কেরলে কর্পোরেট স্বার্থের সুরক্ষায় একই মঞ্চে মিলিত হলো সিপিএম আর বিজেপি। রাজ্য রাজধানী তিরুবনন্তপুরমের ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে ভিজিনজামে আদানি যে সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছেন, সেই প্রকল্প উপকূলবর্তী জনগণের ব্যাপক সংখ্যকের জীবন ও জীবিকায় প্রভূত বিপর্যয় ঘটানোয় তাঁরা ঐ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ স্থগিত করার দাবিতে তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। আর ঐ আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছে ল্যাটিন ক্যাথলিক চার্চ। তাঁদের প্রতিবাদ আন্দোলন ১০০ দিন পেরিয়ে গেছে এবং আন্দোলনের পরিণামে বন্দর নির্মাণের কাজ একরকম স্থগিত হয়েই রয়েছে। সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম সরকারের চালানো বিভিন্ন কৌশল এবং তাদের পুলিশ বাহিনী স্থানীয় জনগণ এবং মৎসজীবীদের আন্দোলনের পথ পরিত্যাগে সম্মত করতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা বন্দর প্রকল্প থেকে ক্ষতিগ্ৰস্ত জনগণের বিরুদ্ধে পাল্টা সমাবেশের কর্মসূচিতে সামিল হলেন। সেই সমাবেশ থেকে আন্দোলনরত জনগণকে একরকম চোখ রাঙানি দিয়ে বলা হলো যে, আদানির বন্দর নির্মাণের পথ প্রতিবন্ধকতা মুক্ত না হলে রাষ্ট্র এবং প্রতিক্রিয়ার শক্তি একযোগে সেই বাধার মোকাবিলায় নামবে।
বন্দর নির্মাণ সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির জন্য প্রতিবাদরত জনগণের বিরুদ্ধে ঐ পাল্টা সমাবেশ সংগঠিত হলো ১ নভেম্বর ২০২২। সমাবেশ সংগঠিত হল ‘ভিজিনজাম বন্দর সুরক্ষার কাউন্সিল’এর পতাকাতলে। সেদিনের কর্মসূচির অন্যতম কার্যক্রম ছিল ১৫ কিলোমিটারের লং মার্চ এবং তাতে অন্যান্যদের সঙ্গে অংশ নিয়েছিল সিপিএম, বিজেপি ও কংগ্ৰেসের প্রতিনিধিবৃন্দ (২০১৫ সালে বন্দর নির্মাণের চুক্তি সম্পাদনের সময় কেরলে ক্ষমতায় ছিল কংগ্ৰেস)। সেদিনের পদযাত্রা থেকে আন্দোলনকারী মৎসজীবীদের বিরুদ্ধে শ্লোগান উঠল, নেতৃত্বদায়ী চার্চের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হলো, ক্ষতিগ্ৰস্ত জনগণ যে ইস্যুগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছেন সেগুলো নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করা হল না, যেকোনো মূল্যে বন্দর নির্মাণ সমাধার আওয়াজ সোচ্চারে ঘোষিত হল। লং মার্চেসিপিএমের তিরুবনন্তপুরম জেলা সভাপতি আনাভুর নাগাপ্পান এবং ঐ জেলার বিজেপি সভাপতি ভিভি রাজেশ উভয়েই তাঁদের ভাষণে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তাঁদের ক্রোধের প্রকাশ ঘটালেন। বিজেপির সঙ্গে হাত মেলানোর অভিযোগ থেকে দূরত্ব রচনার প্রচেষ্টায় সিপিএম নেতা নাগাপ্পান বললেন, “এই প্রতিবাদ সংগঠিত করেছেন ভিজিনজামের স্থানীয় মানুষ যাঁরা আন্দোলন নিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁরা কয়েকটি সম্প্রদায় ভিত্তিক সংগঠন ছাড়াও সিপিএম, বিজেপি ও কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন...।” অর্থাৎ, আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া উপকূলের জনগণ ও মৎসজীবীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত ‘প্রগতিশীল’ লং মার্চের সংগঠক ছিল স্থানীয় জনগণ, আমন্ত্রিত হয়ে তাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন মাত্র। নাগাপ্পান আরও জানিয়েছেন, বিজেপি যেহেতু ঐ কর্মসূচি সংগঠিত করেনি, তাই “বিজেপি অংশগ্ৰহণ করবে বলে জানলেও আমরা অংশ নিতাম”। সাধারণ মানুষের চোখে কিন্তু আদানি-পন্থী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর নির্দিষ্ট অভিসন্ধি কেন্দ্রিক সম্মিলন ছাড়া লং মার্চের সংগঠক তথাকথিত ‘কাউন্সিল’এর গঠনকে কল্পনা করা একরকম অসম্ভব। আর লং মার্চে অংশ নেওয়া বিজেপি নেতা ভিভি রাজেশ কোনো রাখঢাক না করে সরাসরি ক্ষতিগ্ৰস্ত জনগণের আন্দোলনের বিরুদ্ধেই তোপ দাগলেন, “আন্দোলনটা প্রকল্প বানচাল করারই প্রচেষ্টা। বিজেপি ঐ প্রকল্পে সার্বিক সমর্থন দেবে”। এইভাবে, ক্ষতির মুখোমুখি হওয়া জনগণের আন্দোলনের বিরোধী অবস্থান সিপিএম ও বিজেপিকে একসূত্রে বাঁধল। আদানির কোনো প্রকল্প থেকে জনগণকে যত ক্ষতিই স্বীকার করতে হোক না কেন, বিজেপি যে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে না তা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। আর সিপিএম’ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের স্বার্থকে উপেক্ষা করে কর্পোরেট স্বার্থর পক্ষে দাঁড়াতে কোনো দ্বিধা দেখালো না।
উপকূল অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণ এবং মৎসজীবীরা বিপন্নতার যে বৃত্তান্তকে তুলে ধরেছেন, রাষ্ট্র কি তার প্রতি সমব্যথী হয়ে সাড়া দিতে পারে না? বন্দরের নির্মাণ যে হাজার হাজার মৎসজীবীর জীবিকাকে ধ্বংস করেছে, উপকূলের তটভূমি সমুদ্র গ্ৰাসে বিলীন হওয়ায় শত-শত বসতবাড়ি যে সমুদ্র গর্ভে তলিয়ে গেছে, বন্দর নির্মাণ পরিবেশের যে ক্ষতি করে চলেছে, তার প্রতি উপেক্ষা দেখিয়ে কর্পোরেট সংস্থার পাশে দাঁড়ানোটাই কি সরকারের স্বাভাবিক রীতি হয়ে দেখা দেবে? নেতৃত্বদায়ী চার্চের মুখ্য ব্যক্তিত্ব ইউজিন এইচ পেরিইরা জানিয়েছেন, “প্রায় ৪০,০০০ মৎসজীবী তাঁদের জীবিকা হারালেও তা খতিয়ে দেখার কোনো প্রয়াসই রাষ্ট্র করেনি”। হাজার-হাজার মানুষের জীবিকা নষ্ট হয়ে যাওয়া, ঘরবাড়ি সমুদ্র গর্ভে হারিয়ে শত-শত পরিবারের এফসিআই’এর পরিত্যক্ত গুদামে থাকতে বাধ্য হওয়া, অনিশ্চিত ও উদ্বেগজনক ভবিষ্যত তাদের জীবনে চিরস্থায়ী হওয়া — এসবযে রাষ্ট্রের বিবেচনায় গুরুত্বহীন হয়ে পড়ল তার পিছনে এই ধারণাই নির্ধারক হয়েছে যে, কর্পোরেট প্রকল্প জনগণের ক্ষতিসাধন করলেও তার রূপায়ণে সরকারকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে! এটা এখন প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা যে, উপকূলবাসীর জীবনে এত ক্ষতির কারণ মূলত বন্দর প্রকল্পে ব্রেকওয়াটার’এর নির্মাণ। এই ব্রেকওয়াটার হলো সমুদ্র বক্ষে নির্মিত পাথর প্রাচীর, জাহাজগুলোকে সমুদ্রের ঢেউয়ের আঘাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যেই যাকে তৈরি করা হচ্ছে। কী আদানি, কী বাম সরকার, কেউই এটার স্বীকৃতিতে রাজি নয়। ইউজিন এইচ পেরেইরার কথায়, “অনেক বিজ্ঞানী তাঁদের সমীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, ব্রেকওয়াটার’এর নির্মাণই সৈকত ক্ষয়ের কারণ। আদানি অনেক সংস্থাকে এনে আমাদের তোলা বিষয়গুলোকে ভুল প্রমাণ করতে চাইছে।...” আন্দোলনের নেতৃত্ব এই বিষয়টাকে খতিয়ে দেখার ওপর জোর দেওয়াতেই