যদিও নরেন্দ্র মোদী ভোটমুখী গুজরাটের ভোটারদের বিশাল বিনিয়োগ আর বিপুল উন্নয়নের স্বপ্নের ইন্দ্রজালে সম্মোহিত করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন, মোরবীতে ব্রিটিশ আমলের ঝুলন্ত সেতু ভেঙে কমপক্ষে ১৩৪ জনের মৃত্যুবহু ঢক্কানিনাদিত গুজরাট মডেলের কঙ্কালসার চেহারাটা একেবারে স্পষ্ট করে দিল। মোরবী সেতুর মর্মান্তিক বিপর্যয়ের যে বিশদ ছবি উঠে এসেছে তা খুব জঘন্য ধাঁচের শাসনের দিকেই আঙুল তুলছে — সম্পূর্ণ অদক্ষ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। মোরবীর দেওয়াল ঘড়ি তৈরির কোম্পানি ‘ওরেভা’কে দেওয়া হয়েছিল শতাব্দী-প্রাচীন ঝুলন্ত সেতুটির মেরামতি ও রক্ষণাবক্ষেণের কন্ট্রাক্ট। খবরে প্রকাশ, ঐ কন্ট্রাক্ট যার বৈধতা ছিল ২০৩৭ পর্যন্ত এবং যেটি কোম্পানিটিকে সেতু ব্যবহারকারী জনসাধারণের থেকে অর্থ আদায়ের জন্যে অনুমতি দিয়েছিল, সেটি কোনও প্রকাশ্য টেন্ডার ছাড়াই চূড়ান্ত হয়েছিল। কোম্পানি দাবি করেছিল দু’কোটি টাকা খরচ করে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে সেতু মেরামতির কাজ সম্পূর্ণ করে ফেলেছে। আর শুধু যেন বিপর্যয়কে ডেকে আনার জন্যেই, সেতুটি নির্বাচনের আগে তাড়াহুড়ো করে খুলে দেওয়া হল। সরকারি ভাষ্যে ভেঙে পড়ার কারণ হিসেবে সেতুর ওপর মাত্রাতিরিক্ত ভীড়কে দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে নগদ পয়সা দিয়ে টিকিট কাটার পর মানুষকে সেতুতে উঠতে দেওয়া হয়েছে।
ছ’বছর আগে কলকাতায় যখন একটি নির্মীয়মান ফ্লাইওভারের একাংশ ভেঙে পড়েছিল, সেই বিপর্যয়কে নির্বাচনী ইস্যু বানাতে নরেন্দ্র মোদী এক মুহূর্ত দেরী করেননি। তিনি বলেছিলেন, ঐ বিপর্যয় নাকি পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতিগ্রস্ত অপশাসন থেকে বাঁচানো এবং বিজেপি’কে ক্ষমতায় আনার উদ্দেশ্যে স্বয়ং ভগবানের ‘বার্তা’! এখন কি তিনি মোরবীর সেতু ভেঙে পড়ার ঘটনাকে বিজেপি’র দুর্নীতিগ্রস্ত ক্রোনি শাসন থেকে গুজরাটকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ‘দৈববাণী’ বলে মেনে নেবেন? গুজরাটের বেশিরভাগ বাণিজ্যিক গ্রুপের মতো ‘ওরেভা’ গ্রুপও মোদী-শাহ যুগলের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ এবং সেতু ভেঙে পড়ার পর করা এফআইআর-এ ইতিমধ্যেই কোম্পানিটিকে কেসের চৌহদ্দির বাইরে রাখা হয়েছে। এরপর যেটা হয়, বিপর্যয়ের শিকার মানুষজনকে সামান্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে এবং একেবারে নিচুতলার কয়েকজন কর্মীকে শাস্তি দিয়ে কেসটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এবং প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ইতিমধ্যেই মোরবী সেতু ভেঙে পড়ার ঘটনাটিকে জনপরিসরের চর্চা থেকে মুছে ফেলেছে।
