ইরানের নীতি পুলিশদের হাতে তথাকথিত ‘পোশাক বিধি’ লঙ্ঘনের জন্য মাহসা আমিনির হত্যা ইরানে প্রকৃত অর্থেই বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলেছে। ইরান জুড়ে অত্যাচারী ধর্মীয় শাসন এবং প্রাত্যহিক জীবনের ক্রমশ বেড়ে চলা দুর্দশার বিরুদ্ধে নারীসমাজ ও শ্রমজীবী মানুষের ক্রমপুঞ্জিত ক্রোধের প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটেছে এই প্রতিবাদে। ইতিমধ্যে এই সরকার পঞ্চাশ জনেরও বেশি প্রতিবাদীকে হত্যা করছে বলে খরর পাওয়া গেছে, তবুও এই নৃশংস অত্যাচারের প্রকাশ্য বিরোধিতা করে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে আরও ব্যাপক আকারে।
বাইশ বছরের কুর্নিশ তরুণী মাহসা আমিনি তার পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য তেহরানে এসেছিলেন। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ইরানের কুখ্যাত নীতি পুলিশের ‘গাইডেন্স পেট্রল’ তাকে আটক করে, সঠিকভাবে হিজাব পরার পদ্ধতি শেখানোর জন্য ‘পুনর্শিক্ষা কেন্দ্রে’ পাঠায়। তার ভাই যখন তার জন্য থানায় অপেক্ষা করছিলেন, তার পরিবারকে জানানো হয় মাহসাকে হৃদযন্ত্রের সমস্যার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল এবং সেখানেই তিনি গত ১৬ সেপ্টেম্বর মারা যান। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবৃতিতে ধরা পড়েছে যে তাকে জঘন্যভাবে হেনস্থা করা হয় ও নৃশংসভাবে মারধর করা হয়।
মাহসা আমিনির মৃত্যুসংবাদ ইরানের মহিলাদের ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠা ক্রোধকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তারা তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন, আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলন ও জনগণের দাবি সনদের ইতিহাসের ঘটনাপঞ্জিতে যুক্ত করেছেন অনুপ্রেরণা জাগানো প্রতিবাদের এক নতুন অধ্যায়। তাদের সমস্ত শ্লোগান — “জান, জান্দেগি, আজাদি (নারী, জীবন, স্বাধীনতা), ‘আজাদি, আজাদি, আজাদি’ (স্বাধীনতা স্বাধীনতা স্বাধীনতা) এবং ‘মা হামে, মাহসা হাস্তিম, বেজাং তা বেজাঙ্গিম’ (আমরা সবাই মাহসা, আমরা সবাই আছি এই একজোট লড়াইয়ে) গোটা বিশ্ব জুড়ে অনুরণিত হচ্ছে। তাদের নিজেদের চুল কেটে আন্দোলনের পতাকা হিসেবে উড্ডীন করার সাহসী কাজ আগামী বহু প্রজন্মের সৃজন প্রতিভাকে উদ্দীপ্ত করবে।
ইরান একটি বহু বৈচিত্র্যের দেশ, মাহসা আমিনির মর্মান্তিক মৃত্যু বিভিন্ন পরিবেশের মানুষকে তাদের সম্মিলিত দুঃখ, ক্রোধ আর প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছে। ইরানী মহিলাদের ব্যক্তিগত জীবন ও রুচি-পছন্দের ওপর ধর্মীয় শাসনের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে লড়াইকে এখন, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র-পোষিত নজরদারি বাহিনীর সদস্য ও তাদের নৃশংস বর্বরতায় আন্দোলন দমনের চেষ্টার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদের আরও বড় তরঙ্গে ছড়িয়ে যেতে দেখছি। অতীতের অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শনের মতো, ইরানী মহিলারাও আজ ধর্মীয় শাসনের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এক আমূল রাজনৈতিক পরিবর্তনের গভীর আন্দোলনের দিশারী হয়ে উঠেছেন। আর সেই জন্যই ইরানের সংগ্রামী মহিলা ও জনগণের লড়াইয়ের প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি প্রগাঢ় হয়ে উঠছে।
ধর্মান্ধরা এবং মার্কিনপন্থী মাতব্বররা অবশ্য মাহসা আমিনির মৃত্যু ও তার ফলশ্রুতিতে ইরানের উত্তাল প্রতিবাদকে নিজেদের ইসলাম ভীতির ভাষ্য ও ইরানে রাজত্ব পরিবর্তনের শোরগোলকে ব্যাপক করে তোলার উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে উঠে পড়ে লেগেছে। সেই সব শক্তি যারা ভারতে মহিলাদের হিজাব পরার জন্য নির্যাতন ও হেনস্থা করে, তারা ইরানের প্রতিবাদী মহিলাদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করছে। হিজাবটা কোনও ব্যাপার নয় — বিষয়টা হল মহিলাদের ওপর ‘পোশাক বিধি’কে চাপিয়ে দেওয়ার স্বৈরতান্ত্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক জুলুম। ইরান বা আফগানিস্তানের মহিলাদের পূর্ণ অধিকার আছে সেই পোশাকবিধিকে প্রত্যাখ্যান করার যা হিজাব বা সেটা পরার বিশেষ ধরনকে বাধ্যতামূলক করে, তেমনই ভারতেও মহিলাদের একইরকম অধিকার আছে যে কোনও বৈষম্যমূলক হুকুমকে অগ্রাহ্য করার যা তাদের হিজাব পরার ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছে।
