২০২৩ : ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী ফ্যাসিবিরোধী প্রতিরোধের দিকে এগিয়ে চলুন
Anti-Fascist Resistance

নতুন বছরের আগমন সাধারণত নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ ও নতুন অঙ্গীকার করার সময়। মোদী সরকার এটাকে অবশ্য পুরোনো প্রতিশ্রুতিগুলোকে ঝেড়ে ফেলা এবং নতুন সময়সীমা সহ নতুন লক্ষ্য হাজির করার সময় বলেই মনে করে।

২০১৪ সালের জয়যুক্ত নির্বাচনী প্রচারে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোকে অল্পকাল পরেই জুমলা বলে পরিত্যাগ করা হয়। সেগুলো ছিল কালোটাকা ফিরিয়ে আনা, পেট্রল এবং সাধারণের উপভোগের অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্য হ্রাস এবং মার্কিন ডলারের সাপেক্ষে টাকাকে শক্তিশালী করে তোলার মতো বিজেপির ইউপিএ-বিরোধী প্রচারের বিষয়ের ওপর ভিত্তি করা মূলত আর্থিক প্রতিশ্রুতি। ভারত যখন গণপিটুনির ঘটনা এবং সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠানের ফ্যাসিবাদী নকশার অন্যান্য মার্কামারা উপসর্গগুলো সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠছিল, এই জমানা তখন নরেন্দ্র মোদীর পরিচালনাধীনে এক নতুন ভারতের এক রাজসিক বীক্ষাকে তুলে ধরল, যার সূচনা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতে ২০২২ সালে। বলা হয়েছিল, নতুন ভারতে প্রতিটি ভারতবাসীর মাথায় ছাদ থাকবে এবং প্রতিটি বাড়িতে থাকবে বাথরুম আর ২৪ ঘন্টার বিদ্যুৎ সরবরাহ ও নলবাহিত জল সুনিশ্চিত করা হবে। পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে তাদের আয় দ্বিগুণ হওয়ার আশ্বাস কৃষকদের দেওয়া হয়েছিল।

এখন ২০২২ সাল শেষ হয়ে গেছে। আমাদের বলা হচ্ছে, সুনিশ্চিতভাবেই ভারতের রূপান্তরণ ঘটেছে আর নরেন্দ্র মোদী হয়ে উঠেছেন নতুন ভারতের নতুন পিতা। এবং সরকারের ভাষ্য সরে গেছে নতুন লক্ষ্যমাত্রা ও নতুন সময়সীমার দিকে। উদাহরণস্বরূপ, পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতি হওয়া থেকে ভারত এখনও অনেক দূরে রয়েছে, কিন্তু আদানি ও আম্বানিরা আমাদের বলে চলেছেন যে ভারত ২০৫০ সালের মধ্যে ৩০ বা ৪০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হয়ে উঠবে! যে ক্ষুব্ধ কৃষকরা শষ্যের ন্যায্য মূল্যের প্রতিশ্রুত অধিকার আদায়ের জন্য এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের আয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়নি, কিন্তু সরকার কৃষি বাজেটের হ্রাস ঘটাচ্ছে আর সারের দাম বাড়াচ্ছে। ঢাক পেটানো বাড়ি নির্মাণ প্রকল্পকে বাস্তব জীবনে বলতে গেলে ভুলে যাওয়াই হয়েছে, আর তাণ্ডবে মাতা বুলডোজার বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে মানুষকে উচ্ছেদ করছে।

দীর্ঘ প্রতিশ্রুত বুলেট ট্রেনের আবির্ভাব এখনও ঘটেনি, কিন্তু সাড়ম্বর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ও রাজনৈতিক সমাবেশ ঘটিয়ে বন্দে ভারত ট্রেনগুলোকে চালু করা হচ্ছে। গতি এবং পরিষেবার দিক থেকে এই নতুন ট্রেনগুলোর অনেকগুলোই ১৯৮৮ সালে চালু করা শতাব্দী ট্রেনগুলোর সঙ্গে তুলনীয় নয় এবং দুর্ঘটনায় পড়ার জন্য ট্রেনগুলো প্রায়শই খবর হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যে, গুরুত্ব এখন সাধারণ জনগণের জন্য সস্তা ও নিরাপদ রেল যাত্রা থেকে সরে গিয়ে পড়ছে ধনীদের প্রমোদভ্রমণের ওপর, আর পশ্চাদপদ ও দূরবর্তী অঞ্চলগুলোকে সংযুক্ত করার তুলনায় জোর পড়ছে বড় বড় শহর ও পর্যটনের গন্তব্যস্থলগুলোকে সুবিধা দানের ওপর। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে গৃহ নির্মাণ ও পরিবহণ, প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই সরকারি নীতি চালিত হচ্ছে ধনীদের অগ্ৰাধিকারের ওপর ভিত্তি করে, আর সাধারণ জনগণকে তথাকথিত খয়রাতি সংস্কৃতির অযোগ্য দানগ্ৰাহী জ্ঞান করে অপমানিত ও বঞ্চিত করা হচ্ছে।