মোদীর নির্বাচনী প্রচারে ‘উন্নয়নের’ স্বপ্ন সবসময়েই বোনা হয় ঘৃণা ও মিথ্যার সুতোয়। গুজরাটে এবার ঘৃণাবর্ষী প্রচারের সরাসরি লক্ষ্য শুধু মুসলিমরাই নন, শহুরে নকশালরাও। আরও একবার নর্মদা নদী প্রকল্পকে গুজরাটের গর্ব ও কল্যাণের সমৃদ্ধ উৎসের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে মোদী মেধা পাটকরকে ‘শহুরে নকশাল’ বলে দোষারোপ করেছেন। মেধা নাকি উচ্ছেদের বিষয়টিকে সামনে এনে উন্নয়নকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন! সংসদে দাঁড়িয়ে ভাষণে মোদী ‘আন্দোলনজীবী’ বলে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন, আর তারই রেশ টেনে সম্প্রতি তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীদের ‘মগজে ঝড় তোলা’ অধিবেশনের ভিডিও কনফারেন্সের ভাষণে কলমজীবী নকশালদের নির্মূল করার প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরলেন। সংবিধান ও বাকস্বাধীনতার সুরক্ষা, ন্যায় ও মানবাধিকার, পরিবেশ রক্ষা, বাস্তুচ্যুত ও অধিকার হারানো মানুষদের পুনর্বাসন — গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গোটা বিষয়টিকেই ‘শহুরে নকশালবাদ’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে ইউএপিএ বা ঐ ধরনের দানবীয় আইন দিয়ে তার ‘মোকাবিলা’ করার জন্য।
যে সরকার জনসাধারণের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ ও আইনের শাসনের নীতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরায় সম্পূর্ণ ব্যর্থতা তথা বিশ্বাসঘাতকতাকে আড়াল করতে এইরকম ফ্যাসিস্ট আক্রমণ লেলিয়ে দেয়, সেখানে বিরোধীদের কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত? এক দশক আগে, ইউপিএ সরকারের শেষের বছরগুলিতে দুর্নীতি ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে গণসংগ্রামের পটভূমিতে দিল্লীতে আম আদমি দলের উত্থান হয়। দিল্লীর সঙ্গে, এই দল এখন পাঞ্জাবেও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত; খবরে প্রকাশ, গুজরাটেও উল্লেখযোগ্য সাড়া ফেলতে পেরেছে। বিলকিস বানোকে যারা ধর্ষণ করেছিল, তার পরিবারের সদস্যদের যারা হত্যা করেছিল, সেই ধর্ষক-খুনীদের দেশের ৭৫তম স্বাধীনতা বার্ষিকীতে মুক্তি দিয়ে বীরের সম্বর্ধনা দেওয়া; হরিয়ানার ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক আগে, ধর্ষণ-অভিযুক্ত কুখ্যাত রাম রহিমকে ৪০ দিনের প্যারোলে মুক্তি দেওয়া-এ সবের বিরুদ্ধে দলটির কী প্রতিক্রিয়া?
