ভারতের বর্তমান সন্ধিক্ষণ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে
Regarding India's current juncture

-- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

ভারতবর্ষের সংসদীয় গণতন্ত্র যে প্রকৃত অর্থেই সম্পূর্ণ ফ্যাসিবাদী বিপর্যয়ের ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে আছে সে ব্যাপারে দেশের আরো বেশি বেশি মানুষ ও ভারতের রাজনীতি সম্পর্কে সারা পৃথিবীর আগ্রহী পর্যবেক্ষকরা একমত হচ্ছেন। এটা ঠিক যে, ফ্যাসিবাদ শব্দটা সবাই ব্যবহার করছেন না। বহু লেখক ভারতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দক্ষিণপন্থী জনমোহিনীবাদ, কর্তৃত্ববাদ, নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র, জাতবর্ণ ভিত্তিক গণতন্ত্র ইত্যাদি নানাবিধ শব্দ ব্যবহার করে চলেছেন। ধারণাগত স্পষ্টতার জন্য সিপিআই(এমএল) সামগ্রিকভাবে ফ্যাসিবাদ শব্দটার ব্যবহারই সঠিক মনে করছে। ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থার সময়ে যখন স্বৈরতন্ত্র গণতন্ত্রের জায়গা দখল করে ফেলেছিল সেই ব্যতিক্রমী সময়টুকু বাদ দিলে ভারতবর্ষ দীর্ঘ সাত দশক ধরে সংসদীয় গণতন্ত্রের অব্যাহত যাত্রার মধ্যে দিয়ে চলেছে, কিন্তু বর্তমান সময়টা এক অঘোষিত অথচ আরোব্যাপক ও স্থায়ী জরুরি অবস্থা হিসাবে বেশি রকম অনুভূত হচ্ছে। ’৭০ দশকের জরুরি অবস্থা মূলত রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষের উপর আগ্রাসী রাষ্ট্রীয় দখলদারি এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো ছেঁটে ফেলার অভিযান ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক পর্যায়ে ভারতের বৈচিত্র্য ও নানা ভাষা, নানা ধর্মের সামাজিক বিন্যাস মারাত্মক আঘাতের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদী আক্রমণ

তিন দশক আগের অযোধ্যা নিয়ে রক্তস্নাত রথযাত্রার দিনগুলো থেকে আমরা ধারাবাহিকভাবে এই পরিস্থিতি গড়ে উঠতে দেখছি। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাকে আমরা সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের উত্থানের নির্দিষ্ট লক্ষণ বা পূর্বাভাস হিসাবে চিহ্নিত করেছিলাম, যা ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যার ঘটনায় অত্যন্ত সঠিক চিহ্নিতকরণ বলেই প্রতিপন্ন হয়। নরেন্দ্র মোদীকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বানানোর জন্য কর্পোরেটদের চিল-চিৎকার ফ্যাসিবাদের আরো একটা অভ্রান্ত লক্ষণকে সামনে নিয়ে আসে — সর্বোচ্চ নেতার ঘনিষ্ঠ কর্পোরেটদের চূড়ান্ত আনুগত্য। ২০১৪ থেকে ভারতীয় ফ্যাসিবাদের অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো উদ্বেগজনক ও বেপরোয়াভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।

ফ্যাসিবাদ তার ভারতীয় বৈশিষ্ট্যে শাসনবিভাগ, আইনসভা ও বিচারবিভাগের ক্ষমতা ও বিভাজনকে ওলটপালট করে দিয়ে শাসনবিভাগের চরম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে; সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তির মদতপুষ্ট অ-রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর দ্বারা নামিয়ে আনা পরিকল্পিত মুসলিম-বিরোধী দমনপীড়ন, পথে-ঘাটে যত্রতত্র জাতিবিদ্বেষী ও নারীবিদ্বেষী হিংসা ও বাড়তে থাকা গুণ্ডাগিরি; ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যগুলির অধিকারকে ধূলিসাৎ করে ক্ষমতার চরম কেন্দ্রীকরণ এবং রাষ্ট্রীয় মদতে লাগামছাড়া কর্পোরেট লুটপাটের ফলে যাবতীয় সম্পদ মাত্র কয়েকটা ব্যবসায়িক গোষ্ঠী/পরিবারের কুক্ষিগত করে ফেলা; সংঘ বাহিনীর আইটি সেল ও শাসকের পোষ্য মূলধারার কুখ্যাত গোদি মিডিয়ার মিশেলে জনমানসে বিকৃত তথ্য ছড়িয়ে, মানুষকে বিভ্রান্ত করার সম্ভাব্য সবরকম উপায়কে কাজে লাগিয়ে পাইকারি হারে শাসকের স্বৈরাচারী কাজের ও বক্তব্যের সপক্ষে জনমত তৈরি করিয়ে নেওয়া; নিষ্ঠুর দমনের বিভিন্ন দানবীয় আইন প্রয়োগ করে ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতিমালা ও আইনের শাসন ধ্বংস করে যে কোনো ভিন্নমতকে নির্যাতন চালিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া, ভয়াবহ সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করা এবং নাগরিকদের প্রতি মুহূর্তে বেনাগরিক করার হুমকি দিয়ে আধিকার সম্পন্ন নাগরিককে ক্রমাগত রাজতন্ত্র বা ঔপনিবেশিক শাসনের কায়দায় অসহায় প্রজা বানিয়ে ফেলা — এই সবকিছুই ফ্যাসিবাদের লক্ষণ।

