ব্রাজিল: গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ভয়াবহ ফ্যাসিবাদী হামলা
Brazil_Horrific Fascist Attack

ব্রাজিলে ৩০ অক্টোবরের নির্বাচনে পরাজিত পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো এই মুহূর্তে ব্রাজিলে নেই। মাত্র দিনকয়েক আগেই তিনি ব্রাজিল থেকে আমেরিকায় গিয়ে ফ্লোরিডায় রয়েছেন। কিন্তু সেটা তার সমর্থকদের কাছে ব্রাজিলের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর তাণ্ডব চালাতে, নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভাকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করার অভিযানে নামতে কোনো বাধা হল না। গত রবিবার ৮ জানুয়ারি কয়েক হাজার বোলসোনারো সমর্থক তুমুল তাণ্ডব চালালো ব্রাজিলের রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের মূল কেন্দ্র থ্রি পাওয়ার্স স্কোয়ারে — যেখান রয়েছে সংসদ, প্রেসিডেন্ট ভবন ও সুপ্রিম কোর্ট। কয়েক ঘন্টার জন্য এই ভবনগুলোর দখল চলে গিয়েছিল উগ্ৰ দক্ষিণপন্থী বোলসোনারোর লুম্পেন সমর্থক বাহিনীর দখলে।

নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর থেকেই বোলসোনারো প্রচার চালাচ্ছিলেন যে, নির্বাচনে তাঁকে কারচুপি করে হারানো হয়েছে, লুলা জালিয়াতির মাধ্যমে নির্বাচনী বিজয়কে হাতিয়ে নিয়েছেন। পরাজয়ের পর কয়েক মাস ধরে সমাজ মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে এবং প্রথাগত পথে জনমত গড়ার প্রক্রিয়ায় দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে তিনি উত্তেজনাপ্রবণ করে তুলছিলেন। তাঁর সমর্থকরা লুলার বিজয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এবং বোলসোনারোকে আবার প্রেসিডেন্ট করার দাবি জানিয়ে পথে নেমেছিল, সমাবেশ সংগঠিত করছিল। বোলসোনারো ব্রাজিল ছেড়ে আমেরিকা যাওয়ার আগে পর্যন্ত নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কারচুপির ধুয়ো তোলায় প্ররোচনা দিয়ে গেছেন এবং উন্মাদনা সৃষ্টিতে ইন্ধন জুগিয়েছেন। এরই পরিণামে লুলার বিজয়ের পর কয়েকবারই বোলসোনারোর সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে, তারা সরকারি গাড়িতে আগুন ধরায় এবং সহিংস বিক্ষোভ চালিয়ে যায়। তারা এমনকি এই দাবিও জানিয়েছিল যে, সামরিক বাহিনী পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করুক এবং ১ জানুয়ারি দেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠান থেকে লুলাকে আটকাক। এই সমস্ত কিছুই চরম মাত্রায় পৌঁছে পরিণতি লাভ করল ৮ জানুয়ারির ফ্যাসিস্ত হামলায়। নির্বাচনী ফল প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে রাজধানী ব্রাসিলিয়ার সেনা শিবিরের বাইরে তাঁবু খাটিয়ে থাকছিল বোলসোনারোর সমর্থকরা। কয়েক হাজার সমর্থক সেখান থেকে কয়েক কিমি রাস্তা পায়ে হেঁটে স্লোগান দিতে দিতে চড়াও হয় সংসদ ও প্রেসিডেন্ট ভবনে, সুপ্রিম কোর্টে। প্রকাশিত সংবাদ থেকে এটাও জানা গেছে যে অন্তত ১০০টা বাসে ৪০০০’র মতো সমর্থক থ্রি পাওয়ার্স স্কোয়ারে নামে। এইসব সমর্থক ব্রাজিলের পতাকা গায়ে জড়িয়ে দাবি করতে থাকে — দেশ ও দেশের সংসদ তাদের, বোলসোনারোই হবেন দেশের রাষ্ট্রপতি। সামরিক বাহিনীকেও তাদের অভিযানের সঙ্গি হওয়ার আহ্বান জানায়। ভবনগুলোর জানলা-দরজা তারা ভাঙে, আসবাবপত্র তছনছ করে, জিনিসপত্র লুটপাটে মাতে, কোথাও কোথাও আগুনও লাগায়। ভবনগুলোর ছাদে উঠে সেখানে দাপিয়ে বেড়ায়।