ঐ প্রশ্নের একেবারে সুনির্দিষ্ট উত্তর নিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়াল এখন অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি বলছেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির জন্যে ভারতের চাই হিন্দু দেবদেবীদের আশীর্বাদ! আর সেটা পাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় নাকি প্রচলিত ভারতীয় মুদ্রার নোটে সমৃদ্ধির স্বীকৃত দেবী লক্ষ্মী এবং মুস্কিল-আসান সিদ্ধিদাতা জ্ঞানের দেবতা গণেশের ছবি ছাপানো! এই একটা সুপারিশেই কেজরিওয়াল পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে ভগৎ সিং এবং আম্বেদকরের প্রতি মৌখিক শ্রদ্ধা জানালেও তিনি বিজেপি’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তিবাদকে বিদায় জানিয়ে তমসাচ্ছন্ন জ্ঞান-বিরোধী কুসংস্কারকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত! মোদী সরকারকে তার চরম অপদার্থতা এবং বিভাজনমূলক ঘৃণাভরা মতাদর্শের জন্য দায়ী করার পরিবর্তে তিনি অদ্ভুত হাস্যকর ভাবনা ও ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি প্রতিযোগিতামূলক আবেগময় আবেদনের খেলায় নেমে মোদীকে হারাতে চাইছেন! এই রাজনৈতিক লাইনকে কখনও কখনও নরম হিন্দুত্ব বলে অভিহিত করা হয় ও গণ আবেদন ও গ্রহণযোগ্যতার দোহাই দিয়ে তার ওকালতি করার চেষ্টা হয়। শুধু তাই নয়, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধী ও তাঁর ধর্মীয় নানা প্রবচন ও রূপকধর্মী উপমার উদাহরণ টেনে ঐ নরম হিন্দুত্বকে যুক্তিগ্রাহ্য বৈধতা দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়।
রাজনীতিতে এই কৌশল নেওয়ার ব্যাপারে কেজরিওয়াল যে রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রথম, তা মোটেই নয়। কেজরিওয়ালের মত রাজীব গান্ধীও ভারতীয় রাজনীতিতে একটি পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক ভাবমূর্তি নিয়ে উঠে এসেছিলেন। আর সেই সঙ্গে তার ছিল বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে থাকা একবিংশ শতাব্দীর ভারত সম্পর্কে এক বিচক্ষণ দূরদর্শী ভাবনা। ১৯৮৪-তে তিনি, ভারতে আজ পর্যন্ত বৃহত্তম সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্পন্ন একটি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেন। বিজেপি’র সেই সময়ে লোকসভায় আসন সংখ্যা কমে হয় মাত্র দুই। কিন্তু এখন তাকে মনে পড়ে কার্যত বিজেপি’র একজন উৎসাহদাতা হিসেবেই — প্রথমত শাহ বানো রায়ে তার অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ এবং তারপর অযোধ্যায় তার মধ্যপন্থী ভূমিকা। এমনকি এখনও কিছু কংগ্রেস নেতা রাজীব গান্ধীকে অযোধ্যায় রাম মন্দিরের আসল স্থপতি বলে দাবিও করে থাকেন! হিন্দুত্বের মল্লভূমে নেমে কেজরিওয়ালের মোদীকে পরাস্ত করার চেষ্টা — ঐ একই পরিণতি তার জন্যেও ডেকে আনবে।
আসলে বিজেপি’র নির্বাচনী সাফল্যের কারণ ‘ধর্মভীরুতার প্রতি আবেদন’ নয়। ঘৃণাভরা মুসলিমবিরোধী উন্মত্ততায় মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার আর এই সংখ্যাগুরুবাদকে ‘জাতীয়তাবাদ’ বলে দাবি করার ক্ষমতাই হল বিজেপি’র ঐ সাফল্যের চাবিকাঠি! আর এই ঘৃণা ও আগ্রাসনের চোখে চোখ রেখে লড়ে তাকে পরাস্ত করতে পারে সামাজিক ও মতাদর্শগত প্রতিস্পর্ধী এক চূড়ান্ত সমাবেশ; ঐ ঘৃণাকে, প্রতিযোগিতা বা সহযোগিতার মাধ্যমে বৈধতা দিয়ে নয়! অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির জন্য নোটের ওপর ধর্মীয় প্রতীক ছড়িয়ে দেওয়া, তাও আবার পিছনের দেওয়ালে আধুনিক ভারতের মহত্তম দুই স্বপ্নদ্রষ্টার ছবি ঝুলিয়ে — আধুনিক ভারতের ব্রতের প্রতি অতীতের কেজরিওয়ালের বিশ্বাসঘাতকতার মুহূর্ত হিসেবেই মানুষের মনে থাকবে!
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয় ১ নভেম্বর ২০২২)