আজকের দেশব্রতী : ১৭ নভেম্বর ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati_nov-17-22

Conference of AIARLA

“বেয়নেট হোক যত ধারালো, কাস্তেটা শান দিও বন্ধু” — সেই শানিত কাস্তের প্রতীক লাঞ্ছিত লাল নিশানের ঢেউয়ে প্লাবিত হল চন্দননগর, ১৪ নভেম্বর বেলা এগারোটা। চন্দননগর রেলস্টেশন থেকে হাজার হাজার কিষাণ-কিষাণীর হাতে আন্দোলিত রক্ত পতাকার লাল লাভাস্রোতে ভেসে বিশাল মিছিল এগিয়ে চলেছে রবীন্দ্রভবনের দিকে। পাঞ্জাব থেকে আসাম, ত্রিপুরা থেকে তামিলনাড়ু — গ্রামীণ ভারতের গোটা মানচিত্রটাই যেন উঠে এসেছে চন্দননগরের রাজপথে। উৎসুক চোখে দোকানপাট ঘরবাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে শহরবাসী প্রত্যক্ষ করছেন এই লাল মিছিল। অনেকে এগিয়ে এসে ক্যামেরাবন্দী করছেন গ্রামীণ মেহনতীদের স্পর্ধিত অভিযানকে। অবশেষে মিছিল উপস্থিত হয় রবীন্দ্রভবন সম্মেলন স্থলে।

বেলা একটায় রক্তপতাকা উত্তোলনের মধ্যদিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সূচনা ঘটল আয়ারলা (সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি)-র ৭ম সর্বভারতীয় সম্মেলন। এরপর ‘কানাইলাল দত্ত, রাসবিহারী বসু, নজরুল ইসলাম মঞ্চে’ (রবীন্দ্রভবন) শুরু হয় সম্মেলনের প্রকাশ্য অধিবেশন। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পার্টির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, পার্টির বর্ষীয়ান নেতা পলিটব্যুরো সদস্য স্বদেশ ভট্টাচার্য, কার্তিক পাল; আয়ারলার সর্বভারতীয় সভাপতি ও সম্পাদক যথাক্রমে রামেশ্বর প্রসাদ ও ধীরেন্দ্র ঝা, বিহার বিধানসভার সদস্য গোপাল রবিদাস, সত্যদেব রাম, বীরেন্দ্র গুপ্ত, মেহবুব আলম; সারা ভারত স্কিম ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের নেত্রী শশী যাদব, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, পার্থ ঘোষ, অরিন্দম সেন সহ পার্টির অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। এ ছাড়াও মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের নেতা অমিয় পাত্র, পশ্চিমবঙ্গ খেতমজুর সমিতির নেতা স্বপন গাঙ্গুলী এবং চন্দননগরের বিশিষ্ট নাগরিক, বন্ধ ও রুগ্ন শিল্পের শ্রমিকদের আইনি সহায়তার কাজে যুক্ত সমাজকর্মী তথা পরিবেশবিদ বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়। এই অধিবেশনে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের শিল্পীদল প্রথমে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। প্রকাশ্য অধিবেশনে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে স্বাগত ভাষণ দেন আয়ারলার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক সজল অধিকারী। এরপর বক্তব্য রাখেন অমিয় পাত্র। তিনি বিজেপি-আরএসএস-এর সর্বগ্রাসী হামলার বিরুদ্ধে কৃষি ও গ্রামীণ মজুরদের স্বার্থে সংগ্রামরত সমস্ত সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। স্বপন গাঙ্গুলী তাঁর বক্তব্যে “ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে শ্রেণীচেতনাকে যুক্ত করার” আহ্বান জানান। বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় পরিযায়ী  শ্রমিকদের দুর্দশার মর্মস্পর্শী বিবরণ তুলে ধরেন এবং তাদের স্বার্থে লড়াইয়ে তিনি আয়ারলা সহ লড়াকু সংগঠনগুলির পাশে থাকার আশ্বাস দেন। শশী যাদব কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের হয়রানির ঘটনাবলি তুলে ধরার পাশাপাশি আশা, অঙ্গনওয়ারি ও মিড-ডে-মিল মহিলাদের জ্বলন্ত সমস্যা ও সেগুলির প্রতিকারের ইতিবৃত্ত মেলে ধরেন। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন আইসার রাজ্য সম্পাদক নীলাশিস বসু এবং আরওয়াইএ নেতা নীরজ কুমার। সবশেষে অধিবেশনের প্রধান বক্তা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য আয়ারলার গঠন, তার এগিয়ে যাওয়া ও আন্দোলনের কাহিনী শোনানোর পাশাপাশি সমকালীন রাজনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে মূল্যবান বিশ্লেষণগুলি তুলে ধরেন। দীপঙ্করের বক্তব্যের মধ্যদিয়ে প্রকাশ্য অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটে।

we have courage

– দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

চন্দননগরের বুকে লাল নিশান উড়িয়ে কোনো সর্বভারতীয় সম্মেলন, সম্ভবত এই প্রথম অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সমস্ত বামপন্থীরা এ’জন্য গর্বিত হবেন। ঐতিহাসিক এই নজির সৃষ্টির জন্য সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতিকে (আয়ারলা) অভিনন্দন। চন্দননগরের এক অনন্যসাধারণ ঐতিহ্য আছে। সারা দেশ যখন ব্রিটিশের দখলে তখন চন্দননগরে কিন্তু ব্রিটিশ রাজ ছিল না। এটি ছিল ফরাসি উপনিবেশ। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিথোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে চন্দননগরের নাম চির ঊজ্জ্বল। এই শহরের বীর সন্তান কানাইলাল দত্ত মাত্র কুড়ি বছর বয়সে শহিদের মৃত্যু বরণ করেন। জন্ম বর্ধমানে হলেও, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী রাসবিহারী বসুও বড় হয়েছেন এই শহরেই। আর এই হুগলী জেলা ছিল বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুলেরও বিচরণক্ষেত্র। স্বাধীনতার দাবিতে, দাসত্বের বিরুদ্ধে, মহিলাদের মর্যাদার প্রশ্নে তাঁর কলম ঝলসে উঠেছে বারবার। এই ঐতিহ্যমন্ডিত হুগলী জেলা তথা চন্দননগরে যখন আয়ারলা’র ৭ম রাষ্ট্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তখন এর প্রথম সম্মেলনের কথাও বলা দরকার। জমি, মজুরি, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে কৃষিমজুরদের সংগ্রামগুলি ক্রমেই যখন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছিল তখনই স্থির হল এই আন্দোলনকে রাষ্ট্রীয় চেহারা দিতে হলে রাষ্ট্রীয় স্তরে সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। ২০০৩ সালে প্রথম সম্মেলনের মধ্যদিয়ে গড়ে উঠল সারা ভারত কৃষি মজুর সমিতি (আয়লা)। এখন কৃষিমজুররা নতুন নতুন বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। গ্রামীণ গরিবদের, সমস্ত গ্রামীণ মেহনতীদের সংগঠিত করার জন্য আয়লা পালটে হয়ে উঠেছে আয়ারলা (সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি)। যেখানেই হোক না কেন, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিটি প্রশ্নে আয়ারলাকে লড়তে হবে। শুধু জমি নয়, শুধু গ্রাম নয়, সারা দুনিয়াটাকেই জিতে নিতে হবে — এটাই হবে আয়ারলার রণধ্বনি। সম্মেলনে বহু প্রতিনিধি এসেছেন। তবু মনে হচ্ছে, মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব আরো বাড়াতে হবে। সংগঠনে আদিবাসীদের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। করোনা অতিমারীর দাপটে সারা দেশ বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়েছে, বেকারত্ব তীব্র হয়েছে। তাই দাবি উঠছে, “দাম বাঁধো কাজ দাও, কাজের পুরো দাম দাও”। শুধু ন্যূনতম মজুরি নয়, চাই বেঁচে থাকার উপযোগী মজুরি। আমরা দাবি করেছিলাম, সমস্ত গরিবদের প্রকৃত খাদ্য সুরক্ষা সহ খেতমজুরদের জন্য চাই এক সুসংহত আইন। এই দাবি আজও অর্জন করা যায়নি। গরিব মানুষদের জন্য সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থা যে ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে করোনাকাল তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সময়ে ডাক্তার নেই, বেড নেই, অক্সিজেন নেই। সরকার বলছে পয়সা নেই। খেতমজুরদের স্বার্থে আইন কী করে আনব? পালটা আজ আওয়াজ তুলতে হবে, “যে কাজ চায় তাকেই কাজ দিতে হবে। কাজ দিতে না পারলে বেকার ভাতা দিতে হবে।” পশ্চিমবাংলায় ১ বছর ধরে ‘একশো দিনের কাজ’ বন্ধ। এটা চলতে পারেনা। আজ এখন আর একশো দিন নয়, বলতে হবে “একশো দিনটা দুশো দিন কর। যথা সময়ে মজুরি দাও।” ওদিকে মোদী বলছেন, “রেউড়ি বাঁটনেকে লিয়ে হাম নেহি আয়েঁ হ্যায়।” আমরা তোমার প্রজা নই। অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে। দলিতদের জন্য কোন সামাজিক ন্যায় ছিল না। আমরা এই অধিকার আদায় করে নিয়েছি। বিহারে গরিবদের ভোট দেওয়ার অধিকারটুকুও ছিল না। আমরা এ অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছি। দলিত ও পিছিয়ে পড়ারা তাদের প্রতিনিধি রামেশ্বর প্রসাদকে লোকসভা আসনে জেতাতে সক্ষম হয়েছেন।

আজ দেশ কোথায় পৌঁছেছে? বিশ্ব দারিদ্র্য সূচকে আমাদের স্থান শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানেরও পিছনে। এ জিনিস চলবে না। ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনামুল্যে বিদ্যুৎ, সকলের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জল — এ দাবিকে মানতেই হবে। সরকারী স্কুলে এমন দুর্দশা কেন হবে? কেন সরকারী স্কুলকে বলা হবে “খিচুড়ি খাওয়ার স্কুল?” জমি, বাড়ি বেচে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে গরিবরা বাচ্চাদের পাঠাবে কেন? গরিব মহিলাদের পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াবে না? মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিগুলির জুলুমে মহিলারা কেন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবেন? বিহারে আমরা দাবি তুলেছি, “সুস্থ বিহার, আমার অধিকার”। বদলে কেন্দ্র দিয়েছে ‘আয়ুষ্মান ভারতের’ কার্ড। পশ্চিমবঙ্গ দিয়েছে ‘স্বাস্থ্যসাথী কার্ড’। কার্ডে তো চিকিৎসা হয়না। কার্ডের নাম্বার থেকে নার্সিং হোমে টাকা চালান হয়। টাকা শেষ তো চিকিৎসাও শেষ।

লড়াই জোরদার করতে হবে। বিহারে আমাদের বিধায়করা রয়েছেন। আমাদের বিধায়কেরা ভিআইপি নন। আপনারা লড়লে, আপনাদের সঙ্গে থেকে বিধায়করাও লাঠি খাবেন। মোদী জমানায় সংবিধানকে নস্যাৎ করা হচ্ছে। ৩৭০ ধারা বাতিল করা হল। ফল কী দাঁড়াল? জম্মু কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা হারাল। লাদাককে আলাদা করা হল। একটা আস্ত রাজ্যের অবনমন ঘটিয়ে দুটো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হল। এখন বিহারের একাংশ (সীমাঞ্চল) ও উত্তর বাংলাকে নিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরির ফন্দি আঁটা হচ্ছে। রাজ্যগুলির অধিকার এইভাবে খর্ব করা হচ্ছে। সীমান্ত থেকে ৫০ কিমি পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বিএসএফ-কে। সংবিধানে আম্বেদকার সংরক্ষণের মূল স্পিরিট হিসেবে জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যকে সামনে এনেছিলেন। ফলে এসসি/এসটিদের সংরক্ষণের যে আইন তৈরি হয়েছিল তারজন্যই সংখ্যায় অল্প হলেও তাঁদের মধ্য থেকে অনেকে প্রশাসনের উঁচু পদে বসতে পেরেছিলেন। এমন পরিবারগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের জন্য সংরক্ষণের কথা বলা হচ্ছে। এতে দলিত আদিবাসীরা বঞ্চিত হবেন। এরা কারা? বছরে আট লক্ষ টাকা পর্যন্ত (মাসে ৬৬ হাজার) যাদের আয় এমন পরিবারগুলি এরমধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আসল সচ্ছল, ধনী পরিবারগুলিই কেবল নতুন এই সংরক্ষণের সুযোগ পাবে।

National Conference of AIARLA

এখন বুলডোজার রাজ চলছে। বুলডোজারের নিশানা হল গরিবদের ঝুপড়ি ঘর। শুধু গরিব উচ্ছেদ হচ্ছে। ঝাড়খণ্ডে ল্যান্ডব্যাঙ্কের নামেও এই জিনিস চলছে। সরকার বস্তি উচ্ছেদ করে জমির দখল নিচ্ছে। পরে সেই সরকারী জমি আদানিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। রাজধানী দিল্লীতে বুলডোজারের নিশানা হয়েছে সমস্ত ‘বে-আইনি’ বস্তি। মুসলিমরা এই আক্রমণের প্রাথমিক লক্ষ্য। কিন্তু বুলডোজারই হোক আর এনআরসি’ই হোক — সমস্ত ধরনের দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষরাই এসবের শিকার হচ্ছেন। মোদীরাজের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাই ব্যাপক ঐক্য দরকার। মোদীর পিছনে আছে গোটা সঙ্ঘ পরিবার, ১০০ বছর ধরে হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখা আরএসএস। ফ্যাসিবাদকে খণ্ড খণ্ড করে দেখার জায়গা নেই। মমতা বলছেন, “আরএসএসের সবাই খারাপ নয়”। কেজরিওয়াল মোদীর বিরোধিতায় কর্মীদের গেঞ্জির পিছনে আম্বেদকার ও ভগৎ সিংয়ের ছবি আঁকতে বলেছিলেন। এখন তিনি সার বুঝেছেন! সেই গেঞ্জির সামনে এবার লক্ষ্মী আর গণেশের ছবি। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, সেজন্য, অটুট, অখণ্ড শক্তি চাই যার কেন্দ্রে থাকবে বামপন্থীরা। আর বামপন্থী মানেই তো মজদুর, গ্রামের ব্যাপক মেহনতী মানুষ। চাই শাণিত চেতনা। এই চেতনা, প্রতিবাদী কলমকে মোদীজীরা ভয় পান। তাইএখন তিনি ‘কলমধারী নকশালদের’ জব্দ করার নামে সমস্ত বিরোধীস্বরকে স্তব্ধ করতে চাইছেন। সুতরাং লড়াই আরও কঠিন হচ্ছে। আবার লড়াইটা আরো জরুরী হয়ে উঠছে। কিন্তু ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই, ব্রিটিশের অনুগত সামন্তপ্রভু ও ব্রাহ্মণ্যবাদী অনুশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইও কি কঠিন ছিলনা? দলিত হিসেবে ক্রমাগত লাঞ্ছনার মুখে আম্বেদকারকে বৌদ্ধ হতে হয়েছিল। সুতরাং লড়াই চলবে। আমাদের একটা বড় অস্ত্র — সংখ্যা। শ্রমজীবী মানুষ আমরা রয়েছি হাজারে, লাখে, কোটি কোটি সংখ্যায়। মেহনতীদের এই বিপুল জনশক্তিকে একত্রিত করার দায় আমাদের। এই কাজে যত বেশি সাফল্য আসবে তত বেশি আমরা লড়াইয়ে এগিয়ে যাব। কঠিন লড়াইকেও হাসিমুখে পরিচালনার হিম্মত কেবল আমাদেরই আছে।

removed from the Cabinet

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন — তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক ও বাংলার কারা বিভাগের প্রতিমন্ত্রী অখিল গিরি ১২ নভেম্বর ২০২২ তার ভাষণে আদিবাসী সমাজ থেকে উঠে আসা দেশের মহিলা রাষ্ট্রপতি মাননীয়া দ্রৌপদী মুর্মুকে উদ্দেশ্য করে কুৎসিত মন্তব্য ও কদর্য অঙ্গভঙ্গী করে অবমাননা করেছেন। উপর্যুপরি কয়েকবার এমন অশালীন মন্তব্যের নজির তিনি অতীতেও রেখেছেন। এই নারী ও আদিবাসী বিদ্বেষ শাসকদলের মজ্জাগত পরিচিতি তৈরি করছে, যা বাংলার প্রগতিশীল ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতির পরিপন্থী ও লজ্জাকর।

