গুজরাটের মোরবী শহরে মচ্ছু নদীর উপর ঝুলন্ত সেতু ভেঙে পড়ে যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ৩০ অক্টোবর ২০২২ সন্ধ্যায় ঘটল তা আরও একবার সরকার-কর্পোরেট গাঁটছড়ার মধ্যে নিহিত বিপর্যয়ের বিপুল সম্ভাবনাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। ঐ সেতু একেবারে মাঝ বরাবর ভেঙে পড়ল মেরামতি সম্পন্ন হওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যেই এবং এখন পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী তাতে প্রাণ গেল ৪৭ জন শিশু ও বহু নারী-সহ ১৩৫ জনের। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে — সেতুর মেরামতি কি যথাযোগ্য হয়েছিল? যে সংস্থা সেতু মেরামতির দায়িত্ব পেয়েছিল, সেই কাজে তাদের পারদর্শিতা বিচার করেই কি মোরবী পুরসভার সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছিল? সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য সেতু খুলে দিতে গিয়ে কি জনপ্রিয়তাবাদ প্রাধান্য পেয়েছিল এবং জনসুরক্ষা উপেক্ষিত হয়েছিল? দুর্ঘটনার পর রাজ্য প্রশাসন কি চুনোপুঁটিদের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে উঠেপড়ে লেগেছে?
সেতু মেরামতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ ঘনিষ্ঠ এবং বিজেপির অতি কাছের ওরেভা গোষ্ঠীকে। আমেদাবাদ পশ্চিম সংসদীয় ক্ষেত্রের বিজেপি সাংসদ কিরীট সোলাঙ্কি এই গোষ্ঠীর কর্ণধার জয়সুখভাই প্যাটেলকে ‘নব নক্ষত্র সম্মানে’ ভূষিত করেন। প্রাপ্ত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, কোনো দরপত্র না ডেকেই ঐ মেরামতির ভার ওরেভা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। ঐ গোষ্ঠী পরিচিত অজন্তা ব্র্যান্ডের দেওয়াল ঘড়ি নির্মাণের জন্য; এবং ই-বাইক, ইলেক্ট্রিক বাল্ব, ক্যালকুলেটার ও মশা মারার রেকেট তৈরিও গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সেতু সারাইয়ের মতো প্রযুক্তিগত কর্মকুশলতা তাদের থাকার কোনো প্রমাণ সামনে আসেনি। যাঁরা এই গোষ্ঠীর হাতে ১৪০ বছরেরও বেশি পুরনো সেতুর মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণের ভার তুলে দিলেন, তাঁরাও কি এই ধরনের কাজে তাদের দক্ষতা সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন? গোষ্ঠীর কর্ণধার জয়সুখভাই প্যাটেল বলেছিলেন, সেতুর ১০০ শতাংশ সংস্কার হয়েছে। এবং এমন মেরামতি তাঁরা করেছেন যে, সেতুকে অনায়াসে আরও ১৫ বছর ব্যবহার করা যাবে। আর এখন এই অভিযোগ উঠেছে যে, ১৪৪ বছরের পুরনো সেতুর জংধরা কেবলগুলোকে রং করে সেগুলোর ভোল পাল্টানোর চেষ্টা হয়েছে। প্রকৃতই কোনো মেরামতির বদলে ওপর-ওপর রঙের প্রলেপ দিয়ে রূপের বাহার আনার জন্যই কি সেতু মাঝ বরাবর ভেঙে পড়ল? গুজরাটের বিজেপি সরকার পাঁচ সদস্যের যে বিশেষ তদন্তকারী দল গড়েছে, তারা কি এই অভিযোগের সত্যতার অনুসন্ধানে আন্তরিক হবে?