ভারতীয় ফ্যাসিবাদের চালিকাশক্তি হল আরএসএস

মোদী জমানা নিছক একটি কর্তৃত্ববাদী জমানা নয় বরং পুরদস্তুর ফ্যাসিবাদি জমানা — আর এই গুণগত পার্থক্যের কেন্দ্রে রয়েছে আরএসএস, আর এই নতুন জমানার গঠন ও পরিচালনার কেন্দ্রীয় ভূমিকায় রয়েছে আরএসএস। আমাদের একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে বিশ্বের ইতিহাসে ফ্যাসিবাদের প্রথম আস্ফালন অর্থাৎ ইতালিতে মুসোলিনির শাসন এবং তার অব্যবহিত পরেই জার্মানিতে হিটলারের পুরোদস্তুর ফ্যাসিবাদী প্রকল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ১৯২৫ সালে আরএসএসের জন্ম হয়। বাইরে থেকে আমদানি করা এই মতাদর্শকে ভারত-ইতিহাসের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান বিশেষত ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতবর্ণের শোষণব্যবস্থা, পুরুষতন্ত্র ও বিষাক্ত মুসলিম-বিদ্বেষী ঘৃণার সঙ্গে মিশিয়ে আরএসএস ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, যে ধারণা দাঁড়িয়ে রয়েছে সাভারকরের প্রণীত হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্বের উপর।

মুসোলিনি ও হিটলারের ক্ষেত্রে ক্ষমতায় উত্থান আর তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পতন খুব দ্রুত গতিতে ঘটে গিয়েছিল। কিন্তু ভারতে ফ্যাসিবাদের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসতে সময় লেগেছে অনেক বেশি। হিটলার জমানা থেকে শেখা উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ, সমাবেশিত করার কায়দাকানুন ও গণহত্যার নীল নকশার সঙ্গে খবরদারি ও নজরদারি চালানোর ডিজিটাল যুগের কলাকৌশল মিশে আজকের ভারতীয় ফ্যাসিবাদ সম্ভবত দুনিয়ার সবচেয়ে অভিজ্ঞ ফ্যাসিবাদী জমানা। হিন্দু-আধিপত্যকামী উগ্র জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মার্কিন তাঁবেদারি করা বিদেশ নীতির মিশ্রণের মাধ্যমে এই জমানা একই সঙ্গে আভ্যন্তরীণ সমর্থন ও পশ্চিমী দুনিয়ার অনুমোদন হাসিল করে নিতে চায়। বিরাট বাজারের প্রতি বৈশ্বিক পুঁজির আকর্ষণ, বৈশ্বিক পুঁজির সঙ্গে ভারতের কর্পোরেট পুঁজির ক্রমবর্ধমান গাঁটছড়া এবং আমেরিকা ও ইজরায়েলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসাবে ভারতের রাজনৈতিক ভূমিকার সুবাদে মোদী সরকার তার বিদেশ নীতিকে কাজে লাগিয়ে নেওয়ার যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে।