সেদিন রবিবার হওয়ায় সংসদে কোনো কাজ হচ্ছিল না এবং হামলাকারী বাহিনী প্রথম দিকে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর কাছ থেকে কোনো বাধার মুখে পড়েনি। পরে অবশ্য পুলিশ তাদের প্রতিরোধ করে, রবারের বুলেট চালিয়ে, মরিচগুঁড়া ছড়িয়ে, কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে। সেনা সদর বাইরে তৈরি তাদের শিবিরগুলোকেও ভেঙে দেওয়া হয়। অবশেষে সেনাবাহিনী এসে হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে ভবনগুলোর দখল নেয়। হামলা চলার এক ঘণ্টা পর প্রেসিডেন্ট লুলা অভ্যুত্থানের এই প্রচেষ্টাকে নিন্দা করে বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, “ঐ সমস্ত যে মানুষদের আমরা ফ্যাসিস্ত বলি, রাজনীতিতে যা কিছু ঘৃণ্য তার প্রতিনিধি যারা, তারা সরকারি ভবনে হামলা চালিয়েছে, ওরা কংগ্ৰেসে আক্রমণ হেনেছে, সুপ্রিম কোর্টে হামলা করেছে। যথার্থ দুর্বৃত্ত হওয়ায় সামনে যা কিছু পেয়েছে সব ধ্বংস করেছে। আমি বিশ্বাস করি নিরাপত্তায় ঘাটতি ছিল। আর আমি আপনাদের বলছি, যারা এই কাজ করেছে তাদের সবাইকে খুঁজে বার করে শাস্তি দেওয়া হবে। ওরা দেখবে যে গণতন্ত্র যেমন স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার দেয়, তেমনি গণতন্ত্র এই দাবিও জানায় যে জনগণ যেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্মান করে।” প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী প্রায় ১৫০০ হামলাকারীকে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে এবং হামলায় যুক্ত অন্যান্যদের সন্ধান চলছে। বোলসোনারো ব্রাজিলে দীর্ঘকাল চলা সামরিক শাসনের (ব্রাজিল সামরিক শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে চার দশকের কাছাকাছি সময় আগে) মহিমাকীর্তন করে থাকেন। কাজেই, সামরিক শাসনের প্রত্যাবর্তনের বিপদ সম্পর্কে লুলাকে হুঁশিয়ার থাকতে হবে, এবং তা এই কারণেও জরুরি হয়ে উঠেছে যে বোলসোনারোর সমর্থকদের তাণ্ডবে সামরিক বাহিনীর এক অংশের সমর্থন থাকার সংবাদও সামনে এসেছে। ব্রাজিলের ঘটনা দেখিয়ে দিল যে, সেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও যথেষ্ট দুর্বল, এবং সেগুলোকে শক্তিশালী করে তোলাটাও হবে লুলার অন্যতম এজেন্ডা। অতএব, লুলার সামনের রাস্তা যে যথেষ্ট কন্টকাকীর্ণ তা যে কেউই অনুধাবন করতে পারবেন।

