আজকের দেশব্রতী : ১৫ ডিসেম্বর ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
desabrati_15-Dec-22

Pledge

কমরেড বিনোদ মিশ্রের ২৪তম প্রয়াণ বার্ষিকীতে, আমরা তাঁর স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে নিজেদের পুনরায় উৎসর্গ করছি। কমরেড ভিএম এমন এক ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে প্রকৃত অর্থেই ক্ষমতা থাকবে জনগণের হাতে এবং প্রত্যেক নাগরিক আসল স্বাধীনতা উপভোগ করবেন, যেখানে বৈচিত্র্যকেই ঐক্যের বনিয়াদ গণ্য করা হবে এবং পরস্পরের মধ্যেকার পার্থক্যগুলোকে হিংসার উস্কানি দিতে ও মানুষের বিভাজন ঘটাতে ব্যবহার করা হবে না, যেখানে ভিন্নমত ও আলাপ আলোচনা থেকেই গণতন্ত্র তার শক্তি সঞ্চয় করবে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন সেই ভারতের যেখানে ধর্ম ও রাজনীতি পরস্পরের সাথে মিশে যাবে না এবং রাজনীতি ব্যবহৃত হবে সামাজিক রূপান্তরের হাতিয়ার হিসাবে, বৈষম্য ও শোষণের উপর দাঁড়িয়ে থাকা সমাজব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার কাজে নয়।

তিনি চাইতেন যে, সিপিআই(এমএল) একটা বড়, শক্তিশালী ও উদ্দীপনাময় পার্টি হয়ে উঠুক যার মধ্যে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে প্রকৃত গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার উদ্যম, শক্তি ও পরিপক্কতা থাকবে। সংসদীয় ক্ষেত্র সহ সমস্ত আঙিনায় জনসাধারণের আওয়াজকে সোচ্চার করে তোলার শক্তি হিসাবে তিনি সিপিআই(এমএল)-কে দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমাদের এটাও মনে করিয়ে দিতেন যে, ইতিহাসের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের নিষ্পত্তি হয়েছে রাস্তায় জনগণের উত্থানের মধ্য দিয়েই। দেশের মধ্যে অথবা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া অতীতের সমস্ত ভুল ও পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করার চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য এবং সমস্ত লড়াকু শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে সংঘ পরিবারের সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী ভারত নির্মাণের প্রকল্পকে একটা নির্ধারক আঘাত দেওয়ার জন্য তিনি পার্টিকে অনুপ্রাণিত করতেন।

কমরেড ভিএমের ২৪তম প্রয়াণ বার্ষিকীতে আমরা সিপিআই(এমএল)-কে সবদিক থেকে শক্তিশালী করে তোলার এবং ১৬-২০ ফেব্রুয়ারি পাটনায় (বিনোদ মিশ্র নগর) সিপিআই(এমএল)-এর আসন্ন একাদশ পার্টি কংগ্রেস ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘গণতন্ত্র বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’ সমাবেশকে ঐতিহাসিক সাফল্য এনে দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। কমরেড ভিএম লাল সেলাম!

সিপিআই(এমএল) দীর্ঘজীবি হোক!

ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক, গণতন্ত্রের জয় হোক!

Party Congress a People's Festival

সিপিআই(এমএল)-এর একাদশ পার্টি কংগ্ৰেস অনুষ্ঠিত হবে পাটনায় এবং তার আগে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এক বিশাল জনসভা সংগঠিত হবে। এই কংগ্ৰেসের প্রস্তুতির উদ্দেশ্যে গত ৪ ডিসেম্বর ২০২২ পাটনার ভারতীয় নৃত্যকলা মন্দিরে রাজ্যভিত্তিক এক ক্যাডার কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ কনভেনশনে মূল বক্তা ছিলেন সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ এবং তাদের সাথে জেলা সম্পাদকরা এবং দলের কিছু সক্রিয় কর্মীও ঐ কনভেনশনে বক্তব্য রাখেন। সম্মেলন আট-দফা প্রস্তাব গ্ৰহণ করে। নীচে করমেড দীপঙ্করের বক্তব্যের মূল বিষয়গুলোকে রাখা হচ্ছে।

দীপঙ্কর তাঁর ভাষণে বলেন, মোদী জমানায় ‘দেশ’এর নামে গণতন্ত্রের ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ নামানো হয়েছে, আর তার মধ্যে দিয়ে ‘এই দেশের জনগণকেই’ নিশানা বানানো হচ্ছে।

কর্পোরেট সংস্থাগুলো, বিশেষভাবে আদানি ও আম্বানি এই আক্রমণে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন — আরএসএস ও বিজেপির পিছনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। এই সরকারকে টিকিয়ে রাখতে তারা শাসক দলের পক্ষে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে, আর তার বিনিময়ে সরকার দেশের নীতিমালাকে তাদের অনুকূলে চালিত করছে। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরও চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে যাতে দেশের মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া যায়। বাস্তবে বিজেপি কিন্তু দেশের কাছে এক বিপর্যয় হিসাবেই আবির্ভূত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাবরি মসজিদ ধ্বংস থেকে শুরু হওয়া একের পর এক ঘটনা পরিণতি লাভ করল ২০০২ সালে কুখ্যাত গুজরাট গণহত্যার মধ্যে। সিপিআই(এমএল) হল সেই সংগঠনগুলোর অন্যতম যারা সর্বপ্রথম এই প্রবণতাকে ‘সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ’ রূপে চিহ্নিত করে। তারপর থেকে আমরা এই শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি।

মোদী হিমাচল প্রদেশে তাঁর নিজের নামেই ভোট চাইছেন। গুজরাটে অমিত শাহ জনগণকে ২০০২’র কথা মনে পড়িয়ে দিয়ে সেখানে ‘স্থায়ী শান্তি’ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছেন। পরেশ রাওয়াল বলছেন যে, গুজরাটের জনগণ মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারিকে সহ্য করবেন, কিন্তু মুসলিমদের তাদের প্রতিবেশী হিসাবে গ্ৰহণ করতে পারবেন না। তিনি ঘৃণা উস্কিয়ে তুলেই মূল্যবৃদ্ধির মোকাবিলা করতে চাইছেন। আমাদের কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি এবং ঘৃণা উভয়ের বিরুদ্ধেই লড়াই চালাতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদ বিধ্বংসকে একটা অপরাধ বলে অভিহিত করেছে, কিন্তু এখন তা নিয়ে আর কোনও কথা হচ্ছে না। এর থেকে স্পর্ধিত হয়ে আরএসএস কাশী, মথুরা এবং দেশের অন্যান্য ঐতিহ্যময় স্থাপত্যের ওপর দাবি জানাচ্ছে আর সুপ্রিম কোর্ট তাতে সহায়তা করছে।

নির্বাচন কমিশনে নিয়োগগুলো কিভাবে হবে তা এখন সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনাধীন। এরই মধ্যে সরকারি পদে আসীন এক আমলার কর্মজীবনে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সমাপ্তি ঘটিয়ে তাঁকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ করা হয়। বিচারবিভাগে কোনো সংরক্ষণ না থাকাটাও এক বড় প্রশ্ন হয়ে রয়েছে। সরকার আর একটা বিষয়কেও নিজেদের দিকে ঝোঁকাতে চাইছে। কলেজিয়াম ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে বিচারপতিদের নিয়োগে তারা উদ্বিগ্ন বোধ করছে এবং ঐ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চাইছে যাতে বিচারবিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা হল এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা যা স্থায়ী বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জনগণ এই ইচ্ছা প্রকাশ করছেন যে, এই অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যেই ২০২৪’র নির্বাচনে লড়াই করতে হবে।

কমরেড দীপঙ্কর আরও উল্লেখ করেন দেশের জনগণের সাগ্ৰহে বিহারকে পর্যবেক্ষণ করার কথা, আর তা করা হচ্ছে বিহার এক নতুন পথ দেখিয়েছে বলে। বিহারের এই মডেল নিয়ে রাজ্যে যথেষ্ট চর্চা হচ্ছে। সারা দেশের কাছে আমাদের এই সুস্পষ্ট বার্তা পৌঁছাতে হবে যে দেশে এখন ফ্যাসিস্ত শক্তিগুলোর আধিপত্য চলছে।

পার্টি কর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, কংগ্ৰেসের আগে সংগঠিত জনসভায় অংশগ্ৰহণের রেকর্ড সৃষ্টি করতে হবে, আর তারজন্য মূল্যস্ফীতি ও বেকারির মতো ইস্যুগুলোকে অত্যন্ত জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। মর্যাদাপূর্ণ কাজ, উৎপাদিত শষ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য এবং ভাগ চাষিদের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।

পার্টি কংগ্ৰেসের লক্ষ্য হিসাবে তিনি বলেন, পার্টি কংগ্ৰেসকে জনগণের উৎসবে পরিণত করতে হবে। আর যেহেতু উদ্দীপনা ছাড়া কোনো উৎসব হয় না, পার্টি কর্মীদেরও তাই উদ্দিপনায় প্রাণবন্ত হতে হবে।

Behind the smokescreen

পরিসংখ্যানের ধুম্রজাল তৈরি করে প্রকৃত চিত্রকে আড়ালে লুকিয়ে রাখার প্রশ্নে মোদী সরকারের মুন্সিয়ানা ও দক্ষতা রীতিমতো সুবিদিত। ভারতীয় অর্থনীতির প্রকৃত ছবি, তার রূঢ় বাস্তবতাকে নানা পরিসংখ্যানে মুড়ে পরিবেশন করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিশ্বের বৃহৎ অর্থব্যবস্থার তুলনায় ভারতের আর্থিক বনিয়াদ নাকি অনেকটা মজবুত। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬.৩ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। দুনিয়া জুড়ে শেয়ার বাজার যখন নাস্তানাবুদ হচ্ছে, তখন ভারতীয় বাজারে বিপুল পরিমাণে আন্তর্জাতিক প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজি প্রবেশ করে তরতর করে দেশের শেয়ার সূচককে বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর, তা নিয়ে প্রচার করা হচ্ছে দেশীয় অর্থনীতির উজ্জীবনের কাহিনী। কে না জানে, অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী অতিচঞ্চলমতি এই পুঁজি সামান্য ঝুঁকির গন্ধ পেলেই মুহূর্তেই সটান দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্যত্র পাড়ি জমায়।

সিএমআইই’র তথ্য সামনে নিয়ে এল কর্মসংস্থানের বেহাল দশা। এই সংস্থা দেখাল, নভেম্বরে বেকারত্বের হার ফের ৮ শতাংশ টপকে গেছে। শহরে এই বেকারত্বের হার গ্রামের থেকে বেশি, ৯ শতাংশ। আর গ্রামে তা সামান্য কম হলেও (৭.৫৫ শতাংশ) আদৌ আশাপ্রদ নয়। গ্রামাঞ্চলে বেকারত্বের হার সেপ্টেম্বরে ৫.৮৪ শতাংশ থেকে অক্টোবরে এক লাফে বেড়ে ৮.০৪ শতাংশ হয়েছিল। সিএমআইই’র রিপোর্ট অনুযায়ী, গ্রামীণ অর্থনীতিতে মূলত কৃষি বাদে অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ কম থাকায় এই অবস্থা হয়েছে।

এদিকে, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে আর্থিক বৃদ্ধির যে আশা করা হয়েছিল, প্রকৃত বৃদ্ধির পরিমাণ তার থেকে বেশি দাঁড়াবে বলে অনুমান। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আর্থিক বৃদ্ধির পূর্বাভাস যতটা কাটছাঁট করেছিল, তার থেকেও প্রকৃত হ্রাসের পরিমাণ বেশ অনেকটা বেশি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই অর্থবর্ষের দ্বিতীয়ার্ধে আর্থিক অবস্থা বেশ কিছু প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ঘনিয়ে উঠছে মন্দা। ২০২৩ থেকে ২০২৬’র মধ্যে বিশ্ব আউটপুটের ৪ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার সমান আর্থিক মূল্য বরবাদ হবে, যা ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতি, জার্মানির অর্থব্যবস্থার সমান, আর যা ভারতীয় অর্থনীতিতেও বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

যেকোনো অর্থনীতিতে ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন ক্ষেত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। জিভিএ (গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড বা মোট মূল্য সংযুক্তি) হিসাবে গত অর্থবর্ষের তুলনায় এই অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে উৎপাদন ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে ৪.৩ শতাংশ হারে। এই ক্ষেত্রটিতে বিরাট মাত্রায় কর্মসংস্থান হয়ে থাকে, বিশেষত কৃষির উদ্বৃত্ত শ্রম। দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালে, অর্থাৎ, কোভিড হানা দেওয়ার আগে উৎপাদন ক্ষেত্র যে অবস্থায় ছিল, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে তার তুলনায় বৃদ্ধি হবে মাত্র ৬.৩ শতাংশ হারে। এ’থেকে এটা প্রমানিত যে কোভিড নয়, গত ছ’বছর ধরেই দেশের উৎপাদন ক্ষেত্রটির নাভিশ্বাস উঠেছে। ২০১৬-২০২০’র মধ্যে এই ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান অর্ধেক হ্রাস পেয়েছে।

পরিসংখ্যান যা আড়াল করে তা হল, সরকারি ব্যয়ের পরিমাণটি কমেছে লক্ষনীয় হারে। এই বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ গতবছরের এই সময়কালের তুলনায় ৪.৪ শতাংশ কম। এবং, ২০১৯- ২০’র তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে সরকারি ভোগব্যয়ের হ্রাসের পরিমাণ প্রায় ২০ শতাংশ! সরকারি ব্যয় বাড়লে বিশেষত দরিদ্র মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে, ভোগব্যয়ও বাড়ে। আর, আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তার গুরুত্ব অনেক। এই অর্থবর্ষে বাজেটে গ্রামের বিভিন্ন প্রকল্পে ১.৩৬ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল কেন্দ্র আর বিগত অর্থ বর্ষের তুলনায় ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ ও কমানো হয় ২৫ শতাংশের বেশি। গ্রামাঞ্চলে ১০০ দিনের কাজ রোজগারের এক বড় ভরসা। এই প্রকল্পে কাজ করে অর্জিত অর্থ গ্রামীণ অর্থনীতিকে কিছুটা সচল রাখে। এই প্রকল্পের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাজেট বরাদ্দ কাটছাঁট করে মোদী সরকার। বছরের মাঝামাঝি বরাদ্দের অর্থশেষ হয়, কাজ করা সত্ত্বেও মজুরি পায়নি বহু জব কার্ডধারী। থমকে যাওয়া প্রকল্পের কাজ কৃষির বাইরে কর্মসংস্থান তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। ক্রমহ্রাসমান আয়, পাশাপাশি মূল্যবৃদ্ধি গ্রামাঞ্চলের মানুষের ক্রয় ক্ষমতাকে সংকুচিত করেছে, যার প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতির উপরই পড়বে।

ভ্রান্ত অর্থনৈতিক পরিচালনা, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে না চাওয়া, মুষ্ঠিমেয় ক্রোনি কর্পোরেটদের স্বার্থে সমস্ত আর্থিক নীতিকে পরিচালিত করতে গিয়ে দেশ আজ দাঁড়িয়েছে গভীর খাদের কিনারে। অনেক আশঙ্কা নিয়ে অপেক্ষা করছে সামনের দিনগুলো।

Signals and Lessons from Himachal Delhi Elections

গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা এবং দিল্লির পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল মোটামুটি যেমন অনুমান ছিল তেমনই হয়েছে, কেবল গুজরাটে বিজেপির এই মাত্রার জয়ের বিষয়টা ছাড়া যা অবশ্যই আরও নিবিড় অনুসন্ধানের দাবি জানায়। তিনটি নির্বাচনের ক্ষেত্রেই বিজেপি ছিল ক্ষমতায়। তার মধ্যে দুটিতে তারা ক্ষমতা হারাল। এই অর্থে দেখলে মোদ্দা হিসেবে বিজেপি হেরেছে। কিন্তু ভোটের ভাগ (৫২ শতাংশের উপরে) আর আসন ভাগ (৮৫ শতাংশের উপরে) উভয় নিরিখে গুজরাটে তাদের জয়ের মাত্রা স্পষ্টতই তাদের বাকি দুটি পরাজয়কে ছাপিয়ে গেছে। এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে যে হিমাচল ও দিল্লিতে বিজেপি হেরেছে বটে কিন্তু সেখানেও তারা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। গুজরাটে কংগ্রেস অভূতপূর্ব ধাক্কা খেয়েছে। আসন সংখ্যা ৭৭ থেকে নেমে ১৭ হয়েছে। কিন্তু স্বল্প ব্যবধানে হলেও বিজেপির কাছ থেকে তারা হিমাচল প্রদেশ কেড়ে নিতে সফল হয়েছে। আপ-এর আসল লাভ এমসিডি নির্বাচনে বিজয় এবং স্বীকৃত জাতীয় দল হিসাবে তার নবলব্ধ মর্যাদা।