অবশ্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী লবির সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব ও আপেক্ষিক স্বায়ত্ত্বতা বজায় রাখার রাস্তা খোলা রাখতে ভারত ব্রিকস ও সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনেরও সদস্য হয়ে রয়েছে যেগুলোর মধ্যে রাশিয়া এবং চীনও আছে, কিন্তু ট্রাম্প, নেতানিয়াহু ও বরিস জনসনের মতো রাষ্ট্রনেতা যারা তিনজনই ঘটনাচক্রে এখন মসনদ থেকে উৎখাত হয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে মোদীর ব্যক্তিগত দহরম-মহরম মোদী সরকারের বিদেশনীতির মূল দিশা ও জোরটা ঠিকই দেখিয়ে দেয়। ২০০২’র গুজরাট গণহত্যার পরে একটা দীর্ঘ সময় ধরে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডসহ পাশ্চাত্যের বহু দেশ গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মোদীকে ভিসা দিতে অস্বীকার করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থী কর্তৃত্ববাদের বাড়তে থাকা উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদী আজ মার্কিন আধিপত্যে থাকা পশ্চিমী দুনিয়ার আশীর্বাদধন্য ট্রাম্পের শাসনকাল শেষ হয়ে গেলেও আমেরিকার মোদী জমানার সখ্যতা আজও অব্যাহত।

আরএসএস ও তার নানাবিধ নেটওয়ার্কের আগ্রাসী ভূমিকায় ক্রমশ তার হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের সুদূরপ্রসারী অভিসন্ধি ফুটে উঠছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ধ্বংসসাধন, ঢাকঢোল পিটিয়ে রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট ও বেলাগাম অরাষ্ট্রীয় গণহত্যাকারী বাহিনীর ব্যবহার, অনুগত কর্পোরেটদের সমর্থন এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নীতিগত সহযোগিতা — এই চারটি বিষয় হল মোদী জমানার ফ্যাসিবাদী অনুশীলনের দুরন্ত অগ্রগতির চাবিকাঠি। বিজেপি ২০১৪-তে ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারতের’ স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল আর ধাপে ধাপে এগিয়ে আজ তারা ভারতকে এক বিরোধীমুক্ত শাসনতন্ত্রে পরিণত করার পথে। একদিকে যখন বিজেপি সভাপতি বলছে যে, দেশে একটাই মাত্র রাজনৈতিক দল থাকবে আর তা হল বিজেপি, ঠিক তখনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বড়াই করে বলছে যে, আগামী পঞ্চাশ বছর ধরে বিজেপিই দেশ শাসন করবে।

ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে কমিউনিস্টদের ভূমিকা

ভারত নিশ্চিতভাবেই ফ্যাসিবাদের এই বিপদের বিরুদ্ধে জেগে উঠছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের জনগণের বিভিন্ন অংশের উল্লেখযোগ্য লড়াই আন্দোলন চোখে পড়েছে। রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার প্রতিবাদে হওয়া ছাত্র আন্দোলন, গুজরাটের ঊনায় নির্যাতনের বিরুদ্ধে দলিত জনতার পুনর্জাগরণ থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব আইনের বৈষম্যমূলক ও বিভেদকামী সংশোধনীর প্রতিবাদে মুসলিম মহিলাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা উত্তাল শাহীনবাগ আন্দোলন এবং বছরভর চলা ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন — মোদী সরকারকে কৃষিব্যবস্থায় কর্পোরেট দখলদারির লক্ষ্যে বানানো তিনটে কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছে; ঘৃণা, ত্রাস ও তীব্র দমনপীড়নকে অগ্রাহ্য করে এমন একগুচ্ছ শক্তিশালী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ লড়াই আমরা গড়ে উঠতে দেখেছি। জনগণের প্রতিবাদ এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপর চলতে থাকা সর্বাত্মক আক্রমণের ফ্যাসিবাদী স্টীম রোলারই বিরোধী ঐক্য গঠনের গতিশীল প্রক্রিয়াকে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেছে। কিন্তু বিরোধীদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশই আরএসএস ও তার বিদ্বেষমূলক প্রচার ও হিংসার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত, বরং তারা কেবল মোদী সরকারের বিরোধিতাতেই আটকে রয়েছে। সরকারের বিরোধিতার প্রশ্নেও রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন, নাগরিকদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরোধ এবং বেসরকারীকরণের নীতি বাতিল করে জনকল্যাণের দিকে আর্থিক নীতির মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া — এই প্রশ্নটিকে একটা বড় সংখ্যক বিরোধীরা এখনও তাদের ধর্তব্যের মধ্যে রাখছে না।

