ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরি নির্ণায়নের চারটি ক্ষেত্রীয় মাপকাঠি রয়েছে। এই চারটি ক্ষেত্র হল কৃষিক্ষেত্র, উদ্যানপালন ক্ষেত্র, নির্মাণশিল্প ক্ষেত্র এবং অন্যান্য অকৃষি ক্ষেত্র। রিজার্ভব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একমাত্র উদ্যানপালন ক্ষেত্র ছাড়া বাকি তিন ক্ষেত্রীয় মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক কম।
সম্প্রতি ‘Handbook of Statistics on Indian States, ২০২০-২১’ নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে রিজার্ভব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। রিপোর্টে শেষ আর্থিক বছর ২০২০-২১ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণের উপর বিশদ পরিসংখ্যান দেওয়া আছে। সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০- ২১ আর্থিক বছরে উদ্যানপালনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ হল ৩৩৫.৭০ টাকা৷ যা জাতীয় গড় ৩০৯.১০ টাকার তুলনায় বেশ কিছুটা বেশি। ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ছিল ৩৩৯.১০ টাকা। অর্থাৎ ২০২০-২১ আর্থিক বছরে জাতীয় গড়ের থেকে এগিয়ে থাকলেও পরিমাণটি এর আগের আর্থিক বছরের তুলনায় কমেছে।
২০২০-২১ আর্থিক বছরে কৃষি ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ হল ২৮৮.৬০ টাকা৷ যা জাতীয় গড় ৩০৯.৯০ টাকার তুলনায় বেশ কিছুটা কম। যদিও ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে দৈনিক মজুরির পরিমাণ ছিল ২৬৭.৫০ টাকা। এইক্ষেত্রে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বামশাসিত রাজ্য কেরালাতে, যেখানে দৈনিক মজুরির পরিমাণ হল ৭০৬.৫০ টাকা।
নির্মাণশিল্পর ক্ষেত্রে ২০২০-২১ আর্থিক বছরে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ হল ৩০০.২০ টাকা৷ যা জাতীয় গড় ৩৪০.৭০ টাকার তুলনায় বেশ কিছুটা কম। যদিও এই ক্ষেত্রে দৈনিক মজুরির পরিমাণ এর আগের ২০১৯-২০ আর্থিক বছরের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে দৈনিক মজুরির পরিমাণ ছিল ২৯০.৫০ টাকা। এইক্ষেত্রেও গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি কেরালাতে৷ যেখানে দৈনিক মজুরির পরিমাণ হল ৮২৯.৭০ টাকা।
অন্যান্য অকৃষি ক্ষেত্রে ২০২০-২১ আর্থিক বছরে পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ ৩০৫.৮০ টাকা৷ যা জাতীয় গড় ৩১৫.৩০ টাকার তুলনায় কিছুটা কম। যদিও ২০২০-২১ আর্থিক বছরে এই ক্ষেত্রে দৈনিক মজুরির পরিমাণ এর আগের ২০১৯-২০ আর্থিক বছরের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। ২০১৯- ২০ আর্থিক বছরে দৈনিক মজুরি ছিল ২৯১.১০ টাকা। অন্যান্য অকৃষি ক্ষেত্রেও গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি কেরালাতে ৬৭৭.৬০ টাকা।
এই প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও তাঁদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। অর্থনীতিবিদ কুণাল বোস বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রতি কৃষিজমির মালিকদের হাতে জমির পরিমাণ এতটাই কম, চাষ করে কৃষি শ্রমিকদের বেতন দেবার মতো পর্যাপ্ত টাকা তাঁদের হাতে থাকে না। ঠিক সেই কারণেই এই রাজ্যে কৃষি শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি এত কম। আর ঠিক একই কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ ঠিক করে হচ্ছে না। তাই অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন অকৃষি ক্ষেত্র এবং নির্মাণশিল্প ক্ষেত্রেও গ্রামীণ বাংলায় দৈনিক মজুরি কম। রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতির পক্ষে যা খুবই উদ্বেগজনক বিষয়৷’’
অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ নীলাঞ্জন দে বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বিশেষভাবে সচেষ্ট হতে হবে যাতে গ্রামীণ বাংলার এই বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি, জাতীয় গড়ের অন্তত কিছুটা কাছাকাছি আনা যায়। কৃষি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে সরকার এর আগে যথেষ্ট সচেষ্ট হয়নি। এটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কয়েক বছরের মধ্যেই এর সুফল আমরা দেখতে পাই৷’’
প্রাক্তন সাংবাদিক এবং অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ শান্তনু সান্যাল বলেন, ‘‘কৃষি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে যেটা প্রাথমিক দরকার সেটা হল সরকারের নিয়মিত তদারকি। সেই নিয়মিত তদারকি না থাকলে ন্যূনতম মজুরিও নিশ্চিত হবে না৷ সেইসঙ্গে কৃষি শ্রমিকদের জীবনের মানোন্নয়ন না হলে কৃষির উন্নতি হবেনা এবং বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশও হবে না৷’’
(এই লেখাটির পরিসংখ্যানগুলি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট ও প্রতিবেদন থেকে নেওয়া।)