বিজেপি এখন হিমাচল প্রদেশ এবং এমসিডি-তে তাদের পরাজয়ের তাৎপর্য কমিয়ে দেখাতে ব্যস্ত, কিন্তু সবাই জানে যে এই দুটি নির্বাচনেও জয় হাসিল করতে বিজেপি কোনও কসরত বাকি রাখেনি। দিল্লি কর্পোরেশনে কোনও কাজ না করেই দীর্ঘ পনের বছর মেয়াদে থাকার কারণে জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ সম্পর্কে বিজেপি সচেতন ছিল এবং তাই তারা এমসিডি-র দখল ধরে রাখতে বহুবিধ কারসাজি অবলম্বন করেছিল। ২০১৪ সালে মোদি শাসন ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ওরা দিল্লি রাজ্যটাকে কেবল এক মহিমান্বিত পৌরসভায় সংকুচিত করে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছে একদিকে আক্রমণাত্মক কেন্দ্রীয় সরকার ও অন্যদিকে পৌরসভার ক্ষমতার মাঝে নিষ্পেষিত করে৷ দিল্লি রাজ্য সরকারের বিপ্রতীপে মিউনিসিপ্যাল ক্ষমতার মর্যাদা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে দিল্লির তিনটি কর্পোরেশনকে একটি একক সত্তায় কেন্দ্রীভূত করা হয় এবং বিজেপির নির্বাচনী সম্ভাবনা উন্নত করার জন্য অস্ত্রোপচারের নিপুনতায় ডিলিমিটেশনের মাধ্যমে সমস্ত ওয়ার্ডকে পুনর্গঠিত করা হয়। এবারে গুজরাট নির্বাচনের সাথে এমসিডি নির্বাচন মিলিয়ে দেওয়ার জন্য নির্বাচনের সময়সূচিতেও হেরফের করা হয়েছিল সংক্ষিপ্ত নোটিশে হঠাৎ করে তারিখগুলি ঘোষণা করার মাধ্যমে।

এই সবকয়টি নির্বাচনেই বিজেপি তার সবরকম আর্থিক সংস্থান, প্রশাসনিক ক্ষমতা, সাম্প্রদায়িক বিষোদ্গার, প্রোপাগান্ডা ব্লিটজক্রিগ এবং তথাকথিত মোদী ক্যারিশ্মাকে কাজে লাগিয়েছে। হিমাচল ও দিল্লিতে বিজেপির পরাজয়কে এই পটভূমি মাথায় রেখেই বুঝতে হবে। দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও হিমাচল প্রদেশে অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী সম্পর্কে সচেতন মোদি প্রকাশ্যে নিজের নামে ভোট চেয়েছেন। তবুও হিমাচলের ক্ষুব্ধ ভোটাররা বিজেপিকে ভোটআউট করেছে। হিমাচল হল বিজেপি সাংসদ জেপি নাড্ডার আর ঘৃণা ছড়ানো হাই-প্রোফাইল মোদীমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের নিজের রাজ্য। আমদানি বৃদ্ধি ও প্যাকেজিংয়ের উপর জিএসটি-র সম্মিলিত চাপে হিমাচলের আপেল চাষিদের দুর্দশা, পুরানো পেনশন স্কিম ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বত্র সরকারি কর্মচারীদের ক্রমবর্ধমান দাবি এবং অগ্নিপথ প্রকল্পের কারণে সেনাবাহিনীতে নিরাপদ ভবিষ্যত খোঁজার সুযোগ থেকে বঞ্চিত যুবকদের উৎক্ষিপ্ত উত্তেজনা — এই আসল ইস্যুগুলি মোদীর অন্তঃসারশূন্য বাগাড়াম্বরের ঊর্ধ্বে প্রাধান্য পেয়েছে এবং বিজেপিকে ভোটআউট করেছে।

গুজরাটের ফলাফল স্পষ্টতই হিমাচল এবং দিল্লিতে প্রত্যক্ষ করা ভোটপ্রবণতার তীক্ষ্ণ বৈপরিত্যে দাঁড়িয়ে আছে। বিজেপি অলরেডি ২৭ বছর হয়ে গেল রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে — এই বিষয়টা মাথায় রেখে বৈপরীত্যটিকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি? মোদি আমলে গুজরাট অবশ্যই বিজেপির সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি। এটি তো কেবল সংঘ বাহিনীর সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক পরীক্ষাগার নয়, এটি আদানি- আম্বানিরও হোমস্টেট এবং নির্বাচনের ঠিক আগে মোদি মহারাষ্ট্রের বরাত থেকে টেনে গুজরাটে কয়েকটি বড় বিনিয়োগ প্রকল্প ঘোষণা করতে সক্ষম হন। কংগ্রেস একের পর এক দলত্যাগের কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে, বিশেষ করে ২০১৭ নির্বাচনের তারকা প্রচারক হার্দিক প্যাটেলের দলত্যাগের পর। ফলত তাদের প্রচারও ছিল অনেক স্তিমিত ধরনের। আপ এই পরিস্থিতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে এবং সুরাটের পৌর নির্বাচনে তাদের উৎসাহজনক প্রদর্শন ও পাঞ্জাবে এই বছরের শুরুতে তাদের চমকপ্রদ জয়ের প্লাবনে উদ্দীপ্ত হয়ে তারা বিজেপির অব্যাহত শাসনের আসন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে নিজেকে তুলে ধরার যথাসাধ্য চেষ্টা করে। আপের ভোট স্পষ্টতই কংগ্রেসের চিরাচরিত ভিত্তি ভেঙ্গেই এসেছে, বিশেষ করে গুজরাটের আদিবাসী অঞ্চলে, এবং অ-বিজেপি ভোটের এই বিভাজন থেকে বিজেপি ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে।

অ-বিজেপি ভোটের বিভাজন অবশ্য বিজেপির সপক্ষে ৫ শতাংশ ভোটবৃদ্ধির কৌতুহল উদ্রেককারী বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারে না। ভোটগ্রহণের শেষ ঘণ্টায় ভোটদানে ব্যাপক বৃদ্ধির বিষয়টি, বিশেষ করে দ্বিতীয় পর্বে যেরকম হল, গুরুতর সন্দেহের জন্ম দেয় এবং ভারতের নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই এই সমস্যাটি তদন্ত করতে হবে এবং বিশ্বাসযোগ্য উত্তর দিতে হবে। ৫ ডিসেম্বরের শেষ ঘণ্টায় ১৬ লাখেরও বেশি ভোট পড়েছে বলে জানা যায়, যা গড়ে ৬.৫ শতাংশ বৃদ্ধি এবং কিছু কিছু নির্বাচনক্ষেত্রে এমনকি ১০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি ঘটে। ভোটকেন্দ্রের বাইরে দীর্ঘ লাইনের কোনো চিহ্নই ছিল না, অথচ ইভিএম পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে হঠাৎ করে মাত্র ত্রিশ সেকেন্ড পরপর এত ভোট পড়েছে! হাতবাছাই আমলাদের দ্বারা নির্বাচন কমিশন ভরে যাওয়ায়, যা সুপ্রিম কোর্টের মতে এই প্রতিষ্ঠানের অখণ্ডতা ও স্বায়ত্ততা এবং নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব ফেলছে, ভারতের ভোট প্রক্রিয়ার অখণ্ডতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে, ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থা ক্রমশ অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে।

গুজরাট থেকে আসা প্রতিবেদনগুলি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে বিজেপি ইতিমধ্যেই আপ বিধায়কদের মধ্যে দলত্যাগের মরিয়া কারিকুরি চালাচ্ছে। আপ বিধায়কদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অতীতে বিজেপির সাথে যুক্ত ছিল। আপ এপর্যন্ত মূলত কংগ্রেসের গণভিত ভেঙেই বেড়ে থাকতে পারে, কিন্তু এখন তা একটি জাতীয় দল হিসাবে বড় হয়েছে, বিজেপির ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ইচ্ছা এবং শক্তি থাকলে তবেই একমাত্র এই দল গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হতে পারে। কংগ্রেস গুজরাটে খারাপ ফল করেছে, কিন্তু কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে জিগনেশ মেভানির জয় সংঘ ব্রিগেডের সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সকল মানুষের কাছেই এক উৎসাহজনক সংকেত হিসেবে থাকছে। পরের বছর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচন নির্ধারিত আছে — উত্তর-পূর্বের ত্রিপুরা থেকে দক্ষিণে কর্ণাটক পর্যন্ত, ২০২৪-এ বিজেপিকে ভোটআউট করতে আগে মোদী শাসনকে চোট দেওয়ার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি আঘাত হানতে হবে।

এমএল আপডেট সম্পাদকীয় ১৩-১৯ ডিসেম্বর ২০২২

fight go on

আগামী ১৭ ডিসেম্বর ২০২২, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির (এআইপিডব্লিউএ) ১১তম রাজ্য সম্মেলনকে সামনে রেখে শিলিগুড়ি পার্টি কার্যালয়ে ১১ ডিসেম্বর জেলাগতভাবে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির একটি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলার পোড়াঝার ও ফাঁসিদেওয়ার দ্বারাবক্সে ধারাবাহিকভাবে চলা ভূমিরক্ষা আন্দোলনের ফসল হিসেবে সেখানকার মহিলা নেতৃত্বের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন পার্টি ও মহিলা সমিতির জেলা নেতৃত্বও। উপস্থিত ছিলেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার। বর্তমান সময়ের নিরিখে মহিলাদের অবস্হান, ঘরে বাইরে, বিশেষত কেন্দ্রের ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকার এবং রাজ্যের তৃণমূল সরকার যেভাবে মুখে মহিলাদের প্রগতি, বিকাশের কথা বলে, কার্যত মহিলাদের ওপর হিংসা, হামলা চাপিয়ে দিচ্ছে, প্রতিদিন তাদের অধিকার খর্ব করে চলেছে — তারই বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে রোজের লড়াইকে সংঘবদ্ধ করার আহ্বান জানান রাজ্য সম্পাদক। স্বাধীনতা, সমানাধিকার, মর্যাদা, গণতন্ত্রের লড়াইকে প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত করতে বলেন এবং রাজ্য সম্মেলনের লক্ষ্য যাতে সামগ্রিকতার সঙ্গে সফল হয় সেজন্য উপস্থিত সকলকে উৎসাহিত করেন। বক্তব্য রাখেন সভানেত্রী মীরা চতুর্বেদী, মুক্তি সরকার। শেষে জেলা সম্মেলনের লক্ষ্যে ১৩ জনের প্রস্তুতি কমিটি গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে ৮ জন প্রতিনিধিকে আসন্ন রাজ্য সম্মেলনের জন্য বেছে নেওয়া হয়। উপস্থিত ছিলেন মহিলা নেত্রী রুবী সেনগুপ্ত, পার্টির জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ, জেলা সদস্য সুমন্তি এক্কা এবং শাশ্বতী সেনগুপ্ত।

Protest deputation at block office

নামেই দুয়ারে সরকার! কিন্তু কাজের কাজ হয়নি কিছুই! তাই সরকারের দুয়ারে ধাক্কা দিতে এসেছিলেন নাকাশীপাড়ার গরিব আদিবাসী মানুষেরা। তাঁদের মৌন মলিন মুখে ধ্বনিত হল প্রতিবাদের ভাষা-অধিকারের দাবি। গত ১৪ ডিসেম্বর বেলা ২ টায় শতাধিক মানুষের অংশগ্রহণে নাকাশীপাড়া ব্লক দপ্তরে সংগঠিত হল প্রবল বিক্ষোভ ডেপুটেশন। দপ্তরে গিয়ে মহিলারা জোরের সাথে বললেন, ১০০ দিনের কাজ চালু হবে কবে? বকেয়া মিটবে কবে? সরকারি প্রচারে শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন দপ্তরের কাজে নাকি জবকার্ডধারীদের নিয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু তার তথ্য কোথায়? কাদের নিয়োগ করা হচ্ছে? কোন পদ্ধতিতে? ব্লক আধিকারিক কিছুই বলতে পারলেন না। বরং তিনি জানালেন আধার সংযোগ না করলে দু-চার দিনের মধ্যে সমস্ত জবকার্ড নাকি বাতিল হয়ে যাবে। এ বিষয়টি বাধ্যতামূলক কেন? এ নিয়ে যথেস্ট প্রচার করা হয়নি কেন? প্রশাসন নিরুত্তর! বোঝা গেলো কেন্দ্রের মোদী সরকার প্রথমে বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। এখন বড় মাত্রায় জবকার্ড বাতিল করে দেওয়ার চক্রান্ত করছে। আর তৃণমূল গরিবদের প্রতি বঞ্চনা প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিনিধিরা বললেন, দরখাস্ত করেও এক বছর হয়ে গেল আদিবাসীদের জাতিগত সংশাপত্র পাওয়া যায়নি কেন? প্রমান স্বরূপ মীরাইপুর গ্রামের ৫০ জনেরও বেশি সংখ্যক বঞ্চিত আদিবাসীদের অনলাইন দরখাস্তের তথ্য তুলে ধরলেন তারা। তাহলে কি ঘুষ না দিলে কাজ হবে না? আদিবাসীদের শিল্পী-ভাতার দাবি জানানো হল। কয়েকটি নাচের দল ডেপুটেশনে অংশ নিয়েছিল। এ বিষয়ে জেলা তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিকের কাছে যাওয়ার কথা ব্লকের আধিকারিকরা জানালেন।

এখন গ্রামবাংলায় আবাস যোজনা নিয়ে চলছে তুমুল সোরগোল। পঞ্চায়েত ভোটের আগে গ্রামে গ্রামে শুরু হয়েছে সেই দাতা গ্রহীতা রাজনীতির চেনা ছকের খেলা! বিজেপি? না তৃণমূল! কোন সরকার ঘর দিচ্ছে যেন চলছে তার কৃতিত্ব নেওয়ার প্রতিযোগিতা! উপভোক্তা বা অনুগ্রহ পাওয়ার দলে মানুষকে ঠেলে পাঠানোর রাজনীতি! এই ছক ভাঙ্গার লক্ষ্যে তুলে ধরা হল আবাসের অধিকারের প্রশ্ন! দলতন্ত্র ও ঘুষের মিশেলে ২০১৯ সালে তৈরি এই আবাস যোজনা তালিকায় ধরা পড়েছে মোটাদাগের অসঙ্গতি। প্রশ্ন উঠেছে তালিকায় বহু সংখ্যক গরিবের নাম নেই অথচ ঘর পাওয়ার উপযুক্ত, সেই বঞ্চিত মানুষেরা ঘর পাবে কিভাবে? বিপরীতে এই “আবাস প্লাস তালিকা”য় যাদের নাম রয়েছে দেখা যাচ্ছে তাদের ৮০ ভাগেরই পাকা ঘর রয়েছে। সেই ভূয়া নামগুলি বাদ যাবে তো? ওদিকে গ্রামে গ্রামে শাসক দলের মাতব্বররা বলে চলেছে, যতই “দল বহির্ভূত” “নিরপেক্ষ” তদন্ত অনুসন্ধান হোক না কেন, সব তালিকাই নাকি তাদের মর্জিতে হবে! কিন্তু বাস্তবে বিষয়টা এতো সহজে হবে না। মানুষ এখন শাসকের চোখে চোখ রেখে কথা বলছেন, প্রশ্ন তুলছেন। সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে যে প্রকল্প কর্মীরা সরেজমিন তদন্ত করছেন, দলীয় মাতব্বরদের চাপের মুখে কিংবা অনেক বাধা বিপত্তি সত্বেও তারা কিছুটা মাত্রায় সত্যকে তুলে ধরছেন। ডেপুটেশনের প্রতিনিধিরা বললেন, যে তালিকায় বিপুল বিয়োজন ঘটার সম্ভাবনা সেখানে সংযোজন হবে না কেন? ওরা বললেন আদেশ নেই। প্রশাসনের কর্তারা গতেবাঁধা নিয়মবিধির কথা শুনিয়ে বললেন, আবাস তালিকা নিয়ে আপত্তি ও দাবি দুটোই জানান। ডেপুটেশনে জমায়েত মানুষ জানিয়ে দিলেন, আবাসের অধিকারের দাবিতে, দুর্নীতি অনিয়মের বিরুদ্ধে মাঠে ময়দানের লড়াই জারি থাকবে। শালিগ্রাম গাছা এলাকার মানুষেরা প্রশ্ন তুললেন, দীর্ঘ দুই বছর ধরে পশ্চিমপাড়ার একটা রাস্তা নির্মাণের কাজ আটকে রয়েছে কেন? গ্রামের মানুষ নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে সরকারি জমি উদ্ধার করে রাস্তা ও অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্র তৈরি করার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। কিন্তু সর্বসাধারণের উন্নয়নের এই কাজে শাসকদল নিজের বাহাদুরি দাবি করতে পারবে না বুঝেই তারা চুপ করে বসে আছে? প্রশাসনের কর্তাদের জানিয়ে দেওয়া হলো আগামীদিনে গ্রামের মানুষ প্রয়োজনে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে সেই রাস্তা বানাবে।