অন্যদিকে, দেশজুড়ে আদিবাসী মানুষের জমি, জীবিকা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপরে বুলডোজার রাজ নামিয়ে আনা বিজেপি এই সুযোগে হঠাৎ ভোল পাল্টে নিজেদের আদিবাসীপ্রেমী হিসাবে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় রাজ্যজুড়ে অশান্তির আবহ তৈরি করতে চাইছে। রাজ্যবাসীকে এদের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে আহ্বান জানাই।

রাজ্যের শাসক দলগুলির মধ্যে নারী-বিদ্বেষী, জাতি-বিদ্বেষী মনোভাব ও মন্তব্যের যেন প্রতিযোগিতা চলছে।

এই অবমাননাকর আচরণের বিরুদ্ধতায় দেশ ও রাজ্যে বসবাসকারী আদিবাসী সমাজের সম্মানকে মান্যতা দিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অপরাধী অখিল গিরিকে ভর্ৎসনা ও রাজ্য মন্ত্রীসভা থেকে অপসারণ করতে হবে।

state is in the dark

তিনি প্রবল প্রতাপান্বিত সর্বময়ী নেতৃ! রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। নবাব-বাদশা-রাজাধিরাজদের মতোই মুখ ফস্কে কোন কথা বেরোলে সেটাই হয়ে যায় আইন। পবিত্র বিধি নিয়ম। তার পরিণতি যাই হোক না কেন। আপাদমস্তক দুর্নীতির দগদগে পচা ঘা থেকে অবিরাম রক্তক্ষরণ যে রাজনৈতিক দলের চরিত্রলক্ষণ, তারই মাথায় স্বঘোষিত ‘সততার প্রতীক’এর অবস্থান। এরকম কদর্যতম প্রবঞ্চনা আর কিছুই হতে পারে না। রাজ্যজুড়ে শিক্ষক নিয়োগের যে পঙ্কিল দুর্নীতি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছিল, যে কল্পনাতীত অবৈধ অর্থের লেনদেনের সাথে যুক্ত ছিল তাবড় তাবড় নেতা-মন্ত্রী-শিক্ষা দপ্তরের উচ্চপদস্থ আমলা, যে নিপুণ মেশিনারির মাধ্যমে পরিচালিত হতো দুর্নীতির এই বহু শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত বন্দোবস্ত, প্রায় সমগ্র শিক্ষা দপ্তর যখন আজ কারান্তরালে — এতো বড় বহরের দুর্নীতিকে মুখ্যমন্ত্রী স্রেফ “কাজ করতে গিয়ে ভুল করা” বলে অমার্জনীয় একটি অপরাধকে শুধু লঘু নয়, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার এক অমোঘ বার্তা দিলেন তাঁর দলের নেতা কর্মীদের প্রতি। তিনি যেন বোঝাতে চাইলেন দুর্নীতি, তা যত বড় মাপের ও পরিধি জুড়েই হোক না কেন, সকলকে তিনি দেখবেন ‘ক্ষমাসুন্দর চোখে’। তাই “একটা কেষ্টর জায়গায় হাজারটা কেষ্ট”র জন্ম নেওয়ার বার্তার পাশাপাশি, জেল থেকে বেরোনোর দিনে তাকে ‘বীরের সম্মান’ দিয়ে বরণ করার নিদান তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দিয়েছেন।

এই মুখ্যমন্ত্রীই ঘোষণা করলেন, “আমি ক্ষমতায় আসার পর বললাম, সিবিএসই-আইসিএসই’র সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে নম্বর বাড়িয়ে দাও”। তাঁর কথাই আইন। শিক্ষা দপ্তর তাঁর হাতের ক্রিড়নক মাত্র। এ’যেন পড়ুয়াদের হাতে মোয়া মুড়কি তুলে দেওয়া। শিক্ষাক্ষেত্রকে কতটা এলেবেলে মনে করলে এই ধরনের নির্দেশ আসে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের তরফ থেকে। তারই কথায় ও সম্মতিতেই সব চলে, অথচ এতদিন ধরে এতো সুনিপুণ অর্থ লেনদেনের পাট যে শিক্ষা দপ্তরের অধীনে চলতো, তাকে ছোটখাটো ভুল হিসাবে ‘উপেক্ষা’ করে আদতে সেই অপরাধকেই প্রশ্রয় ও মদত দিয়ে গেছেন।

শুধু শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত প্রশ্নে দুর্নীতি নয় — তৃণমূল আমলে আজ ফুটে বেরিয়েছে গোটা রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার হাড় জিরজিরে কঙ্কালসার চেহারাটা। দেউলিয়ে হয়ে গেছে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামো, মারাত্মকভাবে কমেছে শিক্ষক-পড়ুয়ার অনুপাত, ক্ষয়প্রাপ্ত শিক্ষার মান, উধাও স্কুলছুট কমানোর জরুরি পদক্ষেপ ও আরো বেশি সংখ্যক সমাজের পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক বঞ্চিত মানুষদের স্কুলের আঙিনায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা। এ প্রশ্নে মমতা সরকার নিদারুণ ভাবে ব্যর্থ। বেছে নেওয়া যাক একটা মাত্র উদাহরণ। রাজ্যের অন্যতম পশ্চাদপদ জেলা ঝাড়গ্রাম, যা তপশীলি জাতি উপজাতি অধ্যূষিত। মোট ১১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৫৪৮ জনসংখ্যার এই জেলায় তপশীলি জাতি-উপজাতির হার যথাক্রমে ২০.১১ এবং ২৯.৩৭ শতাংশ। এখানকার ‘আধারিশোল প্রাইমারি নয়াগ্রাম’ সার্কেলে মোট স্কুল ৮৩। এরমধ্যে শিক্ষক নেই ১টি স্কুলে, একজন শিক্ষক দিয়ে স্কুল চলছে ৮টি স্কুলে, দু’জন শিক্ষক দিয়ে স্কুল চলছে ৫৯টি স্কুলে! ‘আধারিশোল প্রাইমারি নয়াগ্রাম ১’ সার্কেলে মোট স্কুল ৮৭, যারমধ্যে একজন শিক্ষক দিয়ে স্কুল চলছে ২১টি স্কুলে, দু’জন শিক্ষক দিয়ে স্কুল চলছে ৬০টি স্কুলে। ঝাড়গ্রাম পূর্ব সার্কেলে মোট ৬৪ স্কুলের মধ্যে একজন শিক্ষক রয়েছেন ৪টিতে আর ২ জন রয়েছেন ২৪টিতে। এদিকে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা, তাঁর আমলেই “পশ্চিমবঙ্গে পড়াশুনোর ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন হয়েছে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে”। কিছু স্কুল বিল্ডিং হয়তো বেড়েছে শিক্ষক ছাড়াই, আর এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে এ রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রের ভবিতব্য।

সমস্ত অর্থনীতিবিদ’রা এ বিষয়ে একমত, অতিমারীর ছোবলে ক্ষতবিক্ষত অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা হয়তো ধাপে ধাপে সামাল দিয়ে উঠে দাঁড়াবে, কিন্তু শিক্ষাজগতে যে অপরিসীম ক্ষতি হয়ে গেল, তা আর পূরণ করা যাবে না। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় অধিকাংশ পড়ুয়ারাই আগের পড়া বেমালুম ভুলে গেছে, হারিয়েছে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ। নিয়মিত স্কুলে আসতেও তাদের প্রবল অনীহা। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছাত্রীরাও নিজেদের বক্তব্য গুছিয়ে লিখতে পারছেনা, নিজেদের নামের বানান, সাধারণ যোগ-বিয়োগ, রিডিং — কিছুই সঠিকভাবে করতে পারছেনা। বহু শিক্ষাবিদ এই সংকটের পরিত্রাণ হিসাবে যে ব্রিজ কোর্সের কথা বলেছিলেন, রাজ্য সরকার তা কর্ণপাতও করলনা। এর পাশাপাশি রয়েছে শিক্ষক-পড়ুয়ার অনুপাতের মারাত্মক রকমের ভারসাম্যহীনতা।

দুর্নীতি শিক্ষা ব্যবস্থার দৃশ্যমান এক ভয়ংকর রোগ। যার মূলোৎপাটন করা রীতিমতো কঠিন। যোগ্য কর্মপ্রত্যাশীদের নিয়োগের পাশাপাশি রাজ্যের গোটা শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার সাধনের লক্ষ্যেই বিবেকবান গণতন্ত্রপ্রিয় নাগরিক, বামপন্থীদের এগিয়ে আসতে হবে — অর্থের বিনিময়ে নিজেদের প্রভাবিত বৃত্তে অল্প কিছু জনকে নিয়োগের পাশাপাশি, বিপুল সংখ্যক শিক্ষক পদে নিয়োগ না করে শিক্ষা ব্যবস্থাকেই আজ ঠেলে দেওয়া হয়েছে গভীর অন্ধকারের অতলে।

এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে।

EWS Reservation

সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়টি মোদী সরকারের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর অংশের জন্য ১০% কোটা (সংরক্ষণ)-কে অনুমোদন করেছে। উদ্দেশ্য – অগ্রসর জাতিগুলিকে সংরক্ষণের আওতায় আনা। এই রায় ভারতীয় সংবিধানের মর্মমূলে নিহিত সংরক্ষণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করেছে। এই রায় বঞ্চিত শ্রেণিগুলির প্রতি ঐতিহাসিক অবিচারকে আরও শক্তি জোগালো। তারই পুনরাবৃত্তি শোনা গেল বিচারপতি এস রবীন্দ্র ভাটের পর্যবেক্ষণে যিনি এই রায়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তিনি ভারতের প্রধান বিচারপতি ইউ ইউ ললিতের সঙ্গে সহমত হয়ে, ইডব্লুএস সংরক্ষণের রায়ে বলেছেন — “এই আদালত প্রজাতন্ত্রের সাতটি দশকে এই প্রথম স্পষ্টতই একটি বহিষ্কারমূলক ও বৈষম্যমূলক নীতিকে অনুমোদন করল। আমাদের সংবিধান বর্জনের ভাষা বলে না। আমার সুচিন্তিত অভিমত, এই রায় বাদ দেওয়ার কথা বলে সামাজিক ন্যায়ের বুনন তথা বুনিয়াদি কাঠামোর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত হেনেছে।”

ভারতীয় সংবিধান যখন আজকের চেহারা পাচ্ছিল, তখন ‘সাম্যবাদী ভারত’ গড়ার লক্ষ্যে, জনগণের বঞ্চিত অংশের জন্য সংরক্ষণের নীতি এর মধ্যে বুনে দেওয়া হয়েছিল। সেটিই প্রতিফলিত হয়েছিল ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় যা “মর্যাদা ও সুযোগের সমতার” আশ্বাস দেয়। হাজার হাজার বছরের জাতিভিত্তিক বৈষম্য ওবিসি, দলিত, আদিবাসীদের সমস্ত অধিকার ও সুযোগ কেড়ে নিয়ে তাদের সমাজের এক প্রান্তে ঠেলে দিয়েছিল। বস্তুত সংরক্ষণ শব্দটি অনূদিত হয় প্রতিনিধিত্বে, ঐতিহাসিক অবিচার ও বৈষম্যের জন্য ‘বর্জিতদে’ প্রতিনিধিত্ব ও সমান সুযোগ দেওয়ার চেতনায়। এই বিষয়টিই পুনরায় উচ্চারিত হয়েছে এই ভিন্ন মতের রায়ে “নাগরিকদের মধ্যে সংবিধান-স্বীকৃত অনগ্রসর শ্রেণিগুলির সম্পূর্ণ এবং স্বেচ্ছাচারী বর্জন এবং আরও নির্দিষ্টভাবে তফসিলি জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়গুলির বর্জন, বৈষম্য ছাড়া আর কিছুই নয় আর সেটা পৌঁছে গেছে অন্তর্ঘাতের পর্যায়ে, এবং সমতার সংহিতা, বিশেষ করে বৈষম্যহীনতার নীতিকে ধ্বংস করছে।”

শীর্ষ আদালতের পূর্বোল্লিখিত ঐ বিকৃত রায় ভারতের জাতি ব্যবস্থা এবং বঞ্চিত সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবনে তার প্রকাশের আসল বাস্তবতা থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। সংবিধানে উল্লিখিত “অনগ্রসর” শ্রেণির জন্য সদর্থক পদক্ষেপ হিসাবে এবং নভেম্বর, ১৯৪৮-এ সাংবিধানিক পরিষদে (কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি)-র বিতর্কে বিস্তারিত আলোচনার মূলে থাকা সংরক্ষণের উদ্দেশ্য দারিদ্র্য দূরীকরণ ছিল না। বরং ছিল সামাজিক ন্যায় অর্জন। শীর্ষ আদালতের রায় তাই ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক চেতনাকে লঙ্ঘন করেছে।

সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগে, ২০১৯-এর জানুয়ারিতে মোদী সরকার সংসদে সংবিধান (একশো তিনতম সংশোধন) আইন ২০১৯ পাস করে ইডব্লুএস সংরক্ষণ চালু করার চেষ্টা শুরু করেছিল। এর ফলে সরকার উচ্চতর শিক্ষা ও সরকারি কর্মসংস্থানের ব্যাপারে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে সংরক্ষণ চালু করার ক্ষমতা পেয়ে গেল। এই আইন অগ্রসর শ্রেণিগুলির জন্য সংরক্ষণকে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্যে সংবিধানে ১৫(৬) ও ১৬(৬) সন্নিবেশিত করে ১৫ এবং ১৬ নং ধারায় সংশোধন করে।

এই সংশোধনের উদ্দেশ্য তফসিলি জাতি/উপজাতি/অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিগুলির কোটাকে তলে তলে বিলুপ্ত করা, আরএসএস যা বহুদিন ধরে চেয়ে আসছে। বস্তুত বিচারপতি বেলা ত্রিবেদী এবং বিচারপতি পার্দিওয়ালা, যারা বিচারপতি দীনেশ মাহেশ্বরীর সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিমত গঠন করেছেন, তারা তাদের ঐকমত্যের অভিমতে জানিয়েছেন — সংরক্ষণের বিষয়টি পর্যালোচনা করা ও তার মেয়াদের সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত। সংরক্ষণ ব্যবস্থায় ক্রমশ অযথা বিলম্ব, আইনি ফাঁকফোকর খোঁজা আর অ-কার্যকর করার প্রবণতা বেড়েছে। আর এখন তাকে গোপনে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে নিরঙ্কুশ বেসরকারিকরণের মাধ্যমে।

