হিন্দুত্ববাদী আধিপত্য যে ফ্যাসিবাদকে আজ ভারতে প্রয়োগ করে চলেছে তার অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে বুলডোজার। ‘জবরদখল মুক্ত করা’কে অছিলা করে সংখ্যালঘুদের ঘর-বাড়ি-সম্পত্তি গুঁড়িয়ে দেওয়ার যে হাতিয়ার যোগী আদিত্যনাথ তাঁর রাজ্য উত্তরপ্রদেশে প্রয়োগ করেছেন, সেই বুলডোজার ক্রমে বিজেপির অন্যান্য নেতৃবৃন্দের কাছেও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিং চৌহান থেকে দিল্লীর পূর্ববর্তী পুরশাসক এবং পরে আসামের হিমন্ত বিশ্বশর্মাও মতাদর্শগত প্রতিহিংসার চরিতার্থতায় বুলডোজারের ওপর ভর করেন। গতবছরের ২২ মে আসামের নগাঁও’এর পুলিশ ও প্রশাসন বুলডোজার চালিয়ে সংখ্যালঘুদের পাঁচটা বাড়ি ধূলিসাৎ করে। কিন্তু মুসলিমদের বাড়ি ভেঙে দেওয়ার সেই পদক্ষেপ সম্প্রতি ধিক্কৃত হল গৌহাটি হাইকোর্টে। গত ৩ জানুয়ারির এক নির্দেশে বিচারপতি আর এম ছায়া ও সৌমিত্র সইকিয়ার ডিভিশন বেঞ্চ পুলিশ-প্রশাসনের ঐ পদক্ষেপকে ‘অবৈধ’ বলে অভিহিত করেন। বিচারপতি প্রশ্ন তোলেন, “বুলডোজার দিয়ে বাড়ি ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা” নগাঁওয়ের এসপি’কে কে দিয়েছিল? যাদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভাঙা হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে ‘যথাযোগ্য ব্যবস্থা’ নেওয়ার নির্দেশও আদালত রাজ্য সরকারকে দিয়েছে।
সংখ্যালঘুদের ঐ বাড়ি ভাঙা আসলে ছিল পুলিশের প্রতিহিংসার চরিতার্থতা। যে ঘটনার সূত্রে পুলিশ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে তা ছিল এইরকম। গতবছর ২০ মে রাতে মাছ বিক্রেতা সফিকুল ইসলাম যাচ্ছিলেন শিবসাগর জেলায়। নগাঁও জেলার বাটাড্রাবা থানার পুলিশ তাঁকে ধরে ১০,০০০ টাকা ও তাঁর কাছে থাকা কিছু জিনিস ঘুঁষ চায়। সফিকুলের স্ত্রী খবর পেয়ে থানায় যান এবং টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করবেন বলেন। ইতিমধ্যে স্ত্রীর সামনেই থানার পুলিশ সফিকুলকে মারতে থাকে এবং তাঁর অবস্থা গুরুতর হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। পুলিশি হেফাজতে নিরপরাধ ব্যক্তির মৃত্যুর এই ঘটনায় জনগণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে থানায় অগ্নিসংযোগ করে। এরপর বদলা নিতে আসরে নামেন নগাঁওয়ের এসপি, ২১ জনকে গ্ৰেপ্তার করে নিপীড়ন চালানো হয় এবং বুলডোজার দিয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়ি মাটিতে মেশানো হয়।
৩ জানুয়ারির রায়ের আগে এই মামলার শুনানি চলার সময় গত বছরের ১৭ নভেম্বর হাইকোর্ট নগাঁওয়ের পুলিশকে তিরস্কৃত করে বলেছিল, “আইজি, ডিআইজি বা অন্য যে কেউই সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হোক না কেন, তাদের সবাইকেই আইনের ব্যাপ্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। পুলিশ বিভাগের প্রধান বলেই তারা কারুর বাড়ি ধ্বংস করতে পারে না। এটা অনুমতি পেলে এদেশে কেউই নিরাপদে থাকতে পারবেনা।” পুলিশের বাড়াবাড়ি এইভাবে বিচার বিভাগের ভর্ৎসনার মুখে পড়েছিল।
এই পুলিশি নির্মমতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংগঠনও প্রতিবাদ সংগঠিত করে। গতবছরের ২ ডিসেম্বর সদৌ অসম গ্ৰামীণ শ্রমিক সংস্থা বুলডোজার রাজ এবং বাটাড্রাবা পুলিশের সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে ধর্না সংগঠিত করে। ঐ ধর্নায় হাইডুবি শিবির বস্তি, জামাই বস্তি ও ডোমারাগুড়ি লালুং গাঁওয়ের শত শত মানুষ যোগ দেন। এঁরা সবাই আসাম সরকারের সংখ্যালঘু- বিরোধী অভিযানে ক্ষতিগ্ৰস্ত মানুষ। ঐ সংস্থা নগাঁও জেলার জেলা শাসকের মাধ্যমে রাজ্যপালের কাছে পাঁচ দফা দাবি সম্বলিত একটা স্মারকলিপি পাঠায়। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, (ক) আসাম সরকার বাটাড্রাবায় জমি জবরদখল হওয়ার তথাকথিত যে দাবি করেছে, গুয়াহাটি হাইকোর্টে কর্মরত কোনো বিচারপতিকে দিয়ে তার তদন্ত করতে হবে এবং তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনতে হবে। (খ) জমি সম্পর্কিত আসামের আইন লঙ্ঘনের জন্য নগাঁও জেলা প্রশাসনকে দায়ী করতে হবে। (গ) উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের পুনর্বাসন ও যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। (ঘ) ভারতীয় সংবিধানের ২১নং ধারার প্রয়োগ ঘটাতে হবে, ইত্যাদি।
স্থানীয় প্রশাসন উচ্ছেদের যে নোটিসগুলো পাঠিয়েছে, সদৌ অসম গ্ৰামীণ শ্রমিক সংস্থা সেগুলোকে বাংলাভাষী মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা অভিযানের অঙ্গ বলে ধিক্কার জানিয়েছে। সেদিনের প্রতিবাদ সভায় আয়ারলা এবং সিপিআই(এমএল)-এর বক্তারাও সমবেত জনগণের সামনে বক্তব্য রাখেন।
গৌহাটি হাইকোর্টের ৩ জানুয়ারির রায়ের পর রাজ্য সরকার আদালতকে জানিয়েছে যে, বুলডোজার দিয়ে ঘর ভাঙার তদন্তে মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে একটা কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং আদালতের নির্দেশের ১৫ দিনের মধ্যে দোষী পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরআগে সুপ্রিম কোর্ট ঘরবাড়ি ভাঙা থেকে বুলডোজারকে থামিয়েছিল, এবার গৌহাটি হাইকোর্টও বিজেপির বুলডোজার অনুরাগে ধাক্কা দিল।