বিএলএলআরও তথা জমি দপ্তরের ঘুঘুর বাসায় তীব্র বিক্ষোভ জানিয়ে পার্টি ও গণসংগঠনের প্রতিনিধিরা জানালেন, জমির রেকর্ডে নাম অদলবদল করে দেওয়া হচ্ছে কোন নিয়মে? দুর্নীতি অনিয়মের জ্বলন্ত উদাহরণ, তথ্য প্রমাণ তুলে ধরে রীতিমতো জবাবদিহি চাইলেন তারা। উপস্থিত বিএলএলআরও ও দপ্তরের কর্মচারীরা ভুল হয়েছে বলে মেনে নিলেন। একের পর এক অনিয়ম বঞ্চনা দীর্ঘসূত্রিতার উদাহরণ তুলে ধরা হল। যথা আদিবাসী মানুষদের জমি বেদখল হয়ে রয়েছে, সেই জমি অ-আদিবাসী মানুষেরা বেআইনিভাবে রেকর্ড করে নিয়েছে, খাস বাস্তু জমিতে ৩০ বছর ধরে বসবাস করেও গরিব মানুষেরা পাট্টা পাচ্ছে না, গ্রামের তপশীলী সম্প্রদায়ের মানুষের ব্যবহৃত জমি খাস হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার কথা, কিন্তু সচ্ছল কিছু মানুষ সেগুলি ভূয়া রেকর্ড করে নিয়েছে। এ ধরনের বিষয়গুলি প্রমাণ সহকারে নিয়ে এসে জমির অধিকারের দাবি তুলে ধরা হল। জমিদপ্তরের আধিকারিকরা দায়সারা গোছের উত্তর দিলেন। উপস্থিত মানুষেরা জানিয়ে দিলেন লড়াই জারি থাকবে। পাট্টার জন্য জেলা স্তরে আদিবাসী দপ্তরে দাবি জানিয়ে কর্মসূচি নেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হল।

সমগ্র কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন কৃষ্ণ প্রামাণিক, সন্যাসী ওঁরাও, ইয়াদ আলি, হবিবুর রহমান, জীবন কবিরাজ, কাজল দত্তগুপ্ত, জয়তু দেশমুখ প্রমূখ।

Jhatha of cpiml

কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বেসরকারিকরণ ও সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ৬-১৩ ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদ জেলা ব্যাপি জাঠা কর্মসূচির পর ডিএম ডেপুটেশন ও টেকস্টাইল মোড়ে ১৫ ডিসেম্বর সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ডাকে জনসভা সংঘটিত হয়। এই সভায় অসংগঠিত মহিলাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

hooghly_dheniakhali

ধনিয়াখালি ব্লকে আদিবাসী বর্গাদারদের জমি থেকে উচ্ছেদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ায় সিপিআই(এমএল) নেতা সজল অধিকারীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধারায় মিথ্যা মামলা করেছে পুলিশ। পঞ্চায়েতে টিএমসির দুর্নীতি ও জব কার্ডরেশন কার্ড বণ্টনে কারচুপির বিরুদ্ধে, আবাস যোজনায় প্রকৃত গরিবদের ঘর, বার্ধক্য ভাতা ইত্যাদি এবং আদিবাসী লোকশিল্পীদের ন্যায্য সাম্মানিক ভাতা পাওয়ার দাবিতে এবং পুলিশের মামলা হামলার বিরুদ্ধে পার্টির নেতৃত্বে গ্রামবাসীদের বিক্ষোভ ধনিয়াখালি ব্লক অফিসে ১৪ ডিসেম্বর।

Tripura are strongly condemned

সিপিআই(এমএল), ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি, ১৩ ডিসেম্বর ২০২২ এক প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছে, চাকরির দাবিতে এসটিজিটি বেকার যুবক-যুবতীরা দীর্ঘদিন ধরে লাগাতার দফায় দফায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আসছে। এর অঙ্গ হিসেবে গত সোমবার সকাল থেকে তাঁরা গণতান্ত্রিকভাবে বিক্ষোভ শুরু করেন এবং তারপর ঘেরাও করেন শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ি। আর তাই শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশেই দলদাস পুলিশ কর্মহীন যুবক-যুবতীদের উপর অমানবিকভাবে লাঠিপেটা করেছে। তারফলে ৫০ জন বেকার যুবক-যুবতীরা আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এমনকি পুলিশের হাত থেকে গর্ভবতী মহিলা ও কিডনির জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীও রেহাই পায়নি। সরকারের নির্দেশে পুলিশের এই ধরনের অমানবিক লাঠিচার্জ ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনায় সারা রাজ্যের মানুষ স্তম্ভিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন। এদিকে শিক্ষা দপ্তরে প্রায় ১৫ হাজার শূন্যপদ পড়ে রয়েছে। অথচ রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় পাশ করা ৩৮৯৭ জন গ্রেজুয়েট বেকার যুবক-যুবতীরা রাজপথে হন্যে হয়ে ঘুরছে। সরকার মিথ্যাবাদী। মন্ত্রীরা মহাকরণে বসে বিভিন্ন দপ্তরে শূন্যপদ সৃষ্টির ফিরিস্তি দিয়ে একের পর এক সাংবাদিক সম্মেলন করছেন। মিথ্যা ও ভূয়া সব তথ্য প্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন। আর শিক্ষামন্ত্রী আরও এক ধাপ এগিয়ে বলছেন যে, রাজ্যে নাকি সরকারি চাকরির জন্য শিক্ষিত যোগ্য বেকার প্রার্থী নেই। কাজেই শিক্ষামন্ত্রী নিজেই মিথ্যা কথা বলছেন। শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বেকারদের ন্যায্য দাবিকে বুলডোজার দিয়ে দাবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। শিক্ষামন্ত্রী নাকি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যেই বলেছেন এভাবে আন্দোলন করলে তাঁদের চাকরির ফাইল পাঠানো হবে না। এই সরকার আজ বেকারদের চাকরির অধিকার, আন্দোলনের অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। অধিকার সম্পন্ন নাগরিক নয়, এরাজ্যে সরকারের চোখে আজ সবাই প্রজা। সংবিধান অচল, প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন বিপন্ন। যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সংবিধান সম্মতভাবেই ঐক্যবদ্ধভাবে এর উপযুক্ত জবাব দিতে হবে।

তাই, শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অথচ বেকার যুবক-যুবতীদের উপর সরকারের নির্দেশে অমানবিকভাবে লাঠিচার্জ ও শারীরিক নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানায় এবং অবিলম্বে টেট উত্তীর্ণবেকার যুবক-যুবতীদের শূন্যপদে নিয়োগের ব্যবস্থা করার জন্য দাবি জানায় সিপিআই(এমএল) ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি।

Medical College student movement

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের গণতান্ত্রিক দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশন আন্দোলন চলছে। ছাত্র-ছাত্রীদের অনশন আন্দোলনের সমর্থনে কলেজের প্রাক্তনীরা যেমন পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তেমনই বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল মিটিং সংগঠিত করছেন। আইসা এই আন্দোলনের সমর্থনে প্রচার গড়ে তুলছে। নাগরিক সমাজের বিশিষ্টজনেরা এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন। ১৫ ডিসেম্বর ১২ ঘণ্টার জন্য প্রতীকী অনশন আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন অভিভাবকরা। আন্দোলন ক্রমশই গণচরিত্র অর্জন করছে। রাজ্যের শাসকদলের নেতানেত্রীরা যথারীতি মিথ্যাচার শুরু করেছে। অসুস্থ চিকিৎসা ব্যবস্থার চিকিৎসার জন্য মাঝে মাঝেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠবে। কখনো চিকিৎসকরা, কখনও ছাত্রছাত্রীরা, কখনও স্বাস্থ্যকর্মীরা গণমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও পরিষেবার জন্য এইসব আন্দোলনের সামনে থাকবে। এই গণ আন্দোলনকে সর্বতভাবে সহযোগিতা করতে আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে।

women want equal rights

আমরা, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, মেয়েদের নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রসঙ্গে আহমেদাবাদের শাহি ইমামের সাম্প্রতিক মন্তব্যের বিরোধীতা করছি, যেখানে তিনি বলেছেন, মেয়েদের নির্বাচনের টিকিট দেওয়া অনুচিত কারণ তা ধর্ম-বিরুদ্ধ। আইপোয়ার জাতীয় সম্পাদিকা মিনা তিওয়ারী ও সহসম্পাদিকা ডঃ ফারহাত বানো বলেছেন, সমাজ হোক বা রাজনীতি, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মেয়েদের সমানাধিকারে বিশ্বাস করে আইপোয়া।

মুসলিম মেয়েরা দীর্ঘ লড়াইয়ের পর বিভিন্ন জায়গায় নামাজ পড়ার অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে, বিভিন্ন দেশে প্রভাবশালী রাজনৈতিক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বহাল। বিগত কয়েক শতক ধরে, ভারতের মুসলিম মেয়েরা, রাজনীতি, প্রশাসন, সমাজ বদলের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। তারা সমাজকে দিশা দেখিয়েছে, সম্মান অর্জন করেছে। যেমন, ১৯ শতকে ফাতিমা শেখ, হজরৎ মহলের অবদান, এমন বিশ শতকে স্বাধীনতা সংগ্রামে বহু মুসলিম মেয়ের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। স্বাধীন ভারতে, আসাম, জম্মু-কাশ্মীরে মুখ্যমন্ত্রী পদে থেকেছে মুসলিম মেয়েরা। অনেকেই, নির্বাচনে লড়েছে এবং বিধায়ক, সাংসদ, পঞ্চায়েত প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচত হয়েছে। কখনোই ধর্মের কারণে মুসলিম মেয়েদের অংশগ্রহণ থেমে থাকেনি। শাহি ইমাম হয়ত ভুলে গেছে যে, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রকে বাঁচাতে ভারতজোড়া সিএএ, এনআরসি, এনপিআর বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল মুসলিম মেয়েদের শক্তি আর প্রতিরোধের আকাঙ্ক্ষার উপর ভিত্তি করে। অনেক মুসলিম মেয়ে আজও কারারুদ্ধ।

ইতিহাস যেভাবে এগিয়েছে, সেভাবেই, মুসলিম মেয়েরা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে আত্মঘোষণায় আরো দৃঢ় হয়েছে। আজ, মুসলিম, হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টার — সব ধর্মের মেয়েরা একসাথে সমানাধিকারের জন্য, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়ছে। শাহি ইমাম, ইতিহাসের চাকাকে ঘোরাতে পারবে না। তাই ওনার উচিত, নিজের বক্তব্য অবিলম্বে ফিরিয়ে নেওয়া।

- মিনা তিওয়ারী ও ডঃ ফারহাত বানো, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, ৫ ডিসেম্বর ২০২২

Bogtwi massacre

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, এ বছরের মার্চ মাসে বীরভূমের বগটুই গ্রামে নৃশংস গণহত্যার তদন্ত চালাচ্ছিল কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে এই তদন্ত চলছিল। গতকাল (১২/১২/২২) সিবিআই হেফাজতে এই গণহত্যার অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত লালন শেখের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। জিজ্ঞাসাবাদের নামে বিচারাধীন বন্দীর সঙ্গে কী ধরনের আচরণের ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তির মৃত্যু হল, আজ তা গুরুতর প্রশ্নের মুখে। ইতিমধ্যে লালন শেখের পরিবারের পক্ষ থেকে সিবিআই তদন্তকারী অফিসারের বিরুদ্ধে রামপুরহাট থানায় ৩০২ ধারায় খুনের মামলা রুজু করা হয়েছে। ইতিমধ্যে অভিযোগ উঠেছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে সিবিআই হেফাজতে বিচারাধীন বন্দীর জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদি কাজ চলছিল। ২০২০ সালে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, সিবিআই হেফাজতে তদন্ত চলাকালীন ২৪ ঘণ্টা সি সি ক্যামেরা চালু রাখতে হবে। অথচ রামপুরহাট সিবিআই হেফাজতে কোনো সি সি ক্যামেরা চালু ছিল না। লালন শেখের স্ত্রী আরও অভিযোগ করেছেন, এমনকি তদন্ত ধামাচাপা দেবার জন্য টাকা (ঘুষ) চাওয়া হয়েছিল।

সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বিচারপতির তত্ত্বাবধানে বগটুই গণহত্যার প্রধান অভিযুক্তের সিবিআই হেফাজতে অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিচারবিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।

Bonded laborers are freed

তামিলনাড়ুর পশ্চিমের শিল্পোন্নত জেলাগুলোতে শোষণ যেমন পাশবিক রূপের, তেমনি তা চলে অবাধে ও ব্যাপক ধারায়। এখান প্রচুর সংখ্যায় পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়োগ করা হয় এবং তাদের বাঁধা মজুর করে তোলা এবং জোরজবরদস্তি শ্রম আদায় করাটা একেবারেই নিয়ম হয়ে উঠেছে। এই পরিযায়ী শ্রমিকরা মূলত দলিত ও তফশিলি জনজাতি সম্প্রদায়ের, এদের মধ্যে কমবয়সী ছেলে-মেয়েরাও থাকে। এই শ্রমিকদের কাজে লাগানো হয় পোল্ট্রি ফার্মে এবং রঞ্জক দ্রব্য উৎপাদনের কারখানায়, সুতো তৈরির মিলে, বিদ্যুৎ চালিত তাঁতে, পোশাক তৈরির কারখানায়, যেগুলো হল এই জেলাগুলোর প্রধান শিল্প। এদের অজ্ঞতা এবং স্থানীয় ভাষা না জানাটা শোষণের সহায়ক হয়। ট্রেড ইউনিয়ন না থাকা এবং প্রশাসনের অসংবেদিতা এই নির্মম শোষণকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের বাঁধা মজুর করে তোলার পক্ষে পরিস্থিতিকে অনুকূল করে তোলে।

তামিলনাড়ুর নামাক্কাল জেলার কয়েকটি পোল্ট্রি ফার্মে ছত্তিশগড়ের বস্তার, নারায়নপুর, মহাসামুন্দ জেলা এবং উড়িষ্যা থেকে ৩৭ জন তফশিলি জনজাতির পরিযায়ী শ্রমিক এনে নিয়োগ করা হয়। এই শ্রমিকদের নিয়ে আসে মহারাষ্ট্রের দুই এজেন্ট এবং তাদের তুলে দেওয়া হয় দুই ঠিকাদার প্রকাশ সাহু ও থাংগাভেল’এর হাতে। নামাক্কাল জেলার মোহানুর তালুকের আনিয়াপুরম গ্ৰামের এক পোল্ট্রি ফার্ম সংলগ্ন ভাঙাচোরা বাড়িতে তাদের থাকতে বাধ্য করা হয়, যে বাড়িতে বুনিয়াদি পরিষেবার কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। প্রতিদিন বিকেল তিনটের সময় তাদের ভ্যানে তোলা হতো এবং ফেরানো হতো পরদিন রাত দশটায়, এবং গোটা সময়টা কাজ করতে হতো একাধিক পোল্ট্রি ফার্মে।

প্রতিদিন কোনো বিরাম ছাড়াই প্রায় ১৯ ঘণ্টা কাজ করতে হতো, কাজের এই ঘণ্টা বেড়ে কখনও কখনও ৪৮ ঘণ্টাও হয়ে যেত। তারা ৫ ঘণ্টার বিরামও পেত না। তাদের কোনো মজুরি দেওয়া হতো না, বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু খাবার দরকার সেটুকুই শুধু দেওয়া হত। ঘুমোনো এবং বিশ্রামের সময় চাইলে তাদের মারধোর করাও হত। কাজের নির্মম পরিবেশে তারা বাঁধা পড়েছিল, শ্রম আইনের কোনো সুবিধার অধিকারই তাদের ছিল না। তাদের মোবাইল ফোন ও আধার কার্ড ঠিকাদাররা কেড়ে নিয়ে নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিল, আত্মীয় এবং প্রিয়জনদের কারুর সঙ্গেই তারা যোগাযোগ করতে পারতো না।

এই পরিস্থিতিতে সাহসী কয়েকজন শ্রমিক সেখান থেকে কোনোক্রমে পালিয়ে নিজেদের গ্ৰামে ফিরে গিয়ে তফশিলি জনজাতি আন্দোলনের নেতাদের গোটা বিষয়টা জানান এবং সেই নেতারা আবার ছত্তিশগড়ের সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনকে বিষয়টা অবহিত করে।

ছত্তিশগড়ের জনজাতি সংগঠন এবং ট্রেড ইউনিয়নের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে নামাক্কাল জেলার বাঁধা মজুরদের মুক্ত করতে এআইসিসিটিইউ এবং আরওয়াইএ’র স্থানীয় ইউনিট সক্রিয় হয়। এআইসিসিটিইউ’র কমরেড সুব্রমানি ও ভেঙ্কটেশ এবং আরওয়াইএ’র কমরেড কালিদাস জেলার কালেক্টরের সঙ্গে দেখা করে একটি অভিযোগ দায়ের করে ঐ মজুরদের মুক্তি এবং শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকা-সহ মজুরি ক্ষতিপূরণের দাবি জানান। জেলা প্রশাসন অভিযোগে গুরুত্ব দিয়ে সক্রিয় পদক্ষেপ করে। জেলা কালেক্টর, তহশিলদার, শ্রমিক ও শিশু শ্রমিক সুরক্ষার অফিসারকে নিয়ে একটা টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয় এবং তারা পরিস্থিতিতে সক্রিয় হস্তক্ষেপে সক্রিয় হয়। যারা ঐ পাশবিক পরিস্থিতিতে বাঁধা পড়েছিল, এবছরের ১৯ অক্টোবর সেই ৩৭ জন বাঁধা শ্রমিকের মুক্তি ঘটে। প্রশাসন শ্রমিকদের নিজ নিজ গ্ৰামে ফিরিয়ে দিতে পরিবহণের ব্যবস্থা করে। তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে মজুরি ও ক্ষতিপূরণের টাকা জমা হয় এবং বাঁধা মজুর থেকে মুক্তির সার্টিফিকেটও তাদের দেওয়া হয়। যে ঠিকাদাররা গা ঢাকা দিয়েছিল পুলিশ তাদের গ্ৰেপ্তার করে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ আনে। শ্রমিকদের আরো চার মাসের মজুরি উদ্ধারের প্রচেষ্টা জারি আছে।

এআইসিসিটিইউ এবং আরওয়াইএ’র জেলা নেতৃত্বকে সঙ্গে নিয়ে গোটা উদ্যোগটায়, জেলা প্রশাসন এবং ছত্তিশগড়ের জনজাতি কল্যাণ কর্মীদের সাথে সমন্বয় সাধন করেন সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড চন্দ্রমোহন।

woman's mind

সময় দ্রুত পাল্টে চলেছে। কিন্তু চলমান সময়ে তা পুরো বোঝা যায় না। পরিবর্তনের নকশাতেও থাকে অনেক খামতি, আসে হুমকি। নারীদের কথাই বলছি। বাস্তবিকই এ এক কঠিন যুদ্ধ। প্রতিদিনের। সব সহনশীলতারও একটি মাপকাঠি থাকে। সেটাও বোধ হয় পেরিয়ে যেতে হয় এক নারীকে!

