- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
২০২৪’র সাধারণ নির্বাচনের আর যখন দু’বছরও বাকি নেই এবং অর্থনীতির যখন উত্তরোত্তর অবনমন ঘটছে, মোদী সরকার তখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নন্দ ঘোষ বানানোর পরীক্ষিত ও নির্ভরযোগ্য কৌশলকে মরিয়াভাবে কাজে লাগিয়ে সাধারণ ভারতবাসীর সামনে থাকা জ্বলন্ত ইস্যুগুলো থেকে জনগণের দৃষ্টিকে ঘোরাতে চাইছে — যে ইস্যুগুলো হলো পণ্যের মূল্যস্ফীতি, কাজের লোপ পাওয়া এবং ক্রমেই কমতে থাকা আয়। জুলাই মাসে বিহারের ফুলওয়ারি ও অন্যান্য স্থানে এনআইএ’র হানাদারি, ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপনের দিন গুজরাটে বিলকিস বানো মামলায় ধর্ষণ ও খুনে সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তিদান ও সংবর্ধনা জ্ঞাপন, এখন আবার পিএফআই ও তার সাথে সংযুক্ত সংগঠনগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, এসবই আমাদের জানাচ্ছে যে সামনের নির্বাচনগুলির জন্য সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনী কিভাবে নিজেদের প্রস্তুত করছে — যে নির্বাচনগুলো হলো এ’বছরের শেষে হতে চলা গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন, ২০২৩ সালে অনুষ্ঠেয় কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের অতি গুরুত্বপূর্ণ লড়াই।
২০০২’র গোধরা-পরবর্তী গুজরাট গণহত্যার পথ ধরে মোদী তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বের নিন্দাকে গুজরাটের পরিচিতি ও সম্মানের ওপর আক্রমণ বলেই বর্ণনা করেছিলেন এবং ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ‘গুজরাট গৌরব’কেই তাঁর নির্বাচনের অবলম্বন করে তুলেছিলেন। দু’দশক আগে শক্তিগুলোর ভাবসাম্য এবং মূল ধারার মিডিয়ায় চর্চার প্রকৃতিও একেবারেই আলাদা ছিল — মোদী গুজরাটে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলেও বাজপেয়ী ও আদবানি উচ্চগ্ৰামের ‘ভারত উদয়’ প্রচার চালানো সত্ত্বেও গুজরাটের মূল্য তাঁদের দিতে হয়েছিল। কৃষকদের আত্মহত্যা এবং অর্থনৈতিক দুর্দশার উদ্বেগজনক বাস্তব পরিস্থিতি বাদে গুজরাট গণহত্যাও বাজপেয়ী-আদবানি যুগের অবসানের পিছনে অন্যতম মূল কারণ হয়ে উঠেছিল।
মোদী অবশ্য গুজরাটের মধ্যে ভারতের বড় বড় কর্পোরেটদের আনুগত্যমূলক সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হলেন যারা ‘প্রাণবন্ত গুজরাট’এর পতাকাতলে তাঁর চারপাশে সমাবেশিত হতে থাকল। রাষ্ট্রের ক্ষমতা — যা হল অবাধ ক্ষমতার অধিকারী এক প্রশাসক চালিত পুলিশ রাষ্ট্র — সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ এবং কর্পোরেট স্বার্থের সমন্বয়কে সম্পূর্ণ করে তাকে এক বজ্রদৃঢ় মুষ্টিতে পরিণত করল। এখন সর্বভারতীয় স্তরে গুজরাট মডেলের পুনরাবৃত্তি ঘটানো হচ্ছে আরএসএস’এর আশীর্বাদপুষ্ট সর্বোচ্চ নেতার নিরবিচ্ছিন্ন শাসনকে সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে। এই সর্বোচ্চ নেতা এবং হিন্দু সম্প্রদায় আর দেশ হিসাবে ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে ভেসে ওঠা তথাকথিত বিপদই এই নকশার কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে রয়েছে।