এই জায়গাতেই সবচেয়ে দৃঢ়পণ, সর্বাত্মক ও সুদূরপ্রসারী প্রতিরোধ এবং ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করার জন্য দীর্ঘস্থায়ী লড়াইকে শক্তি যোগানোর কাজটায় বিপ্লবী কমিউনিস্টদের ভূমিকা জোরালো করতে হবে। মাঠে ময়দানের লড়াই তৈরি করা, চলমান লড়াইকে সহযোগিতা করা ও টিকিয়ে রাখার কাজ এবং ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলোকে গদিচ্যুত করার লক্ষ্যে সংসদীয় বিরোধীদের ঐক্য ও গতিশীলতা গড়ে তুলতে সমস্ত শক্তি জড়ো করার কাজটাই করতে হবে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের। ফ্যাসিবাদিরা ইতিমধ্যেই যতটা শক্তি সঞ্চয় করে ফেলেছে, ভারতের গণতন্ত্র এবং অগ্রগতিকে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে, তাতে বোঝা যায় ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধের দায়িত্ব কতটা দীর্ঘস্থায়ী। আম্বেদকরের ভাষায়, যদি আমরা হিন্দুরাষ্ট্রকে ভারতের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসাবে দেখি তাহলে আমাদের প্রত্যুত্তর কেবল তাৎক্ষণিক দুর্যোগ মোকাবিলার মানসিকতা নিয়ে উদ্ধার ও ত্রাণকাজে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, বরং দেশকে পুনর্গঠন করার চ্যালেঞ্জটাও নিতে হবে।

গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আম্বেদকর ভারতের সংবিধানের যাত্রাপথের দ্বন্দ্বগুলোকে চিহ্নিত করেছেন — ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যের প্রেক্ষিতে শুধুমাত্র ভোটের সমানাধিকারের অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া এবং সাংবিধানিক গণতন্ত্রের পরত ও তার নীচে চাপা থাকা অগণতান্ত্রিক জমির মধ্যেকার বিরোধাভাস। ফ্যাসিবাদের জবাব নিহিত রয়েছে গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করা ও তৃণমূলস্তর অবধি পৌঁছে দেওয়ার মধ্যেই, সাংবিধানিক গণতন্ত্রের মোড়কের সঙ্গে অগণতান্ত্রিক ভিত্তিভূমির অন্তর্দ্বন্দ্ব নিরসনে গণতন্ত্রকে সমাজের আরও সুসঙ্গত ও গভীর করে তোলার মধ্যেই। ঐতিহাসিকভাবে এটাই ছিল সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন ও অঙ্গীকার। আর একশো বছর আগে সমাজতন্ত্রের এই স্বপ্নকে রুখে দেওয়া ও চুরমার করার উদ্দেশ্যেই ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল। ভারতকে সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র হিসাবে গড়ে তোলার সাংবিধানিক ঘোষণাকে বাস্তবায়নের মধ্যেই আজকের ভারতের বেড়ে চলা ফ্যাসিবাদের আসল উত্তর রয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট : গভীরতর সংকট, কর্তৃত্ববাদ ও যুদ্ধ

ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করা গেছে যে, ভারতের এই ফ্যাসিবাদী আক্রমণ ঘনীভূত হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থানের সহায়ক পরিবেশে। বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের গভীর ও সুদূরপ্রসারী সংকটের বর্তমান পর্যায় হল দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থানের এই সহায়ক পরিবেশ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কোভিড-১৯ অতিমারীর ব্যাপক আঘাত। একদিকে যখন সৌদি আরব ও ইজরায়েলের দ্বারা ইয়েমেন ও প্যালেস্টাইনের উপর আক্রমণ অব্যাহত, যখন চীনকে নিশানা বানিয়ে চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলার নিত্যনতুন পথ খুঁজে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তখনই ২০২২-র ফেব্রুয়ারি থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন। যুদ্ধ পরিস্থিতি উস্কে দিয়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার এই আগ্রাসনকে সিপিআই(এমএল) স্পষ্টভাবেই বিরোধিতা করেছে এবং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে শান্তি ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে। আমরা রাশিয়ান জাত্যাভিমান এবং তার ইউরেশীয় সম্প্রসারণবাদেরও নিন্দা করেছি, যে সম্প্রসারণবাদী ভাষ্য এটা বলে যে, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ইউক্রেন হল রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং ইউক্রেনের সার্বভৌম অস্তিত্বের অধিকার স্বীকার করাটা আসলে লেনিনের ‘ভুল’ ছিল এবং সেই ভুল এখন সংশোধন করা দরকার।