বোলসোনারো এখন রয়েছেন ট্রাম্পের দেশে, যে ট্রাম্পের তিনি ঘনিষ্ঠ ও একান্ত অনুরাগী। তাঁর সমর্থকরা তাদের লক্ষ্যে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি শুধু এটুকুই বলেছেন যে ওরা ‘সীমানা ছাড়িয়ে গেছে’। ‘সীমানার’ মধ্যে থাকার পরামর্শতিনি কি তাদের দিয়েছিলেন? শান্তিপ্রিয়তা কি তাঁর নিজেরও অভিপ্রেত পথ? ট্রাম্পের প্ররোচনায় তাঁর সমর্থকদের ক্যাপিটল হিল আক্রমণের দৃষ্টান্ত কি তাঁর মধ্যে কোনও প্রেরণার সঞ্চার করেনি? ব্রাজিলের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বোলসোনারো সমর্থকদের হামলার পর প্রায় সমস্ত ভাষ্যকারই ২০২১’র ৬ জানুয়ারি আমেরিকার প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের ওপর ট্রাম্প সমর্থকদের সহিংস আক্রমণের উল্লেখ করেছেন, দুই হামলার মধ্যে সাদৃশ্যকে স্মরণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০’র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাইডেনের বিজয়কে যেমন ট্রাম্প মানতে চাননি, একইভাবে ব্রাজিলের নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংস্থা লুলার বিজয়ে স্বীকৃতি দিলেও বোলসোনারো অভিযোগ করেছেন যে তাঁকে জালিয়াতি করে হারানো হয়েছে। পরাজয়কে মেনে নেওয়ার মানসিক প্রসারতা দেখাতে অক্ষম ট্রাম্প যেমন তাঁর সমর্থকদের ক্যাপিটল হিল আক্রমণে প্ররোচিত করেছিলেন, বোলসোনারোর সমর্থকরাও তাঁদের হতাশার প্রকাশে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চড়াও হওয়ার পথকেই বেছে নিল। কেউ যদি বলেন যে, ট্রাম্পের দৃষ্টান্তকেই বোলসোনারো ও তাঁর সমর্থকরা অনুসরণীয় বলে মনে করেছেন তবে সেই যুক্তিকে একেবারে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

ব্রাসিলিয়ায় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আক্রমণের পর বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের নেতারাই তার নিন্দায় বিবৃতি দিয়েছেন। ধিক্কারের সেই প্রকাশ অনেকের ক্ষেত্রে আন্তরিক হলেও এমন কেউ কেউ বিবৃতি দিয়েছেন যাঁরা নিজেরাই স্বৈরাচারী এবং গণতন্ত্রের অমর্যাদাই যাঁদের প্রকৃতিগত প্রবৃত্তি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বোলসোনারোর সমর্থকদের হামলার নিন্দা করে টুইটে বলেছেন, “ব্রাসিলিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দাঙ্গা ও নাশকতার সংবাদে গভীর উদ্বিগ্ন। গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে সকলেরই সম্মান করা উচিত। ব্রাজিলের সরকারি কতৃপক্ষকে আমরা সার্বিক সমর্থন জানাচ্ছি।” এখানে উল্লেখ্য যে, ট্রাম্প ও বোলসোনারো দু’জনেই মোদীর ঘনিষ্ঠ মিত্র। আমেরিকায় গিয়ে মোদী ট্রাম্পের প্রতি তাঁর প্রবল অনুরাগ প্রকাশ করে এবং ট্রাম্পের সমর্থনে প্রচার চালিয়ে বলেছিলেন — “আব কি বার ট্রাম্প সরকার”। বোলসোনারোকে ২০২০’র প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং সেই আমন্ত্রণ গ্ৰহণ করে বোলসোনারো সে বছর প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃতও করেছিলেন। মোদী নিজেও কি ট্রাম্প, বোলসোনারোর ধারার অনুগামী নন? তিনি কি ক্রমান্বয়ে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দফারফা ঘটাচ্ছেন না, সংসদকে অবজ্ঞা করে কোনো আলোচনা ছাড়াই আইন পাশ করানো হচ্ছে না? বিরোধী দল ভাঙিয়ে, বিরোধী দলগুলোর বিধায়ক ও সাংসদদের কিনে নিয়ে মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, গোয়া, মনিপুর, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যগুলোতে শাসন ক্ষমতা থেকে বিরোধী দলগুলোকে উৎখাত করে গণতন্ত্রকে রসাতলে পাঠানোটা কি নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপির বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠেনি? এই নরেন্দ্র মোদী যখন ‘গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে’ সম্মান করার কথা বলেন তখন তা পরিহাসের উদ্রেক না করে পারে না। ব্রাজিলে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আক্রমণ আমাদের কাছেও এক শিক্ষাকে হাজির করছে, আর তা হল, শাসকদের বুলিতে প্রতারিত না হয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর রক্ষায় সচেতন ও অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-30
সংখ্যা-2