ব্রাজিলে শ্রমিক দল ও লুলার জয়ে বিশ্বের বামপন্থী মহলে খুশির হাওয়া
The victory of the Labor Party

বাইশ কোটি লোক এবং বিশাল এক আয়তনের দেশ ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল সদ্য সামনে এসেছে। এই ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর বর্তমান রাষ্ট্রপতি বোলসেনারোকে পরাস্ত করে শ্রমিক দলের নেতা ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি লুলা বিজয়ী হয়েছেন। উভয়ের ভোটের ফারাক যদিও এক শতাংশ, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ফলাফলকে ব্রাজিল, লাতিন আমেরিকা ও গোটা বিশ্বের বামপন্থী শিবির অত্যন্ত ইতিবাচক রায় হিসেবে দেখছে।

গত কয়েক বছরে সারা বিশ্বে যে সমস্ত চরম দক্ষিণপন্থী ও স্বৈরতন্ত্রী শাসকেরা শাসন করছিলেন, তাঁদের অনেকে — যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প, ইজরায়েলের নেতা বেঞ্জামিন নেতানায়াহু, ব্রিটেনের বরিস জনসন — নির্বাচনে হেরে পরাজিত হয়েছেন। তুরষ্কের এরদোগান, রাশিয়ার পুতিন, ভারতের নরেন্দ্র মোদীর মতো ক্ষমতায় আসীন ছিলেন ব্রাজিলের বোলসোনারোও। কয়েকদিন আগেই ইতালিতে অতি দক্ষিণপন্থী নিও ফ্যাসিস্ট শক্তি নির্বাচনে জয় পেয়েছে। দীর্ঘদিন পর চিলিতে দক্ষিণপন্থীদের হারিয়ে সত্তর দশকের আলেন্দের পর প্রথম জয় পেয়েছেন বামপন্থীরা, কিন্তু তাদের সংবিধান বদলের প্রস্তাব আবার গণভোটে বিপুলভাবে পরাস্ত হয়েছে। এই জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্রাজিলের নির্বাচনে কানঘেঁষে হলেও বামপন্থী লুলার জয় এবং বোলসেনারোর মতো অতি দক্ষিণপন্থীর পরাজয় একটি ইতিবাচক ঘটনা।

বোলসেনারোর যে সমস্ত নীতি তাঁর পরাজয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে তাঁর একটি নিঃসন্দেহে কোভিড অতিমারীর মোকাবিলায় তাঁর হঠকারী নীতি, যা ব্রাজিলে সাত লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়। ট্রাম্পের পতনের পেছনেও অবিবেচক কোভিড নীতি অনেকখানি দায়ী ছিল বলে মনে করা হয়। বোলসেনারোর পতনের আর একটি কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে তাঁর অবিবেচক পরিবেশ নীতি। যেভাবে আমাজন অরণ্য তাঁর আমলে ধ্বংস করা হয়েছে, তা ব্রাজিলের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্তরেই পরিবেশ কর্মীদের কাছে গভীর দুশ্চিন্তার ব্যাপার হয়ে উঠেছিল। লুলা তাঁর নির্বাচনী প্রচারে আমাজন জঙ্গলকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বোলসেনারো জমানায় যেভাবে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও দরিদ্র প্রান্তিক মানুষের প্রিয় নেতা লুলাকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে জেলে পাঠানো হয়েছিল, কিছুদিন আগে ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট সেই রায়কে পক্ষপাতদুষ্ট ও অন্যায় বলে ঘোষণা করে ও লুলাকে সমস্ত অভিযোগ সহ কারাদণ্ড থেকে মুক্তি দেয়। এই ঘটনা নির্বাচকদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।

Brazil is a joy in the world's left-wing circles

লুলা ব্রাজিল, লাতিন আমেরিকা ও বিশ্ব রাজনীতির অত্যন্ত পরিচিত মুখ। ২০০৩ সালে তিনি ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তার ঢের আগেই তাঁর নাম সারা বিশ্বের বাম ও গণতান্ত্রিক মহলে বিশেষ পরিচিত ছিল শ্রমিক দলের প্রধান নেতা হিসেবে। আশির দশকে এই শ্রমিক দল যখন তৎকালীন ব্রাজিলের স্বৈরশাসনের মোকাবিলার লক্ষ্যে গড়ে উঠছিল, তখন তার অগ্রণী নেতাদের অন্যতম ছিলেন তরুণ ধাতুশ্রমিক নেতা লুলা দ্য সিলভা। শ্রমিক দল প্রথমদিকে বুর্জোয়াদের সঙ্গে জোট না করেই এগনোর নীতি নিয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে বাস্তব পরিস্থিতির চাপে অতি দক্ষিণপন্থীদের মোকাবিলায় বুর্জোয়াদের একাংশের সঙ্গে জোট করে আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় স্তরে সরকার গঠনের পক্ষে নীতি পরিবর্তন করে তারা। ২০০২ সালের যে নির্বাচনে লুলা প্রথমবার বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন, সেই নির্বাচনেই উপরাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করা হয় জোটসঙ্গী জোসে আলেনকারকে, যিনি ছিলেন এক বড় পুঁজিপতি। শ্রমিক ও ক্ষেত-মজদুরদের ভোট শ্রমিক দলের জন্য নিশ্চিতই ছিল, এই নির্বাচনী বোঝাপড়া বুর্জোয়া শ্রেণির একাংশের সঙ্গে সমঝোতা ও সমর্থনের ভিত্তি তৈরি করে এবং বহুদিন পর দক্ষিণপন্থীদের হারিয়ে ব্রাজিলের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন বামপন্থীরা।