১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঘোষিত জরুরি অবস্থা কালে আমরা একটা শ্লোগান শুনেছিলাম যাতে ভারতবর্ষ ও তৎকালীন সর্বোচ্চ নেত্রী ইন্দিরাকে সমার্থক করে তোলা হয়েছিল। এখন ঐ সমার্থকতাকে একটু বাড়িয়ে তার মাঝে হিন্দু পরিচিতিকে ঢোকানো হচ্ছে, কেননা, আজকের নেতা ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ নামেও পরিচিত। এই জমানা এবং তার কদর্য রাজনীতি ও তার বিপর্যয়কর ফলাফলের সমালোচকদের নিয়মিতভাবেই একই সাথে দেশদ্রোহী এবং হিন্দু-বিরোধী বা হিন্দু-বিদ্বেষী হিসাবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। এটা অবশ্য আসছে সঙ্ঘ বাহিনীর ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা থেকে। সরকার লাগাতারভাবে হয় বহিরাগত আর না হয় অভ্যন্তরীণ বিপদের কথা বলে চলেছে এবং সরকার বিরোধী মত পোষণ করা নাগরিকদের অভ্যন্তরীণ শত্রু হিসাবে বিভিন্ন বর্গে ভাগ করা হচ্ছে। ‘শহুরে নকশাল’ নিয়ে গলাবাজি ইতিমধ্যেই ভারতের সর্বাপেক্ষা সক্রিয় মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের গ্ৰেপ্তারি এবং এমনকি হেফাজতে মৃত্যুতেও পরিণতি লাভ করেছে। আর এখন পিএফআই ও তারসাথে সংযুক্ত সংগঠনগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি ভারতীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে নির্বিচার ডাইনি খোঁজের নতুন পর্যায়ের সূচনাকে দেখিয়ে দিচ্ছে।
জরুরি অবস্থার সময় ভারতের সংবাদ জগতের ওপর সেন্সারশিপ চাপানো হয়েছিল এবং বিভিন্ন ধারার বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বড় অংশ ও সমাজ আন্দোলনের কর্মীদের জেলে পোরা হয়েছিল। আর তাই গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার একটা মূল শ্লোগানে পরিণত হয়েছিল এবং তার প্রয়োজনীয়তাও ব্যাপকতর স্তরে অনুভূত হয়েছিল। জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে নেওয়া এবং স্বৈরাচারী সরকারের পরাজয় আবার রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দান এবং ১৯৭৪’র রেল ধর্মঘটে বরখাস্ত হওয়া কর্মীদের পুনর্নিয়োগের উদ্দীপনাময় প্রচারের জন্ম দিল। এখন কিন্তু মূল ধারার মিডিয়ার বড় অংশই বর্তমান সরকারের সক্রিয় প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়েছে এবং বন্দি বানানোর অভিযান সীমাবদ্ধ রয়েছে প্রধানত পার্টি-বহির্ভূত কর্মীদের মধ্যে; এর ব্যতিক্রম অবশ্য হলো জম্মু ও কাশ্মীর যেখানে ৩৭০ ধারা নিষ্ক্রিয় করার পর গোটা রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষকেই হয় জেলে পোরা হয়েছিল আর না হয় গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল।
এরমধ্যেই হয়ত আংশিক ব্যাখ্যা রয়েছে যে কেন ডাইনি-খোঁজ অভিযানের অবসান এবং বিবেকসম্পন্ন বন্দিদের মুক্তির দাবি এখনও সংসদীয় বিরোধী পক্ষের কেন্দ্রীয় দাবি হয়ে ওঠেনি। আগেকার এই ভ্রান্ত ধারণাটারও অস্তিত্ব এখনও রয়েছে যে, শুধু অর্থনীতিতে গুরুত্ব আরোপ করলেই বিরোধী পক্ষের চলে যাবে। নরসিমা রাওয়ের এই বিশিষ্ট ধারণাটা ছিল যে, বাজার বিজেপির সাম্প্রদায়িক এজেণ্ডাকে চুপসে দেবে; কিন্তু মোদী পরিঘটনার উত্থান, বাজার মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সংগতিপূর্ণ হওয়ার উঁচু হারকেও দেখিয়ে দিয়েছে। অতি জরুরি এই প্রয়োজনীয়তার প্রতি সজাগ হয়ে উঠে রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে তাদের এজেণ্ডার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় করে তোলার সময় ভারতের রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের কাছে সমুপস্থিত। বিজেপি যখন সংবিধানের বিপর্যয় ঘটিয়ে ভারতকে বিরোধী মুক্ত একদলীয় রাষ্ট্র কাঠামোয় পরিণত করতে বদ্ধ পরিকর, বিরোধী পক্ষকে তখন দ্বিধাকে ছুঁড়ে ফেলে গণতন্ত্র ও সংবিধানের রক্ষায় উঠে দাঁড়াতে হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গণতান্ত্রিক এজেণ্ডাকে মুলতবি রাখা বা কাটছাঁট করা একবারেই চলবে না।