ন্যাটোর পূর্বাভিমুখী সম্প্রসারণকে যুদ্ধের যুক্তি হিসেবে দেখিয়ে যুদ্ধের অপরিহার্যতা প্রমাণ করার রুশ তর্ক আমরা মানি না, কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, এই যুদ্ধে যখন ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়েই রক্তাক্ত হচ্ছে এবং বিশ্বের একটা বড় অংশের মানুষকে এর জন্য খুব চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু এই যুদ্ধে সরাসরি না জড়িয়েও সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে। ঠান্ডা যুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে ও সোভিয়েত পরবর্তী পৃথিবীতে ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে আমেরিকা ন্যাটোকে বারংবার হাতিয়ার বানিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং ওয়ারশ চুক্তির অবলুপ্তির পরে ন্যাটোকে টিকিয়ে রাখারই কোনও যৌক্তিকতা নেই। কিন্তু ন্যাটোকে ভেঙে দেওয়ার পরিবর্তে আমেরিকা ন্যাটোর সদস্য দেশের সংখ্যা প্রতিষ্ঠাকালের ১২ থেকে আজ ৩০-এ নিয়ে গিয়েছে। এই সম্প্রসারণ যে কেবলমাত্র রাশিয়ার কথা বা চীনের সঙ্গে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান মিত্রতার কথা মাথায় রেখে করা হয়েছে তা নয়, এটা হয়েছে সমান্তরাল শক্তি হিসাবে ইওরোপের উঠে আসার রাস্তা বন্ধ করার উদ্দেশ্যেও। এমনকি আজ ইউক্রেনকে তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সাহায্য করার কথা বলেও আমেরিকা ও কর্পোরেট পুঁজি ইউক্রেনে অর্থনৈতিক উপনিবেশ গড়ে তুলতে ব্যস্ত, যার ফলে দেশটার বড় পরিমাণ ভূখণ্ড, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা ও শিল্প কর্পোরেটদের হাতে চলে যাওয়ার পাশাপাশি শ্রম আইন লঙ্ঘন ও ধ্বংসের খেলা চলছে। রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি বিরাট পরিমাণে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির পক্ষে প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন, নিউইয়র্কের শেয়ার কেনাবেচার বাজারে তিনি এর নাম দিয়েছেন ‘অ্যাডভান্টেজ ইউক্রেন’।

ইসলামবিদ্বেষী ‘স্বাধীনতা রক্ষার অভিযান’ বা তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের পরে আমেরিকা এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ঠান্ডা যুদ্ধের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে চাইছে। একদল মার্কিনপন্থী তাত্ত্বিক ও প্রচারক ইতিমধ্যেই রাশিয়া-চীন সখ্যতাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার জার্মানি-ইতালি-জাপান আঁতাতের মতো মূল বিপদ বলে চিহ্নিত করতে শুরু করেছে এবং এই নবগঠিত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত এক আন্তর্জাতিক জোট গঠনের পক্ষে ওকালতি করছেন। সংকট জর্জরিত ক্ষয়িষ্ণু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সাম্রাজ্যবাদী অপরাধগুলো ধামাচাপা দিয়ে একমেরু বিশ্বে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্যকে বজায় রাখতে নিজেকে বিশ্বের গণতন্ত্রের স্বঘোষিত চ্যাম্পিয়ন হিসাবে তুলে ধরতে চায়। কিন্তু আমেরিকা কি বিশ্বজনীন গণতন্ত্র রপ্তানির রক্তাক্ত ও কলঙ্কজনক অধ্যায়টা ভুলে গিয়েছে !

