তিনি বিশ্বের এক নম্বর ধনকুবের। অঢেল তাঁর সম্পত্তি। প্রবল প্রতাপ ও দাপট। তিনি মাত্র ৫৫ বছর বয়সেই টেসলা, স্পেস এক্স, বোরিং কোম্পানি’র মতো দৈতাকৃতি সংস্থাগুলোর কর্ণধার হয়ে বসে রয়েছেন। তিনি এলন মাস্ক। চুয়াল্লিশ বিলিয়ন ডলারে তিনি এবার কিনে নিলেন টুইটার। আর, কেনার পর বেশ নাটকীয় মেজাজে হাতে একটা সিঙ্ক (বেসিন) নিয়ে সটান হাজির হলেন টুইটারের সান ফ্রান্সিসকোর সদর দপ্তরে। কেনার পরই শুরু করলেন দক্ষযজ্ঞ। নির্বিচার ছাঁটাই। প্রথমেই কোপ পড়ল ভারতীয় বংশোদ্ভূত টুইটারের সিইও পরাগ আগরওয়ালের উপর। তারপর সারা বিশ্বে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪,০০০ কর্মীকে ছাঁটাই করলেন। ভারতে দিল্লী-বেঙ্গালুরু-মুম্বাইস্থিত অফিসগুলোতে কোপ পড়ল ৯০ শতাংশ ভারতীয় কর্মীর উপর। সেই চির পুরাতন কর্পোরেট বাহানা — সংস্থার রুগ্ন স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার করতেই নাকি অনিবার্য এই ছাঁটাই’য়ের দাওয়াই। শোনা যাচ্ছে, এই সংস্থাটি কিনতে ব্যাঙ্কগুলোর কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের ঋণ নিতে হয়েছে মাস্ক’কে। তখনই তিনি জানিয়েছিলেন, কর্মীসংখ্যা ব্যাপক মাত্রায় কমিয়ে লাভজনক করার পদক্ষেপ তিনি নেবেন। ছাঁটাই’এর পর্ব সবে শুরু হয়েছে। এটা থামবে কোথায় তা আমরা কেউই জানি না।
কিছুদিন আগে তাঁর করা একটি টুইট থেকে জানা যাচ্ছে, টুইটার প্রতিদিন চার মিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সান্ত্বনা দেওয়ার ঢঙে সেই টুইটে যোগ করেছেন, যাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে তাদের তিন মাসের বিদায়ী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। তার মতে এটা নাকি যা দেওয়ার কথা তারথেকে অনেক অনেক বেশি। লাভজনক করার লক্ষ্যে টুইটার এবার থেকে ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টের জন্য মাশুল ধার্য করার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। ভারতে তা এখনই লাগু না হলেও অদূর ভবিষ্যতে তা চালু হয়ে যাবে। এবার, টুইটারের পদাঙ্ক অনুসরণ করল ফেসবুকের পেরেন্ট সংস্থা মেটা। সেখানেও বিরাট সংখ্যক কর্মীকে ছাঁটাই করা হচ্ছে। জানা গেল সংস্থার ১৩ শতাংশ অর্থাৎ ১৭ হাজার কর্মীকে প্রথম পর্বে ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে, আজ ইউরোপ দেখছে ধর্মঘটের ভূত। প্রায় সমস্ত ইউরোপীয় দেশগুলোতে সর্বস্তরের শ্রমিক কর্মচারীদের সর্বাত্বক ধর্মঘট জনজীবনকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে। সংকটাপন্ন নয়া উদার অর্থনীতি গোলকধাঁধায় খাবি খেতে খেতে পরিত্রাণের পথ খুঁজছে। আর, সেই সংকটের বোঝা চালান করা হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণির ঘাড়ে।