সংবিধান কেবলমাত্র সামাজিক ও শিক্ষাগত অনগ্রসরতাকেই সংরক্ষণের ‘মানদণ্ড’ হিসেবে স্বীকার করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, সংবিধান সেই নীতিকেই স্বীকার করে যে নীতি অনুসারে সংরক্ষণ অর্থনৈতিক বঞ্চনা প্রশমনের কোনো উপায় নয়, শুধুমাত্র প্রথানুগ সামাজিক ও শিক্ষাগত বৈষম্য ও বর্জনকে (কিছুটা পরিমানে) কমাতে পারে। উচ্চ বর্ণের মানুষ, গরিব হলেও, প্রথানুগ বৈষম্য, বর্জনের শিকার, এবং শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগবঞ্চিত — এই দাবিটি কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান বা সমীক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। কর্মহীনতা এবং দারিদ্র্য একটি স্বতন্ত্র সমস্যা এবং তার প্রতিকারের জন্য চাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আরও বেশি মজুরি। আর এই ক্ষেত্রেই মোদী সরকার লক্ষ্যণীয়ভাবে ব্যর্থ।

অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর অংশের (ইডব্লুএস) জন্য ১০% সংরক্ষণ — বাস্তবে এই অভিধাটির সম্পূর্ণ অপপ্রয়োগ হয়েছে। এই সংরক্ষণ নিরঙ্কুশভাবে শুধু উচ্চ বর্ণের জন্য যার উদ্দেশ্য — বঞ্চিত অংশের জন্য সদর্থক পদক্ষেপের নীতিকে গুরুত্বহীন করে দেওয়া। সত্যিই দলিত, আদিবাসী এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিগুলিকে ইডব্লুএস সংরক্ষণের দাবিদারের তালিকা থেকে স্পষ্টতই বাদ দেওয়া হয়েছে। এমনকি যোগ্যতার বিষয়টি বিচ্ছিন্ন করাও এক মস্ত প্রতারণা। শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে ইডব্লুএস সংরক্ষণ কার্যকরী করার জন্য তৈরি নিয়মাবলী অনুযায়ী, যোগ্যতা হল — বার্ষিক আয় ৮ লক্ষ অর্থাৎ মাসিক আয় ৬৭০০০ টাকা। ঐতিহাসিক জাতিভিত্তিক অবিচারের কারণে উৎপীড়িত সম্প্রদায়গুলির ভয়াবহ দারিদ্র্যের প্রতি এটা হল এক নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ! এই মাপকাঠি ‘দারিদ্র্যের’ সংজ্ঞাকে অর্থহীন করে ফেলেছে। আর উচ্চ বর্ণের গরিব ও বেকারদেরও কার্যকরী ভাবে নিশানায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে।

এসসি-এসটি-ওবিসি বহির্ভূত অংশের অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিতদের জন্য চাকরি ও শিক্ষায় কোটার ভাবনা নিয়ে সওয়ালের ব্যাপারে মোদী কোনভাবেই ‘প্রথম’ নন। ১৯৯১ সালে নরসিংহ রাও সরকার একই রকম একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। সে সময়ে “জনগণের অন্যান্য অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা অংশ যারা সংরক্ষণের প্রচলিত পরিকল্পগুলির কোনটির আওতাভুক্ত নন” তাদের জন্য সরকারি পদের ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল। শীর্ষ আদালতের ৯ বিচারপতির এক সাংবিধানিক বেঞ্চ সেই পদক্ষেপকে বাতিল করে দেয়। তাদের পর্যবেক্ষণ ছিল, শুধু দারিদ্র্য অনগ্রসরতার মাপকাঠি (টেস্ট) হতে পারে না এবং যে কোনো সংরক্ষণের একমাত্র সাংবিধানিক ভিত্তি হল সামাজিক ও শিক্ষাগত পশ্চাদপদতা।

সামাজিক ন্যায় ও সংরক্ষণের প্রশ্ন দুটি পরস্পরকে জড়িয়ে আছে, আর তাদের কোনোভাবেই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হিসেবে আলাদা করে দেখা যাবে না। তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য সদর্থক পদক্ষেপ বা সংরক্ষণের ভাবনা ছিল বঞ্চিত সম্প্রদায়গুলির জন্য সামাজিক ন্যায় ও সামাজিক গতিশীলতা সম্পর্কে ডঃ বি আর আম্বেদকরের স্বপ্নের একেবারে সার অংশ — প্রাণ ভোমরা। মোদী সরকার এবং আরএসএস একদিকে আম্বেদকরের দখলদারি নিতে ব্যস্ত আর অন্যদিকে উৎপীড়িত জাতিগুলির জন্য সংরক্ষণের প্রয়োজন সম্পর্কিত তাঁর মৌলিক ভাবনাকেই খারিজ করে দিচ্ছে!

ইডব্লুএস সংরক্ষণ, এইভাবে সংরক্ষণ ব্যবস্থার মধ্যে আরেকটা সমান্তরাল কাঠামো তৈরি করছে যার স্পষ্ট উদ্দেশ্য হল জাতিপ্রথা চালু করা এবং সমাজের ঐতিহাসিকভাবে বঞ্চিত অংশের বিরুদ্ধে বৈষম্যকে আরও ঘনীভূত করা!

মোদী সরকার, যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, এখন ইডব্লুএস সংরক্ষণকে ব্যবহার করছে এক বেপরোয়া অপসারণ কৌশল হিসেবে। সদর্থক পদক্ষেপ চাকরিগুলোকে মোটেই ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেয়নি – মোদী এবং আরএসএস মানুষকে যেটা বিশ্বাস করাতে চাইছেন। সরকার চাকরিগুলো, দেশবাসীর জীবনের মতোই , বলি দিয়ে চলেছে কর্পোরেট মুনাফাবাজি এবং তাদের দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের বেদীতে। আজ ভারতে বেকারত্বের হার লাফিয়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৭৭ শতাংশে, যখন প্রতিদিন আরও আরও বেশি মানুষ কাজ হারাচ্ছেন। তাদের এইভাবেই দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

আমাদের অত্যন্ত কঠোরভাবে ১০ শতাংশ ইডব্লুএস সংরক্ষণের বিরোধিতা করতে হবে কারণ এটি সংবিধানের চেতনার ভয়ঙ্কর লঙ্ঘন এবং সামাজিক ন্যায়ের নীতির প্রতি এক কুৎসিত বিদ্রুপ। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য চাই আরও কর্মসংস্থান, চাই অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন। আর তা অর্জন করতে হলে থামিয়ে দিতে হবে মোদী সরকারের নির্লজ্জ কর্পোরেট-ভজনা এবং বেসরকারিকরণের উৎকট উন্মাদনা!

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয় ৮ নভেম্বর ২০২২)

Historic victory of Joy Engineering

বিগত ২০০৩ সালে বিখ্যাত ঊষা ফ্যান কারখানায়, যা জয় ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ড্রাস্টিজ নামে পরিচিত, ৯০৩ জন শ্রমিককে মালিকরা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর নোটিশ জারী করে। নানা ভয়ভীতি জারি করে শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এর বিরুদ্ধে ১৪ জন শ্রমিক মালিকের এই শ্রমিক বিরোধী নোটিশ প্রত্যাখান করে। এই ১৪ জন শ্রমিক এআইসিসিটিইউ এবং সিআইটিইউ’র সদস্য ছিলেন। কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যুক্তভাবে লাগাতার রাস্তার আন্দোলন ও শ্রম আদালতে যুক্তভাবে ২০ বছর লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এই জয় ছিনিয়ে আনা হয়েছে। শ্রম আদালত রায় দিয়ে জানিয়েছে ২০০৩ সাল থেকে শ্রমিকদের সমস্ত বকেয়া অবিলম্বে মিটিয়ে দিতে হবে। সাথে সাথে অবিলম্বে শ্রমিকদের কাজে পুনর্বহাল করতে হবে। কর্মরত স্থায়ী শ্রমিকদের জোর করে অবসরে পাঠানো, যা ছিল সম্পূর্ণ বে-আইনি। এমনকি মামলা চলাকালীন একজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আদালত রায় দেয় যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন, তাঁর পরিবারকে সমস্ত বকেয়া দিতে হবে।

যখন শ্রমিকদের উপর সর্বত্র হামলা চলছে, আইনি অধিকার ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে, সেই সময় জয় ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানার শ্রমিকদের এই জয় ঐতিহাসিক।

আমরা অবিলম্বে জয় ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা কর্তৃপক্ষকে আদালতে জয়ী শ্রমিকদের দ্রুত নিয়োগের দাবি জানাচ্ছি।

- বাসুদেব বসু, সাধারণ সম্পাদক, এআইসিসিটিইউ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি

Resolutions adopted

(হুগলির চন্দননগরের রবীন্দ্র ভবনে ১৪-১৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত আয়ারলার সপ্তম জাতীয় সম্মেলনে নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয়)

১। বি আর আম্বেদকর জাতিপ্রথাকে শ্রমিকদের মধ্যে বিভাজন রূপে যে বিশ্লেষণ করেছিলেন আমরা তাকে অনুমোদন করি এবং মোদী সরকার সমাজে জাতপ্রথাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আমরা তার বিরোধিতা করি। সুপ্রিম কোর্ট অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বলতর অংশের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের প্রতি যে অনুমোদন দিয়েছে তাতে উচ্চ বর্ণের জন্য ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের মোদী সরকারের সিদ্ধান্তই বহাল রইল। এর মধ্যে দিয়ে সামাজিক ন্যায়ের নীতিই লঙ্ঘিত হলো যা তফশিলি জাতি, তফশিলি জনজাতি, এবং অন্যান্য পশ্চাদপদ শ্রেণীর মতো সংবিধান স্বীকৃত গোষ্ঠীগুলির জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থার পিছনে মূল নীতি হিসাবে কাজ করেছিল। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় ১০ শতাংশ কোটা থেকে এই গোষ্ঠীগুলোকে বাদ দেওয়ার ওপর ভিত্তি করেই হয়েছে। সংরক্ষণ দারিদ্র প্রশমনের কোনো পন্থা নয়, এর জন্য কর্মসংস্থান ও মজুরির উন্নয়ন ঘটাতে হবে আর এই বিষয়ে মোদী সরকার চূড়ান্ত রূপেই ব্যর্থ হয়েছে।

২। আয়ারলা ক্রমবর্ধমান ক্ষুধা ও গ্ৰামীণ ঋণগ্ৰস্ততার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তার সদস্যবৃন্দ ও সাধারণ জনগণের কাছে আবেদন জানাচ্ছে। ঋণগ্ৰস্ততার জন্য যে মৃত্যুগুলো ঘটছে তা মূল্যস্ফীতি এবং গ্ৰামীণ দরিদ্রদের নিঃস্ব হয়ে পড়ার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার লক্ষণগুলোকেই নির্দেশিত করে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান নিকৃষ্ট দেশগুলোর মধ্যেই রয়েছে এবং এই সূচকে স্থানের ধারাবাহিক অবনমন দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সরকার গ্ৰামীণ দরিদ্রদের শিশুদের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করছে যে শিশুরা ওয়েস্টিং (বয়সের তুলনায় ওজন কম) এবং স্টানটিং (বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম) আক্রান্ত এবং ক্রমেই আরও বেশি করে অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। সরকারের অবহেলায় শিশু মৃত্যুর এই বিষয়টা উপস্থিত প্রতিনিধিদের উদ্বিগ্ন করছে এবং চাপিয়ে দেওয়া এই স্বাস্থ্যহীনতা, অপুষ্টি ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে সমাবেশিত হতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

৩। লাগামছাড়া মূল্যস্ফীতি এবং বেকারির ক্রমবর্ধমান যে স্তর জনগণকে খাদ্যগ্ৰহণ হ্রাসে বাধ্য করছে, তার বিরুদ্ধে আমরা অবশ্যই সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলব। সরকার একদিকে মূল্যস্ফীতি এবং বেকারির নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা গ্ৰহণ করছে না, বিপরীতে কর্পোরেট মিত্রদের আরও ধনী করার নীতি নিয়ে অসাম্যকে বাড়িয়ে তুলছে।

৪। পশ্চিম বাংলায় শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির উন্মোচন ঘটেছে এবং তৃণমূল কংগ্রেসের পূর্বতন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি জেলে রয়েছেন। শিক্ষক নিয়োগের মূল ইস্যুটাকে কিন্তু ঠান্ডাঘরে আবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা দাবি জানাচ্ছি, গ্ৰামীণ দরিদ্রদের শিক্ষাকে বানচাল করা চলবে না এবং দ্রুতই স্বচ্ছতার সঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করতে হবে।

৫। বাজেট বরাদ্দের হ্রাস ঘটিয়ে, সময়মতো মজুরি প্রদানের ব্যবস্থা না করে এবং মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারির এই সময়ে কর্ম প্রার্থীদের কাজ থেকে বঞ্চিত করে মোদী সরকার এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকার এমএনআরইজিএ-র যে লঘুকরণ ঘটাচ্ছে এবং তার বিকৃতি সাধন করছে, আয়ারলা তাকে ধিক্কার জানাচ্ছে। এটাকে আমরা গ্ৰামীণ দরিদ্রদের জীবন ও জীবিকার অধিকারের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ বলে মনে করছি, এবং প্রতিদিন কাজের শেষে মজুরি প্রদান, বছরে ২০০ দিনের কাজ এবং দৈনিক মজুরি ৭০০ টাকা করার দাবিতে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্ৰহণ করব।

৬। দলিত ও আদিবাসীদের জীবন, জীবিকা, মর্যাদা, মজুরি, শিক্ষা, কর্মসংস্থানকে যেভাবে পদদলিত করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে রুখে দাঁড়ানোর জন্য আমরা জনগণের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। মনুবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মোদী সরকারের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ সংগঠিত করব। দলিত নারীদের বিরুদ্ধে চালানো হিংসা এবং দলিত ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলব।

৭। এক কোটিরও বেশি যে মহিলারা সরকারি প্রকল্পের রূপায়ণে যুক্ত আছেন তাদের আমরা সরকারের কর্মী ও শ্রমিক বলেই স্বীকৃতি দিই যাদের ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এই মহিলাদের অধিকাংশই গ্ৰামাঞ্চলে কাজ করেন এবং  তাদের অর্থনৈতিক অধিকার অর্জনকে সম্ভবপর করতে আমরা তাদের সংগঠিত করব।

৮। সমস্ত শষ্য এবং উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য লাভকে সুনিশ্চিত করতে রাজ্যপালদের ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের যে আহ্বান সংযুক্ত কিসান মোর্চা জানিয়েছে, আমরা আয়ারলার প্রতিনিধিরা তাতে সম্মতি জানাই। কৃষিকাজের কর্পোরেটিকরণ ঘটানোর যে নীতি সরকার নিয়েছে, তাকে আমরা কৃষি শ্রম/কাজের দর কষাকষির ক্ষমতাকে ছিনিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ বলেই গণ্য করি যে ক্ষমতা বহু সংগ্ৰামের অর্জিত ফসল।

৯। কাশ্মীরে পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুতে আমরা মর্মাহত। এটা মোদী-শাহর নীতির পরিপূর্ণ ব্যর্থতারই পরিণাম;  ঐ নীতি গোটা রাজ্যের ওপর দখল নিয়ে তাকে দুটো কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে ভাগ করেছে, ৩৭০ ধারার বিলোপ ঘটিয়েছে এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে অনাস্থার এক বিষাক্ত পরিমন্ডলের জন্ম দিয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন কেন্দ্র সরকারের হাতে রাজনীতির খেলার খোরাক হতে পারে না। আমরা দাবি জানাচ্ছি, কেন্দ্র সরকারকে আইন তৈরি করে পরিযায়ী শ্রমিকদের মর্যাদা, নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষাকে সুনিশ্চিত করতে হবে।