international context

আমেরিকান একমেরু বিশ্বের পরিবর্তে চাই বহুমেরু বিশ্ব প্রয়োজন

বিশ্বের ক্ষমতাধর শক্তিগুলোর অভ্যন্তরীণ চরিত্র যেমনই হোক না কেন, নয়া উদার অর্থনীতি বাতিল করা এবং সামাজিক রূপান্তর ও রাজনৈতিক উত্তরণের পথ অনুসন্ধানে বিশ্বব্যাপী লড়াই সংগঠিত করার জন্য প্রগতিশীল শক্তিগুলোর পক্ষে বহুমেরু বিশ্ব সবসময় অনুকূল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবল বিংশ শতকের গোড়ায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্মই দেয়নি, এটা নভেম্বর বিপ্লবকেও ত্বরান্বিত করেছিল যা সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম গ্রন্থিকে সাম্রাজ্যবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। নানারকম অভ্যন্তরীণ বিচ্যুতি ও অবক্ষয় সত্ত্বেও, সোভিয়েত ইউনিয়ন ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই পরিসমাপ্তি চলমান উপনিবেশ বিরোধী ও বিপ্লবী লড়াইগুলোর পক্ষে জয়ের আবহ রচনা করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। পরবর্তী দশকগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন অভ্যন্তরীণ সমস্যায় গতিরুদ্ধতায় ভুগলেও এবং পরাক্রমশালী শক্তি হয়ে ওঠার দ্বন্দ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক অসম্ভব অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফাঁদে আটকে পড়লেও আমেরিকান কর্তৃত্বের প্রতিস্পর্ধী শক্তি হিসাবে এর অস্তিত্ব তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশ ও শক্তিকে নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে এবং সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণে উত্তীর্ণ হতে সহযোগিতা করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আমাদের পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও এর এক উল্লেখযোগ্য নজির।

সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ওয়ারশ চুক্তির পতনের পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র মহাশক্তি হিসেবে বিরাজ করছিল এবং বেশ কিছু সময় ধরে মনে হচ্ছিল দুনিয়াটা যেন একমেরু বিশ্বে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণপন্থী তাত্ত্বিকদের বিজয় উল্লাসে ফুকুয়ামা তাঁর ‘দ্য এন্ড অফ হিস্ট্রি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান’ (ইতিহাসের শেষ ও শেষ মানব) গ্রন্থে উদার গণতন্ত্রের সর্বজনীন রাজত্বকে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত রূপ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। অন্যদিকে স্যামুয়েল হান্টিংটন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নতুন ‘শত্রু’র প্রয়োজনীয়তাকে মান্যতা দিয়ে এই নতুন যুগকে মতাদর্শগত সংঘর্ষের স্নায়ু-যুদ্ধের বাস্তবতার পরিবর্তে ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’ হিসেবে বর্ণনা করেন। হান্টিংটন যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমকে কেন্দ্রে রেখে তাঁর বিভাজন রেখাগুলি আঁকছিলেন, ঠিক তখন রুশ রাজনৈতিক দার্শনিক ও বিশ্লেষক আলেকজান্ডার ডুগিন রাশিয়া ও ইউরেশিয়াকে পশ্চিমা আধিপত্যের চূড়ান্ত উত্তর হিসাবে কল্পনা করে ভবিষ্যৎ বিশ্বের কথা ভাবছিলেন।

আজ ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরে, ফুকুয়ামা একে ‘ইতিহাসের শেষের শেষ’ বলে অভিহিত করছেন, আর, টিমোথি স্নাইডার এবং অ্যান অ্যাপেলবামের মতো আমেরিকান ইতিহাসবিদরা বিশ্বের উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলিকে মার্কিন নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে সামরিকসহ যে কোনও প্রয়োজনীয় উপায়ে স্বৈরাচারী শাসনকে পরাস্ত করার আহ্বান জানাচ্ছেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি এই কাজটাই করে থাকে বলে বরাবর দাবি করে আসছে না? বিশেষ করে যুদ্ধোত্তর বিশ্বে? সরাসরি আক্রমণ ও দখলদারির যুদ্ধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদ্ধতিতে দেশে দেশে নির্বাচিত ও ক্ষমতাসীন সরকারকে ফেলে দিয়ে পুতুল শাসককে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক, দমনমূলক, প্রতিক্রিয়াশীল শাসনের পথ প্রশস্ত করার মার্কিন ইতিহাস আমরা ভুলে যাইনি। ইন্দোনেশিয়া এবং চিলি থেকে শুরু করে ইরাক, লিবিয়া এবং আফগানিস্তানের মতো সাম্প্রতিক ঘটনা পর্যন্ত, ‘গণতন্ত্র রক্ষা বা গণতন্ত্র রপ্তানির’ নামে বিশ্বজুড়ে মার্কিন হস্তক্ষেপের নৃশংস সহিংসতা আর ধারাবাহিক ধ্বংসলীলার আমরা সাক্ষী।

