পঞ্চায়েত নিয়ে বাংলার মানুষের বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। স্বশাসিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এখন আর নেই। কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে তা উপর থেকে পরিচালিত হয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক চর্চা চলে কিন্তু জনগণ তার কিছুই পায় না। পঞ্চায়েতগুলি এখন শাসকদলের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। স্বজন-পোষন এবং শাসকের মর্জিতে তা পরিচালিত হয়। গ্রাম সংসদ অর্থাৎ জনগণের মতামত সংগ্রহ করার প্রথা উঠে গেছে। এলাকায় উন্নয়ন বা পরিকল্পনা কী রকম হতে পারে সে বিষয়ে সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণই করতে পারে না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচিত সদস্যরাও তা জানতে পারেন না। বেশকিছু জেলায় পঞ্চায়েতে ১০০ দিনের কাজের মজুরি আজও বকেয়া, আবাস, বিভিন্ন ধরনের ভাতা নিয়ে দুর্নীতি বেশ চর্চিত হয়ে আছে। রাজনীতিগতভাবে ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি সামনে এসেছে। এই রকম অবস্থায় সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। কাজেই আমাদের সেই কাজে অবিলম্বে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ইতিমধ্যেই নির্বাচনের জন্য, আসনের জন্য ভাগবিন্যাসের কাজ শেষ হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন তার প্রস্তুতি কাজ চালাচ্ছে। কাজেই আমাদের স্বাধীনভাবে লড়াইয়ের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে হবে। কাদের সঙ্গে আসন সমঝোতা বা জোট হবে না ভেবে জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি সর্বপরি পঞ্চায়েত দখল এবং আসনগুলিতে সদস্যদের জয় নিশ্চিত করতে, এখন থেকে আসনগুলি বাছাই করতে হবে। সেই অনুযায়ী গণসম্পর্ক অভিযান এবং আন্দোলন বিকাশের সাথে সাথে প্রার্থী নির্ণয় করা জরুরি। পঞ্চায়েত যেগুলি সহজে করতে পারে বা করা উচিত তা আনতে হবে প্রচারের আলোতে। তৃণমূল কংগ্রেস শাসনে দুয়ারে সরকার, দুয়ারে রেশন প্রভৃতি বিভিন্ন আওয়াজ সব সময় শোনা যায়। কিন্তু নিজের গ্রামে নিজেদের পঞ্চায়েত বাইরের হয়ে গেছে কেন? কিছু মাতব্বর সবকিছু কুক্ষিগত করে নিয়েছে। আমার আপনার অধিকার কেড়ে নিয়েছে মা-মাটি-মানুষের কথা বলে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দেয়, কোনও সরকার বা কোনও মন্ত্রী নিজের পকেট থেকে কিছুই দেয় না। তাই এখন থেকে জোরের সাথে নিজের অধিকার বুঝে নিতে হবে।
(১) ১০০ দিনের কাজকে কৃষকদের ফসল উৎপাদন কাজে লাগানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। বিশেষ করে মধ্য ও দরিদ্র কৃষকদের সহযোগিতা করতে পারে।
(২) গ্রামে গ্রামে সরকারী দামে ফসল ক্রয়ের ক্যাম্প গঠনের দায়িত্ব নিতে পারে। যাতে সঠিক মূল্যে ফসল বিক্রি করতে পারে। কৃষকদের অভাবি অবস্থায় কম পয়সায় ফড়েদের কাছে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এই অবস্থা থেকে কৃষকদের পঞ্চায়েতের উদ্যোগে সমবায়ের মাধ্যমে ফসল বিক্রির ব্যবস্থা করে কৃষকদের সাহায্য করতে পারে।
(৩) কৃষকদের স্বার্থে গঠিত সমবায় সমিতিগুলি কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে, আর, তা বিশেষভাবে ব্লক ও জেলা পরিষদকে নজর দিতে হবে। সার, বীজ, কীটনাশক এবং কৃষি কাজের জন্য কম সুদে সমবায় ঋণ সরবরাহ করতে হবে। সমবায়গুলিতে ধনী ও গ্রামীণ ব্যবসায়ীদের আধিপত্য কমিয়ে মধ্য ও গরিব কৃষকদের জায়গা করে দিতে হবে। বাংলার সমস্ত সমবায়গুলিতে নতুন করে নির্বাচন করতে হবে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত সমবায় চাই।