আয়ারলার জাতীয় সম্মেলনে ১৮টি রাজ্য থেকে প্রায় ৯০০ প্রতিনিধি অংশ নেন। সম্মেলন ২০৫ সদস্যের এক জাতীয় পরিষদ এবং ৭৯ সদস্যের জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করেছে। ধীরেন্দ্র ঝা সম্পাদক হিসাবে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন এবং সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন সত্যদেব রাম। আয়ারলার পৃষ্ঠপোষক মনোনীত হয়েছেন রামেশ্বর প্রসাদ এবং সাম্মানিক সভাপতি মনোনীত হয়েছেন শ্রীরাম চোধুরী।

working women

গত ১৪-১৫ নভেম্বর ২০২২ চন্দননগরের রবীন্দ্র ভবনে পালিত হলো আয়ারলা বা সারা ভারত কৃষক ও গ্রামীণ মজুর সমিতির সপ্তম সম্মেলন। সেখানে একত্রিত হন সারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা হরেক রকম মানুষ। তাঁদের পোশাক তাঁদের ভাষা এক একজনের এক এক রকম।

কথা হলো বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা কয়েকজন মহিলার সঙ্গে। জানতে চেষ্টা করা হল তাঁদের সামাজিক পরিস্থিতি কী? তাঁদের বেতন কেমন বা তাঁদের সামাজিক সুরক্ষা কতোটা? তাঁরা সারাদিন মাঠে কাজ করেন, এরপর তাঁদের বাড়ি ফিরে কাজ করতে হয়। তাই সামাজিক সুরক্ষার পাশাপাশি পারিবারিক সুরক্ষা এবং সমানাধিকারও দরকার।

ঝাড়খণ্ডের জামতলা জেলা থেকে আসা এক মহিলা কমরেড জানান তাঁদের বেতনের বৈষম্যতা। এর বিরুদ্ধে তাঁরা প্রতিবাদও করেন। মাঠে সারাদিন খাটুনির পর তাঁদের আবার বাড়িতেও কাজ করতে হয়। তাঁদের দাবি তাঁরা এই যে মাঠে কাজ করে মজুরি পান এতে নিজের জন্য ব্যয় করা দূরে থাক, এতে তো তাঁদের সংসার চলেই না। আবার তাঁদের বক্তব্য ছিল, যেসব পুরুষরা তাঁদের এইসব মাঠের কাজে নিযুক্ত করেন, যদি মহিলারা তাঁদের কথা না শোনেন তাঁদের নানারকম হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকী ওই পুরুষের কথা না শুনলে তাঁদের কাজ দেয় না। এর প্রতিবাদ তাঁরা সংগঠন থেকে করে থাকেন। আর তাই এই প্রতিবাদের ডাকেই তাঁরা উপস্থিত ছিলেন এই সম্মেলনে।

আবার পাঞ্জাবের বর্ধন জেলা শেরপুর থেকে কামরিত পুর্ভিন্দর কৌরের দাবি এই যে, তাঁরা পুরুষদের মতো সমানাধিকার পান না। তাঁরা চান কোনোরকম কোনো পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই তাঁরা যে পুরুষদের সমান কাজ করেন, তারজন্য তাঁরা যেন সমান মজুরি আর সমান সম্মান পান।

আবার বিহারের জুহি নিশা, যিনি বিহার আইপোয়া’র সহসচিব, তিনি জানান মহিলারা কীভাবে তাঁদের পরিবারকে দেখাশোনা করার জন্য বিভিন্নরকম কাজে নিজেকে নিযুক্ত করে থাকেন। কিন্তু তারপরেও তাঁদের বেতন কিছুতেই পুরুষদের সমান হয় না। পুরুষকে যদি সেই কাজের জন্য ৩০০ টাকা দেওয়া হয়, একজন মহিলা সেই একই কাজের বিনিময়ে ২৫০ টাকা পান। এছাড়াও তাঁদের ওপর নানারকম শারীরিক নির্যাতন এমনকী তাঁরা বলাৎকারেরও শিকার হন। তিনিও চান পুরুষ মহিলার মধ্যে এই পার্থক্য দূর হোক। তিনি এও বললেন মহিলারা চাইলে সব করতে পারেন। তাই ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার কিছু নেই। এগিয়ে আসতে হবে তাঁদের এবং লড়াই লড়তে হবে। একই কথা বললেন কেরালার কোন্নর জেলার কে রত্নকুমারী দেবীও। পুরুষের সমান কাজ করেও তাঁরা আজ একই মজুরি পাননা। পেতে হয় নানারকম বাধা, এমনকী নিগ্রহের শিকার। কিন্তু আর কতদিন এইভাবে চলবে? দূর হোক এই বৈষম্য, ঘুচে যাক নারী পুরুষের এই পার্থক্য। গড়ে উঠুক নতুন সমাজ। যে সমাজে পুরুষ মহিলা সকলের বেতন সমান হবে, থাকবে সকলের সমানাধিকার, সম্মান দান এবং যেখানে থাকবে সামাজিক ও পারিবারিক সুরক্ষা।

– অবন্তী ভট্টাচার্য

land for proposed airport

“এখানে বিমানবন্দরের প্রস্তাবিত স্থলের জন্য আমরা আমাদের জমি দেবো না। এটা তোমাদের উন্নয়ন হতে পারে, কিন্তু আমাদের জন্য সর্বনাশ।… শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত আমরা লড়াই করে যাব, কেননা, এটা আমাদের অস্তিত্বের লড়াই।” হিন্দিতে এই কথাগুলো লেখা ছিল উত্তরপ্রদেশের আজমগড় জেলার মান্দুরি গ্ৰাম সংলগ্ন রাস্তায় টাঙানো ফ্লেক্স বোর্ডে। আজমগড়ে বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণের কথা জানতে পেরে আটটা গ্ৰামের কৃষকরা একযোগে প্রতিবাদে নেমেছেন। সরকারের চোখে এবং নীতিতে যা উন্নয়ন, কৃষক ও গ্ৰামবাসীদের কাছে তা সর্বস্ব খুইয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়ার পথ। যে ভূমিতে তাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাস করছেন এবং যে জমি তাঁদের কাছে জীবিকার মূল উৎস, বসবাসের সেই স্থল ও চাষবাসের সেই জমি থেকে উচ্ছেদ হতে হলে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ দুইই নিমজ্জিত হয় অতল অন্ধকারে। ভিটে থেকে উচ্ছেদ হয়ে কোথায় যাবেন, জীবিকার সন্ধান কী হবে, কৃষক হওয়ায় পরিবারের অঙ্গ হিসাবে গবাদি পশুদের হাল কী হবে — এসব প্রশ্নই জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার মুখে দাঁড়ানো মানুষদের চিন্তাচ্ছন্ন করে, তাঁদের খাওয়া-ঘুম চলে যায়, আতঙ্ক তাঁদের তাড়া করে বেড়ায়। জমি নেওয়ার জন্য সরকারের তরফে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা অবশ্য থাকে — কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা কিছু নগদ টাকার হস্তান্তরে পরিণত হয়, নতুন জীবিকার সংস্থান সরকারি কর্তব্যের বাইরে থেকে যায়, যথার্থ পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সরকার কখনই নিজেকে চালিত করে না। নানান ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হওয়া বহু মানুষ আজও প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছেন, যথার্থ পুনর্বাসন তো দূরের কথা। প্রকৃত পুনর্বাসনের এই দুর্লভতারই উন্মোচন ঘটেছে জমি দিতে অসম্মত এক কৃষকের কথায়, “আমাদের হয়তো ফ্ল্যাটের সঙ্গে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, কিন্তু গরু-মোষেরা কোথায় যাবে? তাদেরও কি ফ্ল্যাটে স্থানান্তরিত করা হবে?” সাধারণ জনগণকে সরকার কতটা অবহেলার চোখে দেখে, এই কৃষকের কথায় তারই প্রতিফলন এবং তারমধ্যে প্রতিভাত উচ্ছেদ হওয়া বহু মানুষের প্রতিকূলতার অভিজ্ঞতা।

পাঁচটা বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার এ’বছরের জুলাই মাসে ভারতীয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। প্রস্তাবিত এই বিমানবন্দরগুলো হল — আজমগড়, আলিগড়, চিত্রকূট, সোনেভদ্র ও শ্রাবস্তি। আজমগড়ে বিমানবন্দরের জন্য প্রথম পর্যায়ে প্রয়োজন হবে ৩৬০ একর ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৩১০ একর জমির। এই জমি নেওয়ার পরিকল্পনা আটটা গ্ৰাম থেকে এবং সেগুলো হলো হাসানপুর, কাদিপুর, হরিকেষ, জামুয়া হরিরাম, জামুয়া জোলহা, গদনপুর চিন্দনপট্টি, মান্দুরি জিগিনা করমপুর ও জেহরা পিপরি। জমি অধিগ্রহণের জন্য সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি না হলেও সরকারি কতৃপক্ষ পরপর দু’দিন জমি সমীক্ষায় অংশ নেয়। প্রথম দিন, ১৩ অক্টোবর ২০২২ মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট (এসডিএম) পুলিশ বাহিনী ও পিএসি’র সশস্ত্র সদস্যদের নিয়ে জামুয়া গ্ৰামে জমি সমীক্ষায় আসেন। কিন্তু ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আতঙ্ককে বয়ে বেড়ানো ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ জনগণ তাদের ঘিরে ধরলে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। পরদিন ১৪ অক্টোবর আবার বৃহত্তর বাহিনী নিয়ে হাজির হয় জমি সমীক্ষার উদ্দেশ্যে। পরিকল্পনা মতো তারা পুরুষদের ঘরে আটকে রাখে, কিন্তু মহিলারা সংঘবদ্ধ প্রতিবাদে এগিয়ে আসেন এবং পুলিশ বাহিনী তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। এই ঘটনার পর জামুয়া, জিমিয়া, হাসানপুর, করিমপুরের গ্ৰামবাসীরা একযোগে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র ও বিমানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে ১৪ অক্টোবরের পুলিশি বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। তাঁরা জমি না দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা সমবেতভাবে স্বাক্ষর করা চিঠিতে জানিয়েছেন, বহু সংখ্যক ‘অসম্মতি পত্র’ পাঠিয়েছেন এবং জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে ধরনা সংগঠিত করেছেন। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন — জমি দিতে তাঁদের অসম্মতির পরিপ্রেক্ষিতে সমীক্ষার প্রয়োজন কি আদৌ রয়েছে? তাঁদের আরও প্রশ্ন — আজমগড় থেকে কয়েক ঘন্টার দূরত্বে রয়েছে বেনারস, কুশিনগর, গোরখপুর, অযোধ্যা ও লক্ষ্ণৌ বিমানবন্দর। সেক্ষেত্রে আজমগড়ে বিমানবন্দর নির্মাণ কি একান্তই আবশ্যক? উল্লিখিত ব্যক্তিদের কাছে লেখা চিঠিতে তাঁরা তাঁদের উন্নয়নের আকাঙ্খার রূপরেখাকে তুলে ধরে বলেছেন, “আমরা বিমানবন্দর চাই না, কিন্তু ভালো স্কুল, হাসপাতাল ও একটা বিশ্ববিদ্যালয় চাই।”

Azamgarh farmers pledge

বিমানবন্দর নির্মাণের নামে উন্নয়নের যে মডেলের প্রয়োগ যোগী সরকার উত্তরপ্রদেশে ঘটাতে চাইছেন তা গণতন্ত্র এবং তার সাথে জনস্বার্থেরও বিরোধী। জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে জমির মালিক কৃষকের সম্মতিকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করা হচ্ছে। কৃষকদের মতামতকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে জমির ওপর তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে খারিজ করা হচ্ছে। জমি শুধু কৃষকের নয়, কৃষি শ্রমিকেরও জীবিকার উৎস। সেই জীবিকাকে উৎসর্গীকৃত করা হচ্ছে নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির চূড়ান্ত লক্ষ্য কর্পোরেট স্বার্থের বেদীমূলে। আজমগড়ের কৃষকরাও বলছেন, কর্পোরেট কর্তা ও রাজনীতিবিদরা পারস্পরিক স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ, এবং কর্পোরেটদের অর্থনৈতিক স্বার্থই যোগী সরকারকে চালিত করছে ‘উন্নয়ন’এর বিমানবন্দর নির্মাণের পথে যা দাঁড়িয়ে রয়েছে সমগ্ৰ কৃষক স্থার্থের বৈপরীত্যে। কৃষক ও কৃষি শ্রমিক উভয়েরই জীবিকার অধিকার এইভাবে রাষ্ট্রের চালানো উন্নয়নের রথের চাকায় নিষ্পেষিত হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদী যেমন সংসদীয় গরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করছেন সংসদে কোনো আলোচনা ছাড়াই নিজেদের কাঙ্খিত প্রকল্পগুলোকে অবাধে চালিত করতে, উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারও বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর ভিত্তি করে কৃষক জনগণের সমবেত প্রতিরোধের বিরুদ্ধেই নিজেদের দাঁড় করাচ্ছে। মোদী সরকারের তৈরি তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল, সেই সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা আজমগড়ের কৃষকদের প্রতিরোধে সমর্থন জানিয়েছে এবং তারাও কৃষকদের সমর্থনে প্রতিবাদ সংগঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া, সমাজবাদী পার্টি, কংগ্ৰেস, বিএসপি’র মতো বিরোধী পক্ষের দলও কৃষকদের জমি দানের অসম্মতির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। দেড় দশক আগে পশ্চিমবাংলাতেও জমির ওপর কৃষকের অধিকার বনাম কর্পোরেট স্বার্থে জমি অধিগ্রহণের সংঘাত মঞ্চস্থ হয়েছিল। টাটার কেশাগ্ৰ কাউকে স্পর্শ করতে দেওয়া হবে না বলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সদম্ভ হুঙ্কারের পর তাদের যাবতীয় আত্মম্ভরিতাকে ধুলোয় মিশে যেতে আমরা দেখেছিলাম। আজমগড়ের কৃষকদের প্রতিরোধ শেষমেষ কোন পরিণতি পায় তার দিকে আমরা অবশ্যই সাগ্ৰহে তাকিয়ে থাকব।

– জয়দীপ মিত্র

The judgment cry

গণধর্ষণ কাণ্ডে লিপ্ত তিনজন অপরাধীকে এবার বেকসুর খালাস করে দিল সর্বোচ্চ আদালত! আটবছর পর। গণধর্ষণের পর নৃশংস ভাবে সেই মহিলাকে খুন ও করা হয়। যে ট্রায়াল কোর্ট ওই তিনজন অপরাধীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিল, সুপ্রিম কোর্ট সেই রায়কে খারিজ করে আসামীদের মুক্তি দিয়ে দিল।

সুপ্রিম কোর্টের তিনজন বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ — সদ্য প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ইউ ইউ ললিত, এস রবীন্দ্র ভট্ট, এবং বেলা এম ত্রিবেদি, বিচার প্রক্রিয়ার শেষে জানান, যে সমস্ত পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য সাবুদের উপর নির্ভর করে এই তিনজনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়, তা অত্যন্ত দুর্বল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আর প্রমাণ সাপেক্ষ নয়।

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফাঁসির আদেশ দেওয়ার সময় সেশন কোর্ট বলেছিল, “এই তিনজনের বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই। যে ঘৃণ্য অপরাধ তারা করেছে, তার জন্য এদের নেই বিন্দুমাত্র অনুতাপ”। ২০১৪ সালের আগস্টে দিল্লি হাইকোর্টে এই মামলাটির শুনানির পর সেখানেও নিম্ন আদালতে ফাঁসির আদেশ বহাল রাখা হয়।