ভোর থেকে রাত্রির বিছানা পর্যন্ত এক লম্বা লড়াই। সেই পিতৃ-অঙ্গন থেকে শ্বশুর-অঙ্গনের আলিঙ্গনে এসে কেমন যেন বদলে যেতে থাকে এক একটি নারীর জীবন। আগুনের আঁচের উত্তাপে সেও পুড়তে থাকে, খোলা আকাশ বন্দি হয়, রোদ্দুরের সাথে আড়ি, শুধু একটি নদীর স্রোত ভেসে চলে দুটি চোখের পাতায়। সত্যি কি নারীরা স্বাধীন!

আজ জীবিকার তাগিদে মহিলাদের বাইরে বেরিয়ে আসতে হয়েছে কল-কারখানায়, সরকারি অফিসে, অসংগঠিত শ্রমিক বা পরিচারিকার কাজে। তারপরেও শুনতে হয় নোংরা ভাষা, “এতো দেরি করে বাড়ি ফের কেন, কোনো আউট ইনকাম আছে নাকি” ইত্যাদি। অথচ এই নারীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে করে সংসারের সিংহভাগ খরচ বহন করে চলে। গৃহ পরিচারিকাদের মধ্যেও কেউ অসুস্থ হয়ে দু’চার দিন কাজে না যেতে পারলে, কাজ থেকে ছাঁটাই করে আরো একটু কম টাকায় কাজের লোক খুঁজে নেয় মধ্যবিত্ত গৃহস্থ। কোভিডের পর ওরা যেন আরও অসহায়। কাজের সুযোগ কমে গেছে। তাই পারিশ্রমিক আরও কমে গেছে। ঘর থেকে তাই বেরোনোর সাহস ও উৎসাহও কমে গেছে।

বেখোফ আজাদি কিংবা নারী স্বাধীনতার কথা আমরা বলি, সত্যিই কি নারীরা স্বাধীন! অনেক সময় দেখেছি, অদম্য ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেয়েরা পায়ের শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারে না। তাই নারীদেরকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে নারীদেরই। শেখাতে হবে জোট বাঁধতে। সামাজে, পরিবারে সব শোষণের বিরুদ্ধে আরো বেশি করে সামিল করতে হবে। নারী-পুরুষের মধ্যে সুন্দর বোঝাপড়া, সুগম পথের দিশায় এগিয়ে চলার কথাই বলতে হবে। তবেই প্রগতিশীল কথাটির অর্থ বাস্তবিকই গতিময় হয়ে উঠবে।

- মীরা চতুর্বেদী

innermost words of a woman

===
গভীর সংকটে লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার আবর্তে অর্ধেক আকাশ

(১) ২০২১ সালের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট’ বলছে, সারা বিশ্বে লিঙ্গ নির্ধারণপূর্বক যে ভ্রূণহত্যা হয় তার ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই হয় ভারত ও চিনে। কন্যা শিশু জন্মালেও বিপরীত লিঙ্গের চেয়ে বেশি সংখ্যায় তারা মারা যাচ্ছে।
(২) ১৪৬টি দেশের মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্যের বিশ্বতালিকায় ভারত এখন ১৩৫ নম্বরে।
(৩) আদালতে গার্হস্থ হিংসার কেস অমীমাংশিত ঝুলছে ৪ লক্ষের বেশি। ধর্ষক জামিন পেয়ে বাইরে বেরিয়ে একই নারীকে আবার ধর্ষণ করছে, তাকে বা তার আত্মীয় পরিজনকে খুন করছে। ২০২০ সালে ভারতে ধর্ষকদের সাজা দেওয়া হয়েছে মাত্র ২৭ শতাংশ। অভিযোগ জানাতেই পারেননি এমন মহিলাদের সংখ্যা অসংখ্য।
(৪) ভারতে ১০০ জনে ৩০ জনের বেশি নারী আজও নিরক্ষর। মাত্র ৪১ শতাংশ ছাত্রীই ১০ বছর স্কুলে টিঁকে থাকতে পারছে। কোভিডের পর কত সংখ্যক ছাত্রী যে স্কুল ছাড়া হয়েছে, তার হিসাব পাওয়া দুষ্কর।
(৫) ভারতের সমগ্র শ্রমশক্তিতে মেয়েদের যোগদান এখনও ২০ শতাংশ ছুঁতে পারেনি। এর সিংহভাগটাই অসংগঠিত ক্ষেত্রে, যেখানে বেতন বৈষম্য প্রকট।
(তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা)

cheap labor

‘অমৃত মহোৎসব’-এর বছরেও ভারতবর্ষের বহু মানুষ খোলা আকাশের নিচে শীতার্ত রাত কাটাবেন। কাটাতে বাধ্য হবেন। বহু মানুষের মাথা গোঁজার একটা আস্তানা থাকলেও ‘পাকা’ ঘর নেই। মাঝে মাঝে সরকারের ‘দাক্ষিণ্যে’ কিছু গৃহহীন মানুষ ঘর পান, কারও ভাঙা মাটির ঘর ‘পাকা’ হয়। নির্বাচনের আগে সরকারি বিজ্ঞাপন আলো করে। কংগ্রেসী জমানায় ১৯৮৫ সালে শুরু হওয়া ‘ইন্দিরা আবাস যোজনা’ই এখন মোদী সরকারের ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’। অঙ্ক কষেই কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্যে সম্প্রতি এই যোজনায় কিছু অর্থ বরাদ্দ করেছে। সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। আর বিজেপি’র রাজ্য নেতৃত্ব তাতে এমন হুঙ্কার ছাড়ছেন যেন টাকাটা তাদের পৈতৃক জমিদারি থেকে এসেছে। যদিও ভুলে গেছেন ১০০ দিনের কাজে আমাদের রাজ্যের বকেয়াই সব চেয়ে বেশি (২৭৪৪ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা যেখানে যোগীরাজ্যের বকেয়া মোটে ৫২ কোটি ৪৮ লক্ষ টাকা!)।

মোদী সরকার ‘লুঠ’কে প্রাতিষ্ঠানিক করে ফেলেছে। রাজ্যে শাসকদলের মন্ত্রী- নেতা-কর্মীরা, এমনকি কিছু আমলাও, দুর্নীতিকে তাই-ই করতে চলেছেন – নিয়োগ দুর্নীতি থেকে বগটুই-এর শিহরণ জাগানো মর্মান্তিক ঘটনা – সবই তার প্রমাণ। স্বাভাবিকভাবেই অনতি অতীতে আবাস যোজনার কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে বিরাট প্রশ্ন থেকে গেছে। এই আবহে আবাস যোজনার সমীক্ষার, অর্থাৎ সঠিক প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ চাপিয়ে দেওয়া হল অঙ্গনওয়াড়ি ( আইসিডিএস কর্মী ) ও আশাকর্মীদের ওপর। যারা অত্যন্ত কম পারিশ্রমিকে তৃণমূল স্তরে মাটির সঙ্গে থেকে গোটা রাজ্যে শিশুশিক্ষা, প্রসূতি ও শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিচর্যার দেখভাল করেন। আশাকর্মীদের কাজটি এমনিতেই যথেষ্ট ঝুঁকি পূর্ণ। আসন্নপ্রসবাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, কোনো সমস্যা হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো, সুস্থ থাকার বার্তা পৌঁছে দেওয়া, রাত- বিরেতে পথে-ঘাটে কত রকমের বিপদ ও সমস্যার ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করেন। তার ওপর আবার মাটির বাড়ি চিহ্নিত করার কাজ।

কাজটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্বপূর্ণ। কিন্তু আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের কেন দেওয়া হল এই গুরুদায়িত্ব? তারা তো অন্য দায়িত্ব পালন করছেন? সম্ভবত তাদের পরিষেবার মান, দক্ষতা, কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রশাসনের কাছে গ্রহণযোগ্য শুধু নয়, প্রশ্নাতীত। আশাকর্মী হিসাবেই নয়, প্রাথমিকভাবে মহিলা হিসেবেই তাদের হাতে অতীতের কলঙ্ক মোচনের এই ভার তুলে দেওয়া হল।

একেবারে তৃণমূলস্তরের এই কর্তৃত্ব নিঃসন্দেহে একজন হতদরিদ্র মহিলার কাছে উপভোগ্য। একজন দোতলাবাড়ির মালিকের নাম নাকচ করা আর একটা পাকা ঘরের স্বপ্ন দেখা গরিব মানুষের স্বপ্নকে বাস্তব করার প্রথম সিঁড়িটা তৈরি করে দেওয়া – এর মধ্যে অবশ্যই একটা কর্তৃত্ব, একটা মর্যাদার স্বাদ আছে। কাজের প্রশ্নে আছে একটা আত্মতৃপ্তি। বিশেষ করে যারা চিরকাল মাথা নিচু করে অন্যের কর্তৃত্ব মেনে চলতেই অভ্যস্ত।

গ্রামে অশিক্ষা অজ্ঞতা কুসংস্কার জাত পাত বর্ণবিভাজনের অন্ধকার ঠেলে আশা-দিদিরা, আইসিডিএস কর্মীরা কীভাবে শিক্ষা স্বাস্থ্য পুষ্টির নিভু নিভু প্রদীপটি অনির্বাণ রেখেছেন, রাখছেন তার পরিচয় আমরা পেয়েছি কোভিড ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর প্রতিবন্ধকতা বোধ হয় রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা পেশীশক্তির আস্ফালন। সেখানে শাসক- বিরোধী দলে কোনো ফারাক নেই। মাত্রায় হয়তো কম-বেশি। সমাজে থাকা পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে এই ক্ষমতাতন্ত্রের মোকাবিলা করা কতটা দুরূহ যারা হাতে কলমে কাজটা করেন, তারাই জানেন। দোতলা বাড়ির মালিকের নাম কাটার পরে তার আস্ফালন, গালি-গালাজ, অসম্মান এমনকি প্রাণে মারার হুমকির ভয়কে এই গরিব স্বল্পশিক্ষিত মহিলারা উপেক্ষা করবেন কীভাবে? কাজের সময়ে তাদের সঙ্গী শুধু একজন গ্রামীণ পুলিশ। কে দেবে তাদের নিরাপত্তা? বাকি সময়ে? এই চরম টানা পোড়েন, মানসিক চাপের মূল্য প্রাণ দিয়ে দিয়ে গেলেন স্বরূপনগরের শাঁড়াপুল নির্মাণ পঞ্চায়েতের আশাকর্মী রেবা বিশ্বাস। এই চাপ সইতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছেন তিনি। আর প্রচ্ছন্নভাবে বলে গেলেন, গরিব মানুষেরও একটা শিরদাঁড়া থাকে, কর্তব্যের প্রতি দায়বদ্ধতাও থাকে! প্রশাসন তার প্রাণ মান রক্ষা করতে পারুক আর না-ই পারুক!

প্রশ্নটা শুধু সেখানে নয়। এই রেবা বিশ্বাসরা নিয়মিত যে কাজটা করে থাকেন – সেই প্রসূতি মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি পরিচর্যার তদারকি – সেটা কি থেমে থাকবে? সেটা কি থামিয়ে রাখার মতো কাজ? প্রশাসনের কাছে সে কাজটি কি গুরুত্বহীন? নাহলে তারা চাপালেন কীকরে এই বাড়তি দায়িত্ব?

কোভিড-এর আগের থেকেই একশো দিনের কাজ প্রায় বন্ধ। কাজের টাকাও বকেয়া রাখা হয়েছে। সমানেই চলেছে চাপান-উতোর কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে। তাতে কি আয়হীন নিরন্ন মানুষের পেট ভরবে? রোগের চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা হবে? সেগুলোও তো তর্জনীর ইঙ্গিতে থেমে থাকার বিষয় নয়! তাহলে এই আবাস যোজনার সমীক্ষার কাজটি গ্রামের অন্য মহিলাদের দেওয়া গেল না কেন? সময়ের তাড়া, না কোষাগারের টাকা বাঁচানো? এক আশাকর্মী জানালেন, তাদের নাকি বাড়তি কিছু টাকা দেওয়া হবে। হবে তো বটেই, কিন্তু এই সমীক্ষার কাজে যে দায়িত্ব শ্রম এমনকি প্রাণের ঝুঁকি পর্যন্ত জড়িয়ে আছে, তার সঙ্গে এই ‘বাড়তি’ টাকা কতটা সাযুজ্যপূর্ণ? কতটা উপযুক্ত? নতুন কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ, তাছাড়া তাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে গেলে সরকারি কোষাগারের অনেক টাকা খরচ! মানে অনেক হ্যাপা! তাড়াতাড়ি কাজটা নামাতে হবে ন্যূনতম ব্যয়ে। তাই প্রশাসনের চোখে আশা-দিদিরাই মুস্কিল আসান, আসলে ‘ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো’!

আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা এর বিরুদ্ধে মুখর হয়েছেন অনেক জেলার অনেক ব্লকেই। তাদের সংগঠন থেকেও সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এই তাড়াহুড়োর বেগার শোধের কাজে নানা কারণেই প্রচুর অসঙ্গতিও থাকছে। সংবাদে নজর রাখলেই সেইসব অনিয়ম ধরা পড়ছে। কোনো কোনো অঞ্চলে মানুষ বিশেষ করে মহিলারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন।

আসল কথাটা হল, নারীর শ্রম এখন ঘরের বাইরে এসেছে, পণ্যায়িত হয়েছে কিন্তু তার দাম লিঙ্গ বৈষম্যের এই সমাজে বড়ই কম। খুবই সস্তা! কল্পনাতীত সস্তা নারীর রক্ত ঘামের দাম! তাই তো মিড ডে মিল-এর দিদিদের মাসে মাত্র ১৫০০ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাদের অত্যন্ত দায়িত্ব ও ঝুঁকিপূর্ণ দৈনিক কয়েক ঘণ্টার শ্রম কিনে নেওয়া যায়! ষাট বছর পেরোলে বা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে, একেবারে খালি হাতে বিদায় দেওয়া যায়! এক কথায় ব্যয় সংকোচের নাম করে নির্দ্বিধায় নারীর শ্রম লুঠ চলছে! লুঠ করছে সরকার – কেন্দ্রে-রাজ্যে। আর তাই আজ ‘নারীশক্তি’র এত মাহাত্ম্য কীর্তন! নারী ‘সেবাপরায়ণা’, ‘মায়ের জাত’, ‘ধরিত্রীর মতো সহিষ্ণু’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলে সেই লুঠ চলছে। করপোরেট আধিপত্যের নয়া উদারবাদী অর্থনীতি নারীশ্রম শোষণে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

কিন্তু ধরিত্রীও উপেক্ষিত নির্যাতিত হতে হতে আজ চরম অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছেন। নারীদেরও সহিষ্ণুতার বাঁধ ভাঙছে! শুধু একজোট হওয়ার অপেক্ষা!