এই সেতুর মালিকানা মোরবী পুরসভার এবং ওরেভা গোষ্ঠীর সঙ্গে মোরবী পুরসভার চুক্তির মধ্যেই সম্ভবত বিপর্যয়ের বীজ নিহিত ছিল। পুরসভার সঙ্গে ওরেভা গোষ্ঠীর এই চুক্তি হয় যে, সেতু সারাই এবং তাতে নবরূপ দানের সমস্ত খরচ ওরেভা গোষ্ঠীই বহন করবে। বিনিময়ে তারা সেতুতে প্রবেশের টিকিট বিক্রি করে সেতু সারাই ও তার রক্ষণাবেক্ষণের খরচ তুলবে। টিকিট প্রতি প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ১৫ টাকা এবং ১২ বছরের কম বয়সীদের জন্য ১০ টাকা করে এবং টিকিটের দাম প্রতি বছর দু’টাকা বৃদ্ধির অনুমতি তারা পেয়েছিল (এই বরাতটা অবশ্য পায় ওরেভার পারিবারিক সংস্থা অজন্তা ম্যানুফ্যাকচারিং প্রাইভেট লিমিটেড)। সেতু ভেঙে পড়ার দিন ওরেভার পক্ষে ১৭ টাকা মূল্যের সাড়ে ছশোর মতো টিকিট বিক্রি করা হয়েছিল বলে সংবাদ বেরিয়েছে। জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য ২৬ অক্টোবর ২০২২ সেতু খুলে দেওয়ার আগে ওরেভার কর্ণধার জয়সুখভাই প্যাটেল জানান — সেতুতে নবরূপ দানে তাঁরা দু’কোটি টাকা খরচ করেছেন! তাহলে, ৭৬৫ ফুট দীর্ঘ এবং ৪.৬ ফুট চওড়া ১৪৪ বছরের পুরনো, জংধরা কেবল যুক্ত সেতুর মেরামতির খরচ মাত্র দু’কোটি! জয়সুখভাই প্যাটেল আরও জানান, মেরামতির কাজে তাঁরা বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করেছেন এবং ‘বিশেষজ্ঞ সংস্থার’ নির্দিষ্ট করা উপকরণ তৈরি করিয়ে সেগুলো সারাইয়ের কাজে লাগিয়েছেন। সেগুলোর ব্যয়ও নিশ্চয় ঐ দু’কোটির মধ্যে রয়েছে। এই সমস্ত বিষয় সারাইয়ের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন না তুলে পারেনা। এবং জংধরা কেবল ঘষে-মেজে রং করার অভিযোগের সত্যতার আভাসও দেয়।
সারাইয়ের জন্য সেতু মার্চ মাস থেকে বন্ধ ছিল। মেরামতি শুরুর সময় বলা হয়েছিল সেতু আট থেকে বারো মাস বন্ধ থাকবে। কিন্তু সারাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সময় শেষ হওয়ার আগেই সেতুকে খুলে দেওয়া হল। এই খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ওরেভা গোষ্ঠীর নিজের না এর পিছনে প্রশাসনের চাপ কাজ করেছিল তা জানতে পারাটা একরকম অসম্ভব। তবে, সেতু খোলা হয়েছিল গুজরাটি নববর্ষের দিন। দেওয়ালি উৎসবের সময় চলছিল এবং সামনে ছিল ছট পুজো। আর গুজরাট বিধানসভার নির্বাচন তো রয়েইছে। এই আবহে জনগণের কাছে আকর্ষণীয় সেতুতে প্রবেশ ও ঘুড়ে বেড়ানোর সুযোগ করে দেওয়ার তাড়নার কাছে কি অবহেলিত হল জন সুরক্ষা?
এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার দায় এড়াতে গুজরাত রাজ্য সরকার এবং মোরবী পুরসভার মধ্যে একটু বাদানুবাদ দেখা গেল, যদিও দুটোই বিজেপি শাসিত। মোরবী পুরসভার প্রধান অফিসার সন্দীসসিন জালা বলেছেন, “২৬ অক্টোবর ঐ কোম্পানি (ওরেভা) আমাদের না জানিয়েই সেতুর উদ্বোধন করে। ওরা জনসাধারণের জন্য সেতু সারাইয়ের আগে আমাদের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেয়নি।” তিনি আরও জানিয়েছেন, তাঁদের কাছ থেকে নেওয়া সেতুর কোনো ‘ফিটনেস সার্টিফিকেট’ও ছিলনা, এবং সেতু উদ্বোধনের সময় পুরসভার কোনো অফিসারও উপস্থিত ছিলেন না। আর গুজরাতের প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নেতা নীতিন প্যাটেলের কথায়, “সেতুর সংস্কার ও উদ্বোধন করিয়েছেন মোরবীর পুর কর্তৃপক্ষ। এতে গুজরাত সরকারের কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিলনা।” জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনায় এবং প্রবল চাপের মুখে বিজেপির সবাই দুর্ঘটনা থেকে নিজেদের দূরত্ব তৈরি করতে চাইছে। জনগণের কাছে এই প্রয়াস কতটা আমল পাবে তা অবশ্যই কৌতূহলের বিষয়। তবে, গুজরাট নির্বাচনে এই দুর্ঘটনার একটা প্রভাব যে পড়বে তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না।
১৯৯০’র দশকের গোড়ায় নরসিমা রাওয়ের কংগ্ৰেসি জমানায় চালু হওয়া নয়া-উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতি অর্থনীতিতে কর্পোরেট আধিপত্যের পথ প্রশস্ত করে। আর নরেন্দ্র মোদী গুজরাটে এই নীতিকে এক উচ্চতর মাত্রায় নিয়ে গিয়ে রাজনীতি-কর্পোরেট সখ্যতাকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেন। অর্থনীতির এই ধারায় কর্পোরেটদের ফুলেফেঁপে ওঠার সঙ্গে রাজনীতিবিদদেরও আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। কর্পোরেট তোষণ ও কর্পোরেটদের হাতে আর্থিক-প্রাকৃতিক সম্পদের সমর্পণের পথে দুর্নীতির বৃদ্ধিও অমোঘ হয়ে ওঠে। এই ‘গুজরাট মডেল’কেই নরেন্দ্র মোদী আজ সর্বভারতীয় স্তরে প্রয়োগ করছেন। রবিবার, অর্থাৎ ৩০ অক্টোবর ২০২২ সন্ধ্যায় সেতু ভেঙে পড়লেও নরেন্দ্র মোদী তার পরপরই দুর্ঘটনাস্থল ও আহতদের দেখতে হাসপাতাল পরিদর্শনের সময় পাননি। ‘কর্তব্য’ পালনের নামে গুজরাট নির্বাচনের আগে প্রকল্পগুলোর শিলান্যাস করে গিয়েছেন, গুজরাতে নির্বাচনের দিন ঘোষণায় বিলম্ব ঘটিয়ে যে ‘কর্তব্য’ করার সুযোগ নির্বাচন কমিশন তাঁকে করে দিয়েছে। পরে, মঙ্গলবার ১ নভেম্বর ২০২২ বিকেলে তিনি দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং বেছে নেওয়া কয়েকজন আহত মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে তিনি প্রশাসনিক আধিকারিকদের বলেন যে, সমস্ত দিক থেকে তদন্ত করে দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করতে এবং তার থেকে ‘শিক্ষা’ নিতে হবে। তবে, এই দুর্ঘটনা সর্বাগ্ৰে এই বিষয়টাকেই সামনে আনছে যে, প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। তাহলে, গ্ৰেপ্তার হওয়া ন’জনের মধ্যে শুধু দু’জন ম্যানেজার, দু’জন শ্রমিক, তিনজন নিরাপত্তা কর্মী এবং দুজন টিকিট বিক্রেতা কেন? সেতু মেরামতির দায়িত্ব পাওয়া ওরেভা গোষ্ঠীর কর্ণধারের নাম দায়ের হওয়া এফআইআর থেকে বাদ গেল কেন? তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে। তাঁকে খুঁজে বের করাটা কি প্রশাসনিক দায়িত্ব বলে নির্ধারিত হবেনা? বিজেপির কোন্ নেতার নির্দেশে দরপত্র ছাড়াই ওরেভা গোষ্ঠীর হাতে মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণের ভার তুলে দেওয়া হয়েছিল, তার অনুসন্ধানও অত্যন্ত জরুরী। এবং অপরিহার্য যে ‘শিক্ষা’কে এই দুর্ঘটনা তুলে ধরছে তা হলো, সর্বভারতীয় স্তরে প্রয়োগ হতে থাকা ‘গুজরাট মডেল’কে বিলকুল বিদায় জানাতে হবে। আর তারজন্য যে এই মডেলের পৃষ্ঠপোষক ও প্রয়োগ কর্তাদের উৎখাতই সর্বাগ্ৰে প্রয়োজন তার উল্লেখ বোধকরি নিষ্প্রোয়জন।
- জয়দীপ মিত্র