স্বভাবতই, সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ে ভেঙে পড়েন মেয়েটির বাবা ও মা। তারা বলেন, “আমরা গরিব। তাই আমাদের এই পরিণতি।” মৃতার বাবা একজন নিরাপত্তা কর্মী। বোঝাই যাচ্ছে, অভাবে দিন কাটানো এই পরিবারটির পক্ষে অনেক অর্থের বিনিময়ে কোনো একজন প্রথম সারির আইনজীবীকে নিয়োগ করা সম্ভবপর ছিল না।

১৯ বছরের ওই মহিলাটি গুরুগ্রামের সাইবার সিটি অফিস থেকে ফেরার সময় অপহৃত হন। মেয়েটির সাথে তাঁর তিন বন্ধু ছিল। আততায়ীরা গাড়ি করে এসে তাঁকে টেনে হিঁচড়ে তুলে নেয়। বাড়িতে দীর্ঘক্ষণ না ফেরায় তাঁর পরিবার পুলিশ স্টেশনে অভিযোগ দায়ের করে। পরে পুলিশ বেশ কিছুটা দূরে তিন দিন পর এক গ্রামের পাশে মেয়েটির ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ উদ্ধার করে। পুলিশ পরে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের অনুসন্ধান রিপোর্টে বলা হয়েছে, মেয়েটির ক্ষত বিক্ষত দেহে অনেক আঘাতের চিহ্ন। পুলিশের রিপোর্ট জানিয়েছে, গণধর্ষনের পর মেয়েটিকে খুন করা হয়েছে। মৃতার বাবা বলেন, তাঁর মেয়েকে ধর্ষণ করার পর অ্যাসিড ঢেলে বেদম শারীরিক অত্যাচার করে খুন করা হয়।

সর্বোচ্চ আদালতের যুক্তি হল, তারা খতিয়ে দেখেছেন যে যাদের যাদের সাক্ষী হিসাবে দাঁড় করানো হয়, তারা জানিয়েছে যে কোনো টিআই প্যারেড হয়নি (অপরাধীদের সনাক্ত করার জন্য যা করা হয়ে থাকে), কোনো সাক্ষীও অপরাধী হিসাবে অভিযুক্ত আসামীদের সনাক্ত করেনি, তাই গোটা তদন্ত প্রক্রিয়াটাই দাঁড়িয়ে ছিল নিছক সন্দেহের ভিত্তিতে, পারিপার্শ্বিক সাখ্য সাবুদের উপর, কোনো দৃঢ় প্রমাণের আধারে নয়। সুপ্রিম কোর্ট আরও জানায়, গাড়ি থেকে শুরু করে যে সমস্ত অস্ত্র বা নানান ধরনের জিনিষপত্র পাওয়া গেছিল, সেগুলো যে ধর্ষণকাণ্ডে ব্যবহার করা হয় তার উপযুক্ত প্রমাণ, ফরেন্সিক রিপোর্ট ও অনুসন্ধানকারী কর্তাব্যক্তিরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। “গভীর এক ষড়যন্ত্রের সাথে এই ব্যক্তিরা জড়িত থাকলেও, যেহেতু আদালতে তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তাই তাদের রেহাই করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই” — এই ছিল সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ।

দু-দুটো আদালত যে ফাঁসির আদেশ দিল ও বহাল রাখল, তা কি এতই ফাঁপা ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ছিল? প্রশ্ন উঠেছে, গুরুতর এই অপরাধের তদন্ত অনুসন্ধান কি এতই গা-ছাড়া মনোভাব নিয়ে পরিচালিত হয়? এতই ভাসা ভাসা পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-সাবুদের উপর যে তদন্ত দাঁড়িয়ে ছিল তা কি রায়দানের সময় মহামান্য আদালতের বিবেচনায় ধরা পড়েনি? কেনই বা ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনার ফের যথাযথ, পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও তার ফাঁকগুলোকে ভরাট করার আদেশ দেওয়া হল না কেন?

এই সমগ্র ঘটনা আবার চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্ত অপরাধীদের শাস্তি দিতে পুলিশ-প্রশাসন, বিচারদানের প্রক্রিয়া কী নিদারুণভাবে পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে পরিচালিত হয়, যার শত ছিদ্রপথ দিয়ে অপরাধীরা মুক্তি পেয়ে যায়, বা বেকসুর খালাস করার রাস্তা তাদের তৈরি করে দেওয়া হয়।

এই ঘটনা এই শিক্ষা দিল, গোটা তদন্ত প্রক্রিয়ায় নাগরিক সমাজের যথাযথ নজরদারি, আইনের ফাঁক গুলোকে ভরাট করার জন্য তীব্র জনমত গড়ে তোলা এবং প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার উপর লাগাতার চাপ বজায় রাখা কতটা জরুরি।

বিলকিস বানো-র অপরাধীদের ফুলের মালা পরিয়ে জেল থেকে বরণ করা হল, এই ঘটনায় ধর্ষকেরা দিব্যি মুক্তি পেল “প্রকৃত সাক্ষ্যের অভাবে”। কি বিচিত্র আইনের ব্যাখ্যা। ততধিক বিচিত্র আদালত-পুলিশ প্রশাসন ও তদন্তকারী অফিসারদের অবস্থান। মানুষকে তাই এই সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত আওয়াজ তুলতে হবে।

(তথ্য সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রস, ৮ নভেম্বর)
– স্বপ্না চক্রবর্তী

demonetisation

৬ বছর আগে, নভেম্বরের ৮ তারিখে, সন্ধে রাতে ছিলাম বিধান সরণীতে, বাড়ি থেকে ১০-১২ কিমি দূরে। হঠাৎ স্ত্রী ফোন করে বললেন, ফেরার সময় যেন দোকান বাজার করে নিয়ে আসি কারণ, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল হয়ে যাচ্ছে রাত ১২টা থেকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মোদিজি তেমনটাই ঘোষণা করেছেন খানিক আগে রাত ৮ টার সময়ে। যেহেতু অর্থনীতির ছাত্র ও রাজনীতিও অল্পবিস্তর করি তাই বুঝতে চেষ্টা করলাম কী ঘটতে চলেছে। মানিব্যাগে একটি ৫০০ টাকার নোট ও আরো শ দুয়েক টাকা ছিল। সেটা জানিয়ে স্ত্রীকে বলেছিলাম, বাজার যাই করি না কেন, ওই দুশো টাকার মধ্যেই করতে হবে কারণ, রাত ১২টা অবধি ৫০০ টাকা চালু থাকলেও কেউ এখন তা নেবে না। ফলে কেন ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ৫০০/১০০০ টাকার লেনদেনের বন্দোবস্ত খুলে রাখা হয়েছিল তা বোধগম্য হল না, যদিও পরে বুঝেছিলাম। তার পরের দিন থেকে বাজারে যেতে পারিনি, বাসেও উঠতে পারিনি। বিক্রেতাদের কাছে ধার দেনা করে চালিয়েছি। যেহেতু সচ্ছল মধ্যবিত্ত তাই পরিচিত বিক্রেতারা ধার দিয়েছেন। কিন্তু দরিদ্র দিন আনা দিন খাওয়া অটোচালক, রিক্সাচালক, বাসচালক, বাস কন্ডাক্টর অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জীবন দুর্বিসহ ছিল।

নোট বাতিলের পরে একজন কলেজ সহপাঠী, যিনি বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ, এখন মাঝেমাঝে বাংলায় সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকে অর্থনীতি সংক্রান্ত বিশেষ লেখা লেখেন, সম্পাদকীয় পাতায়, তিনি সামাজিক মাধ্যমে ওই নোটবাতিলের গুণাগুণ বললেন, কীভাবে তা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে তা বললেন, এবং সেই সময় কলকাতায় এসে তিনি যে কোনো অসুবিধের সম্মুখীন হননি, বাজারের বিক্রেতাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না তাও জানালেন। ৬ বছর পরে ওই সব বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাইদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, “কালো টাকা কত পাওয়া গেল শুনি।“ যে সমস্ত অর্থনীতিবিদ, হিসাব রক্ষক, উকিল, চিকিৎসক, অভিনেতা ও ভক্তজন নোটবাতিলের পক্ষে উদ্বাহু হয়ে নেচেছিলেন, তাঁরা বলতে পারবেন, কত কালো টাকা উদ্ধার হয়েছিল, নোট বাতিলের ফলে?

কালো টাকাকে সমূলে বিনাশ করার আত্মম্ভরী ঘোষণাকারী নরেন্দ্র মোদি দেশের মানুষের স্বার্থ নিয়ে নাটকীয়তায় পারদর্শিতা অর্জন করেছেন। সামাজিক সূচকে ক্রমাগত পিছিয়ে চলা দেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি নিজ দেশের মধ্যে জনপ্রিয়তার নিরিখে বিশ্বে জনপ্রিয়তম রাষ্ট্রপ্রধান। যদিও তাঁর মূল কৃতিত্ব নাটকীয় ঘোষণার মাধ্যমে জনসাধারণকে কখনো ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড় করিয়ে,  আবার কখনো  রেললাইনে শুতে বাধ্য করে মৃত্যুমুখে পাঠানোয়। কোনো ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা ব্যতিরেকেই হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা করে লাখো পরিযায়ী শ্রমিককে, শিশু পরিবার সহ, যোজনের পর যোজন হাঁটতে বাধ্য করেছিলেন তিনি। যদিও, হু-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী কোভিডের ফলে ভারতে মারা গেছেন প্রায় আধ কোটি লোক, যা ভারত সরকারের পরিসংখ্যানের প্রায় ১০ গুণ। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই ১২ বছরের শিশু শ্রমিক জামালো মাকদামের কথা যে ছত্তিশগড় থেকে ওড়িশা গিয়েছিল কাজ করতে, ২৫০ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি পৌঁছানোর কয়েক কিলোমিটার আগে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মারা গিয়েছিল। ফলে কোভিডের লকডাউন কোভিড নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হোক না হোক, জনসাধারণকে কষ্ট দিতে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। ‘জনপ্রিয়তম’ প্রধানমন্ত্রী নোট বাতিলেও অনুরূপ মর্ষকামী আনন্দ পেয়েছিলেন কি? নাহলে নোট বাতিলের পরে কীভাবেই বা হাসতে হাসতে বলেন, ‘ঘর মে সাদি হায়, পয়সা নেহি হায়’।

নোটবাতিলের ফলে আমাদের মতো সমালোচকরাও ভেবেছিল, ব্যাঙ্কে ২-৩লক্ষ কোটি টাকার দুনম্বরি অর্থনীতির সূত্রে জমা থাকা নোট ফিরবে না। কিন্তু শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ব্যাঙ্কে ফেরেনি মাত্র ১১ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে আমাদের বাড়ির ১০০০ টাকার একটি নোট, আমার আমেরিকা প্রবাসী বন্ধুর দেশ থেকে ঘুরে যাওয়ার পরে থেকে যাওয়া লক্ষাধিক টাকা, অপর বন্ধুর পুত্রদ্বয়ের উপনয়নে পাওয়া ১৭ হাজার টাকাও রয়েছে। অর্থাৎ ওই ১১ হাজার কোটি টাকা মোটেই দুনম্বরি টাকা নয়, দুনম্বরী আয়ের টাকা যথাবিহিত রাস্তা তৈরি করে ফিরে গেছে মালিকের কাছে। তার জন্যই মোদিজি ওই ৪ ঘন্টার (৮টা থেকে ১২টার) সময়কাল নির্দিষ্ট রেখেছিলেন। কেবল তাই নয়, লাখো জনধন ব্যাঙ্ক একাউন্ট তৈরি করানো ছিল, সম্ভবত যেখানে জমা করিয়ে সেই টাকার সামান্য ভাগ দিয়ে ওই সব দুনম্বরি টাকার মালিকরা পুনরায় টাকার মালিক হয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক অনুমানেও যে পরিমাণ নগদ দুনম্বরি টাকা জমা ছিল তাদের মালিকদের কাছে তাও শাসক-মালিক কারসাজিতে ব্যাঙ্কে জমা পড়ে গেছে।

৬ বছর আগে ঘটানো নোটবাতিলের রাজনীতি ভারতীয় অর্থনীতির নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষজনের যে দুর্দশার মধ্যে ফেলে দিয়েছে তা শুধরানো কোনোদিন সম্ভব হবে না। যারা নোটের লাইনে দাঁড়িয়ে মারা গেছেন তাঁরা ফিরে আসবেন না। বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ব্যবসায় লাটে উঠেছে, তার হদিশ পাওয়া যাবে না। কিন্তু অর্থনীতির উপরের তলার মানুষজন অনলাইন ব্যবসায়, ইউপিআই এসব নিয়ে অধিকতর ধনী হয়ে উঠেছে, তারা কখনো নোটবাতিলের বিরোধিতা নাও করতে পারেন। তাই নোটবাতিলের বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা উঠলে সরকার বলতে পারে অবলীলাক্রমে, নোটবাতিল বিষয়টি একাডেমিক তাই মামলার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ঘটনাট ৬ বছর পরেও নোটবাতিলের বৈধতা সাজানো হচ্ছে তাই কোর্টে হলফনামা দিতে গড়িমসি করা হচ্ছে। একথা অনস্বীকার্য, নোটবাতিলের ফলে ‘কালো টাকা’ উদ্ধার হয়নি, জাল নোট অকার্যকরী হওয়ায় ‘সন্ত্রাসবাদী’ কাজকর্ম শেষ হয়ে যায়নি। যদি তেমনটাই হয়ে থাকে তাহলে ২০১৬ সালের পরে ইউএপিএ-তে সমাজকর্মীদের, সিদ্দিক কাপ্পান, উমর খালিদদের গ্রেফতার করা হয় কেন, কেন কাশ্মীরে পন্ডিতরা বাসস্থান ছাড়েন, কেন রোজ ‘সন্ত্রাসবাদি’দের ‘এনকাউন্টার’এ হত্যা করা হয়, কেন পিএফআই নিষিদ্ধ হয়? নোটবাতিলের ফলে সরকারের কাঙ্খিত নগদ লেনদেনের অর্থনীতিও নগদহীন লেনদেনের রাস্তায় হাঁটেনি, গত ৬ বছরে জনসাধারণের হতে নগদের পরিমাণ বেড়েছে ৭০%। সব মিলিয়ে মোদিজির কোনো ঘোষিত লক্ষ্যই পূরণ হয়নি। অবশ্য ওই সব লক্ষ্যগুলি সত্যিই ছিল কি?

মনে হয় না। যদি দুনম্বরি টাকা ধ্বংস হত তাহলে কোন টাকায় কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রে বিধায়ক কেনাবেচা হত? যদি নোটবাতিল করে আয়কর ফাঁকি দেওয়া টাকা উদ্ধার করাই উদ্দেশ্য হত, তাহলে নোটবাতিলের পরদিন প্রতিটি কাগজে পাতাজোড়া পেটিএমএর বিজ্ঞাপনে নরেন্দ্র মোদির ছবি কীভাবে থাকত? জানিনা কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসায়িক সংগঠনের হয়ে প্রধানমন্ত্রী বিজ্ঞাপন দিতে পারেন কিনা। সেটি যদি বেআইনি নাও হয়, অনৈতিকতো বটেই। যে পেটিএমএর বিজ্ঞাপনী আইকন হয়েছিলেন মোদিজি, তারাই মূলধনী বাজার থেকে শেয়ারে ১৮,৩০০ কোটি টাকা তুলেছিল, যার বাজার মূল্য এখন কমে ৫,০০০ কোটি টাকায় তলানিতে ঠেকেছে। পেটিএমএর শেয়ার ক্রেতারা মোদিজির ব্রান্ড ভ্যালু ভালোই বুঝতে পারছেন। সে অর্থে পেটিএম-এর শেয়ার ছাড়া খুচরো বিনিয়োগকারীদের ঠকানোর একটা কারসাজি ছিল। মোদিজিকে সেই কারসাজির সূত্রপাতের অংশ বলে ধরা অনুচিত হবে কি?