আদানি থেকে বিজেপি, সিপিএম আন্দোলনকারীদের বন্দর প্রকল্প এবং উন্নয়নের বিরোধী বলে দেগে দিচ্ছেন। আন্দোলনে অংশ নেওয়া জনগণ কিন্তু বলছেন যে, তাঁরা বন্দর প্রকল্প পরিত্যক্ত হওয়ার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেননি। বন্দরের নির্মাণ পরিবেশের ক্ষতি করছে কিনা, সমুদ্র সৈকতের ধ্বংসসাধন করছে কিনা, তার অনুসন্ধানের জন্য এই বিষয়ে পারদর্শী সংস্থাকে নিয়োগ করা হোক। আর যতদিন ঐ সংস্থা সমীক্ষা শেষ করে রিপোর্ট না দিচ্ছে ততদিন বন্দর নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখা হোক। এই প্রস্তাবে সম্মত হতে সরকার একেবারেই নারাজ। আন্দোলনের নেতৃত্ব জানিয়েছেন, এই বিষয়টির সমীক্ষায় তাঁরা সাত সদস্যের এক কমিটি তৈরি করেছেন যারা তিন মাসের মধ্যে তাদের রিপোর্ট দেবে। সেই রিপোর্টে ব্রেকওয়াটার’এর নির্মাণের ফলাফল নিয়ে আন্দোলনকারীদের বক্তব্য সমর্থিত হলে তাকে মেনে নেওয়ার মত মনের প্রসারতা কি বাম সরকার দেখাতে পারবে?
সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম সরকার হয়তো ভেবেছিল যে, তারা নরমে-গরমে আন্দোলনের নেতৃত্বকে প্রতিবাদের পথ থেকে সরিয়ে দিতে সফল হবে। কিন্তু বিপর্যয়গ্ৰস্ত জনগণ আন্দোলনের পথে অবিচল থাকায় সিপিএম নিজেদের শুধু আন্দোলনকারীদের প্রতিপক্ষ হিসাবেই দাঁড় করালো না, তাদের কলঙ্কিত করতেও উঠেপড়ে লাগল। আন্দোলনকারী জনগণ এবং নেতৃত্বদায়ী চার্চের বিরুদ্ধে আক্রমণের ঢল নামালো, যাতে সহযোগী হলো কিছু কর্পোরেট মিডিয়া। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হল যে, বন্দর নির্মাণকে বানচাল করতে তারা অবৈধ পথে জোগাড় করা ১১ কোটি টাকার বিদেশি অর্থকে কাজে লাগাচ্ছ; দাঙ্গা বাধানোর ভিত্তিহীন অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে তোলা হল; আরও বলল যে, আন্দোলনকারীরা এমন গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে যাদের ‘গোপন অভিসন্ধি’ রয়েছে। সেই অভিসন্ধিকে স্পষ্ট না করলেও আদানির বন্দর প্রকল্পের মধ্যে নিহিত উন্নয়নের বরবাদ হওয়ার সম্ভাবনাকেই সম্ভবত বুঝিয়েছেন। কেরলের ভিজিনজামে আদানির বন্দর প্রকল্প এইভাবে পরিস্থিতিতে দুটি বিকল্পকে তুলে ধরেছে — উপকূলবাসী ও মৎসজীবীরা কি চিরাচরিত পথে উপকূল কেন্দ্রিক জীবনধারাকে অনুসরণ করতে পারবেন, নাকি তাঁদের তথাকথিত উন্নয়নের নিমিত্তে উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে হব। আন্দোলনের ১০০ দিন পূর্ণ হওয়ার সময় মৎসজীবীরা ক্রোধে তাঁদের জীবিকার উপকরণ নৌকো ও জালে আগুন ধরিয়ে দেন। আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক মহিলা সেদিন বলেন, “উপকূল না থাকলে আমাদের জীবনও থাকে না। আমরা আমাদের জীবিকার সরঞ্জামগুলোতেই আগুন লাগিয়ে দিচ্ছি। বন্দরের সৃষ্টি হলে আমরা চিরদিনের মতো উপকূলকে হারিয়ে ফেলব।” বন্দর নির্মাণের পরিণামে উপকূলের ধ্বংস হওয়াকে প্রতিহত করে উপকূলবাসীদের কাছে তটভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার কথা কি কেরলের সিপিএম নেতৃত্ব ভাবতে পারেন না? ফ্যাসিবাদকে রোখার জন্য আদানি, বিজেপি এবং উন্নয়নের চলতি মডেলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধটা একান্ত আবশ্যক — এটাও কি এক অপরিহার্য বামপন্থী বোধ নয়?
- জয়দীপ মিত্র