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

revolution in agriculture

গত মার্চ মাসে ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া হরিয়ানায় কৃষকদের নির্দেশ দেয় সরকারি মাণ্ডিগুলির বদলে সরাসরি আদানি কোম্পানির সাইলোতে ফসল বেচতে। কৃষকের বিরোধিতার মুখে পড়ে এফসিআই নোটিশটিকে সংশোধন করে নিতে বাধ্য হয়। নোটিশটিতে বলা হয়েছিল যে, আগামী মরশুম থেকে মাণ্ডিগুলির খোলা খলিয়ানে আর গম নেওয়া হবে না এবং আদানি কোম্পানির সাইলোগুলোর কাছাকাছি থাকা সরকারি মাণ্ডিগুলির এজেন্টরা কৃষকদের বস্তা সরবরাহ করবে না। নোটিশটিতে এ’কথাও জানানো হয় যে উপরতলার নির্দেশে আদানিদের সাইলোগুলিতে সরাসরি গম পাঠাতেই এই ব্যবস্থা। কৃষকদের বিক্ষোভের পর এফসিআই নতুন একটি নোটিশ এনে বলেছে যে কৃষকেরা ‘চাইলে’ আদানির সাইলোতে সরাসরি ফসল দিতে পারে এবং এজেন্সিগুলি ‘চাইলে’ বস্তা সরবরাহ করতে পারে।

ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া (এফসিআই)-কে ধাপে ধাপে ‘আদানি এগ্রি লজিস্টিকস’-এর হাতে তুলে দিচ্ছে মোদি সরকার। পাব্লিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের নামে। ফুড-চেইনের ব্যবস্থাগত সমস্ত দিকই দ্রুত কেন্দ্রীভূত হচ্ছে আদানির হাতে। দেশ জুড়ে ৯০০’র ওপর সাইলোর এক জাল বিছিয়েছে আদানি। পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় সাইলোগুলিকে ঘিরে প্রাইভেট রেল, স্বয়ংক্রিয় শস্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা ইত্যাদি সবরকম পরিকাঠামো আদানিদের নিজস্ব। সরকারি কোষাগার থেকে এসবের জন্য ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। আদানিদের পরিকাঠামো সম্পত্তি পাহারা দেওয়ার জন্য নিজস্ব সশস্ত্র সুরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলতেও সবরকম পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে সরকার।

সবুজ বিপ্লবের দশক থেকে ভারতীয় কৃষিতে কৃষকের পতন ও কর্পোরেট আধিপত্যের উত্থান শুরু হয়। নয়া উদার অর্থনীতি আসার পর এদের চরম বৃদ্ধি ঘটে। আহরণ, পরিবহন, সঞ্চয়ন, প্রক্রিয়াকরণ ও বিতরণ – সর্বক্ষেত্রে বড় বড় কর্পোরেটদের বিস্তার ঘটে। এদের স্বার্থেই তিনটি কৃষি আইন প্রণয়নের চেষ্টা করেছিল মোদি সরকার। ফসলের ব্যবসা বাণিজ্য, ফসলের মূল্য নির্ধারণ এবং ফসল মজুতদারি — এই তিনটি বিষয়ে তিনটি আইন। এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে ব্যাপক ও একরোখা প্রতিরোধ গড়ে তোলে পূর্বতন সবুজ বিপ্লবের মূল মূল এলাকার কৃষকেরা। কৃষকদের মূল কথা ছিল, আইনগুলি সমগ্র কৃষি ব্যবস্থার ওপর কর্পোরেট কোম্পানিগুলির একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে কৃষি থেকে কৃষকদেরই বিচ্ছিন্ন করে দেবে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সম্পূর্ণ ধ্বংস করবে। দিল্লি সীমান্ত ঘিরে গড়ে ওঠা অভূতপূর্ব কৃষক আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকারকে বাধ্য করে আইনপ্রস্তাবগুলি প্রত্যাহার করে নিতে। কিন্তু ভারতীয় কৃষির ওপর কৃষি-কর্পোরেটদের একাধিপত্যের গতি থেমে যায়নি। রিলায়েন্স ফ্রেস, আদানি এগ্রিফ্রেস, ভারতি’স ফিল্ডফ্রেস — কাঁচা ফসলের বাজারে কর্পোরেটরা জাঁকিয়ে বসছে। বীজ থেকে ফসল হয়ে পাকস্থলিতে খাদ্য পৌঁছনো পর্যন্ত খাদ্যপ্রবাহের সমগ্র প্রক্রিয়া আরও তীব্র গতিতে কর্পোরেট কোম্পানিগুলির হাতে একচেটিয়া হয়ে যাচ্ছে। এই আধিপত্য আরও আঁটোসাটো ও সর্বব্যাপি করে তোলার নতুন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আসছে ডিজিটাল-কৃষি, যাকে বিশ্ব ইতিহাসের ‘চতুর্থ কৃষি বিপ্লব’ বলছেন অনেকে।

সবুজ বিপ্লবের ধারাতেই ভারতের কৃষিতে এই নতুন বিপ্লব আসছে। কৃষিক্ষেত্রে স্মার্টবিপ্লব বা ডিজিটাল-কৃষি। আপাতত পাঁচ বছরের পরিকল্পনা হিসেবে ‘ডিজিটাল এগ্রিকালচার মিশন ২০২১–২০২৫’ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে। বলা হয়েছে, ডিজিটাল-কৃষি ব্যাপারটা সে অর্থে কোনও প্রজেক্ট সম্পর্কিত ব্যাপার নয়, জনগণ সম্পর্কিত ব্যাপার, এবং ব্যাপারটা বাস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পন্ন হবে। এ’বছর ‘পিএম কিসান সম্মান সম্মেলনে’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বর্তমানে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ড্রোন প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক কৃষি পদ্ধতিই সময়ের দাবি”। তিনি এ’কথাও বলেন যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আমাদের আরও খোলা মনে গ্রহণ করা দরকার।

জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে চীনের সরকারি মেগা কর্পোরেট সিনজেন্টা (Syngenta) ভারতে ১৭ হাজার কিলোমিটার ড্রোনযাত্রা সংগঠিত করেছে ১৩টি রাজ্যের ক্ষেত-খামারের ওপর দিয়ে ৫০টি ড্রোন উড়িয়ে। অনেকগুলি রাজ্যে বড় বড় ইভেন্ট ছিল এই ড্রোনযাত্রার অঙ্গ। কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের মন্ত্রীরা সেগুলিতে উপস্থিত ছিলেন। সিনজেন্টা ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, আধুনিকতম প্রযুক্তির প্রয়োগে কৃষিকে কৃষকের পক্ষে লাভজনক করে তোলাই সিনজেন্টার লক্ষ্য, অনেকগুলি রাজ্য সরকারের সাথে বেশ কিছুদিন যাবৎ সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে। নভেম্বরে নয়টি ফসল সংক্রান্ত ‘ক্রপওয়াইজ গ্রোয়ার’ অ্যাপ চালু করেছে সিনজেন্টা যার মাধ্যমে নয়টি ভারতীয় ভাষায় ড্রোন ও বুম স্প্রেয়ার প্রযুক্তির নাগাল তথা আট রকম মূল মূল বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান পাবে কৃষকেরা। প্রধানমন্ত্রী আমাজন কোম্পানির হাতে তুলে দিয়েছেন ভারতের ৫ কোটি কৃষকের সরকারি ডেটা। নীতি আয়োগের সাথে আইবিএম কোম্পানির চুক্তি হয়েছে চার বছর আগেই। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে আণবিক জৈব কারিগরির ব্যবসায়িক প্রয়োগের পর থেকে বীজ ও কীটনাশক উৎপাদন ক্ষেত্র দুটি পরস্পর যুক্ত হতে থাকে। এখন বিগ-ডেটা স্ট্র্যাটেজি তাদের আরও বৃহত্তর মিলনক্ষেত্র যোগাচ্ছে। অ্যাপল, আমাজন, গুগল, আলিবাবা সহ সমস্ত বিগডেটা কর্পোরেটগুলি খাদ্যশিল্পের বিগ প্লেয়ার হয়ে উঠছে—“ডেটা এখন নতুন মাটি”।

বিশ্বের বীজ ও কৃষি রাসায়নিকের বাজার যে ৪টি কর্পোরেটের একচেটিয়া দখলে, সিনজেন্টা তাদের মধ্যে এক নম্বরে। সুইজারল্যাণ্ডের কৃষি-রাসায়নিক কোম্পানি সিনজেন্টাকে ২০১৭ সালে কিনে নিয়ে চীনা সরকার তাদের নিজস্ব দুটি সংস্থা ‘সাইনোকেম’ ও ‘কেমচাইনা’-কে সিনজেন্টায় মিলিয়ে দেওয়ার পর পৃথিবীর কৃষিশিল্পে বৃহত্তম অংশের নিয়ন্ত্রক সিনজেন্টা। শুধু বীজ ও রাসায়নিক উৎপাদনে নয়, কৃষি উপাদানের সমস্ত ক্ষেত্রসহ — বড় ডেটা, বড় প্রযুক্তি আর বড় লগ্নি — এই সমস্ত মূল মূল ক্ষেত্র জুড়েই ছড়ানো তাদের পুঁজির জাল। অন্তরজাল বিস্তারের জন্য আগামী কয়েক বছরের মধ্যে চীন মাহাকাশে নিম্নকক্ষপথে স্থাপন করবে ১০ হাজার ভূ-স্থির স্যাটেলাইটমালা। চীনের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রের বাইরে সিনজেন্টার ব্যবসায়ের ঘোষিত ফোকাসবিন্দু হল ভারত, ব্রাজিল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০৫০ সালের দিকে তাকিয়ে তাদের দিশা ঘোষণা করেছে তারা : জনসংখ্যা ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে খাদ্যের চাহিদা বাড়বে, খামারগুলি আরও কেন্দ্রীভূত হবে, কৃষিকাজ একক চাষির কাজের বদলে যৌথ বিজনেস ফার্মের চেহারা নেবে, রোবট ও ড্রোন মানবশ্রমকে প্রতিস্থাপিত করবে, জিন সম্পাদিত শস্য ব্যাপক প্রচলিত হবে, স্যাটেলাইট নজর রাখবে প্রতিটি ফসলের শরীর স্বাস্থ্য, নির্দেশ দেবে ও ব্যবস্থাপনা করবে চাষের প্রতিটি পদক্ষেপে।

Smart revolution in agriculture_0

সিনজেন্টা ও আদানি কোম্পানি হাত মিলিয়েছে হিমাচলের আপেল চাষিদের উপকার করতে। সিনজেন্টা ‘আদর্শ আপেল বাগিচা’ গড়ে তুলছে, আর আদানি এগ্রিফ্রেশ সরাসরি বাগিচা থেকে আহরণ করে বাজারজাত করছে। হিমাচল প্রদেশের ৭ শত গ্রামের ১৭ হাজার আপেল উৎপাদককে নিজেদের আওতায় এনেছে আদানি। আপেল চাষের ‘সিনজেন্টা প্রোটকল’ ও আদানির সিমলায় স্থিত ‘আবহাওয়া নিয়ন্ত্রক গুদাম’-এর সমন্বয়ে ও তত্ত্বাবধানে চলবে আপেলের বাগিচা ও বাজার। বড় বড় শহরের দৈনন্দিন বাজার ও রেস্তোরাঁয় কাঁচা সব্জি সরবরাহের নেটওয়ার্ক ‘নিঞ্জাকার্ট’-এর লগ্নিকারীদের মধ্যে অন্যতম হল সিনজেন্টা ও ওয়ালমার্ট। ভারতে টম্যাটো, ক্যাপসিকাম, মরিচ, তরমুজ, ভুট্টা সহ বহু ফসলের বীজের বাজার সিনজেন্টার। সিনজেন্টার ৪০ ধরনের কীটনাশক ভারতে অনুমোদিত। ধান, তুলো ও সয়াবিন — আপাতত এই তিনটি চাষে ড্রোনের মাধ্যমে কীটনাশক ছড়ানোর ছাড়পত্র পেয়েছে তারা। ‘জয় কিসান’ ফিনটেক (লগ্নি-প্রযুক্তি) সংস্থার সাথে গাঁটছড়া বেঁধে কৃষিঋণের বাজারেও বিস্তার করছে তাদের পসার। দেশের ৭৫টি সেরা কৃষি-বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাকেন্দ্রের ভেতরে কাজ করছে সিনজেন্টা।

অবশ্য নিছক ব্যবসা নয়, সামাজিক দায় সম্পর্কেও বলেছে সিনজেন্টা। ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’-র দায় মেটাতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সিনজেন্টার ঘোষিত সামাজিক কর্মসূচি হল : ৭৫টি বুনিয়াদি পরিকাঠামোযুক্ত সব্জি-বাজার, ৫০০ গ্রামে সৌর বিদ্যুৎ, ৩০টি গ্রামের সামাজিক পরিবর্তন, ১০ হাজার যুবাকে গ্রামীণ শিল্পদ্যোগী হিসেবে ট্রেনিং; ১০ হাজার কৃষককে সেচ ও চাষ প্রকল্পে সুবিধা প্রদান, ১০০ গ্রামে নিরাপদ পানীয় জল, ১০ হাজার কৃষককে মাটির উর্বরতায় সহযোগ; ৫ লক্ষ কৃষককে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা প্রদান, ডাক্তারদের জন্য ২৫০০ সচেতনতা বৃদ্ধি শিবির, অভাবী কৃষককে সহযোগিতা; সিনজেন্টা কমিউনিটি এনগেজমেন্ট উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষা, শুচি ও পরিচ্ছন্নতা, গ্রামীণ পরিকাঠামো ইত্যাদি শিক্ষা প্রদান।

কোন জমিতে কোন বছর কোন বীজ কোথা থেকে কিনে কোন মেসিন দিয়ে কীভাবে বপন করবেন, আবহাওয়া কেমন, মাটিটা কেমন, কতটা আর্দ্র, কতটা শুষ্ক, চারার শরীর-স্বাস্থ্য কেমন আছে, কোন বিষ কোন সার কোন পুষ্টি কতটা দিতে হবে — এইসব চিন্তা আর কৃষককে করতে হবে না। কৃষকের হাতের স্মার্টফোনে অ্যাপে আসা নির্দেশ মেনে চললেই হবে। লেবার খুঁজতেও হবে না, রোবোট ও ড্রোন করে দেবে কাজগুলি। রোবোট হোক বা ড্রোন, কৃষির সব যন্ত্রপাতিই হবে স্মার্ট। আকাশে হাজার হাজার স্যাটেলাইটের সাথে ইন্টারনেটে যুক্ত থাকবে স্মার্টমেসিনগুলি। তারা চাষের প্রতি মুহূর্তের সমস্ত ডেটা সংগ্রহ করে পাঠাবে আর আকাশ থেকে আসা নির্দেশ অনুযায়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করবে। ফসল ফলানোর পর কোন বাজারে কোন চেইনের মধ্যে দিয়ে কত দরে বিক্রি করবেন তাও স্মার্টভাবে ঠিক হবে। প্রতিটি পণ্যের প্রতিটি ক্রয়-বিক্রয়ের হদিস ধরা থাকবে ব্লকচেইন কারিগরিতে, উপভোক্তা চাইলে জেনে যাবেন বস্তুটি কোন খামারে কোন কৃষকের জমিতে ফলানো। উৎপাদন শুরু হওয়ার অনেক আগে বীজের জীন সম্পাদনা থেকে শুরু করে উৎপাদনের পরে শেষ উপভোক্তার কাছে পৌঁছনো পর্যন্ত সমগ্র প্রক্রিয়াটি হবে ডিজিটাল ও স্মার্ট। সুতরাং ভারতীয় কৃষিতে অবশেষে আচ্ছে দিন আসছে।

- মলয় তেওয়ারী

wages are falling

আইএলও প্রকাশ করল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক নথি — গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট, ২০২২-২৩, দ্য ইম্প্যাক্ট অফ ইনফ্লেশন অ্যান্ড কোভিড-১৯ অন ওয়েজেস অ্যান্ড পার্চেজিং পাওয়ার। বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায়, বিশ্ব মজুরি রিপোর্ট, ২০২২-২৩, মজুরি ও ক্রয় ক্ষমতার উপর মূল্যস্ফীতি ও কোভিড-১৯’এর প্রভাব।

অত্যন্ত উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে এই রিপোর্ট জানিয়েছে যে এই শতাব্দীতে এই প্রথম প্রকৃত উৎপাদশীলতা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেলেও মজুরির প্রকৃত বৃদ্ধি একেবারে তলানিতে নামতে নামতে ঋণাত্মক হয়েছে! এই শতাব্দীতে এই প্রথম প্রকৃত মাসিক মজুরি নেমে গেছে ঋণাত্মকে, -০.৯ শতাংশে। শ্রমের উৎপাদনশীলতা ও মজুরির প্রকৃত বৃদ্ধি বেড়েই যাচ্ছিল, কিন্তু, রিপোর্ট দেখাল ১৯৯৯’র পর ২০২২ থেকে শ্রমের প্রকৃত উৎপাদনশীলতা (রিয়াল প্রডাক্টিভিটি) ও মজুরির প্রকৃত বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি চওড়া হয়েছে বিশেষ করে উচ্চ আয়সম্পন্ন দেশগুলোতে। সমস্ত স্তরের কর্মীই এই ক্রমাগত মজুরি হ্রাসের শিকার হলেও যে পরিবারগুলো নিম্ন আয় সম্পন্ন, সেই সমস্ত পরিবারগুলোর উপর এর অভিঘাত সবচেয়ে বেশি তীব্র হয়েছে।