– অমিত দাশগুপ্ত

Revolution in Russia

(নভেম্বর বিপ্লবের তাৎপর্যকে মনে রেখে এই লেখাটি প্রকাশিত হল আগের লেখাটির ধারাবাহিকতায়।)

১৯১৭’র নভেম্বর বিপ্লবে বিজয়ের পরে যে সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুখে শ্রমিক ও কৃষকদের নতুন সরকারকে পড়তে হয়েছিল, তার অন্যতম ছিল রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ।

রাশিয়ার গৃহযুদ্ধর সূচনাকাল বেশিরভাগ ঐতিহাসিক ১৯১৮’র মাঝামাঝি থেকে ধরতে চান এবং মনে করেন ১৯২০ পর্যন্ত তা চলেছিল। কিন্তু অনেকের মতে অক্টোবর বিপ্লবের অব্যবহিত পর থেকেই রাশিয়ার গৃহযুদ্ধর সূচনা ধরা উচিত, কেননা তখন থেকেই বলশেভিকদের রাশিয়ার নানা ফ্রন্টে নানা শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছিল। এটা ঠিক যে ১৯১৭’র ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময় বলশেভিক পার্টির সদস্যসংখ্যা যেখানে ছিল মাত্র চব্বিশ হাজার, সেটা অক্টোবর বিপ্লবের সময় বেশ কয়েকগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল তিন লক্ষতে। কিন্তু রাশিয়ার বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় শুধু নয়, রাশিয়ার রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের হিসেবেও সংখ্যাটা ছিল বেশ কম। উপরোন্ত বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার মধ্য ও উত্তর পশ্চিম অংশে যতটা ছিল, অন্যত্র ততটা ছিল না। শ্রমিকদের মধ্যে এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব থাকলেও কৃষকদের মধ্যে বলশেভিকদের প্রভাব ছিল তুলনায় কম এবং সোশ্যালিস্ট রিভোলিউশনারিদের (এসআর) কৃষকদের ওপর প্রভাব ছিল অনেক বেশি।

অক্টোবর বিপ্লবের কয়েকদিনের মধ্যেই বলশেভিকদের প্রধান ক্ষমতাকেন্দ্র পেত্রোগ্রাদে কিছু তরুণ ইয়ুঙ্কার কাদেত বিদ্রোহ করে। জেনারেল ক্রাসনভের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর কসাক রেজিমেন্টের একটি অংশও বিদ্রোহী হয়। সেনাবাহিনীর অন্য একটি অংশ বলশেভিক পন্থী আন্তোনোভ ও কর্ণেল মুরাভিয়েভের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহকে দমন করে। মস্কো শহরে বেশ কিছুদিন রাস্তায় রাস্তায় চলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। মধ্য ও উত্তর পশ্চিম রাশিয়ার অন্যান্য প্রধান শহরগুলিতে বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করতে পারে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই, কিন্তু এজন্য তাদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। বছর শেষ হবার আগেই রাশিয়ার পঁচাত্তরটি প্রদেশ ও অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গায় বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। রাশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৯০০টি সোভিয়েতে বলশেভিকদের শক্তি ক্রমশই বাড়তে থাকে। কিন্তু ককেশাস অঞ্চল, ফিনল্যান্ড, ইউক্রেনের চারটি প্রদেশ এবং কসাক অধ্যুষিত ওরেনবার্গ, ডন ও কুবান অঞ্চল বলশেভিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে যায়। ডন অঞ্চলে বলশেভিক বিরোধী অংশের নেতৃত্বে ছিলেন কসাক নেতা জেনারেল আলেক্সি কালেদিন।

বিপ্লবের অব্যবহিত পরে ঘোষিত ডিক্রিগুলি একান্ত বলশেভিক নীতির বদলে সাধারণ সোভিয়েত নীতি হয়ে ওঠায় বলশেভিক সরকারের জনপ্রিয়তা অনেকটা বেড়েছিল। বিশেষ করে দ্বিতীয় ডিক্রিটিতে বলশেভিকরা নিজেদের জমির জাতীয়করণ ও সোশালিস্ট ফার্ম গঠনের নীতির বদলে জমিদারদের জমি অধিগ্রহণ করে চাষীদের মধ্যে তা বন্টনের এসআর নীতিমালাটিই গ্রহণ করেছিল। এসআর’দের মধ্যেও একটা বিভাজন হয় এবং বামপন্থী এসআর’রা বলশেভিকদের কাছাকাছি চলে আসে ও সরকারে অংশগ্রহণ করে। এরফলে বলশেভিকদের কাজ অপেক্ষাকৃত মসৃণ হয়। এসআর ও বলশেভিকরা ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি অনেকটা হীনবল হয়ে পড়েছিল। বিশেষত মধ্য ও দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক শিবির প্রতিদিন তাদের সমর্থন ও জনভিত্তি হারাচ্ছিল।

বিপ্লবের সময় রাশিয়ার জনসংখ্যা ছিল ষোল কোটি মত। তার একটা অপেক্ষাকৃত ছোট অংশ, দু’কোটি ষাট লাখ মতো বিভিন্ন শহরে থাকত, জনসংখ্যার বড় অংশটিই ছিল গ্রামে। গ্রামে এসআর’দের শক্তি অনেক বেশি থাকলেও শহরে বলশেভিকদের প্রভাব ছিল বেশি। শহরাঞ্চলে সাংবিধানিক গণতন্ত্রী কাদেতদের প্রভাব দ্রুত কমছিল। সংবিধান সভার নির্বাচনে শহরাঞ্চলে কাদেতরা পেয়েছিল ২৪ শতাংশ ভোট আর বলশেভিকরা পেয়েছিল ৩৬ শতাংশ ভোট। তবে শহরাঞ্চলগুলিতে বলশেভিকদের জনপ্রিয়তা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছিল এবং সমীকরণ বলশেভিকদের অনুকুলে প্রতিদিন বদলে যাচ্ছিল। পেত্রোগ্রাদে বলশেভিকরা পেয়েছিল ৪৫ শতাংশ ভোট, মস্কোতে তা ৫০ শতাংশ ছাপিয়ে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে শহরাঞ্চলের চার কোটি ভোটের মধ্যে বলশেভিকরা এক কোটি চল্লিশ লক্ষের বেশি ভোট পেয়েছিল। সংবিধান সভার ভোটে প্রায় ৫০ লক্ষ সেনা ভোট দেন এবং সেই ভোটের মধ্যে বলশেভিকরা পায় ৪২ শতাংশ। এসআর’রাও ৪১ শতাংশ ভোট পায়। রাজধানী পেত্রোগ্রাদে সেনাবাহিনীর অবশ্য বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ ছিল। সেখানে বলশেভিকরা পায় ৮০ শতাংশ ভোট ও এসআর’রা পায় ১২ শতাংশ ভোট। মস্কোতেও সেনাবাহিনীর ভোটের ৮০ শতাংশ পায় বলশেভিকরা, এসআর’রা পায় ৬ শতাংশ।

প্রাথমিক সাফল্যের পর বলশেভিকদের রাজনৈতিক বিরোধিতা ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়, যখন জানুয়ারি মাসে আহুত সংবিধান সভা তারা প্রথম রাতের অধিবেশনের পরেই ভেঙে দিল এতে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায়। কিন্তু সংবিধান সভা ভেঙে দেবার পরে এই বোঝাপড়া ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং তা চরমে ওঠে এই সময়েই চলা ব্রেস্ট লিটোভস্ক চুক্তিকে কেন্দ্র করে। এসআর’রা এর তীব্র বিরোধিতা শুরু করে। জার্মান রাষ্ট্রদূতকে তারা হত্যা করার পর তাদের সরকার থেকে বের করে দেওয়া হয় ও ধরপাকড় শুরু হয়। বলশেভিকদের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ এই সময় থেকে আবার বাড়তে থাকে।

কিন্তু রাশিয়া জুড়ে বলশেভিকদের উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সময়ে ভেতরের এই রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ এককভাবে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটানোর মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না। রাশিয়ার গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হতে পেরেছিল জারপন্থী সেনাপ্রধানদের সক্রিয়তা এবং বিভিন্ন বৈদেশিক শক্তির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মধ্যে দিয়ে। ১৯১৭’র ব্যর্থ অগস্ট অভ্যুত্থানের পর থেকেই কার্ণিলভ বন্দী ছিলেন পেত্রোগ্রাদ থেকে চারশো মাইল দূরবর্তী সেনার সদর দপ্তর মগলিয়েভের নিকটবর্তী এক কারাগারে। বিপ্লবের সময় মগলিয়েভের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেকে অস্থায়ী সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন দুখোনিন নামের এক তরুণ সেনাপতি। তিনি রাজনৈতিকভাবে ছিলেন বলশেভিক বিরোধী। মধ্যপন্থী এসআর’দের একটি অংশ পেত্রোগ্রাদ বলশেভিকদের হাতে চলে যাবার পর মগলিয়েভে চলে আসেন এবং দুখোনিনের সঙ্গে বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে একটি বলশেভিক বিরোধী ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ার চেষ্টা চালাতে থাকেন। বিপ্লবের ছাব্বিশদিন পর ট্রেন বোঝাই করে বলশেভিক লাল রক্ষীরা মগলিয়েভে পৌঁছন, বাল্টিক সাগরের নৌ-সেনারাও চলে আসেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন বলশেভিক সরকার নির্বাচিত নয়া সেনাপ্রধান ক্রাইলেঙ্কো। দুখোনিন রাস্তাতে একদল জনতার ক্রোধের সামনে পড়েন এবং তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তারা হত্যা করে। দুখোনিনের পতন হলেও নয়া সেনাপ্রধান ক্রাইলেঙ্কো মগলিয়েভে আসার ঠিক আগের দিন মগলিয়েভের দশ মাইল দূরে অবস্থিত সেনা কারাগার বাইখোভ জেল থেকে কার্ণিলভ পালিয়ে যান। তার সঙ্গেই পালান লুকোমস্কি, দেনিকিন, মার্কভ সহ অগস্ট প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানের অন্যান্য অনেক বন্দী সেনাপতি। তারা বুঝলেন মধ্য রাশিয়ায় তাদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। ৬০০ মাইল দীর্ঘ পথ পেরিয়ে তারা চলে যান দক্ষিণ পূর্ব রাশিয়ায় ডন নদী তীরবর্তী কসাকদের এলাকায়। এই বাইকভ বন্দীরাই এরপর গড়ে তুললেন ‘শ্বেতরক্ষী বাহিনী’ এবং গৃহযুদ্ধ শুরু করলেন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তির মদতে। রাশিয়ার রক্ষণশীল চার্চ এবং দক্ষিণপন্থী বলশেভিক ও সমাজতন্ত্র বিরোধীশক্তিগুলিও তাদের মদত জোগাতে থাকল।

Progress of the Revolution in Russia

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ ও জারের রাশিয়া যেহেতু একপক্ষে থেকে জার্মানদের বিরুদ্ধে লড়ছিল, তাই রাশিয়াকে অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করার জন্য উত্তরে ফিনল্যান্ড সীমান্তের কাছে মার্মাস্কে একটি বন্দর ও মার্মাস্ক থেকে পেত্রোগ্রাদ অবধি একটি রেল লাইন তৈরি করা হয়েছিল। ব্রেস্ট লিটোভস্ক সন্ধির সময় থেকে এখানে ব্রিটিশরা সেনা মোতায়েন করে। তাদের লক্ষ্য ছিল মার্মাস্ক যেন জার্মানদের হাতে চলে না যায়। পরে বলশেভিকদের হাতেও এর নিয়ন্ত্রণ যেন না যায়, সেই চেষ্টাও তারা চালিয়ে যায়। এই সময়েই আর্খানজেলেক্সে মার্কিন সহায়তায় শ্বেতরক্ষী বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে ও ব্রিটিশরা তাদের মদত দিতে থাকে। রাশিয়া সীমান্তের কাছে নানা বিদেশী শক্তি সেনা সমাবেশ করে। এরমধ্যে ছিল ২ ডিভিশন ব্রিটিশ সেনা, ২ ডিভিশন জাপানী সেনা, এক ব্রিগেড কানাডিয়ান সেনা, এক ব্রিগেড মার্কিন সেনা, এক ব্রিগেড ইতালিয়ান সেনা, এক ব্রিগেড চিনা সেনা, ২ ব্যাটেলিয়ন ফরাসী সেনা ও এক লিজিয়ন চেক সেনা।

ব্রিটিশরা ১৯১৮ সালের অগস্টে বাকু বা আজারবাইজান দখল করে এবং সেখান থেকে ক্রমশ ছড়াতে থাকে। ১১ নভেম্বরে জার্মানীর আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। এর সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশরা রাশিয়ার শ্বেতরক্ষী বাহিনীকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও নানা সাহায্য দিয়ে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করতে শুরু করে। জানুয়ারি ১৯১৯এ বলশেভিক বিরোধী শ্বেতরক্ষীদের সংখ্যা হয় তিন লক্ষ এবং মার্চ ১৯১৯’র মধ্যেই তা পাঁচ লক্ষে পৌঁছে যায়। ব্রিটিশরা শ্বেতরক্ষী বাহিনীর হাতে দশ লক্ষ রাইফেল, পনেরো হাজার মেশিনগান, সাতশো সাঁজোয়া গাড়ি, ট্যাঙ্ক এবং প্রচুর গোলাবারুদ, পোশাক ও অন্যান্য নানা সামগ্রী তুলে দেয়। ফ্রান্স থেকেও তাদের জন্য সাহায্য আসে। বিশ্বযুদ্ধ শেষে ষাট হাজার সেনাসমৃদ্ধ চেক লিজিয়নও শ্বেতরক্ষী বাহিনীর হয়ে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

১৯১৯ সাল জুড়ে শ্বেতরক্ষী বাহিনীর তিনদিক থেকে বলশেভিক নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় রাশিয়া ও মস্কো, পেত্রোগ্রাদের মতো রাজনৈতিক কেন্দ্রগুলির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। দক্ষিণ দিক থেকে অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন দেনিকিন। পূর্ব দিক থেকে আসা বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন কোলচাক এবং উত্তর পশ্চিম দিক থেকে আসা শ্বেতরক্ষীবাহিনীর নেতা ছিলেন ইউদেনিচ। ১৯১৯ সালের মাঝামাঝি ইউক্রেনের ক্রিমিয়া সহ এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্রোহ হয় এবং এর নেতৃত্ব দেন ইউক্রেনের অ্যানার্কিস্ট নেতা নেস্টর মাখনো। মাখনো বলশেভিক ও শ্বেতরক্ষীবাহিনী উভয়েরই বিরোধী ছিলেন তবে গৃহযুদ্ধের একটা পর্বে শ্বেতরক্ষীদের বিরুদ্ধে বলশেভিকদের সঙ্গে সমঝোতা গড়ে তোলেন। সেই সমঝোতা আবার ভেঙেও যায়। ইউক্রেনের শ্বেতরক্ষীবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন পিওতর ওয়ার‍্যাঙ্গেল।

