রাজ্যে প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা। তার সাথে মৃত্যুও। কলকাতার গন্ডি পেরিয়ে ডেঙ্গি ছড়িয়ে পড়ছে শহরতলীতে, একের পর এক জেলায়। শিলিগুড়ি, মুর্শিদাবাদও এসে পড়েছে এই মানচিত্রের অধীনে। স্বাস্থ্য দপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই বছরে ডেঙ্গির প্রকোপ আগের সমস্ত রেকর্ডকেও ছাপিয়ে গেছে। কলকাতা পুরসভার পরিসংখ্যান অনুযায়ী এবারের ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা গত পাঁচ বছরে সর্বাধিক। ২৫ অক্টোবরের আগের সপ্তাহে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ৩,০০০ পার হয়েছে। এবার আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছে গেছে ৪৫,০০০’র কাছাকাছি। এরমধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। পুলিশ কর্মী, গর্ভবতী মা, অল্পবয়স্ক শিশু — কেউ বাদ যায়নি। রাজ্য সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৯’র প্রথম ২৬ সপ্তাহে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১,০৩৭। ২০২০ এবং ২০২১-এ এই সংখ্যাটা ছিল যথাক্রমে ৬১৯ ও ২৭৩। কিন্তু এ’বছরের প্রথম ২৬ সপ্তাহে এই সংখ্যাটা লাফ দিয়ে বেড়েছে ১,৭৫১-তে। খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে রোগীর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতির কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। কলকাতার বেশ কিছু ওয়ার্ডে প্রায় ঘরে ঘরে ডেঙ্গি ছড়িয়ে পড়েছে। এরকম অবস্থায় আজ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী কোনো বিবৃতি দিয়ে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে তা মোকাবিলার কোনো বার্তা দেননি। নাগরিকদের আশ্বস্থ করার জন্য চোখে পড়ার মতো কোনো অর্থবহ পদক্ষেপ লক্ষ্য করা গেল না।
ঝাঁ চকচকে বেসরকারি ব্যয়বহুল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের আধিক্য যে মৌলিক স্বাস্থ্য সঙ্কটকে সামাল দিতে পারেনা তা অতিমারীর থাবা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। অতিমারী এই শিক্ষা দিয়েছিল, একেবারে তৃণমূল স্তরে, ওয়ার্ড ভিত্তিক স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা ও একই সাথে সদা সতর্ক নজরদারি রাখার উপর রাজ্য সরকার ও পৌর সভাগুলোকে প্রাথমিক নজর দিতে হবে। কিন্তু সেই শিক্ষা নেওয়া হয়নি। রাজ্য সরকার ও পৌর প্রশাসনের নির্লিপ্তি, অপরাধসম অবহেলার সুযোগ নিয়ে ক্রমে ক্রমে মশাবাহিত এই রোগটি গুটি গুটি পায়ে আজ যেভাবে ছড়িয়ে পড়ল তা উক্ত ওই দু’টি প্রতিষ্ঠানের চরম ব্যর্থতাকেই দেখিয়ে দেয়। নানান জেলায় উঠছে গাফিলতির অভিযোগ। শিলিগুড়ি শহরে ডেঙ্গি মোকাবিলায় প্রশাসনিক স্তরে খামতির কথা কিছুদিন আগেই বলেন উত্তরবঙ্গের বিশেষ জনস্বাস্থ্য আধিকারিক। এই গোটা ঘটনা দেখিয়ে দেয়, নাগরিকদের একান্ত অপরিহার্য মৌলিক স্বাস্থ্য পরিষেবা, মশাবাহিত রোগ ঠেকাতে প্রাথমিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বজায় রাখতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো আমলই দিল না।
মশাবাহিত রোগগুলি আমাদের রাজ্যে বারে বারে মাথা চাড়া দিয়ে গোটা স্বাস্থ্য কাঠামোর দেউলিয়ে স্বরূপকে উলঙ্গ করে দিচ্ছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা মেরামত করা হল না। এব্যাপারে রাজ্য সরকারের কোন অগ্রাধিকারই কোনো দিন চোখে পড়ল না।
বেহাল রাজ্যের অর্থনীতি, গোটা ব্যবস্থায় আপাদমস্তক দুর্নীতির দগদগে ঘা, অপরাধী রাজনীতিবিদদের নিবিড় আঁতাত, রাজ্যে তৃণমূল শাসিত সরকারের প্রকৃত চেহারাকে উন্মোচিত করে দিয়েছে। একান্ত ন্যায্য গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়াকে শুধু উপেক্ষা নয়, তাকে পুলিশ প্রশাসনের দুরমুশ দিয়ে দমন করার একের পর এক স্বৈরাচারী পদক্ষেপ রাজ্যবাসী দেখেছে। নাগরিকদের জীবন রক্ষার মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার পালনের কর্তব্য থেকে পুরোপুরি বিচ্যুত স্খলিত এই রাজ্য সরকার ও তার অধীনে পরিচালিত পুর প্রশাসন।
নাগরিকদের একান্ত মৌলিক স্বাস্থ্যের অধিকারকে রক্ষা করা যে সরকারের দায়িত্ব তা আরো একবার জোরের সাথে পুনর্ঘোষণা করার সময় এসেছে।