প্রস্তাব
আদর্শ নির্বাচন বিধিতে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত সংশোধনী প্রশ্নে
Standard Election Rules

নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতির বিষয়ে আদর্শ নির্বাচন বিধিতে ভারতের নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত সংশোধনীর প্রশ্নে সিপিআই(এমএল)-এর পাঠানো উত্তর

এটা আমাদের সুবিবেচিত মতামত যে ০৪-০৪-২০২২ তারিখে ভারতের নির্বাচন কমিশন কর্তৃক 437/6/ Manifesto/ECI/INST/FUNCT/MCC/2015নং পত্রের মাধ্যমে জারি করা প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলি আইনসিদ্ধ নয় এবং এগুলি প্রকৃতিগতভাবে অগণতান্ত্রিক।

একদম শুরুতেই আমরা আপনার নজরে আনতে চাই যে ভারতীয় সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে ভোটার তালিকা তৈরির নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ, তত্ত্বাবধান এবং সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনার ক্ষমতা ও দায়িত্ব ভারতের নির্বাচন কমিশনের উপর অর্পিত। সংবাদ মাধ্যমেও ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে (No power to check parties, governments from promising freebies: ECI to SC, Indian Express, April 9, 2022) যে, ECI নিজেই সুপ্রিম কোর্টে তার দাখিল করা হলফনামায় এই সাংবিধানিক প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছে (অশ্বিনী কুমার উপাধ্যায় বনাম ভারতের ইউনিয়ন মামলা)।

ECI দ্বারা জমা দেওয়া হলফনামা থেকে উদ্ধৃতি। “নির্বাচনের আগে বা পরে বিনামূল্যে কিছু দেওয়ার যে কোনও প্রতিশ্রুতি/বণ্টন সংশ্লিষ্ট দলের নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং সেই প্রতিশ্রুত নীতিগুলি আর্থিকভাবে কার্যকর কিনা বা সেগুলি রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে কিনা সে প্রশ্ন রাজ্যের ভোটারদের বিবেচনা ও সিদ্ধান্তের বিষয়৷ বিজয়ী দল সরকার গঠন করে রাজ্যে কোন নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তা ভারতের নির্বাচন কমিশন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আইনে সেরকম কোনও প্রবিধান ছাড়াই তা করলে সেটা হবে ক্ষমতার ঊর্ধ্বে গিয়ে কাজ করা।”

এই ধরনের কোনো ক্ষমতা না থাকার কথা স্বীকার করা সত্ত্বেও ECI দ্বারা নির্ধারিত প্রফর্মাটি সেই ক্ষমতার সীমা অতিক্রমের কাজটাই করছে। এটা লাগু হলে রাজনৈতিক দলগুলিকে তাদের নিজস্ব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য বিশদ পরিকল্পনা প্রদান করতে হবে, সুবিধাপ্রাপকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এবং প্রতিশ্রুত রূপায়নে প্রয়োজনীয় আর্থিক সঙ্গতির উৎস ও পদ্ধতি বিশদে নির্ধারণ করতে হবে। এরকম প্রফর্মা চালু হলে তা ক্ষমতাসীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী ইশতেহারের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার অযাচিত ক্ষমতা দেবে যা বাস্তবে নির্বাচনকেই নিয়ন্ত্রিত করার নামান্তর।

আসুন আগে আমরা একটা বিষয় স্পষ্ট করে নিই যে, দেশের দুর্দশাগ্রস্ত জনতাকে তাৎক্ষণিক ত্রাণ দেওয়ার এবং জনসংখ্যার বঞ্চিত ও প্রান্তিক অংশগুলির অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাকে উন্নত করার প্রয়োজনীয় কল্যাণমূলক পদক্ষেপগুলিকে ‘দান-খয়রাতি’ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা প্রত্যাখ্যান করব। ‘দান-খয়রাতি’ বলে যদি কিছুকে চিহ্নিত করতে হয় তাহলে প্রকৃতপক্ষে বড় বড় কর্পোরেট ও অতি ধনীদের দেওয়া কর ছাড় ও কর ছুটি, সস্তা ঋণ, ঋণের ছাড়পত্র বা ঋণ মকুব, সরকারি সম্পত্তি বেচে এবং বিভিন্ন উপায়ে প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তরের মাধ্যমে প্রভূত সুবিধা লোটা ইত্যাদিকে চিহ্নিত করতে হবে।

এই ধরনের ‘দান-খয়রাতি’ সরকারী কোষাগারের উপর এক বিশাল বোঝা। এই প্রক্রিয়ায় প্রতি বছর সরকারি কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। ২০২০-২১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেটদের আয়কর, আবগারি ও শুল্ক মকুব করে দিয়ে অতি ধনীদের ৫,৫১,০০০ কোটি টাকা লুট দিয়েছে। তার আগের বছর লুটের পরিমাণ ছিল ৫,০০,৮২৩ কোটি টাকা। আর ২০০৫-০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত হিসেব করলে সে লুট মোট ৪২ ট্রিলিয়ন টাকারও বেশি।

আমাদের সংবিধান ভারতের জনগণের কাছে সমতা ও সার্বিক সুবিচারের এক মহান অঙ্গীকার করেছে। মৌলিক অধিকার ছাড়াও, আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার প্রতি নির্দেশমূলক নীতিমালার একটি বিভাগ রয়েছে যা প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারের নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করার কথা। তা না করে প্রস্তাবিত সংশোধনী এবং নির্ধারিত প্রফর্মাটি নির্বাচনী ইশতেহারকে চলতি বাজেট বরাদ্দের অধীনস্থ করতে চায় যে বাজেট জনগণকে সর্বজনীন খাদ্য নিরাপত্তা, আশ্রয়ের অধিকার বা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা বা কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিতে নিদারুণ ব্যর্থ। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর আমরা বৈশ্বিক ক্ষুধাসূচকে ১২২টি দেশের মধ্যে ভারতকে ১০৭তম স্থানে দেখতে পাচ্ছি।

সমগ্র নীতি-নির্ধারণ ও বাজেট অনুশীলনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত অগ্রাধিকারগুলিকে পুনর্বিন্যস্ত করা ও প্রয়োজনীয় সংস্থানগুলিকে একত্রিত করা এবং আমাদের জনগণের মৌলিক অধিকার ও তাদের সর্বোত্তম কল্যাণ নিশ্চিত করতে সেগুলিকে যথাযথ উপায়ে ব্যবহার করা। জনগণ রাজনৈতিক দলগুলিকে তাদের ট্র্যাক রেকর্ডের ভিত্তিতে বিচার করবে, বিশেষত ভোট দিয়ে যাদের ক্ষমতায় আনা হয়েছে তাদের কাছে জবাবদিহি চাইবে। রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী ইশতেহারের খসড়া তৈরির স্বাধীনতার উপর আমলাতান্ত্রিক যথাস্থিতিবাদী যাচাই-বাছাই সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রগতিকে এবং জনগণের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের উপায় এই নির্বাচনী গণতন্ত্রকে এবং প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির গতিশীলতা ও ভূমিকাকে বাধাগ্রস্ত করবে।

তাই আমরা প্রস্তাবিত সংশোধনীটিকে পত্রপাঠ সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করছি এবং সাংবিধানিক এখতিয়ার উল্লঙ্ঘন করে, ECI’এর নিজস্ব বিবৃতিকে লঙ্ঘন করে এই রকম অযৌক্তিক একটি প্রবিধান ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার অতিরেক সম্পন্ন একটি ধারণা চালু করা থেকে বিরত থাকতে ECI’কে অনুরোধ করছি।

খণ্ড-29
সংখ্যা-41