তাই সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসকে একটি একরৈখিক বৈশ্বিক আখ্যান বা সোজাসাপ্টা গণতন্ত্র-বনাম-স্বৈরাচার বাইনারিতে পর্যবসিত করে দেওয়া চলে না। আমরা চাই ইউক্রেন সফলভাবে তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করুক, রাশিয়ার জনগণ পুতিন শাসনের অলিগার্কি ও নৃশংস দমনপীড়ন কাটিয়ে উঠুক এবং চীনের জনগণ, তাদের বিপর্যস্ত সংখ্যালঘুরা সহ সকলে, অনেক বেশি আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা অর্জন করুক। কিন্তু আমাদের এ’কথাও স্বীকার করতে হবে যে, রাশিয়া ও চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার মার্কিন কৌশলের পেছনে মোটেই এরকম কোনও সদিচ্ছা কাজ করছে না, বরং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বব্যাপী আধিপত্য রক্ষা করা এবং বিশ্বকে বহুমেরু হওয়া থেকে বিরত রাখাই ওদের উদ্দেশ্য। ইউক্রেনেই আজ বিশ্বের একমাত্র যুদ্ধ চলছে এমনটাও নয়, যদিও বিশ্বব্যাপী মিডিয়া অন্যান্য সংঘাত ও যুদ্ধগুলিকে ঢেকে দিয়েছে বা দৃশ্যপট থেকে মুছে দিয়েছে। সমস্ত যুদ্ধেরই নিজস্ব কারণ ও প্রেক্ষাপট রয়েছে, একটি যুদ্ধের সমাধান হলেই তা অন্য যুদ্ধকে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার দিকে পরিচালিত করবে এমন নয়। আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের প্রতিটি অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র খর্ব করা ও দমনের প্রতিটি ঘটনার বিরুদ্ধে শান্তি, ন্যায় ও গণতন্ত্রের শক্তিকে সর্বত্র সোচ্চার হতে হবে।

জাতীয় অগ্রাধিকার এবং আন্তর্জাতিকতাবাদী অঙ্গীকারের সমন্বয়

এইখানে আমরা, কমিউনিস্ট বা আরও সাধারণ অর্থেভারতের সমস্ত ধারার গণতান্ত্রিক শক্তি ভারতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রাথমিকতার বাধ্যতামূলক প্রশ্নে এসে পড়ি। কমিউনিজম একটি আন্তর্জাতিকতাবাদী মতাদর্শ ও আন্তর্জাতিক আন্দোলন হওয়ায় কমিউনিস্ট হিসেবে আমাদের অবশ্যই আন্তর্জাতিক ভূমিকাকে ক্রমাগত সমন্বিত করে চলতে হবে যেখানে আমরা আমাদের জাতীয় ভূমিকার সাথে সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরি। সমন্বয়ের এই কাজের কথা আমরা যত সহজে বলি, বাস্তবে তা করে তোলা অতটা সহজ হয় না, এবং বিগত একশ বছর ধরে ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস এরকম বেশ কয়েকটি উদাহরণের সাক্ষী হয়ে রয়েছে যেখানে এই প্রশ্নেই ভুল বা বিপর্যয় হয়েছে।

এই চ্যালেঞ্জকে সঠিকভাবে বুঝতে চাইলে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের মূল ভিত্তিগুলিতে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। কমিউনিস্ট ইশতেহারটি অবশ্যই এক সর্বাত্মক আহ্বানের সাথে শেষ হয়েছিল যেখানে দুনিয়ার শ্রমিকদের বিশ্বব্যাপী ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং আন্তর্জাতিকভাবে পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াই করে তাকে পরাজিত করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে সবকিছুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে নিজেকে সর্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে জীবনের প্রতিটি দিককে পণ্যে পরিণত করাকে ইশতেহারে পুঁজির অন্তর্নিহিত প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। শ্রমিক শ্রেণীকেও তাই বিশ্বব্যাপী চিন্তার আধারে কাজ করা উচিত। একই সঙ্গে, ইশতেহারে এই বিষয়েও অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল যে, প্রতিটি জাতি-রাষ্ট্রে পুঁজিকে সিংহাসনচ্যুত করে জাতির স্বার্থ ও পরিচয় নির্ধারণের ক্ষমতা পুঁজির হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া এবং নিজেকেই জাতি হিসেবে ঘোষণা করা সেই জাতি-রাষ্ট্রের সর্বহারা শ্রেণীর কর্তব্য। অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, জাতির অভ্যন্তরে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সর্বহারা শ্রেণীকে তার স্বাধীন আত্মপ্রকাশ ঘটাতে হবে। কমিউনিস্ট ইশতেহারের এই মূল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নভেম্বর বিপ্লবের বিজয়ের মাধ্যমে জাতীয় সীমানার মধ্যে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার সম্ভাবনা প্রথমবার বাস্তবায়িত হয়েছিল।

শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলি সমাজতান্ত্রিক/কমিউনিস্ট আন্দোলনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মাত্রা এবং কাজগুলিকে একত্রিত করার এই চ্যালেঞ্জ টানাপোড়েনের মুখোমুখি হয়েছিল। প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক সংহতির বার্তা ও চেতনা ছড়িয়ে দেয় এবং নৈরাজ্যবাদী ও সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে প্রধান প্রধান মতাদর্শগত পার্থক্যরেখাগুলিকে চিহ্নিত করে প্রতিযোগী জাতীয়তাবাদ এবং প্রথম আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের চাপে ‘সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক’ নামক দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকটি ভেঙে পড়ে। ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ নামক তৃতীয় আন্তর্জাতিকটি বিজয়ী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেতনাকে ছড়িয়ে দিয়েছে এবং উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম থেকে শুরু করে উদার গণতন্ত্রে সংসদীয় সংগ্রাম পর্যন্ত বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এই নতুন কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ছড়িয়ে পড়তে ও আকার নিতে সাহায্য করেছে, আর ফ্যাসিবাদরূপে আসা চরম প্রতিক্রিয়াকে মোকাবিলা করতে সহযোগিতা করেছে।

চীন এবং ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপরীত অভিজ্ঞতা কিন্তু জাতীয় পরিস্থিতির মূল্যে আন্তর্জাতিককে অগ্রাধিকার দেওয়ার সমস্যাকেও দেখিয়ে দেয়। চীনের কমিউনিস্ট আন্দোলন আন্তর্জাতিক কেন্দ্রীয় নির্দেশনামা অগ্রাহ্য করে নিজস্ব গতিপথ তৈরি করতে সফল হয়েছিল। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে জাতীয় আন্দোলনের দাবি ও জাতীয় বাস্তবতার জটিলতার সাথে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের দিকনির্দেশনার সমন্বয় সাধনে আমরা ব্যর্থ হয়েছিলাম। সমস্যাটি সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির দ্বারা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত হওয়ার পর এই বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে কমিউনিস্ট মূল্যায়ন ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ’ থেকে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়ে ‘জনযুদ্ধ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়। ভারতের নিজস্ব উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামের অগ্রগতিকে অগ্রাধিকার দিতে ব্যর্থ হওয়ার কৌশলগত ত্রুটির ফলে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলন সাময়িক ধাক্কা খায়। আমাদের নিজেদের সিপিআই(এমএল) আন্দোলনেও, প্রধানত কৃষি-প্রধান ও পশ্চাৎপদ সমাজে বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালনা করতে গিয়ে, চীনা বিপ্লবের বিজয় থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার চেষ্টা করার সময় আমরা ভুল করে এমন স্লোগান এনে ফেলেছিলাম যা আমাদের পার্টি ও আন্দোলনকে চীনের বশংবদ অনুকরণ হিসাবে প্রতিভাত করেছিল এবং ভারতীয় বাস্তবতায় আমাদের স্বাধীন ভূমিকাকে খাটো করে দিয়েছিল।

আজ ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন ফ্যাসিবাদী আক্রমণকে পরাস্ত করার জন্য সর্বোত্তম অবদান রাখার ঐতিহাসিক দায়িত্বের মুখোমুখি। বিশ্বজুড়ে গভীর এবং দীর্ঘায়িত অর্থনৈতিক মন্দা, কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থান এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়ের মুখে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও সমস্ত প্রগতিশীল শক্তির কাছ থেকে একটি সমন্বিত শক্তিশালী প্রত্যুত্তর দাবি করে। বিশ্বব্যাপী প্রগতিশীল শক্তিকে সকল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, স্বৈরাচারী শক্তিকে তাদের নিজ নিজ প্রেক্ষাপটে প্রতিহত করতে হবে এবং একবিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াইকে তীব্রতর করতে হবে।

খণ্ড-29
সংখ্যা-39