রিপোর্ট দেখিয়েছে, কোভিড-১৯’এর গভীর সংকটকালীন সময়ে শ্রমিক ও তাদের পরিবারগুলো মারাত্মকভাবে মজুরি খুইয়েছে, আর কাজ হারানোর ফলেই ওই পরিবারগুলো সংকটের আবর্তে পড়ে যায়। কম মজুরির পেশায় যুক্ত শ্রমিক, ইনফর্মাল শ্রমিক ও শ্রমজীবী মহিলারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। অতিমারির নির্দয়তম সময়ে নিচু তলার ওই সমস্ত শ্রমজীবীদের মজুরি একেবারেই তছনছ হয়ে যায়, অবর্ণনীয় আর্থিক সামাজিক সমস্যার মুখে তারা পড়েন। ওই গভীর দুঃসময়ে খেয়ে পড়ে বাঁচতে ঋণ নিতে বাধ্য হন উচ্চহারে সুদের বিনিময়ে। কোভিড পরবর্তীতে আগের তুলনায় কম মজুরির কাজ পেলেও উচ্চসুদ ও হ্রাসপ্রাপ্ত মজুরির এই দ্বিমুখী চাপে আজ তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। আর এরফলে একটা দেশের অভ্যন্তরে ও অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে বৈষম্য।

এই আর্থিক সামাজিক বিপর্যয়কারী প্রভাব থেকে সাধারণ মানুষকে পরিত্রাণ করার কার্যকরী পলিসির অভাবে শ্রমিক শ্রেণির প্রকৃত আয় ধারাবাহিকভাবে নিচের দিকে গড়াতে শুরু করে, যার প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। আয়ের মারাত্মক সংকোচন ভোগ ব্যয়ে রীতিমতো প্রভাব ফেলে, বাজারে চাহিদায় টান পড়ে বাড়তে থাকে মুল্যস্ফীতি, বিশ্বজুড়ে নানান দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো রক্ষণশীল মুদ্রানীতি অবলম্বন করায় তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ফলে, রিপোর্ট জানাচ্ছে, অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো, কর্মসংস্থানের অবস্থা উন্নত হওয়ার বিপরীতে তা আরও ঘোরালো হয়ে উঠছে দুনিয়া জুড়ে, সামাজিক অস্থিরতা তীব্রতা পাচ্ছে।

বৈশ্বিক আর্থিক — শ্রমবাজার ও তার প্রেক্ষিত

কোভিড-১৯ — ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ ইউক্রেন যুদ্ধ — ২০২১ থেকে জীবন ধারণ ক্রমাগত ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে ওঠার এই একগুচ্ছ কারণগুলোর সম্মিলিত ফলাফলে ২০২২ থেকেই জীবনযাপনের খরচ ব্যাপকবৃদ্ধি পেয়েছে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল জুড়ে। এরকমই এক অনিশ্চয়তার পরিমন্ডলে আইএমএফ ২০২২’র জন্য বৈশ্বিক আর্থিক বৃদ্ধিকে ৩.৬ থেকে ৩.২ শতাংশে নামিয়ে আনল আর অক্টোবরে তারা যে চিত্রটা তুলে ধরেছে তা আরও কম। সেখানে তারা জানিয়েছে, ২০২৩এ বৃদ্ধির হার হবে আরও মন্থর, আর দাঁড়াবে ২ থেকে ২.৭ শতাংশের মধ্যে। অনেকেই মনে করছেন, ২০২৩ সারা দুনিয়া মন্দার কবলে পড়বে। ২০২২’র দ্বিতীয়ভাগে উন্নত দেশগুলোতে কর্মসংস্থানের চেহারা আগের তুলনায় ভালো হলেও মধ্য বা নিচু রোজগেরে দেশগুলোতে কর্মসংস্থান ২ শতাংশের নিচে নেমে গেছে — যা প্রাক অতিমারীর তুলনায় বেশ কম। দেখা যাচ্ছে, ইনফর্মাল অর্থনীতি ফর্মাল অর্থনীতির তুলনায় অনেক দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুমান ২০২২’র শেষে সারা দুনিয়ায় মুল্যস্ফীতি ৮.৮ শতাংশে ঠেকবে। ২০২৩-এ তা নামবে ৬.৫ শতাংশে আর ২০২৪-এ ৪.১ শতাংশ হারে। আইএলও তার রিপোর্টে জানিয়েছে, মূল্যস্ফীতির সাপেক্ষে শ্রমিকদের আয়ে সামঞ্জস্য না আসলে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানে যে অধোগতি নেমে এসেছে তা রোধ করা যাবে না।

মজুরির আন্তর্জাতিক প্রবণতা

আইএলও’র রিপোর্ট মারাত্মক এক উদ্বেগজনক প্রবণতাকে চিহ্নিত করেছে। ২০২২’র প্রথম অর্ধে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়েই মাসিক মজুরি প্রকৃত অর্থে হ্রাস প্রাপ্ত হয়ে -০.৯ শতাংশে নেমেছে, এই শতাব্দীতে যা আগে কখনো লক্ষ্য করা যায়নি। রিপোর্ট দেখিয়েছে, অন্যান্য দেশের তুলনায় চিনে মজুরি বৃদ্ধির হার বেশ খানিকটা বেশি। তাই, চিনের মজুরি বৃদ্ধি যদি উল্লিখিত মজুরি বৃদ্ধির মধ্যে না ধরা হয় তবে মোট বৃদ্ধি আরো নেমে ওই পর্যায়ে এসে দাঁড়াবে -১.৪ শতাংশ। জি-২০ দেশগুলোর মধ্যে, যেখানে রয়েছে বিশ্বের ৬০ শতাংশ মজুরি প্রাপক শ্রমিক, সেই সমস্ত অগ্রণী দেশগুলোতে ২০২২’র প্রথম অর্ধে মজুরি হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে (-২.২ শতাংশ) হারে। আর, আত্মপ্রকাশমান দেশগুলোতে খুবই মন্থর হারে ০.৮ শতাংশ হিসাবে তা বজায় ছিল। বোঝাই যাচ্ছে, বহু দেশ মজুরি বৃদ্ধির কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি।

কোভিডের সময়ে অগুন্তি শ্রমজীবী পরিবারের মজুরির হ্রাস ঘটে লক্ষণীয়ভাবে। বিশ্বজুড়ে গড় মজুরি বৃদ্ধি ২০২০ ও ২০২১ সালে হয় যথাক্রমে ১.৫ এবং ১.৮ শতাংশ হারে। কিন্তু ঘোর অতিমারীর সময়ে এই বৃদ্ধির জন্য মূল্য চোকাতে হয়েছে বিরাট মাত্রায় কাজ খুইয়ে, কর্মসংস্থানের ধরন বা গঠন বিন্যাসে বদল ঘটিয়ে। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই উচ্চ আয় সম্পন্ন দেশগুলোতে অতিমারীর সময়ে বিশাল পরিমানে খেটে খাওয়া মানুষ যারা কাজ খুইয়েছেন, তারা হলেন স্বল্প আয় সম্পন্ন শ্রমজীবী মানুষ, আর বিপরীতে খুবই উচ্চ আয় সম্পন্ন কর্মীদের কাজ বজায় ছিল। এরফলে বেড়েছে বৈষম্য, গড় মজুরির হার হয়েছে আরও চওড়া।

জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোতে মজুরি বৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি

আইএলও’র রিপোর্ট দেখিয়েছে, জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে (যাতে ভারত ও রয়েছে) ২০০৮ থেকে ২০২২’র এই তুলনামূলক লম্বা পর্যায়ে একমাত্র চিনেই প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ২০০৮-এ মজুরির প্রকৃত মূল্যের তুলনায় চিনে প্রকৃত মাসিক মজুরি ২.৬ শতাংশ হারে বেড়েছে। বিপরীতে, চারটি দেশে — ইতালি, জাপান, মেক্সিকো এবং গ্রেট ব্রিটেনের ইউকে ও নর্থান আয়ারল্যাণ্ডে ২০০৮’র তুলনায় ২০২২’র প্রকৃত মজুরি বেশ কম হয়ে যায়। জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোর প্রকৃত মজুরি ২০২২’র প্রথম অর্ধে হ্রাস প্রাপ্ত হয়েছে -২.২ শতাংশ হারে, কিন্তু জি-২০’র আত্মপ্রকাশমান দেশগুলোতে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে ০.৮ শতাংশ হারে, যা ২০১৯’র সাপেক্ষে (অর্থাৎ কোভিডের আগের বছরে) ২.৬ শতাংশ কম। জি-২০ ভুক্ত দেশ ভারতে মজুরির প্রকৃত বৃদ্ধি নিচে গড়িয়ে পড়েছে। ২০০৬ সালে ৯.৩ শতাংশ থেকে নামতে নামতে ২০২১-এ ঋণাত্মকে, -০.২ শতাংশে এসে ঠেকেছে। অতিমারীর পর থেকে ঋণাত্মক বৃদ্ধি শুরু হয়েছে।

শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে, কমেছে প্রকৃত মজুরি

নয়া উদার অর্থনীতির অন্যতম ‘অবদান’ হল শ্রমের উৎপাদনশীলতা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও বিপরীত মেরুতে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে প্রকৃত মজুরি। ১৯৮০’র আগে থেকেই দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত মজুরির গড় বৃদ্ধির তুলনায় শ্রম উৎপাদনশীলতার গড় বৃদ্ধি অনেক বেশি! অনেকগুলো উন্নত দেশে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আইএলও’র রিপোর্ট দেখিয়েছে, ২০০০’র পর থেকে উচ্চ-আয় সম্পন্ন উন্নত অর্থনৈতিক ৫২টা দেশে (যতটুকে তথ্য পাওয়া যায়) উৎপাদনশীলতা ক্রমাগত বেড়ে চললেও সেই তালে বাড়েনি মজুরি। একবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে, ২০২২’র পর উৎপাদনশীলতা ও মজুরির বৃদ্ধির হার রীতিমতো চওড়া হতে শুরু করে — মজুরি বৃদ্ধির সাপেক্ষে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে ১২.৬ শতাংশ।

Real wages are falling

নারী-পুরুষের মধ্যে আয়-বৈষম্য

অতিমারী শুরু হওয়ার আগে নারী-পুরুষের মধ্যে যে আয়-বৈষম্য বজায় ছিল, তার কোনো হেরফের এখনও হয়নি। প্রকৃত মজুরি ক্ষয়ের ক্ষেত্রে অতিমারী দায়ী থাকলেও আয়ের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য আগেও যেমন ছিল, তেমনটাই রয়েছে। রিপোর্ট দেখিয়েছে, ৮০টি দেশে এই আয়-বৈষম্য রয়েছে ২০ শতাংশ।

ভারত কোথায় দাঁড়িয়ে?

সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে, লিঙ্গ আয়ের বৈষম্যের ক্ষেত্রে ভারত আরো নিচে তলিয়ে ১৪৬টা দেশের মধ্যে স্থান করেছে ১৩৫ নম্বরে! এর অর্থ হল তালিবান শাসিত আফগানিস্থান থেকে ভারত মাত্র ১১ ধাপ উপরে, যে আফগানিস্থানে মেয়েদের স্কুলে প্রবেশই নিষিদ্ধ। অন্যন্য প্রতিবেশী দেশ — নেপাল, বাংলাদেশ, মায়ানমার, ভূটান, চিন ও শ্রীলঙ্কার অবস্থা ভারত থেকে বেশ খানিকটা উপরে রয়েছে। মাত্র ৬ বছর আগে, ২০১৬-তে, এপ্রশ্নে ভারতের স্থান ছিল ৮৭ নম্বরে।

ক্রমাগত মজুরি হ্রাসের এই বিপজ্জনক প্রবণতাকে ঠেকাতে আইএলও প্রস্তাব — স্বাক্ষরকারী দেশগুলো ন্যূনতম মজুরির কাঠামোকে সংশোধন করুক, নিয়মিত ব্যবধানে মজুরি বৃদ্ধির বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিক। নারী পুরুষের মধ্যে এই যে মজুরির ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলেছে তার জন্য ইতিবাচক কর্মনীতি গ্রহণ করুক, আলাপ আলোচনার কাঠামোগুলোকে আরও প্রসারিত ও মজবুত করুক, শক্তিশালী করুক শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর দরকষাকষির ক্ষমতাকে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব যথাযথ করার উপর ও জোর দেওয়া হয়েছে।

পরিহাস এটাই, আইএলও’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দেশ ভারত এই সমস্ত পরামর্শ বা সুপারিশকে আজ বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষিপ্ত করেছে। ট্রেড ইউনিয়নকে ঠেলে দিয়েছে প্রান্তিকে, ন্যূনতম মজুরির বদলে আনছে ফ্লোর স্তরের মজুরি। মোদীর আমল আজ ভারতকে নিয়ে যাচ্ছে চরম অধঃপাত ও সর্বনাশের কিনারে।

- অতনু চক্রবর্তী

Amalasol Still suffering

আমলাসোল নিশ্চয় আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। বামফ্রন্ট জমানায় ২০০৪ সালে সবর সম্প্রদায়ের পাঁচজনের অনাহারে মৃত্যুর পর সে খবর নাগরিক বিবেককে উদ্বেলিত করেছিল — সরকারি আমলা, বেশকিছু এনজিও ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সেখানে গিয়েছিলেন পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে। বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন বলেছিলেন আমলাসোল কোনো ব্যতিক্রম নয়, এরকম আমলাসোল আরও রয়েছে। কিন্তু আঠের বছর পর আজ ২০২২ সালে আমলাসোল কোথায় দাঁড়িয়ে? যে সবর সম্প্রদায়ের মানুষরা অনাহারে মারা গিয়েছিলেন, তারা কি অনাহার থেকে মুক্তি পেয়েছেন? বড় মুখ করে মমতা ব্যানার্জির ঘোষণা করা বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প সেখানে কি সচল হয়? তারা কি আদৌ কাজ পায়? সম্প্রতি নিউজক্লিক ওয়েব পত্রিকার পক্ষে সাংবাদিক মধুসূদন চ্যাটার্জি আমলাসোল গিয়ে সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি সরজমিনে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই অনুসন্ধানের ভিত্তিতে তিনি একটা রিপোর্ট তৈরি করেছেন যার শিরোনাম ‘আমলাসোল — এ সাগা অব এক্সট্রিম পভার্টি এলংসাইড সিনিক রিসর্টস ইন বেঙ্গলস ঝাড়গ্ৰাম’। সেই রিপোর্ট থেকে চয়ন করে আমলাসোলের বর্তমান পরিস্থিতির মূল বিষয়গুলোকে আমরা এখানে রাখছি।

আমলাসোল আজও চরম দারিদ্র লাঞ্ছিত এক অঞ্চল। আজও সেখানে অনাহারে মানুষ মারা যায়, সরকারি প্রকল্পে কাজ পাওয়াটা একরকম অনুপস্থিত, জীবিকা খুঁজে পাওয়াটা আক্ষরিক অর্থেই দুর্লভ। আজও সবর সম্প্রদায়ের জীবন নির্বাহের একমাত্র উপায় হলো পিঁপড়ের ডিম বিক্রি। জঙ্গলে গিয়ে তাঁরা পিঁপড়ের ডিম সংগ্ৰহ করেন আর সেটুকু দিয়ে যেটুকু অর্থ পান তাই দিয়ে দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর চেষ্টা হয়। এতেও বাজারের পাইকারি ব্যবসাদারদের হাতে তাঁদের বঞ্চনা অমোঘ বাস্তব। স্থানীয় সবর সম্প্রদায়ের মানুষ নিমাই সবরের স্ত্রী সোনামনি সবরের কথায়, “পাইকারি ব্যবসাদার আমাদের কাছ থেকে কেনে ৭০ টাকা কেজি দরে (বাজারে যেটা বিক্রি হয় ৩০০ টাকা কেজি দরে)। রেশনের মাধ্যমে যে চাল দেওয়া হয় তাতে সারা মাস চলে না। আমরা (স্বামী ও স্ত্রী) দুটো ছেলে নিয়ে থাকি। মাত্র ১২ কেজি চালে আমাদের পেট ভরে না। সব্জি আর মশলাপাতি কেনার কথা আমরা ভাবব কী করে?”