সমঝোতার কারণে লুলার সেই সময়ের সরকারকে এমন কিছু নীতি নিয়ে চলতে হয়েছিল যা ছিল বাধ্যতামূলক আপোষ। নির্বাচনের আগেই লুলা সেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বর্তমান কার্দাসো জমানার ব্যাঙ্কগুলির আধিপত্য নষ্ট হবেনা। নির্বাচনে জেতার পরে লুলা অর্থমন্ত্রী করেন অতি রক্ষণশীল পাওলচ্চিকে। কৃষিমন্ত্রী করা হয়েছিল জমিদার শ্রেণি বা ল্যাটিফুন্ডিয়ার মালিকদের থেকে। বড় জমিদারদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এড়ানোর জন্য জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করার বদলে হাত দিতে হয় আমাজন অরণ্যতে। বন কেটে জমি উদ্ধার করে তা কৃষির জন্য ভূমিহীনদের মধ্যে বিলি করা হয়। বোলসেনারো জমানার বিরুদ্ধে আমাজন ধ্বংসের অভিযোগের বিপরীতে লুলা এবার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বটে, কিন্তু বাস্তবে ২০০৩ সালে তিনি ক্ষমতায় আসার পর ২৪,০০০ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি এক বছরেই ধ্বংস করা হয়েছিল। সয়াবীন চাষ বৃদ্ধি, এশিয়া ও ইউরোপে মাংস রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য আমাজনের জঙ্গল কেটে সাফ করা হয়েছিল। আজকের বোলসেনারোর মতোই লুলা সম্পর্কেও পরিবেশ ধ্বংসর অভিযোগ ছিল এবং পরিবেশবিদেরা বলেছিলেন লুলা আমাজনকে হ্যামবার্গার ফ্যাক্টরিতে পরিণত করার দিকে এগোচ্ছেন। লুলা পেনশন আইন সংস্কার করে পেনশনের জন্য ন্যূনতম চাকরীর সময়সীমা বৃদ্ধি করার মতো নীতি নেওয়ায় বিখ্যাত লাতিন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ ও বামপন্থী রাজনৈতিক বিশ্লেষক জেমস পেত্রাস অভিযোগ করে বলেছিলেন যে লুলা সরকার শ্রমজীবীদের সমর্থন বন্ধক রেখে বুর্জোয়াদের সেবা করছেন।

লুলার সরকারের আমলে দারিদ্র ও বেকারত্ব বাড়ছিল, শ্রমশক্তির অর্ধেক চলে গিয়েছিল অসংগঠিত ক্ষেত্রে, মাদকের ব্যবহার ও অপরাধ মারাত্মকভাবে বেড়েছিল। পুলিশের ক্ষমতা বহুগুণ বাড়ানো হয়েছিল। লুলা এইবার ঠিক কী নীতিমালা নেবেন তা নির্বাচনী প্রচারে স্পষ্ট করেননি। আমাজন ধ্বংস বন্ধ করবেন আর সামাজিক ঐক্যের দিকে নজর দেবেন — এই ধরনের সাধারণ কিছু আশ্বাসবার্তাই দিয়েছেন কেবল। ব্রাজিলের সংসদে বামপন্থীরা এখনো সংখ্যালঘু, বোলসেনারোর দক্ষিণপন্থী দল ও মধ্যপন্থীদেরই সংসদের দুই কক্ষে পাল্লা ভারি। কিন্তু এসব সত্ত্বেও সারা বিশ্বের বামপন্থীরা এবারে লুলার বিজয়ের মধ্যে ইতিবাচক বার্তা পাচ্ছেন। তার কারণ বোলসেনারোর মতো অতি দক্ষিণপন্থীর পরাজয়। ২০১৮’র পর থেকে লাতিন আমেরিকার আটটি বড় দেশের সাতটিই – আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, মেক্সিকো, পেরু, হন্ডুরাস, চিলি, ব্রাজিল যে বামপন্থীদের ক্ষমতায় নিয়ে এল — তার রাজনৈতিক মূল্যও কম নয়।

- সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-29
সংখ্যা-42