এই সময় বলশেভিকদের রেড আর্মির নেতা ছিলেন লিও ট্রটস্কি। তিনি বুঝেছিলেন পিপলস মিলেশিয়া দিয়ে কেবল শ্বেতরক্ষী বাহিনীকে হারানো যাবে না। তাই সমালোচনা সত্ত্বেও ট্রটস্কি জার আমলের পেশাদার সেনা ও সেনাপতিদের রেড আর্মিতে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ চালিয়ে যান। পাশাপাশি মস্কো সহ বিভিন্ন শহরাঞ্চলের শ্রমিক শ্রেণির হাতেও অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। এই জোড়া কৌশলের মাধ্যমে রেড আর্মির শক্তি অনেক বৃদ্ধি পায় এবং তারা ক্রমশ রণাঙ্গনে সাফল্য পেতে থাকে। ট্রটস্কি একটি বিশেষ ট্রেনে রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল গৃহযুদ্ধের গোটা সময়টায় চষে ফেলেন এবং সামনে থেকে শ্বেতরক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে রেড আর্মির প্রতিরোধ আক্রমণকে নেতৃত্ব দেন। ১৯১৯ সালের শেষ ও ১৯২০ সালের শুরুর দিকে বলশেভিকরা শ্বেতরক্ষীবাহিনীকে অধিকাংশ রণাঙ্গনে কায়েম করে ও কেবল বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গাতেই বিক্ষিপ্তভাবে আরো কিছুদিন লড়াই চলে।

১৯২০ সালের মধ্যেই রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ কার্যত শেষ হয়ে যায় এবং শ্বেতরক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে রেড আর্মি ও বলশেভিকদের নির্ণায়ক বিজয় হয়। ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে ইতস্তত বিচ্ছিন্ন কিছু লড়াই চলে কোনও কোনও অঞ্চলে। পূর্বদিকের সীমান্তে ও মধ্য এশিয়ার এই সমস্ত লড়াইতেও বলশেভিকরা জেতেন। জর্জিয়া রেড আর্মির অধিকারে চলে আসে ১৯২১’র ফেব্রুয়ারি মাসে। এপ্রিলে রেড আর্মি আর্মেনিয়ার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২৫ অক্টোবর ১৯২২এ জাপান ভ্লাদিভস্তোক ত্যাগ করে এবং তার পরে রাশিয়ার মাটি বিদেশী সেনা মুক্ত হয়। ১৯২২’র শেষদিকে পূর্ব সীমান্তের দিকের লড়াইগুলিও শেষ হয়ে যায় ও সেসব জায়গা বলশেভিক নিয়ন্ত্রণে আসে।

গৃহযুদ্ধের সাফল্যের জন্য বলশেভিকরা বিশেষভাবে নির্ভর করেছিল কৃষক ও শ্রমিক মৈত্রীর ওপর। বিশেষ করে কুলাকদের কোণঠাসা করে ছোট ও মধ্য কৃষকদের বড় অংশটিকে নিজেদের দিকে নিয়ে আসার মধ্যে দিয়েই শ্বেতরক্ষী ও বিদেশী হানাদারদের সাঁড়াশি আক্রমণের মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছিল। উইলিয়ম হেনরী চেম্বারলিন বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার প্রথম চার বছরের অনুপুঙ্খ ইতিহাস লেখার সময়ে গৃহযুদ্ধ প্রসঙ্গে তাঁর বিখ্যাত বইতে বলেছিলেন এই যুদ্ধে শ্বেতরক্ষী ও বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে বলশেভিক ও লালফৌজের বিজয় নেহাৎ কোনও সামরিক ঘটনা নয়। এই জয়ও রাজনৈতিক বিজয় এবং বলশেভিকদের শ্রেণি সংগ্রামের অংশ।

- সৌভিক ঘোষাল

the ghosts of strikes

আজ গোটা ইউরোপ ভূত দেখছে। ধর্মঘটের ভূত। গত কয়েক দশক অগ্রগামী পুঁজিবাদী দুনিয়া ধর্মঘটের এই ব্যাপ্তি, পরিধি, প্রভাব ও তীব্রতা দেখেনি। নয়া উদারবাদী অর্থনীতি যখন নাছোড় সংকটের আবর্তে খাবি খেতে শুরু করেছে, পরিত্রাণের পথ খুঁজতে গিয়ে শ্রমিকশ্রেণি ও সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে সংকটের বোঝা, ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে ইউরোপের সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণি ধর্মঘট সংগ্রামের সঠিক মুহূর্ত বেছে নিলেন। আইএমএফ গতবছরে অনুমান করেছিল, যে প্যান্ডেমিক সমগ্র দুনিয়ায় অর্থনীতিকে বিধ্বস্থ, বিপর্যস্থ করে দিয়েছে, সেই ভগ্নদশা থেকে অর্থনীতি উঠে দাঁড়িয়ে আবার শক্তিশালী পুনরুদ্ধার ঘটাবে। কিন্তু হালে, আইএমএফ নিজস্ব অনুমানকে শুধরে ২০২৩-এ নিম্নগামী আর্থিক বৃদ্ধির কথা বলে সতর্ক করল যে, সারা দুনিয়ার অর্থনীতি ক্রমবর্ধমান মন্দার বিপদের সম্মুখীন, বারে বারে যা নানান ধাক্কার মুখে পড়বে আর ২০২৬’র মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির আউটপুট ক্ষয়প্রাপ্ত হবে চার লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারে — যা ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতি সমগ্র জার্মানির অর্থনীতির সমান। গভীর উদ্বেগের সঙ্গে এই কথাগুলি বলেছেন আইএমএফ’এর কর্ণধার।

গত চার দশকে ইউরোপে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে যাওয়া মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষকে নিঙড়ে নিচ্ছে, কিন্তু বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে থাকা বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর যেন পোয়া বারো! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুরো অফ ইকনমিক অ্যানালিসিস (বিইএ) দেখিয়েছে, মজুরি ও ব্যক্তিগত আয় যখন দিনের পর দিন নিচে নামছে, ঠিক সেই সময়ে কর্পোরেট মুনাফা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। একটা রিপোর্টে বিইএ দেখিয়েছে, সমস্ত কিছু আর্থিক দায় মিটিয়ে দেওয়ার পরও মূল্যস্ফীতির সাপেক্ষে কর্পোরেশনগুলো নিজের পকেটে মুনাফা পুরে রাখতে পেরেছে বার্ষিক ৪১ শতাংশ হারে বছরের দ্বিতীয় অর্ধে, আর দু’বছর আগে অতিমারিরজনিত মন্দা শেষ হওয়ার পর ১৭ শতাংশ হারে! বিপরীতে, মুদ্রাস্ফীতির সাপেক্ষে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ধারাবাহিকভাবে নিচে গড়িয়ে পড়েছে গত পাঁচটা ত্রৈমাসিকে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসাবে খ্যাত একটি সংস্থা ইকনমি পলিসি ইন্সটিটিউট দেখিয়েছে, মূল্যস্ফীতির উপর কর্পোরেটদের ক্রমাগত বেড়ে চলা মুনাফা সামঞ্জস্যহীন প্রভাব ফেলেছে। ২০২০’র দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক থেকে ২০২১’র শেষ ত্রৈমাসিক পর্যন্ত সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির উপর কর্পোরেট মুনাফার অবদান ৫৪ শতাংশ — বিগত চার দশকে (১৯৭৯- ২০১৯) তা ছিল ১১ শতাংশ — এই নাটকীয় উল্লম্ফন ঘটেছে। বিপরীতে, মূল্যস্ফীতির সাপেক্ষে ইউনিট লেবার কস্টের (অর্থাৎ, এক ইউনিট আউটপুটের জন্য সংস্থা সেই কর্মীকে কত মজুরি দেন) অবদান ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। পূর্বের দশকগুলোতে যা ছিল ৬২ শতাংশ! আর, সম্প্রতি মূল্যবৃদ্ধির জন্য আমেরিকায় ন্যূনতম মজুরির প্রকৃত মূল্য বিগত ৬৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। ( ডিলিং উইথ ইনফ্লেশন — জয়তী ঘোষ)।

সমগ্র ইউরোজোনে, গত জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতির হার চড় চড় করে বেড়ে ৮.৯ শতাংশের ঘরে পৌঁছেছে। আর, সেকারণে, স্পেন-গ্রিস-ফ্রান্স-জার্মানি-বেলজিয়ামের শ্রমিকরা বেতন-মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আজ উত্তাল। নেমে পড়েছেন রাজপথে। যে জার্মানিতে ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ধর্মঘটের আঁচ কম পড়েছিল, সেখানেও গোটা পরিবহন ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আজ সোচ্চার। নেদারল্যান্ডসে রেল শ্রমিক এবং জার্মানিতে বিমান কর্মীরা ধর্মঘটের পথে। যতই শীত এগিয়ে আসছে, পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নানান নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রেও নেমে আসছে তার মারাত্মক প্রভাব। এক কথায় কর্পোরেট সংস্থাগুলো আগের তুলনায় অনেক বেশি মুনাফা যখন লুটেপুটে নিচ্ছে, তখন শ্রমিকরাও আরও বেশি মজুরির দাবি সামনে আনছেন।

Europe is seeing ghosts

ব্রিটেনে মূল্যস্ফীতির হার ১০.১ শতাংশ ছুঁয়ে গত চল্লিশ বছরে সর্বোচ্চ স্তরে ঠেকেছে। তীব্র আর্থিক সংকট রাজনৈতিক সংকট ডেকে আনায় অল্প সময়ের ব্যবধানে এই দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক স্তরে বার বার পালাবদল ঘটল। সম্প্রতি ব্রিটেন জুড়ে ধর্মঘটের একের পর এক তরঙ্গ উঠল যা দেখা গেল বেশ কয়েক দশক পর। সমাজের প্রায় সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন এই সমস্ত ধর্মঘটে। ১০ নভেম্বর ২০২২, লন্ডনের রেল, বন্দর ও সড়ক পরিবহনের হাজার হাজার শ্রমিক ধর্মঘটে সব কিছু অচল করে দেন। রেল, ম্যারিটাইম, ট্রান্সপোর্ট এবং ইউনাইট ইউনিয়নের নেতৃত্বে বেশ কয়েকমাস ধরে ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে, পেনশন, সুরক্ষিত কর্মস্থলের দাবিতে তারা আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। ধর্মঘট এড়াতে বেসরকারি পরিবহন মালিকদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক হওয়া সত্ত্বেও দাবি সমুহের মীমাংশা না হওয়ায় ধর্মঘট অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই গ্রীষ্মে রেল শ্রমিকদের ধর্মঘট, যা তিন দশকের পর সংঘটিত হল, গোটা দেশকে স্তব্ধ করে দেয়। রেল শ্রমিকদের পাশাপাশি পোস্টাল, ডক, বাস চালক, কল সেন্টারের কর্মী, ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের আইনজীবীরা আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, নিরাপদ কর্মস্থল, বেতন বৃদ্ধির দাবিতে সারা দেশজুড়ে ধর্মঘটের পথে পা বাড়িয়েছে। গ্যাসের ৮০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির দরুণ জনগণের নানা স্তর ধর্মঘটের পথ বেছে নিয়েছেন। ধর্মঘটিদের দাবি, গতবছরে কোম্পানিগুলো বিপুল মুনাফা কামায়। এদিকে অতিমারির ও সম্প্রতি বিপুল মূল্যস্ফীতি তাঁদের প্রকৃত মজুরিকে চেটেপুটে খেয়ে নিচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, আগস্টের শেষে ১,১৫,০০০ ডাক কর্মী ধর্মঘট করায় চিঠিপত্র বিলিবন্টন মুখ থুবড়ে পড়েছিল। বহু বছর পর্যন্ত ডাক বিভাগটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এক চেক ধনকুবেরের কব্জায় আসার পর বিরাট বঞ্চনার শিকার হয়েছেন তাঁরা। শিক্ষকদের সংগঠন, জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার কর্মীরাও ধর্মঘটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমান সংস্থা, জার্মানির লুফৎথান্সার কর্মী ইউনিয়ন ভার্ডি তাদের বেশ কয়েক হাজার গ্রাউন্ড স্টাফদের বেতন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হল। ওই বিমান সংস্থার গ্রাউন্ড স্টাফরা বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট করে সমগ্র উড়ান ব্যবস্থাকে অচল করে দেন। ধর্মঘটের চাপে কর্তৃপক্ষ ইউনিয়নের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হয়। নতুন এই চুক্তির ফলে ২০২৩’র জানুয়ারির শুরুতেই তাঁদের মূল বেতন বাড়বে ২.৫ শতাংশ, তারপর ১ জুলাই থেকে বৃদ্ধি পাবে আরও ২.৫ শতাংশ। ১৮ মাস পর্যন্ত বহাল থাকবে এই চুক্তি, যার ফলে উপকৃত হবেন ২০,০০০’র বেশি গ্রাউন্ড স্টাফ।

এদিকে ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়ল গোটা প্যারিস মহানগরী। ১৯৮৫’র পর এই প্রথম ফ্রান্সের মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ স্তরে উঠেছে। চড়া মূল্যবৃদ্ধিতে নাজেহাল রাষ্ট্রীয় পরিবহন সহ মেট্রো রেলের শ্রমিক কর্মচারী, শিক্ষক সহ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিভিন্ন কর্মীদের এই উত্থান যেন কাঁপিয়ে দিল গোটা ফ্রান্সকে। ফ্রান্স সংসদে বিতর্কিত এক পেনশন বিল আনতে চলেছে মাঁকর। অবসর গ্রহণের পূর্বে দীর্ঘ দীর্ঘ সময় তাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে নানা কন্টকিত শর্তে কাজ করার যে বিল পেশ হতে চলেছে, তার বিরুদ্ধেই যেন গোটা ফ্রান্স ফুঁসছে। হাজারে হাজারে বিক্ষোভকারী রাজপথে নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশের সাথে তাদের ক্ষন্ডযুদ্ধ বাধে। সরকারের তরফ থেকেই জানানো হয়, ১১ জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ফ্রান্সের ইউএনএএসএ আরএটিপিপিএস ইউনিয়নের অধীনে ৭০,০০০ কর্মী জানাচ্ছেন, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি তাঁদের মূল বেতনে ধ্বস নামিয়েছে, অত্যন্ত কম কর্মীকে দিয়ে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য করার জন্য কর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, বাড়ছে অসুস্থতাজনিত ছুটি। অতিমারির সময় বিপুল সংখ্যক কর্মীকে ছাঁটাই করার পর নতুন নিয়োগ না হওয়ায় বেড়ে গেছে কাজের বোঝা। সিজিটি ইউনিয়নের ডাকা ধর্মঘটে অচল মেট্রো। এফিল টাওয়ারকে ও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ধর্মঘটের জেরে। সরকারি কর্মী, শিক্ষক স্বাস্থ্যকর্মী ডাক বিভাগের কর্মী — সর্বস্তরে ফ্রান্স জুড়ে ধর্মঘটে সামিল শ্রমিক কর্মচারীরা। ধর্মঘটের চাপে সরকার গ্যাস, পেট্রল জ্বালানির দামে লাগাম টানলেও বিক্ষোভ স্থিমিত হয়নি।

বেলজিয়াম হল আরেকটি ইউরোপের দেশ যেখানে ছড়িয়ে পড়েছে ধর্মঘটের তরঙ্গ। এই দেশে এক বছরের মধ্যে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৮৫ শতাংশ, জ্বালানি ৫৭ শতাংশ, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। ৯ নভেম্বর ২০২২ গোটা বেলজিয়াম কার্যত স্তব্ধ হয়ে পড়ে সাধারণ ধর্মঘটের জেরে, দেশের বৃহত্তম শ্রমিক ইউনিয়ন যার ডাক দিয়েছিল। এমনকি স্তব্ধ হয়ে যায় ব্রাসেলস জ্যাভেন্টাম বিমানবন্দর। এই নিয়ে এ’বছরে চতুর্থবারের জন্য ইউনিয়নগুলো ধর্মঘট করল যার জন্য রেল থেকে শুরু করে গোটা পরিবহন ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে।