এখানে ১০০ দিনের প্রকল্পে কোনো কাজ হয় না, পঞ্চায়েতের উদ্যোগও অনুপস্থিত, আর তাই কাজের দেখা মেলে না। কাজের এই অলভ্যতার কারণে যুবকদের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভও রয়েছে। এই অঞ্চলে এক সময় মাওবাদীদের প্রাধান্য ছিল। সরকারের পক্ষে বলা হয়েছিল যারা মাওবাদী নয় তাদের কাজ দেওয়া হবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি কাগজে-কলমে রয়ে গেছে, আমলাসোলের বাস্তবে তার কোনো নিদর্শন মেলে না। দেহে অপুষ্টির প্রকট চিহ্ন বহন করা বুদ্ধেশর সবর ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছে, “আমি কেন কাজ পেলাম না? যারা মাওবাদী ও বন পুলিশ নামে পরিচিত তারা মমতা সরকারের অধীনে এই সুযোগটা পেয়েছে। আমি রোজগার করতে পারি না, আর সেই কারণেই আমার পেটে খাবার নেই।” বুদ্ধেশ্বরের দাবি অনুযায়ী সে মাওবাদী না হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ মাওবাদী সন্দেহে ২০০৮ সালে তাকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর পুলিশি হেফাজতে চরম নিপীড়ন ভোগ করা ও ছ’মাস জেলে কাটানো। এই বুদ্ধেশ্বরের বাবা সামাই ও দিদি মঙ্গলি অনাহারে মারা গেছে বলেই স্থানীয় মানুষরা জানিয়েছেন।

ঘোষিত সরকারি প্রকল্পের কোনো সুবিধার সঙ্গে আমলাসোলের মানুষরা সম্পূর্ণ অপরিচিত। জয় জহর প্রকল্প অনুসারে ৬০ বছর বয়স পেরোনোর পর জনসাতি সম্প্রদায়ের ভাতা পাওয়ার কথা। কিন্তু ১৪টা সবর পরিবারের মধ্যে ৭টা পরিবার ভাতা পাওয়ার যোগ্য হলেও কোনো ভাতা তাঁরা পান না। ২০০৪ সালে অনাহারে মারা যাওয়া নাথু সবরের বৃদ্ধা স্ত্রী ফুলমণি সবর ভাতা না পাওয়ার এবং ২০০৪ সালে অনাহারে মৃত্যুগুলির পর দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ার কথা জানিয়ে বলেছেন, “ওরা বলেছিল আমাদের জীবিকা পাওয়ায় ওরা সাহায্য করবে। এ সত্ত্বেও আমি কোনো ভাতা পাইনি। এ কথা কাকে বলব? আমাদের জন্য কারো কী কোনো মাথাব্যথা আছে।”

starvation and government neglect

সরকারের তরফে দরিদ্রদের জন্য বসত বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়ার প্রকল্প আগে ছিল, এখনও রয়েছে। এখন প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় দরিদ্রদের বাড়ি দেওয়া হয়, আর নরেন্দ্র মোদী দাবি করেন যে এই বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার ফলে গরিবরা ‘লাখোপতি’ হয়ে গেছে। কিন্তু আমলাশোলে দরিদ্রদের জন্য বাড়ি তৈরির কোনো চিহ্ন নেই। আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগে ইন্দিরা আবাস যোজনায় সেখানে কিছু বাড়ি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। বনমালি সবর জানিয়েছেন, “আমরা পঞ্চায়েতকে জানিয়েছিলাম, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি”।

শিক্ষার ব্যবস্থাও অত্যন্ত করুণ। আমলাসোল থেকে ৫ কিমি দূরে কোকরাঝাড়ে একটা মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে। যথেষ্ট শিক্ষক না থাকায় শিক্ষা সেখানে ধুঁকছে। আর আমলাসোল থেকে ২৬ কিমি দূরে বেলপাহাড়িতে রয়েছে একটা হাইস্কুল। এত পথ পেরিয়ে সবর সন্তানরা কি সেখানে পৌঁছতে পারবে?

আমলাসোলে কোনো বিদ্যুৎ নেই, সবর ঘরে রাতে তাই একটা বাতি টিমটিম করে জ্বলে। স্থানীয় মানুষরা জানিয়েছেন, ১৪ বছর আগে কয়েকটা ইলেক্ট্রিক পোল পোঁতা হয়েছিল এবং তখন দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষদের বিদ্যুতের জন্য কোনো ফী দিতে হত না। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় ২০১১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু কেন তা করা হয়েছিল তার কারণ আজও তাঁদের কাছে অধরা রয়ে গেছে।

স্বাস্থ্য পরিস্থিতিও সেখানে তথৈবচ। হেলথ সেন্টার নামে স্বাস্থ্য পরিষেবার একটা কেন্দ্র রয়েছে বটে। আগে সেখানে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতি সপ্তাহে যেতেন। এখন কেউ সেখানে যান দু’তিন মাসে একবার। সরকারি হাসপাতাল রয়েছে আমলাসোল থেকে ৫ কিমি দূরে কোকরাঝাড়ে। আর প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে ৩০ কিমি দূরে বেলপাহাড়িতে। স্বাস্থ্য পরিষেবার কোনো উন্নতি এখানে হয়নি ১৮ বছরে। মমতা জমানায় স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বেসরকারি ক্ষেত্রের রমরমা ঘটেছে, মালটি স্পেশালিটি হাসপাতাল হয়েছে অনেক। কিন্তু দরিদ্রদের কাছে, দারিদ্র সীমার নীচে বাস করা মানুষদের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা শুধু দুর্লভই নয়, সুদূরের বস্তুও।

তবে শুধু আমলাসোল নয়, আরও অনেক গ্ৰামের মানুষের দুর্দশায় কোনো ঘাটতি নেই। যেমন ঢেঙ্গাকুসুম ও কদলবোনি। পিঁপড়ের ডিম বিক্রি এখানের মানুষেরও প্রধান জীবিকা। পাহাড়ের টিলায় বাস করা এখানকার মানুষের জলকষ্টও মাত্রাতিরেক। জল যোগাড়ে তাঁদের যেতে হয় ৩ কিমি দূরে।

পাহাড় ঘেরা আমলাসোলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখন পুঁজিকে আকৃষ্ট করেছে, আমলাসোল পরিণত হয়েছে পর্যটন কেন্দ্রে, সেখানে তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে বহু রিসর্ট। তবে পুঁজির আগমন মানে শুধু কাজ নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে অর্থের দৌরাত্ম্য, কাজ টেকার অনিশ্চয়তা এবং কিছু বিধিবহির্ভূত কাজ। যে সমস্ত রিসর্ট গড়ে উঠেছে ও উঠছে সবক্ষেত্রে সেগুলোর জমি কি নিয়মের পথে প্রাপ্ত হয়েছে? এখন যেমন যে জমিতে একটা রিসর্ট তৈরি হতে যাচ্ছে সেটা বামফ্রন্ট আমলে দেওয়া হয়েছিল গুরুপদ সবরকে, তার পাট্টাও রয়েছে। গুরুপদর ছেলে লক্ষ্মীকান্তর ক্ষোভ, “কার কাছে আমরা অভিযোগ জানাতে যাব? আমরা কি জমিটা ফিরে পাব?” এছাড়াও প্রশ্ন, ঐ রিসর্টগুলোতে কি সবররা কাজ পায়? রিসর্টগুলোর ব্যাপক সংখ্যাধিক কর্মীকেই আনা হয়েছে বাইরে থেকে।

দেশের সব শাসকই গরিবের নামে শপথ করে, কিন্তু স্বার্থরক্ষা করে পুঁজির ও পুঁজিপতিদের। এর প্রশ্নহীন উদাহরণ আজকের মোদী সরকার। মমতা ব্যানার্জিও ‘শ্রী’ যুক্ত প্রকল্পগুলোর বড়াই করে দরিদ্রদের উদ্ধার করার আস্ফালন করেন ও ভোট চান। আর দরিদ্ররা রয়ে যায় অবহেলা ও উপেক্ষার অন্ধকারে। আমলাসোলও এর ব্যতিক্রম নয়।

contributors to the funds of the ruling party

মেসেজ এল, আপনার গতমাসের বিদ্যুতের বিল অনাদায়ী থাকার কারণে আজ সন্ধের মধ্যে তা না দিলে বিদ্যুত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এরথেকে পার পেতে চাইলে ৬২৯০৩২৬০৭৭ নাম্বারে ফোন করুন। ফোন করলাম, ফোন ব্যস্ত। একটু বাদে ফোন এল ৬২৯১৫৮৭২৩ নাম্বার থেকে। বলল ইলেকট্রিসিটি অফিস থেকে বলছি, আপনি তো একটু আগে ফোন করেছিলেন। বললাম, এই নাম্বারে করিনি তো। জানাল, ওই একই অফিস। আপনার বিদ্যুতের বিল দেননি বলে মেসেজ গিয়েছিল তো। জানতে চাইল, কীভাবে বিদ্যুত বিল দেই। বললাম, অনলাইনে। বলা হল, আপনি আপনার কজিউমার নাম্বার বলুন। জানালাম, সেটা তো এরকম মনে থাকে না। প্রায় হুকুমের সুরে বলল, আপনি অনলাইনে বিল দেন আর কাস্টমার আইডি মনে থাকে না? আমি বললাম, আপনার কনজিউমার নাম্বার বা কাস্টমার আইডি মনে আছে? বলল, ইলেকট্রিক বিলে লেখা আছে দেখে বলুন। আমি প্রশ্ন করলাম, আমাকে মেসেজ করেছেন আমি বিল দেইনি বলে, আর আপনি কনজিউমার নাম্বার বা কাস্টমার আইডি জানেন না? ব্যাস, গালাগালি দিয়ে ফোন রেখে দিল। যদি কাস্টমার আইডি জানাতাম, তাহলে কথা চলত, অনাদায়ী বিদ্যুত বিলের একটা পরিমাণ বলা হত। তাড়াতাড়ি কিছু টাকা দিয়ে বিদ্যুত যোগাযোগের বিচ্ছিন্নকরণ আপাতত রুখে দেওয়ার জন্য একটি লিংকে ক্লিক করতে বলা হত। ক্লিক করলে ফোনের নিয়ন্ত্রণ চলে যেত মেসেজ পাঠানো মানুষগুলির কাছে। সেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করে ব্যাঙ্ক একাউন্ট বা ক্রেডিট কার্ড একাউন্ট থেকে টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হত। এরকম খবর প্রতিনিয়তই দেখছেন খবরের কাগজে। কেবল এভাবেই নয়, বিভিন্নভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রতারণা করা হচ্ছে।

দেশজুড়ে স্বল্পবিত্ত মানুষজনকেও ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেনে উৎসাহিত করা চলছে। পাঠকেরা অনেকেই জিপে, ফোনপে, পেটিএম, হোয়াটসএ্যাপপে ব্যবহার করেন — এগুলি ইউপিআই ভিত্তিক লেনদেন। দেশের বহু ছোটবড় দোকানে ইউপিআই পেমেন্টের জন্য কোড লাগানো থাকে যা স্ক্যান করে টাকা দেওয়া যায়, বহু লোকে দেন। সেই বন্দোবস্তে যে প্রতারণা হয় তা রিজার্ভ ব্যাঙ্কও স্বীকার করছে। বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে যাতে সাধারণ মানুষ প্রতারণা স্বীকার না হন। কিন্তু প্রতারিত মানুষজন তাদের অর্থফেরত পাচ্ছেন খুব কম ক্ষেত্রেই। গত দু’টি ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন ও জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০২২) কেবল ইউপিআই মাধ্যমে লেনদেনে একলক্ষ চল্লিশ হাজার প্রতারণা হয়েছে। মে, ২০২২-এ ইউপিআই মাধ্যমের লেনদেনে ২০০ কোটি টাকার প্রতারণা হয়েছে। সরকারি সাইবার অপরাধ দফতরের তথ্য অনুসারে কেবল ওই মাসেই ৬১,১০০টি ডিজিটাল লেনদেন সংক্রান্ত অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, যারমধ্যে অর্ধেক ইউপিআই লেনদেনের ক্ষেত্রে ঘটেছে। এগুলির শিকার যারা হয়েছেন, তাঁদের কজন টাকা ফেরত পেয়েছেন? যার টাকা যাচ্ছে তিনি একজন বিচ্ছিন্ন প্রতারিত মানুষ হিসেবে গণ্য হচ্ছেন। সরকার, ব্যাঙ্ক, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, পেমেন্ট এ্যাপের প্রতিষ্ঠান, পুলিশ কারুর কোনো আইনি দায় নেই প্রতারিত সাধারণ মানুষ বা আমানতকারীর অর্থ ফেরত দেওয়ার।

বেশ কিছুদিন ধরেই এদেশে ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেন চালু হয়েছে। বর্তমান মোদী সরকার সারা দেশকে ডিজিটাল বন্দোবস্তে জোড়ার জন্য উদগ্রীব। সেটা জুড়তে পারার কৃতিত্বের দাবিদার হয়ে উঠতে বহু ধরনের প্রচার চালানো হচ্ছে। যদিও দেশে স্মার্টফোনের চল হয়েছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের হাত ধরে এবং ন্যাশনাল পেমেন্ট কর্পোরেশন তৈরি হয়েছিল মনমোহন সিংহের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে এপ্রিল ২০০৯-এ। রঘুরাম রাজন গভার্নার থাকাকালীন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্যোগে ন্যাশনাল পেমেন্ট কর্পোরেশন ইউপিআই বা ইউনিফায়েড পেমেন্ট ইন্টারফেস নামক প্রযুক্তি তৈরি করার জন্য পরিকল্পনা করে, যা শেষ পর্যন্ত চালু হয় ২০১৬ সালে মোদী সরকারের আমলে। ইউপিআই ভারতে তৈরি প্রযুক্তি যার রূপ হল, ভিম-ইউপিআই, গুগলপে, ইয়োনোপে, ফোনপে জাতীয় বিভন্ন এ্যাপ, যার মাধ্যমে ওই এ্যাপের ব্যবহারকারী অনুরূপ এ্যাপের ব্যবহারকারীর কাছে টাকা পাঠাতে পারে।

২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে মোদী সরকার ১০০০ টাকা ও ৫০০ টাকার নোট মাত্র ৪ ঘণ্টার নোটিশে বাতিল করে কালো টাকা দূর করার মিথ্যা আশ্বাস দেয়। কালো টাকা যথা পূর্বং থাকলেও গরিব শ্রমজীবী মানুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অপূরণীয় ক্ষতি করতে সক্ষম হয় নোট বাতিলের কর্মসূচি। মনে হয়, নোট বাতিলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল ক্ষুদ্র অসংগঠিত ব্যবসায়গুলিকে দুর্বল ও ধ্বংস করা, যেকাজে নোট বাতিল বহুলাংশে সফল হয়েছে ও কর্পোরেট দুনিয়া বিশেষত কতিপয় সাঙ্গাত পুঁজিপতিকে অতীব শক্তিশালী করে তুলেছে। কর্পোরেটদের হাতে দেশের অর্থনীতিকে তুলে দেওয়ার অন্যতম কারসাজি হল জনসাধারণকে ডিজিটাল লেনদেনে আকৃষ্ট করে তোলা। সেই কাজও অনেকটা করতে সক্ষম হয়েছে মোদী সরকার। মনে রাখা দরকার, ৮ নভেম্বর ২০১৬ সালে নোট বাতিলের পরের দিন, ৯ তারিখে খবরের কাগজের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন ছিল পেটিএম’এর, মোদীজির ছবি সমেত। কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো ব্যবসায়ে বিজ্ঞাপন করেছেন বলে জানা নেই, অন্তত ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী এমনটা করেননি।

পেটিএমের বিজ্ঞাপন দিয়ে যার শুরু, ডিজিটাল লেনদেনের প্রসার ও প্রচার, তা ক্রমাগত বাড়িয়ে তোলার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে ধারাবাহিক প্রচার করে চলেছে মোদী সরকার। ভারতকে ডিজিটাল ইন্ডিয়া বানাতে হবে। একদিকে ভারতীয় সংস্কৃতির আবাহনের নামে, প্রাগৈতিহাসিক কুসংস্কারে দেশকে আচ্ছন্ন করা অপরদিকে আর্থিক লেনদেন করার জন্য ডিজিটাল ব্যবস্থায় উৎসাহ প্রদান। ফলে সাধারণ নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষজন অবলীলাক্রমে ডিজিটাল প্রতারণার ফাঁদে পড়ছে। মনে রাখা দরকার, ধর্মীয় কুসংস্কারে বিশ্বাসীরা হোয়াটসএ্যাপ, এসএমএসে আসা সংবাদকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে থাকে কারণ অন্ধ বিশ্বাসেই তাদের আনন্দ।

কম্পুটার, বা স্মার্টফোন, মোবাইল ফোনে ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট বা তথ্য কীভাবে থেকে যায়, যার অস্তিত্ব ফোন বা কম্পুটারের ব্যবহারকারী জানেন না, সে বিষয়ে কোন ধারণাই আমাদের নেই। একটি স্মার্টফোন আমার হাতে থাকেলেও তার নিয়ন্ত্রণ কীভাবে প্রতারক দখল করতেন পারে জানিই না আমরা। ব্যাঙ্ক বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক উপভোক্তাকে সাবধান করলেও যে তিনি সাবধান হতে শেখেন না সেবিষয়ে কি সরকার অবহিত নয়? ফলে যত ডিজিটাল লেনদেন বাড়ছে তত প্রতারণাও বাড়ছে।

দেখেশুনে মনে হয়, সরকার, পুলিশের অপদার্থতা ও নিষ্ক্রিয়তার জন্যই এই ধরণের অপরাধের বাড়বাড়ন্ত। এই অপরাধীদের সঙ্গে শাসকদের, পুলিশের বোঝাপড়া আছে কি? কে জানে। নাহলে তো, অনায়াসেই এই অপরাধীদের ধরা পড়ার কথা। প্রথমে শুরু হওয়া প্রতারণার প্রচেষ্টার কথা ধরা যাক। যে ফাোন থেকে এসএমএস এসেছিল তা ভারতীয় নাম্বার, যে ফোন থেকে ফোন এসেছিল সেটি ভারতীয় নাম্বার। তাহলে ওই নাম্বারের অধিকারীদের খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। সকলেই জানেন যে, এদেশে ফোন পেতে গেলে মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারীদের কাছে নিজের সম্পূর্ণ পরিচয় প্রদান করেই তা পেতে হয়। ফলে ওই পরিষেবা প্রদানকারীদের কাছ থেকে পুলিশ অনায়াসে ওই মোবাইল ফোন নাম্বারের অধিকারীদের ধরতে পারে। যদি এমনটা হয় যে ওই নাম্বারের অধিকারীদের পরিচয় পরিষেবা প্রদানকারী দিতে পারছে না, তাহলে সেই পরিষেবা প্রদানকারীকেই ওই প্রতারণার জন্য অবশ্যই দায়ী করা যেতে পারে। সেব্যাপারে সরকার কেন আইনি বন্দোবস্ত করছেনা। যেখানে ছ’মাসে দু’লাখ প্রতারণার ঘটনা ঘটছে, একমাসে চার-পাঁচশ কোটি টাকার প্রতারণা করা হচ্ছে, সেইসব অপরাধ ও অপরাধীকে ধরার ক্ষেত্রে সরকার ও পুলিশ এত নিরুত্তাপ কেন?

