীরতা সম্পর্কে এখনও উদাসীন শাসক ও পরিবেশ ধ্বংসকারী অতিমুনাফালোভীদের ঝুঁটি ধরে টান মারল সজোরে।

বর্ষশেষের উৎসব মরশুমে যখন পাশ্চাত্যের এই দেশগুলো মেতে ওঠে, ঠিক সেই সময়ে বম্ব সাইক্লোনের ছোবল বিপর্যস্থ করে দিল আমারিকা ও কানাডার বিরাট এক এলাকাকে, ২৫ কোটির ও বেশি মানুষ প্রকৃতির এই উন্মত্ত রোষে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্থ। তীব্র তুষার ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়েছে শহর থেকে গ্রাম, কনকনে ঠান্ডা ও ঝড়ের প্রভাবে প্রাণ হারিয়েছেন ৭০’র মতো মানুষ — যার প্রভাব পড়েছে তিন হাজারের ও বেশি কিলোমিটার জুড়ে। বাফেলো শহরটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রায় দু’লক্ষ মানুষ ওই প্রবল ঠাণ্ডায় বিদ্যুৎ হীন হয়ে দিন কাটিয়েছেন। পুরু বরফের চাদরের তলায় অসংখ্য গাড়ি চাপা পড়েছে। আবাহবিদরা ক্রমবর্ধমান বিশ্ব উষ্ণায়নকে দায়ী করে জানাচ্ছেন, অদূর ভবিষ্যতে এই ধরনের দুর্যোগ আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তীব্র তাপপ্রবাহ ইতিমধ্যেই গত ৩০ বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতির বহু লক্ষ কোটি ডলারের লোকসান ঘটিয়েছে। আর এর মাশুল সবচেয়ে বেশি দিতে হয়েছে গরিব দেশগুলোকে। এরফলে আরও চওড়া হয়েছে আর্থিক অসাম্য। ডার্কমাউথ কলেজের এক অধ্যাপক জাস্টিন মানকিন তাঁর এক গবেষণা পত্রে দেখিয়েছেন (যা প্রকাশিত হয়েছে প্রখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা ‘সায়েন্স অ্যাডভ্যান্স’এ) প্রকৃতিকে ধ্বংস করার উন্মত্ত এই ট্রাজেডি ডেকে এনেছে বিরাট আর্থিক বৈষম্য। ১৯৯২ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তাপপ্রবাহের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে মূল্য চোকাতে হয়েছে ১৬ লক্ষ কোটি ডলার! এরফলে একদিকে ধনী দেশগুলো যেমন হারিয়েছে তাদের বার্ষিক মাথাপিছু জিডিপি’র ১.৫ শতাংশ, তেমনি তারথেকে অনেক বেশি খুইয়েছে গরিব দেশগুলো। তাদের বার্ষিক মাথা পিছু জিডিপি’র ৬.৭ শতাংশ লোকসান হয়েছে। এর প্রধান কারণই হল, তুলনামূলক গরিব দেশগুলো ট্রপিক বা ক্রান্তিরেখার কাছাকাছি অবস্থিত, আর তাই এই দেশগুলো সহজেই তাপপ্রবাহের শিকার হয়।

হালে, রাষ্ট্রসংঘ এক সমীক্ষায় দেখিয়েছে, ৩৪ হাজার উদ্ভিদ, ৫,২০০ পশুদের প্রজাতি, প্রতি ৮’এর মধ্যে একটি করে পক্ষীদের প্রজাতি আজ বিলুপ্তির পথে! যে বনভূমি গোটা বিশ্বের জীব-বৈচিত্র‍্যকে, ভারসাম্যকে বজায় রাখে, সেই আদি বনাঞ্চলের ৪৫ শতাংশই আজ বিলুপ্ত। মুনাফার লালসায় নির্মম, বোধ-বিচারহীনভাবেই বনাঞ্চলকে কেটে সাফ করা হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিপর্যয়কারী প্রভাব আজ সর্বব্যাপী। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ঝড়-ঝঞ্ঝা, অনাবৃষ্টি, খরা-বন্যা, জীব-বৈচিত্রের উপর সর্বনাশা প্রভাব ও তাদের ক্রম অবলুপ্তি, ফসল উৎপাদনে নেমে আসা সংকট, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নতুন নতুন বিপদ, নেমে আসা অভাব ও প্রতিস্থাপন — এমন বহুমাত্রিক বিপদ ও সংকটের আবর্তে আবিশ্ব।

এর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াতেই হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে। আমাদের ধরিত্রি, গোটা বিশ্বকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার স্বার্থে।

খণ্ড-30
সংখ্যা-1