(৪) পঞ্চায়েতগুলিতে নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যদের ক্ষমতা কমিয়ে আমলাদের ক্ষমতাবৃদ্ধি করানো হচ্ছে। আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা অধিষ্ঠিত করা হচ্ছে। গ্রাম সংসদ ব্যবস্থা, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে পঞ্চায়েত পরিচালনা তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কাজেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থাতে শাসকদের দাপাদাপি বেড়ে চলছে। গ্রামীণ কৃষক, কৃষি মজুর ও সাধারণ জনগনের নিজস্ব ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে কৃষক সহ সমস্ত জনগণের অংশীদারি বাড়াতে কৃষিমজুর ও কৃষক সংগঠনকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।
(৫) খোলামুখ কয়লাখনির, বা গ্রামের জনগণের জমি অধিগ্রহণ করে বিদেশি কোম্পানির ও কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত বন্ধ করতে হবে। এই ধরনের কাজে পঞ্চায়েতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জমি অধিগ্রহণের নিয়ম অনুযায়ী পঞ্চায়েতের মতামত নিতে হবে। আমলা ও শাসক পার্টির মতামতকে জনগণের মতামত বলা যাবে না। রাজ্য সরকারকে জনগণের মতামত নিশ্চিত করতে হবে।
(৬) আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই সমস্ত দাবি পূরণ করার জন্য আমাদের কৃষিমজুর ও গ্রামীণ মজুর, কৃষক এবং গ্রামীণ জেলা পার্টি সংগঠনকে ভূমিকা নিতে হবে।
বাংলার রাজনীতি ঘটনাবহুল হয়ে উঠছে। বিভিন্ন ধরনের ইস্যুতে সরকার বিরোধী ক্ষোভ বাড়ছে। ছাত্র যুব আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছে। সরকারি চাকরির দাবিদাওয়া নিয়ে কর্মপ্রত্যাশীরা প্রায় ৬০০ দিন রাস্তায় অবস্থানে বসে রয়েছেন। বধির সরকার কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেনি। হাইকোর্ট সিবিআই এবং কেন্দ্রীয় সরকার ইডিকে দায়িত্ব দিয়ে দায়মুক্ত হয়েছে। মেধাবী চাকরি প্রার্থীদের আমলা ও মন্ত্রীদের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নজিরবিহীন দুর্নীতির ছবি সামনে এসেছে। শুধু এই চাকরি নয়, ১০০ দিনের কাজে, পঞ্চায়েতে বিভিন্ন ধরনের সরকারি কাজে একই অবস্থা চলছে।
এই ধরনের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বাংলার গ্রামাঞ্চলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে রাজনৈতিক আন্দোলন জরুরি হয়ে পরেছে। নিজের ভোট নিজে দিন এবং পঞ্চায়েতে জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য ব্লকে ব্লকে রাজনৈতিক প্রচার শুরু করা দরকার।
তৃণমুল কংগ্রেস ২০১৮ সালের মতো রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে চাইবে। আমাদের তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য জনমত গড়ে তুলতে এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। ইতিমধ্যে বিজেপি ২০২৪’র লোকসভাকে মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। গ্রামে গ্রামে বিজেপি যাতে হিংসাত্বক ও বিভেদমূলক কার্যকলাপ করতে না পারে সে বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে। আমাদের কিছু বন্ধু তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিজেপির সাথে অলিখিতভাবে আসন সমঝোতা করে বসে। যা সম্প্রতি শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা দেখলাম। লোকাল রাজনীতি করতে গিয়ে নীতি ও কৌশল নিয়ে নজর রাখতে হবে। এই ধরনের সুবিধাবাদী রাজনীতি আত্মহত্যার সামিল। তাই, আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিজেদের স্বাধীন অবস্থানকে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বাম গণতান্ত্রিক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রক্রিয়া এখন থেকেই শুরু করা দরকার।
- কার্তিক পাল