দ্বিতীয়ত, সাইবার অপরাধ বা ডিজিটাল লেনদেন জনিত অপরাধের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তির কাছে টাকা যাচ্ছে তা ব্যাঙ্কিং লেনদেনের গতিকে অনুসরণ করলেই জানা যায়। যে ব্যাঙ্ক খাতায় (একাউন্টে) টাকা যাচ্ছে তার পরিচিতিও ব্যাঙ্কের কাছে থাকা বাধ্যতামূলক। সারা বছর সাধারণ মানুষের কাছে নো ইয়োর কাস্টমার (কেওয়াইসি) তথ্য ও কাগজপত্তর চেয়ে চলেছে ব্যাঙ্কগুলি। তাহলে ওই সকল প্রতারক হিসেব খাতাগুলির মালিকদের খুঁজে বের করতে পুলিশ সক্ষম হয় না কেন? নাকি ওই সব অপরাধীদের সঙ্গে পুলিশ, শাসকের বোঝাপড়া আছে? ওই প্রতারকরা কি শাসকের নির্বাচন তহবিলের অন্যতম যোগানদার?

- অমিত দাশগুপ্ত

Comrade Anju Barkatk
Comrade Anju Barkatki Lal Salam

নারী আন্দোলনের নেত্রী, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি’র জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, আসাম রাজ্যের আইপোয়ার প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি, ‘জোনাকিবাট’ পত্রিকার প্রকাশক এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের আসাম রাজ্য কমিটির প্রাক্তন সদস্য ও আসাম নারী কমিশনের প্রাক্তন সদস্য কমরেড অঞ্জু বরকটকি দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে গত ১২ ডিসেম্বর প্রয়াত হয়েছেন। আমরা তাঁর পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি। নারী মুক্তি আন্দোলনে তাঁর ভুমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কমরেড অঞ্জু বরকটকি লাল সেলাম।

Comrade NK
Tributes to Comrade NK

ভাল্লিয়ামাল ও কোডারিয়াপার দেবীর সন্তান কমরেড শনমুগারাজের জন্ম হয়েছিল ১৯৫৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর তামিলনাড়ুর দিন্দিগুল জেলার সন্নিকট অট্টানচাত্রামের আরাসা পিল্লাই গ্ৰামে। তিনি সারা পার্টিতে কমরেড এনকে নটরাজন নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি স্কুলের পাঠ সমাপ্ত করেন অট্টানচাত্রামে। স্নাতোকত্তর স্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেন পালানি আন্দাভার কলেজ অব আর্টস এন্ড কালাচার বিদ্যায়তনে। কলেজে পড়ার দিনগুলিতে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করতেন দর্শন ও রাজনৈতিক বিষয়ের সুগভীর চর্চায়। গান্ধীবাদী দর্শন, বিবেকানন্দর শিক্ষা ও জেসি কুমারাপ্পার ধারণাগুলি সম্পর্কে অধ্যয়ন করেন।

কারাটুপট্টির কমরেড মুথুরাজের সান্নিধ্যে বিপ্লবী রাজনীতি, চারু মজুমদার এবং মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। ১৯৮০’র দশকের গোড়ায় তিনি পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হন। এরআগে তিনি কিছুদিন সংবাদপত্রে সাংবাদিকের কাজও করেছেন। নীলগিরি জেলার পণ্য উৎপাদনের বাগিচাগুলিতে শ্রমিকদের সংগঠিত করার মধ্যে দিয়ে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মীর জীবন শুরু করেন। তীব্র নিপীড়নের সময়কালে তিনি কোয়েম্বাটুরের কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করেছেন। তিনি তামিলনাড়ুর নামাক্কাল, ইরোড, সালেম ও ধরমপুরি জেলায় সম্পাদক ও নানান পদমর্যাদায় দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তিনি নামাক্কাল ও ইরোড জেলার কুমারাপালায়াম ও পাল্লিয়াপালায়াম অঞ্চলে নিপীড়িত পাওয়ারলুম শ্রমিকদের জঙ্গি সংগ্ৰাম সংগঠনে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন। তাদের মধ্যে পার্টি গঠনেও তিনি সফল হয়েছিলেন। তিনি রাজ্য সম্পাদক হিসাবে এবং বিপ্লবী ট্রেড ইউনিয়ন কাজে প্রতিশ্রুত এআইসিসিটিইউ’র অন্যতম সর্বভারতীয় নেতা হিসাবেও অনুশীলনে অবদান রেখেছেন। অসংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যে তিনি সরল ও সাদাসিধে জীবন কাটিয়েছেন, জীবন ও জীবিকার জন্য তাদের সংগ্ৰামে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিতেও তাদের নিয়ে এসেছেন।

কোয়েম্বাটুর জেলায় তিনি বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের সংগঠিত করেছেন, কয়েকটা ইউনিয়ন গড়ে তুলেছেন এবং এআইসিসিটিইউ’র পতাকাতলে প্রিকল শ্রমিকদের জঙ্গি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সাধারণ জনগণ এবং শ্রমিকদের চালানো সংগ্ৰামের জন্য বেশ কিছু মমলায় অভিযুক্ত হন এবং জেলেও যান। কমিউনিস্ট কর্মী হিসাবে জনগণের জন্য ভালোবাসা এবং শ্রেণী সংগ্ৰামের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার ছিল অপরিসীম। জনগণ, শ্রমিক এবং পার্টি ক্যাডারদের কাছ থেকে পেয়েছেন নিরতিশয় ভালোবাসা।

কমরেড নটরাজনকে সবাই এনকে বলেই ডাকত, আর তিনি দীর্ঘদিন ধরে পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য ছিলেন। রাজ্য পার্টিতে ২০১৯ সালে কিছু সমস্যা দেখা দেয় এবং তাঁকে তখন রাজ্য পার্টির সম্পাদক করা হয়। ২০২০ সালে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। ২০২২ সালের ২৬-২৭ নভেম্বর ত্রিচিতে অনুষ্ঠিত রাজ্য সম্মেলনে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে রাজ্য সম্পাদক হিসাবে পুনঃনির্বাচিত হন। রাজ্যে ২৮টা জেলায় পার্টির বিস্তারে তিনি নেতৃত্ব দেন। তিনি বাম ঐক্যের প্রতি প্রভূত গুরুত্ব আরোত করেন এবং ফ্যাসি-বিরোধী এজেন্ডায় বাম, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিগুলোকে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালান। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাটনায় অনুষ্ঠিত হতে চলা পার্টি কংগ্ৰেসকে সফল করে তোলার জন্য তিনি সারা রাজ্যে ঘোরাঘুরি করছিলেন। কমরেডদের বারবার বলা সত্ত্বেও তিনি নিয়মিত ওষুধ খেতে ভুলে যেতেন। গত ১০ ডিসেম্বর (যেদিন ছিল মানবাধিকার দিবস) পার্টির দিন্দিগুল জেলা বৈঠকে ভাষণ দেওয়ার সময় বিকাল ৪টা নাগাদ তাঁর শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। একটা বেসরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁকে দিন্দিগুল সরকারি মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কমরেডদের যথাসাধ্য প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সন্ধ্যা প্রায় ৬টার সময় আমরা কমরেড এনকে’কে হারাই। গোটা পার্টির কাছেই বিশ্বাস করাটা এখনও শক্ত হচ্ছে যে কমরেড এনকে আর নেই।

গত ১১ ডিসেম্বর বিকাল ৪টার সময় তাঁর নিজের গ্ৰাম আরাসাই পিল্লাইপট্টিতে তাঁকে দাহ করা হয়। পার্টির রাজ্য নেতৃবৃন্দ, আন্দোলনের কর্মীরা এবং বাম ও প্রগতিবাদী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তাঁর প্রতি দরজ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদক কমরেড কে বালকৃষ্ণান তাঁর গ্ৰামে যান এবং কমরেড এনকে’র প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। তিনি বাম ঐক্যের প্রতি কমরেড এনকে’র অঙ্গীকারবদ্ধতার প্রশংসা করেন এবং রাজ্যের বাম, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিজেপি-বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার তাঁর প্রচেষ্টার সমাদর করেন।

পিইউসিএল’এর অন্যতম সর্বভারতীয় সম্পাদক কমরেড বালোমুরুগণ কমরেড এনকে নটরাজনের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘকালের আন্তরিক সংযোগের স্মৃতিচারণা করেন এবং আন্দোলনের স্বর্থে তাঁর নিষ্ঠা ও দৃঢ় অঙ্গীকারের তারিফ করেন।

প্রিকল শ্রমিকদের নেতা কমরেড নটরাজন, এলটিইউসি’র জয়প্রকাশ এবং কোয়েম্বাটুর কর্পোরেশনের পূর্বতন কাউন্সিলর ভেল মুরুগানও তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কয়েক শত জনগণের উপস্থিতিতে তাঁর শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়।

তাঁর স্বপ্ন ছিল হাজার হাজার পার্টি সদস্য হবে, গণসংগঠনের সদস্য হবে লক্ষ লক্ষ, পার্টি অনেক বড় আকার নেবে। আসুন, আমরা তাঁর স্বপ্ন পূরণ এবং তাঁর আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথ নিই।

কমরেড এনকে লাল সেলাম।

not writing for the sake of writing

দেশব্রতীতে (খন্ড ২৯, সংখ্যা ৪৭, ৮ ডিসেম্বর ২০২২) প্রকাশিত ‘লাচিত বরফুকন ও সংঘ পরিবারের ইতিহাস নির্মাণ প্রকল্প’ শিরোনামে লেখায় সৌভিক ঘোষাল “সরাইঘাট যুদ্ধই লাচিতের জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি” বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি লেখার শুরুতে এও বলেছেন যে, “চার শতাব্দী আগের এই সমরনায়ককে নিয়ে ইদানিং বিশেষ করে সংঘ পরিবারের পক্ষ থেকে নানা অনুষ্ঠান ও আলোচনাসভা আয়োজিত হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে লাচিত কে ছিলেন, কী তাঁর কীর্তি, সেই নিয়ে এই লেখায় যেমন আমরা কথা বলতে চাইব, তেমনি বুঝতে চাইব বিজেপি ঠিক কোন দৃষ্টিকোণ থেকে লাচিত বরফুকনকে নিয়ে সংস্কৃতির রঙ্গমঞ্চে নেমে পড়েছে।” লেখকের উদ্দেশ্যকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। প্রথমেই জানিয়ে রাখা ভালো, ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাচিতকে নিয়ে নতুন করে ইতিহাস লেখার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁকে হিন্দু বীর প্রমাণেরও প্রয়াস চলছে। কিন্তু খন্ড ইতিহাস রচনা করে কী আসল ইতিহাসকে ধামাচাপা দেওয়া যায়? সংঘ বাহিনী বা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি ঠিক তাই করতে চায়। সবক্ষেত্রেই নতুন করে ইতিহাস নির্মাণের নামে খন্ড ইতিহাস তুলে ধরছে নয়তো ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাচ্ছে। এটি না বুঝতে পারলে লেখকের মহান উদ্দেশ্য বানচাল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় একশ শতাংশ।

তাই, সংঘীদের অস্ত্রেই সংঘীদের উন্মোচন না করলে লেখাটির গুরুত্ব যেমন থাকে না, একই সঙ্গে তাদের বক্তব্যকেও খন্ডন করার প্রকল্প ব্যর্থ হয়ে যায়। সৌভিক তাঁর লেখায় সরাইঘাট যুদ্ধের অপর সেনাপতি, ইসমাইল সিদ্দিকি ওরফে বাঘ হাজারিকার কথা একবারও উল্লেখ করেননি। সংঘবাহিনীর তরফে সিদ্দিকির বীরত্বের কথা উল্লেখ করা হবেনা, বা, সিদ্দিকি মুশলিম বীর বলে উল্লেখ করলে লাচিতকে হিন্দু বীর হিসাবে প্রতিষ্ঠা করানো যাবে না। এটা তো সংঘের পরিকল্পিত মিথ্যাচার। অর্থাৎ, অন্য কেউ নয়, লাচিতই সরাইঘাট যুদ্ধের আসল নেতা, এটা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তাই তাদের ইসমাইলের ভূমিকাকে নস্যাৎ করার সমান্তরাল প্রচেষ্টা চলছে বলে ইতিহাসবিদরা মনে করছেন। ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ বলছেন মোগলদের হাতে পরাজিত স্বর্গদেও জয়ধ্বজ সিংহ ঘিলাঝারিঘাটের সন্ধির শর্ত অনুসারে কন্যা রমণী গাভরুকে অওরঙ্গজেবের ছেলে আজমের সঙ্গে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। তাঁর নতুন নাম হয় রহমত বানু বেগম। ওই রমণীই মোগল দরবারে কিশোর ইসমাইলের বীরত্ব দেখে তাকে অসমে পাঠান। সে খালি হাতে বাঘ মারায় রাজা জয়ধ্বজের ছেলে চক্রধ্বজ সিংহকে বাঘ উপাধি দেন এবং এক হাজার সেনার নেতা অর্থাৎ ‘হাজারিকা’ করে দেন। সরাইঘাট যুদ্ধে অহোম বাহিনী মোগলদের সঙ্গে পেরে উঠছিল না। সেই সময়ে বাঘ হাজারি কৌশলে কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে মোগল গোলন্দাজেরা ফজরের নমাজ পড়ার সময়ে কামান ছেড়ে নমাজ পড়তে গেলে কামানের ভিতরে জল ঢেলে সেগুলি অকেজো করে দেয়। পরে মোগল বাহিনী কামান থেকে গোলা ছুঁড়তে গেলে ব্যর্থ হয়। অহোম বাহিনী এরফলে উত্তরপার দখল করে। অহোম বাহিনীতে বাঘ হাজারি ছাড়াও লাইধন খাঁ, পেটুয়ার মতো অনেক মুশলিমই যুদ্ধ করেছিলেন।

হিন্দু জাগরণ মঞ্চ যদিও দাবি করেছে বাঘ কাল্পনিক চরিত্র। কিন্তু বাঘ হাজারিকার বীরত্বের কাহিনী সূর্যকুমার ভুঁইঞা, এমএস হাজারিকা, তুলন গোঁহাইদের বইয়ে উল্লেখ আছে। এছাড়াও, ভুবন চন্দ্র সন্দিকৈয়ের বইতেও উল্লেখ করা হয়েছে একাধিক মুশলিমদের নাম। ইতিহাসবিদরা এও দাবি করেছেন, লাচিত হিন্দু বা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়, আসলে নেমেছিলেন দিল্লীর আধিপত্য বিস্তারের বিরুদ্ধে। অসমের বেশ কিছু ইতিহাসবিদও দাবি করেছেন, সরাইঘাট যুদ্ধে লাচিতের কথা আসলে বাঘ হাজারিকার নাম আসবেই।

সুতরাং, লেখার জন্য লেখা না করে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস উল্লেখ করে লেখা না হলে পণ্ডশ্রম হয়ে যায়। লেখাটি যে উদ্দেশ্যে লেখা, তাও পাঠকের কাছে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে এবং উদ্দেশ্যও ব্যর্থ হয়ে যায়।

- সনাতন মুর্মু, কলকাতা

== 0 ==

খণ্ড-29
সংখ্যা-48