নারীর স্বাধীনতা ও অধিকারের সংগ্রাম ফ্যাসিস্ট-আধিপত্যের অধীনে থাকা ভারতে যেমন জরুরি তেমনই জরুরি ধর্মীয় শাসনাধীন ইরান বা এমনকি গণতন্ত্রের স্বঘোষিত রক্ষক এবং রপ্তানিকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই হোক, যেখানে মহিলাদের আবার একবার লড়তে হচ্ছে গর্ভপাতের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ফিরে পেতে। আজ ইরানের লড়াইটা যদি হয় ধর্মীয় শাসনের কবলমুক্ত গণতন্ত্রের জন্য, আমাদের মনে রাখতে হবে আধুনিক ইরানের প্রগতির ধারাকে বিশেষ বিশেষ সন্ধিক্ষণের সংকটকালে কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ পিছিয়ে দিয়েছে।
১৯৫০-এর দশকের শুরুতে ইরান সিআইএ — পরিকল্পিত সামরিক অভ্যুত্থান ‘অপারেশন এজেএএক্স’-এর শিকার হয়েছিল যার উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মহম্মদ মোসাদ্দেঘ সরকারকে ফেলে দিয়ে ইরানকে পাহলভী রাজবংশের রাজতন্ত্রের শাসনের অধীন করা। মোসাদ্দেঘকে উৎখাত করা হয়েছিল তার প্রগতিশীল রাজনীতি, বিশেষ করে তার ইরানের তেল শিল্পকে জাতীয়করণের সাহসী পদক্ষেপের জন্য।
১৯৭৯-এর বিপ্লব শেষ পর্যন্ত হস্তগত হয়েছিল ধর্মতন্ত্র (থিয়োক্রেটিক)-এর শক্তির দ্বারা। উদ্দেশ্য ছিল ইরানকে এক ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত করা। কিন্তু বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে আয়াতোল্লা খোমেইনি-কবলিত ইরান পাহলভী যুগের মার্কিনপন্থী ইজরায়েলপন্থী নীতিতে ফিরে যায়নি। আমরা যদি ইরানের গণতন্ত্রপ্রেমী আন্দোলনকারীদের কথা কান পেতে শুনি তাহলে বুঝতে পারব কীভাবে ইরানকে মার্কিন মঞ্জুরি এবং মার্কিন-ইজরায়েল অক্ষের সর্বক্ষণের নিশানায় রাখা আসলে ইরানের অত্যাচারী শাসককে আভ্যন্তরীণ সমর্থন লাভের জন্য প্রচার চালাতে ও তার উৎপীড়নের শাসনকে বৈধতা দিতে সাহায্য করছে।
ইসলামিক বিশ্বে মহিলাদের অধিকার ও গণতন্ত্রের নামে আমেরিকার অশুভ নীতির প্রভাব কতটা সর্বনাশা হতে পারে তার আরেকটি নিদর্শন হল আফগানিস্তান — কয়েক দশকের সামরিক দখলদারির পর তালিবানদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে মাত্র কিছু দিন আগে আমেরিকা আফগানিস্তান ছেড়েছে।
ভারতবর্ষেও, আমরা খুব ভালো করেই জানি কীভাবে সঙ্ঘ পরিবার মুসলিম মহিলাদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করে নিজেদের নারীবিদ্বেষ ও ধর্মান্ধতাকে আড়াল করার চেষ্টা করে চলেছে। তিন তালাক এবং এখন হিজাবের বিরুদ্ধে তাদের প্রচারকে, মুসলিম মহিলাদের ক্ষমতায়নের বিষয়ে তারা কতটা ‘ভাবিত’ তার প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু সমান নাগরিকত্বের জন্য শাহীনবাগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর মুসলিম মহিলাদের প্রতি তাদের আসল মনোভাব একেবারে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। বিদ্বেষমূলক মিথ্যা, বুল্লি বাই-এর মতো বিষাক্ত অ্যাপের মাধ্যমে অন লাইনে লাঞ্ছনা এবং ডিজিটাল নিগ্রহ থেকে শুরু করে দানবীয় আইনে জেলে পোরা ও প্রতিহিংসামূলক বুলডোজার আক্রমণ – সব কিছুর মধ্যে মুসলিম আন্দোলনকারী মহিলারা সঙ্ঘ বাহিনীর নির্যাতনমূলক ও চরম ঘৃণার ধারাবাহিক প্রচারের চূড়ান্ত নিশানায় নিজেদের দেখতে পাচ্ছেন। জাকিয়া জাফরির পুনর্বিবেচনার আবেদনকে ঘৃণা ও অবজ্ঞায় খারিজ করা, সহ-আবেদনকারী তিস্তা শেতলবাদের প্রতিহিংসামূলক গ্রেফতার এবং বিলকিস বানো মামলায় ধর্ষক ও খুনিদের নির্লজ্জভাবে সংবর্ধনা দেওয়ার ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে মুসলিম নারীদের ন্যায় চাওয়ার অধিকারকে প্রকাশ্যে অস্বীকার করা হচ্ছে।
পূর্ণ অধিকারসমূহ ও ধর্মতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্র থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রামরত ইরানের মহিলাদের প্রতি আমাদের উষ্ণ ও নিঃশর্ত সমর্থন জানাতে হবে। আমরা কোনও রকম পশ্চিমী হস্তক্ষেপ ছাড়াই ইরানের জনগণের নিজেদের পথ নিজেরাই নির্ধারণ করার অধিকারকেও পূর্ণ সমর্থন জানাই। পিতৃতন্ত্র ও নারী বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই সামাজিক রূপান্তরের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এই লড়াইকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য প্রতিটি সংগ্রামে শক্তির মহান উৎস হিসাবেই দেখতে হবে। ইরানের সংগ্রামী মহিলারা বিজয়ী হোন!
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২)