২০ নভেম্বর ২০২২ থেকে কাতারে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বিশ্বের বৃহত্তম ক্রীড়া কর্মকান্ড — বিশ্বকাপ ফুটবল। এই প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ফুটবল বিশ্বকাপ, আর তারজন্য নির্মিত হয়েছে আটখানা পেল্লাই স্টেডিয়াম। চোখ ধাঁধানো ঝলমলে এই সমস্ত অনবদ্য বিস্ময়কর স্থাপত্য কাতারের যাযাবর অতীত, সেই দেশের সংস্কৃতি ও জীবন যাপনকে প্রতিবিম্বিত করেছে — ৬০,০০০ আসন বিশিষ্ঠ অল বায়ত স্টেডিয়াম, যেখানে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী পর্ব, সেটি হল আরেকটি বিস্ময়কর সৃষ্টি, যা গড়ে তোলা হয়েছে সেই দেশের যাযাবরদের তাঁবুর ধাঁচে।
অঢেল অর্থ বিনিয়োগে যেন রূপকথার স্বপ্নপুরিতে জেগে উঠেছে এই মরু প্রান্তর। কিন্তু, এই বিশাল বিত্ত বৈভব, মায়াবি রাজ্যে জেগে ওঠা কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের গোটা কর্মকান্ডের নেপথ্যে যে অমানবিক শোষণ, নিপীড়ন ও বর্বর বঞ্চনার মর্মান্তিক কাহিনী চাপা পড়ে রয়েছে, তাকে দিনের আলোয় উদঘাটিত করল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক অন্তর্তদন্ত। এই গোটা কর্মকান্ডে নিয়োজিত ভারতের যে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকরা সেখানে কাজ করতে গিয়েছিলেন, যাদের ঘাম-রক্তের বিনিময়ে নির্মিত হয়েছে সেই সমস্ত অলৌকিক স্থাপত্য, তাঁদের মধ্যে অনেকেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। এক কানাকড়িও ক্ষতিপূরণ তাঁরা পাননি। ঘিঞ্জি অস্বাস্থ্যকর ঝুপড়িতে, প্রচন্ড তাপপ্রবাহে, ৫০ ডিগ্রির উপর তাপমাত্রায়, তাঁদের কাজ করতে হতো দীর্ঘদীর্ঘ সময় ধরে। চরম ঝুঁকি নিয়ে নির্মাণ কাজে কর্মরত অবস্থায় অনেকের প্রাণহানি ঘটেছে। অত্যন্ত প্রতিকূল আবহাওয়া ও পরিবেশে অমানুষিক পরিশ্রম করতে গিয়ে মারা গেছেন আরও বেশ কয়েকজন।
এদিকে পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রলুব্ধ করতে কত রঙিন স্বপ্ন, কত লোভনীয় কাজের শর্তাবলি ফেরি করেছিল কাতারের সেই কোম্পানি, যারা বিশ্বকাপ ফুটবলে নির্মাণ কাজের বরাত পেয়েছিল। কী কী দেবার কথা তারা বলেছিল?
আট ঘন্টার শিফট, কাজের চাপ থাকলে দু’ঘন্টার ওভারটাইম, নিয়মিত কাজের দিনগুলোতে নির্ধারিত শ্রমঘন্টার বেশি কাজ করলে মজুরির ১২৫ শতাংশ দেওয়া হবে, আর সপ্তাহ শেষে ১৫০ শতাংশ। মেডিকাল কার্ড সহ যাতায়াত ও থাকার খাওয়ার নিশ্চিত ব্যবস্থা। প্রথম দু’বছরে ২১ দিনের সবেতন ছুটি যা তারপর দ্বিগুণ করা হবে। দু’বছরের শেষে দোহা থেকে সেই শ্রমিকের যেখানে বাসস্থান, তার নিকটস্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত ফেরার বিমান টিকিট। যে মজুরি দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, তা হল ১২,০০০ কাতারি রিয়াল বা প্রায় ২৭,০০০ টাকা। যারা যারা ওই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন তারা প্রায় প্রত্যেকেই ভারতের গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দা, গ্রামে কাজের অভাবে বেকারত্বের জ্বালায় ভিন্ দেশে পাড়ি দিয়েছেন কাজের সন্ধানে।
কিন্তু কাজের শেষে যারাদেশে ফিরে এসেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা তিক্ত। প্রবঞ্চনাময় ওই চুক্তির কোন শর্তই মানেনি কন্ট্রাক্টর সংস্থাটি। কর্মরত অবস্থায় বা কাতারে থাকাকালীন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ বা বিমার প্রশ্নে পুরোপুরি নীরব ওই সংস্থাগুলো। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বিশ্বকাপ ফুটবল সংগঠিত করতে যে সংস্থাটি দায়বদ্ধ, সেই সুপ্রিম কমিটি ফর ডেলিভারি অ্যান্ড লিগাসি প্রায় তিন বছর আগেই নিয়োগকর্তাদের জানায় সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য জীবন বিমা করতে হবে, মৃত্যু হলে কোথায় ও কী কারণে তা হয়েছে তা বাছবিচার না করে তাঁদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ যেন সুনিশ্চিত করা হয়।