নতুন আখ্যানে লক্ষ্যে পৌঁছানোর সময়সীমাকে পাল্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ২০৪৭ সালে, যেটা হলো ভারতের স্বাধীনতার শতবার্ষিকী। শতবার্ষিকীর সঙ্গে আমাদের সংযোগের যে সিকি শতক সামনে রয়েছে সেই সময়কালকে অভিহিত করা হয়েছে ‘অমৃত কাল’ রূপে আর নরেন্দ্র মোদী এই গোটা পর্যায়ের জন্য ‘কর্তব্য’কেই কেন্দ্রীয় বিষয় করতে চান। তাঁর ২০২২’র ১৫ আগস্টের ভাষণে যে পাঁচটা অঙ্গীকার উল্লিখত হয়েছে সেগুলোর মূল বিষয় হল জাতীয় অস্মিতা, ঐক্য, আনুগত্য ও কর্তব্য। এই ভাষ্যে লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত জনগণের অধিকার এবং সরকারের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে কোনো ধারণা। সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ এবং জনগণের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য সরকারের ধারণাকে পাল্টে তার স্থানে নিয়ে আসা হচ্ছে সর্বোচ্চ নেতার শাসনাধীন নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রের ধারণাকে যে নেতার অভিপ্রায়ই হলো আইন। বিমুদ্রাকরণ চরম বিপর্যয়কর আঘাত হানা এবং ঘোষিত কোনো লক্ষ্য পূরণেই প্রকট ব্যর্থতার নজির রেখে যাওয়ার ছ’বছর পর সুপ্রিম কোর্ট তাতে যে ‘বৈধতা’ প্রদান করল তা এই স্বৈরতন্ত্রকে আগামী দিনগুলোতে সংবিধান এবং নাগরিকদের অধিকারের ওপর আরো আক্রমণ হানতেই স্পর্ধিত করবে।

মোদী সরকারের কাছে ২০২৩ হয়ে উঠবে ২০২৪’র অতীব গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের সূচনা মঞ্চ। এবছরে নটা রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যারমধ্যে চারটে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে (ত্রিপুরা, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড ও মিজোরাম), দুটো দক্ষিণে (কর্নাটক ও তেলেঙ্গানা) এবং তিনটে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে (ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান)। মোদী সরকারের কাছে যে কোনো অনুষ্ঠানই হল নির্বাচনী প্রচারের উপলক্ষ আর ২০২৪ এগিয়ে আসায় একটা বছর আমাদের চড়া প্রচার এবং তীব্র ঘৃণাবর্ষী প্রচারাভিযানের মুখোমুখি হতে হবে। জি-২০ গোষ্ঠীর সভাপতিত্বের ভার ইন্দোনেশিয়ার কাছ থেকে ভারতের হাতে আসায় মোদীর নেতৃত্বাধীনে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় ভারতের তথাকথিত উত্থান নিয়ে নিজেদের পিঠ চাপড়ানো সোচ্চার প্রচারও অনেক দেখা যাবে। জি-২০ শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে দিল্লীতে (৯-১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩), এবং তার আগে সারা দেশের ৫৬টা স্থানে ২০০টা প্রস্তুতিমূলক ও অনুপূরক বৈঠক হবে যার অর্থ হলো একবছর ধরে বৈশ্বিক সম্মেলনগুলো চলতে থাকা।

জি-২০ শীর্ষবৈঠকে সব সময়ই বিশ্বায়নবিরোধী প্রতিবাদ দেখা গেছে। ভারতে জি-২০ বৈঠকগুলো জাতীয় অস্মিতা জাহির করার মঞ্চ হতে পারে না, শাসক দলের একতরফা সুবিধা অর্জনের কথা তো ওঠেই না; ভারতের জাগ্ৰত জনমতের কাছে তাকে হতে হবে কর্পোরেট লালসা ও মুনাফার জন্য লুণ্ঠনের বিপরীতে জনগণের অধিকারের আত্মঘোষণার এবং জনস্বাস্থ্য, পরিবেশের সুরক্ষা ও জলবায়ুর প্রতি সুবিচারের লক্ষ্যে বৈশ্বিক সংহতিকে সম্প্রসারিত করার উপলক্ষ। আমাদের, ভারতের জনগণকে গণতন্ত্রের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং প্রতিটি ফ্রন্টে ফ্যাসিবাদী চক্রান্তকে ব্যর্থ করতে ২০২৩-কে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৩ জানুয়ারি ২০২৩)

খণ্ড-30
সংখ্যা-2