স্পেন-গ্রিস-সুইডেন-নরওয়ে প্রভৃতি দেশগুলো এর বাইরে নেই। ইউরোপের চতুর্থ বৃহতম অর্থনীতির দেশ স্পেনের শাসকবর্গ আর্থিক সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে একগুচ্ছ কঠোর ব্যয় সংকোচের রাস্তা নিয়েছে, যা দেশের মানুষ গ্রহণ করতে পারছেন না। এই আর্থিক সংকটকে যুঝতে শুরু হয়েছে গণ ছাঁটাই — প্রতি চারজনের মধ্যে একজন কর্মী তাঁর কাজ হারিয়েছেন। নয়া শ্রমআইন কর্পোরেটদের হাতে আরও শক্তি দিয়েছে যার উপর ভর করে শুরু হয়েছে ছাঁটাই, পেনশন সংকোচন, মজুরি কেটে নেওয়ার মতো শ্রমিক বিরোধী পদক্ষেপ। যে ইউরপের দেশগুলোতে তুলনামূলক কল্যাণমূলক দিকগুলো মজবুত ছিল, যেখানে ট্রেড ইউনিয়নের সাথে দরকষাকষির ব্যবস্থা বহাল ছিল, সেই সব শিকেই তুলে নিয়োগকর্তার সর্বাত্বক হামলার বিরুদ্ধে আজ স্পেন তোলপাড়।

এদিকে, বিরাট মাত্রায় খাদ্য সংকট আজ নেমে এসেছে দুনিয়া জুড়ে। রাষ্ট্রসংঘের বিশ্ব খাদ্য প্রোগ্রামের কার্যনির্বাহী অধিকর্তা রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে রিপোর্ট পেশ করে বলেছে, ৮২টি দেশের ৩৪ কোটি ৫ লক্ষ মানুষ কল্পনাতীত এক খাদ্য সংকটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আর ইউক্রেন যুদ্ধ সাত কোটি মানুষকে অনাহারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ‘বিশ্বজোড়া নজিরবিহীন এই খাদ্য সংকট’ থেকে পরিত্রাণ পেতে আবেদন জানিয়ে তিনি বলেছেন, “৪৫ দেশের পাঁচ কোটি মানুষ চরম অপুষ্ঠির কবলে, দুর্ভিক্ষ তাঁদের দোরে কড়া নাড়ছে”। এরপর তিনি মন্তব্য করেন, “যা এতদিন ক্ষুধার তরঙ্গ ছিল, তা আজ ক্ষুধার সুনামিতে পরিণত হয়েছে”।

নয়া উদারবাদী অর্থনীতির উপর ভর করে চলা বিশ্ব ব্যবস্থার সমস্ত দেউলিয়েপনা আজ উন্মোচিত। বিশ্বজুড়ে বিপুল জনসংখ্যার ক্রমাগত বেড়ে চলা দারিদ্র সর্বসান্ত হওয়ার নির্মম প্রক্রিয়ার বিপরীতে চলছে মুষ্ঠিমেয় কতিপয় অতি ধনীর হাতে অঢেল সম্পদের কেন্দ্রীভবন। কোভিড অতিমারী যাকে আরও ত্বরান্বিত করেছে।

এর বিরুদ্ধেই আজ শ্রমিক শ্রেণির প্রতিবাদ। প্রতিরোধ। এইভাবেই এগোয় প্রগতির চাকা।

- অতনু চক্রবর্তী

Qatar World Cup

আর এক সপ্তাহের প্রতীক্ষা। দীর্ঘ চার বছরের প্রতীক্ষার শেষে শুরু হতে চলেছে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব – ফুটবল বিশ্বকাপ, ২০২২। যেই উৎসবে সারা বিশ্বের অগণিত ফুটবলপ্রেমী মানুষ সামিল হন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে। একটি মাসের জন্য গোটা বিশ্ব মেতে উঠবে সাম্বার জাদুতে কিংবা স্প্যানিশ তিকিতাকায়। বহু মানুষ রাত্রি জাগবে আর্জেন্টাইন রাজপুত্রের পায়ের জাদু দেখতে। মুগ্ধ করবে সবুজ গালিচায় জার্মান আভিজাত্য। বহু মানুষ উপভোগ করবে পর্তুগিজ তারকার - The last dance।এবার সেই মহোৎসবেরই কেন্দ্রবিন্দু হতে চলেছে এশিয়ার একটি ‘ছোট্ট’ দেশ — কাতার।

২০১০ সালে জুরিখ শহরে যখন ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ হিসেবে তথাতকথিত ‘ফুটবল শক্তিধর’ দেশগুলির বাইরে গিয়ে যখন কাতারের নাম ঘোষণা করলেন তৎকালীন ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটার, তখন স্বভাবতই নানা জল্পনার সূত্রপাত হয়। মাত্র আঠাশ লক্ষ জনসংখ্যার একটি দেশ, যাদের ফুটবল সংস্কৃতির সঙ্গে দূর দুরন্ত পর্যন্ত কোন সম্পর্কই ছিল না, এমনকি উন্নতমানের একটি ফুটবল স্টেডিয়ামও পর্যন্ত ছিল না যেসময়, সেইসময় দাঁড়িয়ে তারা এত বড় একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব পেল কীভাবে? কাতার নিছকই আরব সাগরের তীরে অবস্থিত একটি ছোট্ট মরুভূমির দেশ নয়।দেশটি প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডারের নিরিখে তৃতীয়, এবং তেলের ভান্ডারের  তালিকায় ত্রয়োদশ বৃহত্তম দেশ। এই দেশের পার ক্যাপিটা জিডিপি একাশি হাজার ডলার। খুব সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায় বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশগুলির মধ্যে একটি হল কাতার। এই দেশটিতে জুন-জুলাই মাসে, অর্থাৎ যখন বিশ্বকাপ সাধারণত অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, তখন তাপমাত্রা মাঝে মধ্যেই প্রায় ৪৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ছুয়ে ফেলে। ফিফা শুধু মাত্র কাতারে অনুষ্ঠিত করতে হবে বলেই বিশ্বকাপের সময় বদলে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে নিয়ে এল। আপাতদৃষ্টিতে দেখে খুবই সাধারণ সিদ্ধান্ত মনে হলেও, গোটা  ইউরোপ জুড়ে [যে মহাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি ১৩ টি দেশ অংশগ্রহণ করে বিশ্বকাপে] প্রতিটা দেশের ঘরোয়া লীগগুলির সময়সূচী ওলট-পালট হয়ে গেল। ইউএফার বারংবার বিরোধ সত্ত্বেও আয়োজক দেশ এবং ফিফা এসবে কর্ণপাত করল না। এবার সবচেয়ে বড় বিষয়, পূর্ববর্তী বিশ্বকাপগুলি, যেমন রাশিয়া বিশ্বকাপ [২০১৮] অনুষ্ঠিত করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ১১৬০ কোটি ডলার, ব্রাজিল বিশ্বকাপ [২০১৪] অনুষ্ঠিত করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ১৫০০ কোটি ডলার, দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ [২০১০] আয়োজন করতে খরচ হয়েছিল ৩৫০ কোটি ডলার। সেই  সবাইকে ছাপিয়ে কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনে খরচ হয়েছে ২২০০০ কোটি ডলার – যেটি একটি বিশ্বকাপ আয়োজনের ক্ষেত্রে অনেকটাই বেশি। যার মধ্যে বিশ্বকাপের জন্য শহরের অন্যান্য কাঠামো তৈরিতে কয়েকশো কোটি খরচ করে দিয়েছে কাতার। হয়েছে সাতটি নতুন স্টেডিয়াম, নতুন একটি বিমান বন্দর, নতুন একটি সুবিশাল মেট্রো স্টেশন এবং উল্লেখযোগ্য লুসেইল শহর, যেটিতে বিশ্বকাপের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। যার কিছু বছর আগে পর্যন্তও কোনো অস্তিত্ব ছিল না। শুধুমাত্র বিশ্বকাপের জন্য কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা হয়ে হয়েছে একটি গোটা শহর। তাহলে হঠাৎ করে এত পরিমাণ টাকার প্রয়োজন পড়ল কেন? এখানেই সবচেয়ে বড় প্রশ্নের জন্ম নেয় – মাত্র আঠাশ লক্ষর একটি দেশ যত পরিমাণ টাকাই খরচ করুক না কেন, এই বিশাল পরিমাণ কাজের জন্য শ্রমিক পেল কোথায়?

তথ্য বলছে প্রায় ১৭ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এই বিশাল আয়োজন, গোটা দেশের শ্রমিক শ্রেণীর ৯০ শতাংশই যাদের দিয়ে তৈরি। এদের অধিকাংশই এসেছেন ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং নেপাল থেকে। এই লক্ষ্য লক্ষ্য শ্রমিকদের অত্যন্ত খারাপ পরিবেশে থেকে, নূন্যতম আহার এবং উপার্জনের উপর ভিত্তি করে কাতারের দুঃসহ গরমে কাজ করে যেতে হয়েছে। তাদের সপ্তাহের প্রতিদিন ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা করে কাজ করতে হত কোনরকম ছুটি ছাড়া। বিভিন্ন হিউম্যান রাইটস গ্রুপ বারেবারে এদের পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করে গেছে, হয়েছে নানারকম তথ্যচিত্র। কিন্তু তাতে না ছিল কাতারের সরকারের ভ্রুক্ষেপ, না ছিল সেই সকল শ্রমিকেদের দেশের সরকারগুলির। গারডীয়ানের সমীক্ষায় উঠে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য — বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ হিসেবে কাতারের নাম ঘোষণা করার পর থেকে কাতারে প্রায় ৬৫০০ পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। কাতারের সরকার সেই তথ্যকে সরাসরি নাকচ করে দেয়। তারা শুধুমাত্র নির্মাণ সাইটে সরাসরি মৃত্যুগুলিকে চিহ্নিত করে আসল সংখ্যাটিকে সকলের অগোচরে রেখে দেয়। কিন্তু সেই সাইটে দিনভর গরমের কাজ করার ফলে হৃদ যন্ত্রের দুর্বলতা এবং শ্বাসবায়ুর সমস্যার কারণ গুলিকে সেই সরকার সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে গেছে। আইএলও এবং অন্যান্য হিউমান রাইটস গ্রুপস-গুলির বারংবার চাপে ২০১৭-তে কাতারের সরকার বাধ্য হয় শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে। তারা বিভিন্ন প্রকারের চমকপ্রদ ভিডিও বানিয়ে নিজেদের পদক্ষেপগুলো জাহির করতে থাকে, যেটার সাথে আমরা ভারতীয়রা খুব ভালোভাবে পরিচিত। কিন্তু এই পদক্ষেপগুলি ছিল অনেকটা তাদের দেশের নারী স্বাধীনতার মতোই! এই প্রসঙ্গে উঠে আসে কাতারের আরও একটি অদ্ভুত নিয়মের কথা। মধ্য-প্রাচ্যের এই দেশে সমকামিতা বেআইনি। এর কারণে বিশাল অঙ্কের জরিমানা থেকে শুরু করে, জেল সাজা, এমনকি মৃত্যুদন্ডও পর্যন্ত হতে পারে! বিশ্বকাপের মতো একটি আয়োজন, যেখানে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নানারকমের মানুষ এসে গা ভাসাবেন এই আনন্দের জোয়ারে – সেখানে কাতারের মতো একটি অত্যন্ত সংরক্ষণশীল দেশ অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে কি না সেটাই চিন্তার।এর প্রতিবাদে যেমন বিভিন্ন বড় বড় দেশের ফুটবল সংস্থা, ফুটবলার এবং বিজ্ঞাপন সংস্থারা মুখ খুলেছেন, তার সাথে মুখ খুলেছেন অস্ট্রেলীয়ার যস ক্যাভালো, বিশ্বের প্রথম অ্যাক্টিভ gay ফুটবলার। ততসত্ত্বেও ফিফা নীরব!

এত প্রতিকূলতা, এত প্রতিবাদের পরেও কি প্রয়োজন পড়ল ফিফার কাতারেই আয়োজন করার?

কাতারের ২০১০ সালে বিড পাওয়াটা কোনোকালেই স্বচ্ছতায় মোড়া ছিল না। কাতারের সরকার দাবি করে গেছে বারবার যে সমস্তটাই ফিফা কমিটির সিদ্ধান্ত। তথাপি সেই সময় ফিফা কমিটির বেশ কিছু বড় বড় নাম ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে সাসপেন্ড হয়েছিল আমেরিকান কোর্টের দ্বারা।

সেপ ব্লাটার নিজেই বিভিন্ন রকম তদন্তের অধীনে ছিলেন, বিশাল পরিমাণ অর্থ তছরূপের জন্য। এমনকি দুর্নীতির জন্য তাকে আট বছরের নির্বাসনের সম্মুখীনও হতে হয়েছিল। অবশেষে ২০২০ সালে আমেরিকান সুপ্রিম কোর্টের কথায় সিলমোহর পরে যে কাতারের bid টাকার মাধ্যমেই কেনা হয়েছিল। আরও তদন্তের পর জানা যায় সেই ২২ জনের ফিফা কমিটির যে ১৬ জন কাতারের পক্ষে ভোট দিয়েছিল তাদের অর্ধেকই নানারকম দুর্নীতির সাথে যুক্ত এবং তিনজন সরাসরি কাতারের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার জন্য অভিযুক্ত হয়েছিলেন।

স্বভাবতই কাতারের পক্ষ থেকে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। এত কিছুর পরেও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এই উৎসবে সামিল হতে আসবেন। এবং তাদের সমস্ত রকম চমকে মুড়ে রাখতে কাতার জলের মতো অর্থ খরচ করতেও পিছপা হবে না। কাতার অবশ্যই প্রথম দেশ নয় যে কিনা বিশ্বমঞ্চে নিজেদের দেশকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সবরকম প্রচেষ্টা করছে। এবং অবশ্যই কাতারের মতো ধনী দেশের কাছে এটি প্রথম সুযোগ বিশ্বের শক্তিধর দেশদের মধ্যে নিজস্ব একটি স্থান সুনিশ্চিত করার। কিন্তু সেই গৌরবগাথা কোনদিনই হাজার হাজার মানুষের প্রাণের বিনিময়ে হতে পারে না। আজ বারবার এই পুঁজির খেলার মধ্যে কোথাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে ফুটবলের আসল মাধুরী। বারবার যেন আরও উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠছে টিউনিশিয়ার সেই ক্লাবের tifo - CREATED BY THE POOR, STOLEN BY THE RICH.

– অয়ন গুহরায়

Comrade Abu Taher Sheikh passed away

পুর্ব বর্ধমান জেলার পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের মুশিমপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের কুবাজ পুর গ্রামের সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের দীর্ঘদিনের পার্টি সদস্য কমরেড আবু তাহের

সেখ ১১ নভেম্বর ২০২২ বিকাল ৪টার সময় বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি রেখে গেছেন তাঁর একমাত্র কন্যা, স্ত্রী ও জামাতাকে। তিনি কিছুদিন থেকে অসুস্থ ছিলেন। কয়েকদিন আগে প্রতাপ নগর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে বর্ধমান মেডিকাল কলেজে পাঠানো হয়। তিনি দীর্ঘদিনের পার্টি কর্মী, অনেক লড়াইয়ের যোদ্ধা ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সেও ঋণমুক্তি আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন। গরিব পরিবারে চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে শাসক পার্টির শত প্রলোভনেও পার্টির প্রতি দৃঢ় ছিলেন। কমরেডের মৃত্যুতে এলাকার কর্মীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। পুর্ব বর্ধমান জেলা কমিটি কমরেডের মৃত্যুতে শোক জ্ঞাপন করছে এবং তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে।

কমরেড আবু তাহের সেখ লাল সেলাম।

==x==

খণ্ড-29
সংখ্যা-44