কিন্তু, দেখা গেল, ওই মরু প্রান্তরকে আন্তর্জাতিক ফুটবল কেন্দ্রে রূপান্তরিত করার পর বিহার, পাঞ্জাব, তেলেঙ্গানা থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা গ্রামে ফিরে এলেন, অনেকেই শেষ পর্যন্ত কফিন বন্দি হয়ে! আট মাস ধরে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এই পরিঘটনার অন্তর্তদন্ত করতে গিয়ে ঘাঁটাঘাটি করেছে সরকারি নথি, সাক্ষাৎকার নিয়েছে কন্ট্রাক্টরদের যারা সেখানে শ্রমিকদের নিয়োগ করেছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের কল্যাণে যারা কাজ করেন সেই সংস্থাগুলোর, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন স্তরের সরকারি আধিকারিকদের সাথে। তথ্য জানার অধিকার আইন প্রয়োগ করে সেই সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারগুলোর সাথে যোগাযোগ করেন, যারা কাতারে কর্মরত অবস্থায় মারা যান। পত্রিকার পক্ষ থেকে এমন ৯টি পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হয়, কয়েকটি পরিবারের সাথে তাঁদের ঘরে গিয়ে। সাংবাদিকরা সেখানে প্রত্যক্ষ করেছেন, সেই পরিবারগুলোর অবর্ণনীয় দারিদ্র, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুর পর গোটা পরিবার ডুবে গেছে চরম আর্থিক সংকটে। তাঁদের প্রত্যেকের একটা সাধারণ অভিযোগ — কর্মরত অবস্থায় যাদের মৃত্যু হয়েছে, নিয়োগকর্তারা তাঁদের পরিবারকে দেয়নি এক কানাকড়িও ক্ষতিপূরণ। এই ৯ জন শ্রমিকের মধ্যে তিনজনের বয়স ৩০’এর নিচে, তারমধ্যে একজনের বয়স তো মাত্র ২২, ছ’জনের বয়স ৫০’এর কম। যারা যারা মারা গেছেন, তাঁদের কোন শারীরিক অসুস্থতা ছিলনা, আর সেই শংসাপত্র কাজে যোগ দেওয়ার সময় নিয়োগকর্তার কাছে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু নিয়োগকর্তা এই সমস্ত মৃত্যুকে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বলে ঘোষণা করে, দেয়নি কোন ক্ষতিপূরণ। মৃত্যুর খবরও পরিবারকে দেওয়া হয়নি। পরিবারগুলো তাঁদের আপনজনের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছেন পরিচিত মানুষদের কাছ থেকে যারা সেখানে কাজ করতে গেছিলেন।
“আমার স্বামীর মৃত্যু সংবাদ ওখানকার নিয়োগকর্তার কাছ থেকে আমি পাইনি”, বলেন সবিতা কুমার, যার স্বামী অখিলেশ বিহারের সিওয়ানে সাল্লাপুর গ্রামের বাসিন্দা। “আমরা তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়েছি আমাদেরই গ্রামের এক পারিবারিক বন্ধু মারফত, যার এক নিকট পরিচিত কাতারে কর্মরত”। দোহার সন্নিকটে ভূগর্ভস্থ এক পাইপ লাগানোর সময় আচমকা ধ্বস নামে, আর অখিলেশ মাটি চাপা পড়ে মারা যায়। অখিলেশের সাথে সেই দিনেই একই জায়গায় মারা যান আরেকজন শ্রমিক, ৩২ বছরের জগন সুরুকান্তি, তেলেঙ্গানার মল্লারপুর গ্রামের বাসিন্দা। ক্রন্দনরত অবস্থায় তাঁর পিতা রাজা রেড্ডি (৫৯) বলেন, “সম্পূর্ণ সুস্থ শরীর নিয়ে আমার ছেলে সেখানে কাজ করতে গেছিল। কিন্তু ফিরে এল তাঁর দেহ, বাক্সবন্দি হয়ে।”
