প্রতিবেদন
২৭তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন প্রসঙ্গে
World Climate Conference

এই প্রতিবেদন রচনাকালে নভেম্বরের ৬ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, মিশরের পর্যটন নগরী শার্ম এলশেখে। এটি ২৭তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। প্রথমবার ১৯৯৫ সালে জার্মানির বার্লিন শহরে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতিবছর সাধারণত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এটি হয়ে থাকে। এর আগের ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনটি হয়েছিল ২০২১ সালের নভেম্বরে, স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে।

এই সম্মেলনের মূল কাজ হল বিশ্ব উষ্ণায়ন (গ্লোবাল ওয়ার্মিং) এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য সঙ্কটগুলির মোকাবিলা করার ব্যাপারে ১৯৭টি দেশ ও অঞ্চলকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করা। প্রতিটি জলবায়ু সম্মেলনেই কিছু না কিছু নতুন বিষয় সামনে আসে। অতীতের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনগুলিতে সবমিলিয়ে প্রায় গোটা চব্বিশেক গুরুত্বপূর্ণবিষয় আলোচিত হয়েছে। প্রথম দিকে এই সম্মেলনগুলিতে আলোচনার মূল বিষয় ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের ধারাকে থামিয়ে বা কমিয়ে দেওয়া বা প্রশমন (মিটিগেশন) করার উপায়। কিন্তু দ্বিতীয় দশকে এসে আইপিসিসি চতুর্থ মূল্যায়ন রিপোর্ট পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিল যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় শুধু প্রশমন প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। এরপর থেকে আলোচনায় প্রশমনের পাশাপাশি গুরুত্ব পেল জলবায়ু অভিযোজন (অ্যাডাপটেশন)।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের নানা দেশই কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনার ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্যোগী হচ্ছে না। বিশেষ করে উন্নত বা সম্পদশালী দেশগুলো এ’ব্যাপারে তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। আবার উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেকেই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ঠিকমতো অভিযোজন করতে পারছে না। মূলত সম্পদের স্বল্পতা এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার এও দেখা যাচ্ছে যে পর্যাপ্ত পরিমাণে অভিযোজনের দিকে না এগনোয় কিছু অভিযোজন করার পরও তারা বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত সম্পদশালী দেশগুলোর জোট জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতির শিকার দেশগুলোর অভিযোজনের জন্য এর আগে অ্যাডাপটেশন ফান্ড, গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড ইত্যাদি নামে তহবিল তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে ধনী দেশগুলো প্রতিশ্রুত অর্থের খুব সামান্যই দিয়েছে বিভিন্ন জলবায়ু তহবিলে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ থেকে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতিকে লস অ্যান্ড ড্যামেজ বলা হয়। যেমন ঘূর্ণিঝড়, খরা, তাপপ্রবাহ, মরুকরণ, লবণাক্ততা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি। সরাসরি অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও অর্থনীতি বহির্ভূত ক্ষয়ক্ষতি, যেমন পরিবেশ বা প্রতিবেশের ক্ষতি, স্বাস্থ্য বা জীবনহানি, বাস্তুচ্যুতির কারণে সামাজিক ও মানসিক ক্ষতি — এসবই লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডের মধ্যে পড়ে। ফেব্রুয়ারি ২০২২এ প্রকাশিত আইপিসিসি’র ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা ক্রমেই বেড়েছে। ফলে ধীরগতির দুর্যোগ, যেমন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, মরুকরণ ইত্যাদিও বাড়বে। কৃষি, বনায়ন, মৎস্য, পর্যটনসহ বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো, সম্পদ ও সরবরাহব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অর্থনৈতিক ও অর্থনীতি বহির্ভূত ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে। উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন, জীবিকা ও খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে বাস্তুচ্যুতি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হবে।

লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিংয়ের আওতায় প্রাপ্ত অর্থদিয়ে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর মতামতের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করলে জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতিকে মোকাবিলা করা সহজ হবে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষকদের জন্য বিরূপ আবহাওয়ার ক্ষতি মোকাবিলায় শস্যবিমা, দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিকাঠামো পুনর্নির্মাণ, জীবিকা পুনরুদ্ধার, ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ সহায়তা ইত্যাদি সবই সম্ভব হবে লস অ্যান্ড ড্যামেজের ফান্ড থেকে। এমনকি এই লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড থেকে স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসন এবং নতুন জীবিকা অনুসন্ধানে সহায়তা করা যাবে।

বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করেই ২০০৭ সালে ১৩তম জলবায়ু সম্মেলনে বালি কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে লস অ্যান্ড ড্যামেজ আনুষ্ঠানিক আলোচনায় আসে। পরে ২০১০ সালে ১৬তম জলবায়ু আলোচনায় লস অ্যান্ড ড্যামেজের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে দোহায় ১৮তম জলবায়ু আলোচনায় ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় লস অ্যান্ড ড্যামেজের অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং সক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য আলোচনা হয়। তবে সত্যিকারের উদ্যোগটি ঘটে ২০১৩ সালের জলবায়ু আলোচনায়। সেখানে সব পক্ষ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা কমিয়ে আনা এবং বন্ধ করার জন্য ওয়ারশ ইন্টারন্যাশনাল মেকানিজম (ডব্লিউআইএম) ফর লস অ্যান্ড ড্যামেজ নামক একটি ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে একমত হয়। আর ২০১৫ সালে ১৯তম জলবায়ু আলোচনায় প্যারিস চুক্তির আর্টিকেল ৮এ লস অ্যান্ড ড্যামেজের আওতায় ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে পরিকল্পনার একটি কার্যকর ধারণা দিয়েছে। আমরাও অনেক আশাবাদী হয়ে উঠলাম। তবে পরের জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে কার্বন উদ্‌গিরণের জন্য দায়ী ধনী এবং সম্পদশালী দেশগুলো ক্ষয়ক্ষতির ঐতিহাসিক দায় তাদের ঘাড়ে আসতে পারে ভেবে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিংয়ের আলোচনা আর বেশি দূর এগোতে দেয়নি।

লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিংয়ের বিষয়ে এযাবৎ দৃশ্যমান বড় কোনো অগ্রগতি না হলেও এই ইস্যু চলমান ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হবে। লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিংকে একটি সুনির্দিষ্ট আলোচ্যসূচি হিসেবে গ্রহণ করার জন্য ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্কের উদ্যোগে ৪০০’র বেশি সংগঠন গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে। এই সমস্ত দাবির কতটা পূরণ হয় ও এই সম্মেলন থেকে জলবায়ু সঙ্কটের সমাধানে কোন দিশা উঠে আসে, তাই নিয়ে পরিবেশবিদ থেকে সাধারণ মানুষের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে।

- সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-29
সংখ্যা-43