অর্থনৈতিক উদারীকরণের যুগে সারা ভারতে (কেবল পশ্চিমবঙ্গে নয়) বহু কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ঠিক কত শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছেন তার হিসাব কোনো রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমমন্ত্রকও দিতে পারবে বলে মনে হয় না। কোভিডও কি বিপুল মানুষের রুটি রুজি কেড়ে নিয়েছে, সে সম্পর্কে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা চালিয়েছে। আইএলও তার রিপোর্টে এ’সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করলেও ভারত সরকার আজও জানায়নি ঠিক কত শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছেন।
শোনা যাচ্ছে মাস্ক টুইটার অধিগ্রহণের আগেই টুইটার বিশাল কর্মী ছাঁটাই’এর একটা পরিকল্পনা করেছিল। এই কর্মী ছাঁটাই’এর ফলে নাকি টুইটার কোম্পানি প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার বা তার বেশি খরচ কমাতে পারত। অর্থাৎ লাভ করার অছিলায় এই ধরনের ছাঁটাই করা হচ্ছে।
সুতরাং ছাঁটাইয়ের আসল কারণ হল মুনাফা বাড়ানো। কত বাড়ানো? এর কোনো নির্দিষ্ট উত্তর নেই, কারণ মালিকের লোভের কোনো শেষ নেই। যেকোনো স্তরের কর্পোরেট কর্মচারীই জানেন, আজকাল পরের আর্থিক বর্ষের ব্যবসার লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয় আগের বছরের মুনাফা অনুযায়ী। আগেরবারের চেয়ে বেশি মুনাফা না করা গেলেই হিসাবে ক্ষতি লেখা হয়। অর্থাৎ লাভ-ক্ষতির সংজ্ঞাই বদলে ফেলা হয়েছে পুঁজির হাঙরদের ক্ষিদে মেটানোর জন্য।
ইলন মাস্ক’এর মতো অতি বৃহৎ কর্পোরেট মালিকও নয়া উপনিবেশের ব্যবস্থার খেলোয়াড় মাত্র। এক সময়ের crowd funding’এর মহানায়ক (খান একাডেমিকে ৫ বিলিয়ন ডলার দিয়েছিল) এখন ৫০ শতাংশ লোক ছাঁটাই করছে, তৃতীয় বিশ্বের অফিসগুলো তুলে দিচ্ছে। যেগুলো দেখতে পাই না, তা হচ্ছে মাসিক ৮ ডলার দিয়ে কোনো তৃতীয় বিশ্বের গ্রাহক একাউন্ট কিনবেন না। অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্ব এবার থেকে প্রথম বিশ্ব থেকে আলাদা হয়ে গেল। এদিককার খবর প্রথম বিশ্বের কাছে পৌঁছুবে না, উল্টোটাও হবে না।
এবার কর্পোরেট কোম্পানিগুলো শুরু করেছে কৃত্রিম মেধার প্রযুক্তি। যাতে কর্মচারী আরও কম লাগে অর্থাৎ অনেক কাজ একজন কি দু’জন কর্মচারী করে ফেলতে পারে এবং তারফলে মালিকপক্ষ আরও লাভ করতে পারে।
এটা শোনা যাচ্ছে মাস্কের আরেকটি সংস্থা টেসলার শেয়ারহোল্ডাররা সেই সংস্থা থেকে মাস্কের বার্ষিক বিপুল পে প্যাকেজ ৫,৬০০ কোটি ডলারের উপর প্রশ্ন তুলে মামলা দায়ের করেছে মার্কিন আদালতে।
“যে মুহূর্তে মেশিনারি একটি নির্দিষ্টি শিল্পশাখার শ্রমিকদের মুক্ত করে দেয়, সেই মুহূর্তে এই প্রতীক্ষমান কর্মপ্রার্থী মানুষগুলো ছড়িয়ে পড়ে কর্ম-সংস্থানের নতুন নতুন প্রবাহে এবং অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় অন্যান্য শাখায়। ইতোমধ্যে এই অতিক্রমণের কালে যে শ্রমিকেরা গোড়ায় বলি হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই উপোস করে থাকতে থাকতে শেষ হয়ে যায়” — কার্ল মার্ক্স
- অর্ণব মুখার্জী