বর্তমান সময় বিশ্বের সর্বত্র গিগ ইকোনমির বৃদ্ধি ঘটছে। রাইড শেয়ারিং, ই-কমার্স, অনলাইন মার্কেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অ্যাপভিত্তিক নানা কাজে যুক্ত হচ্ছেন দেশের তরুণরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে গিগ অর্থনীতির দিক থেকে ভারত এবং বাংলাদেশের অবস্থান উল্লেখযোগ্য। প্রযুক্তির ব্যাবহার, স্বল্প সময়ে পরিষেবা পাওয়ার অভ্যাস, জীবনযাত্রার গতির বৃদ্ধি মানবসভ্যতাকে যন্ত্র নির্ভরশীল করে তুলছে। এই সমস্ত কিছুর অন্তরালে অবিরত পরিশ্রম করা কর্মচারীদের জীবন-জীবিকা-ভবিষ্যৎ নিয়ে সমাজ তথা সরকার উদাসীন। এমতাবস্থায়, সাম্প্রতিককালে নিউজিল্যান্ডে বিশ্বখ্যাত কোম্পানি উবের বনাম চার কর্মচারীর মামলার রায় এক নয়া মোড় সৃষ্টি করেছে।
জুলিয়ান আং, নুরেদ্দিন আব্দুরহমান, প্রাফুল বিল রামা এবং মে’ওল কেইল — চারজন ইটিউ এবং ফার্স্ট ইউনিয়নের মাধ্যমে উবের কোম্পানিকে আদালতে নিয়ে গিয়েছিলেন ঠিকাকর্মীর বদলে কর্মচারী হিসেবে সম্পূর্ণ পরিচয় লাভের জন্য। দেশের কর্মসংস্থান আদালত এই চারজন কর্মচারীর পক্ষে যুগান্তকারী রায় দেয়, যে তারা কোম্পানির কর্মচারী এবং স্বাধীন ঠিকাদার নয়। চালকরা নিজস্ব ব্যবসা চালাচ্ছেন না এবং তারা কার্যকরভাবে উবেরের কর্মচারী হিসেবেই কাজ করছেন বলেই রায় দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ক্রিস্টিনা ইঙ্গলিস। তার মতে, “উবারই একমাত্র দল যে ব্যবসা চালাচ্ছে। এই কোম্পানিই, বিপনন, মুল্য নির্ধারণ, রাইডার, রেস্তোরাঁ এবং ভোজনকারীদের দেওয়া পরিষেবার শর্তাবলী ও প্রকৃতি নির্ধারণের দায়িত্বে রয়েছে।” উবের কোম্পানি এই রায়ের বিরুদ্ধে অবিলম্বে অ্যাপিল করবে বলে ঘোষণা করেছে, যা নিউজিল্যান্ডের কর্মসংস্থান আইনের অধীনে চালকের ন্যূনতম মজুরি, কাজের সময়, ছুটির বেতন, অসুস্থ অবস্থায় ছুটি, অন্যায্য বরখাস্তকে চ্যালেঞ্জ করার অধিকারের বিরুদ্ধে।
ভারতবর্ষে করোনাকালীন সময়ে চাকরির বাজার যত সঙ্কুচিত হয়েছে ততই মানুষের পেটের দায়ে ও কাজের খোঁজে গিগ কাজের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কাজের ক্ষেত্রে, শিক্ষাগত যোগ্যতার মানদণ্ড খুবই স্বল্প। জানতে হয় অ্যানড্রয়েড ফোনের ব্যবহার। এই কাজের পরিসর যত বড়, ততটাই অধিক সংখ্যায় তৈরি হচ্ছে সস্তার শ্রমিক। একাধিক সময়, সুইগি-জোম্যাটো-উবের তথা অন্যান্য কোম্পানির কর্মচারীদের কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন অসুবিধা নিয়ে সরব হতে দেখা গিয়েছে। গিগ ওয়ার্কারদের কোম্পানির কর্মচারীর পরিচয় দেওয়া হয় না। তাদেরকে ফ্রিলান্সার হিসেবে কাজে নিযুক্ত করা হয়। পুঁজির সঞ্চয়ন ও মুনাফা বৃদ্ধির হারকে বজায় রাখতে সারপ্লাস ভ্যালু বা উদবৃত্ত মূল্যকে ক্রমাগত বাড়িয়ে চলতেই হয়। পারিবারিক যূথবদ্ধতাকে গ্রাস করে পুঁজি। কম খরচে বেশি পরিমাণ শ্রমিক তৈরির ছকে আসে প্রযুক্তি। কোনো কারখানা স্থাপন ছাড়া, নতুন পণ্য উৎপাদন ছাড়াও কেবল মাত্র প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধম্যে অ্যাপনির্ভর মার্কেটিং ও সার্ভিসে বিপুল বেকার বাহিনীকে মুষ্টিমেয় মজুরির বিনিময়ে চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ প্রদান করা হচ্ছে।