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ন’টি নিয়োগকর্তার মধ্যে আটজনের হদিশ পায়। মৃতের পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে সাতজন কোন উত্তর দেয়নি। আরেকজনকে ই-মেল বা ফোনে ধরতে পারা যায়নি। এদিকে, কাতারের সরকারি সংস্থা, সুপ্রিম কমিটি ফর ডেলিভারি অ্যান্ড লেগ্যাসি, যাদের উপর এই বিশ্বকাপ ফুটবল সংগঠিত করার ভার পড়েছে, তাঁরা জানিয়েছে, “এই গোটা কর্মকান্ডে সারা পৃথিবী থেকে আগত কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে মাত্র তিনজনের মৃত্যু হয়েছে কাজ করতে গিয়ে, আর ৩৭ জন শ্রমিক মারা গেছেন অন্যান্য কারণে — সরাসরি কাজের সাথে যার নেই কোনও সম্পর্ক।”
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাতারে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের কাছে তথ্য জানার অধিকার আইনের ভিত্তিতে জানতে চায়, কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল দায়িত্ব পাওয়া থেকে সেখানে যে সমস্ত কর্মকাণ্ড শুরু হয়, তাতে কতজন ভারতীয় শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। ভারতীয় দূতাবাস মে ২০২২-এ লিখিত উত্তরে জানায়, “দোহায় ভারতীয় দূতাবাসের কাছে এই সংক্রান্ত কোনও তথ্য নেই”।
যে ন’জন শ্রমিক বা তাঁদের পরিবারের সাথে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস যোগাযোগ করতে পেরেছিল, তাঁদের নাম সহ পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে ভারতীয় দূতাবাসের কাছে এক প্রশ্নপত্র পাঠানো হয় পত্রিকার পক্ষ থেকে। কিন্তু তার কোনও উত্তর দেয়নি।
বিশ্বকাপ ফুটবলের আন্তর্জাতিক গভর্নিং বডি ফিফা’র কাছে উক্ত ন’জন মৃত শ্রমিকের বিস্তারিত তথ্য পাঠিয়ে মতামত চাইলে তারাও নীরব থাকে। পরে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস গত মে মাসে এক সংবাদ মারফত জানায়, ফিফার সভাপতি গিয়ানি ইনফান্টিনো নাকি বলেছেন, এই গোটা নির্মাণপর্বে মাত্র তিনজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
লোকসভার রেকর্ড দেখাচ্ছে, গত তিন বছরে, ২০২০ থেকে ২০২২’র জুলাই পর্যন্ত ভারত থেকে কাতারে মোট ৭২,১১৪ জন শ্রমিক গেছিলেন। আর, বিদেশ মন্ত্রকের পেশ করা তথ্য হল, ২০১১ থেকে ২০২২’র মে পর্যন্ত ৩,৩১৩ জন ভারতীয় নাগরিক কাতারে প্রাণ হারিয়েছেন।
হিউমান রাইটস্ ওয়াচ রিপোর্টের মতে, কাতারের শ্রমকানুন এমনই যে একমাত্র কর্মস্থলে বা কাজ করার সময়ে মৃত্যু হলে পরিবারগুলো ক্ষতিপূরণ পাবে। আর, পরিবারগুলোর পক্ষে তা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যায়। ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’র ক্ষেত্রে পোস্ট মর্টেম করার প্রয়োজন হয় না। তাই প্রায় সব মৃত্যুর ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তারা জানিয়েছে, ‘হৃদরোগে মৃত্যু’ হয়েছে, আর শুধুমাত্র বকেয়া মজুরি পরিবারের কাছে পাঠিয়েই হাত ধুয়ে ফেলেছে। অবাক করার বিষয় হল, সেখানে সরকার বা অন্য কোনও স্বাধীন নিরপেক্ষ সংস্থা/ সামাজিক সংগঠনের তরফ থেকে এমন কোনও তদন্ত অনুসন্ধান হল না যে কেন এতোগুলো মানুষ ‘হৃদরোগ’ বা ‘স্বাভাবিক কারণে’ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে।
বারবার ফিরে ফিরে আসে এই একই মর্মান্তিক অধ্যায়। বঞ্চনা, উপেক্ষা, প্রবঞ্চনার অমানবিক কাহিনী। আর, উপরে বর্ণিত রিপোর্ট থেকেই দেখা যাচ্ছে, এই সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রশ্নে ভারতীয় দূতাবাস থেকে শুরু করে সমস্ত প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফা, ওই দেশের সরকার কি হিমশীতল সহানুভূতিহীন অসংবেদি মনোভাব পোষণ করে চলছে। অতীতে ভারতে অনুষ্ঠিত এশিয়াডের সময়েও নির্মাণকান্ডের সাথে যুক্ত শ্রমিকদের অশেষ যন্ত্রণা, বঞ্চনার মর্মন্তুদ কাহিনী সামনে আসে। কিন্তু, ক্রীড়া অনুষ্ঠান সাঙ্গ হয়, অপূর্ব সমস্ত নির্মাণকল্প থেকে যায় অন্তরালে অস্ফুট আর্তনাদের বোবা কান্না নিয়ে!
- অতনু চক্রবর্তী