পুঁজির বিকাশের যুগে স্থায়ী ও ঠিকা শ্রমিক এবং কায়িক ও মানসিক শ্রমের বিভাজন তো ছিলই। উদার অর্থনীতির যুগে কল-কারখানা, শিল্পসংস্থা নানান জায়গায় ছোট ছোট আকারে ছড়িয়ে পড়ায় উদ্ভব হল পরিযায়ী শ্রমিকদের। তবুও এই অংশের একটা শ্রমিক পরিচয় (আইডেন্টিটি অফ লেবার) ছিল কোন-না-কোন উৎপাদনের সাথে যুক্ত থাকার কারণে। কিন্তু গিগ ওয়ার্কাররা উৎপাদনের জগতে সরাসরি যুক্ত না থাকায় শ্রমিক পরিচয় ঘুচিয়ে কেবলমাত্র কর্মীবাহিনী হিসেবে চিহ্নিত হল। শ্রমিক নয় বলেই তাদের জন্য শ্রমকোডের কোন বালাই নেই; নেই সংগঠন করার অধিকার। কাজের নিশ্চয়তা ও চাকরি শেষে আর্থিক নিরাপত্তা — এইসব প্রশ্ন তোলা মানা। বরং প্রযুক্তির সাহায্যে সার্ভিলেন্সের মাধ্যমে এইসব কর্মীদের কাজের ওপর নজরদারি বাড়ানো হল। ঠিক সময়ে গরমাগরম খাবার খদ্দেরদের কাছে পৌঁছেছে কিনা, সঠিক সময়ে যাত্রীকে গাড়িতে তোলা — নামানো হচ্ছে কিনা, ইত্যাদি সব অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইল বা কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠতে লাগল। নিরাপত্তাহীনতা তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
কার্ল মার্ক্স পুঁজির নিজস্ব দ্বন্দ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণদিক তুলে আনার সময় বলেছিলেন, “শ্রমিক সংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধি পুঁজির সঞ্চয়নের প্রয়োজনকে মেটাতে পারে না, অথচ এ সংখ্যা সবসময় সেই প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত, এটাই হলো পুঁজির গতিবিধির সহজাত দ্বন্দ্ব। পুঁজি চায় অধিকতর সংখ্যায় যুবক শ্রমিক, স্বল্পতর বয়স্ক শ্রমিক। পুঁজির দ্বারা শ্রমশক্তির ব্যবহার এত দ্রুত যে, জীবনের অর্ধেক পার হলেই শ্রমিক প্রায় তার গোটা জীবনীশক্তিকে নিঃশেষ করে ফেলে। ফলে সে ওই অতিরিক্তদের দলে পড়ে যায়।”
আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ভারতের গিগ অর্থনীতি প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে যেখানে প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান এই গিগ অর্থনীতিতে হচ্ছে, তা বেড়ে হবে ২.৪০ কোটি। আর আগামী আট থেকে দশ বছরের মধ্যেই প্রায় নয় কোটি মানুষ এই অর্থনীতির মধ্যেই কর্মসংস্থান পাবেন, কারণ মূলধারার অর্থনীতি আরও সঙ্কুচিত হবে ও সুরক্ষিত কর্মসংস্থান অতীতের বস্তুতে পরিণত হবে। ভারতের ক্ষেত্রেও ৪৮ শতাংশ গিগ কর্মী হল ১৯-২৫ বছর বয়সী নবীন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা, যাদের কাছে স্থায়ী চাকরির সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। আর এইক্ষেত্রে মহিলাদের সংখ্যা ২৮ শতাংশের আশেপাশে। যে সুদূর ভবিষ্যতের দিকে আমরা এগিয়ে চলেছি, তাতে শরীর-স্বাস্থ্যর তোয়াক্কা না করে কেবল দৌড়তে হবে। নাহলে পেটের দায়ে থেমে যাবে জীবনের স্পন্দন, মানবস্পন্দনকে কি চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে এনে ফেলছে এই গিগ ইকোনমি।
সরকার বারবার করে বলে চলেছে — গিগ প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক কর্মচারীদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। চারটি শ্রম কোডের মধ্যে ‘সামাজিক সুরক্ষা আইন ২০২০’তে গিগ ওয়ার্কারদের সুরক্ষার নিদান দেওয়া আছে, যদিও তার নির্দেশনামার বাস্তব রূপরেখাই বানানো হয়নি। বিশ্বব্যাপী যে ঘৃণ্য পরিকল্পনা চলছে তার বিরুধে দাঁড়িয়ে নিউজিল্যান্ডের ঘটনা মার্কনির্দেশক। শ্রমিকের শ্রেণীর পরিচয় মুছে ফেলার যে চেষ্টা ক্রমাগতভাবে পুঁজিবাদী সংস্থাগুলি করে চলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিকতা মজবুত হয়ে উঠবে। আজকে সমস্ত ঠিকা, পরিযায়ী ও প্ল্যাটফর্ম জগতের কর্মীদের নিয়ে সংগঠিত লড়াই গড়ে তুলতে হবে।
- অন্যন্যা