প্রতিবেদন
গর্ভপাত আইনে নতুন সংযোজনঃ সুরক্ষার সম্প্রসারণ
Extension of Protection

২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ দিনটি ভারতের নারীদের কাছে অবশ্যই একটি খুশির দিন। আদালত আর হাসপাতালের মধ্যে ছুটোছুটি করার থেকে মুক্তি পেয়েছে তারা। ২৫ বছরের অবিবাহিতা গর্ভবতী মেয়েটির লড়াইকে মান্যতা দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। তিন বিচারপতির বেঞ্চ, এর অন্যতম ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় তাদের যুগান্তকারী রায় প্রসঙ্গে বলেন, “গর্ভপাত আইন সবার জন্য। সে মহিলা বিবাহিত হোক কী অবিবাহিতই হোক।” এ আইন একক নারীদের জন্যও, বলে ঘোষিত হল। ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’কেও গর্ভপাত আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হল। আর এভাবেই প্রজন্ম বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার বৃহত্তর অধিকারের পথে আরও একটি মাইলফলক নির্মিত হল মনুবাদী পথে অগ্রসরমান ভারতবর্ষের মাটিতে। এটা হঠাৎ কোনো বিষয় নয়। দীর্ঘদিন ধরে ভারতে যে প্রগতিশীল চিন্তার ও আন্দোলনের ধারাবাহিক প্রবাহ চলেছে এ তারও এক অর্জন। এই দিনটিকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তথা হু ‘আন্তর্জাতিক নিরাপদ গর্ভপাত দিবস’ রূপে উদযাপন করছে। আর তা করতে গিয়ে হু বলছে, “গর্ভপাত একটি স্বাস্থ্যসেবা আর স্বাস্থ্য হল একটি মানবিক অধিকার”। এই মানবিক অধিকার পেলো সমগ্র ভারতীয় নারীসমাজের কিছু খণ্ডিত অংশ। বাকি পথ কিন্তু এখনও অনেক দূর।

গর্ভপাতের আইনি স্বীকৃতিতে ভারত কিন্তু যথেষ্ট পিছিয়েই ছিল। তিউনিসিয়া একটি মুসলিম রাষ্ট্র। কিন্তু ১৯৫৬ সালে ফরাসিদের হাত থেকে স্বাধীন হবার পরই নতুন শাসক নারী ও পুরুষের সমানাধিকার ঘোষণা করে। সেই সাল থেকেই গর্ভপাতের অধিকার অর্জন করে সে দেশের নারীরা। আর ভারতে তা বৈধতা পায় ১৯৭১ সালে, স্বাধীনতার ২৪ বছর পর। তাও কিছু শর্ত সাপেক্ষে। তারপর এই সংযোজন করতে সময় লেগে গেলো আরও ৫০টা বছর। ভারতের গর্ভপাত আইনটির নাম ‘মেডিক্যাল টার্মিনেশন অফ প্রেগন্যান্সি’। এখানে ৫টি বিষয় সুনির্দিষ্ট করা আছে।

(১) কার গর্ভপাত করা হবে।
(২) গর্ভপাতের কারণ।
(৩) গর্ভস্থ ভ্রূণের বয়স।
(৪) কে বা কারা এই অস্ত্রপচার করতে পারবেন।
(৫) কোথায় অস্ত্রপচার হবে।

এর সাথে বিশেষ কিছু ব্যতিক্রমের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এখনও আইনটি পূর্ণতা পায়নি বলে অনেকেই মনে করছেন।

বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় সঠিকভাবেই বলেছেন, “আইন কোনো অনড় বিষয় নয়। সমাজের মানসিকতা পরিবর্তনের সাথে তা পরিবর্তিত হয়।” বর্তমানে ভারতীয় সমাজব্যবস্থা কিছুটা হলেও তার সংরক্ষণশীলতাকে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। যৌন জীবনযাপনের ছাড়পত্র যোগাড় করতে বিবাহের বাধ্যবাধকতাকেও অনেকে অস্বীকার করছে। নিজের শরীরের উপর সবার আগে অধিকার শুধু নারীর — এটাও ক্রমশ স্বচ্ছ হয়ে উঠছে। এখন গর্ভধারণের নিয়ন্তা হবে কেবল মাত্র নারী, পুরুষ নয়। সেই অর্থে স্বামীও নয়। পরিবারের অন্য কেউ তো নয়ই। বর্তমানে বহু মহিলারাই একক জীবন বেছে নিচ্ছে। তবে তাদের অনেকেরই পুরুষ বন্ধু থাকতে পারে। অনেকে লিভ-ইন করেন। আর এসব ছাড়াও যৌন জীবনে অনেক ছেলেমেয়েই বিয়ের আগেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। এসবের সংখ্যা তত বেশি নয়। যত বেশি ভাবনাচিন্তা না করে আবেগের বসে বা কখনও নেশার ঘোরে অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে যাওয়া। স্বামী-স্ত্রীর বিছানাতেও স্ত্রীর নিজস্ব পরিসরের স্বীকৃতি মিলেছে। যার উল্লঙ্ঘনের অর্থ ‘ধর্ষণ’। আর ভারতীয় সমাজে ধর্ষণ মহামারীর কোনো কার্যকরী প্রতিষেধক আজও তৈরি করা যায়নি। এই সমস্ত ক্ষেত্রেই ঘটে যেতে পারে অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ।

গর্ভপাতের প্রধান কারণ এই অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ। জাতিপুঞ্জ বলছে এই অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের শিকার মূলত ১৯ বছরের কম অবিবাহিত কিশোরীরা। এরা আবার বেশিরভাগই দরিদ্র, সংখ্যালঘু ও বিপন্ন জনগোষ্ঠী পরিবারের। অনেক সময় পড়াশুনো বা কাজের জন্য বা দারিদ্র্যের কারণে কোনো আত্মীয়র বাড়িতে, হোস্টেলে বা বাবুদের বাড়িতে থাকে। যেখানে সুরক্ষা হতে পারে নিম্নমানের। পরিবারে অশান্তির কারণেও সন্তানরা বাবামায়ের দেখভাল থেকে উপেক্ষিত হয়ে অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ভারতে একক নারীর সংখ্যাও কম নয়। ২১ শতাংশ বা ৭০ মিলিয়ন। এরমধ্যে রয়েছে অবিবাহিত, বিবাহ-বিচ্ছিন্না, পৃথক থাকা ও বিধবা মহিলারা। স্বেচ্ছায় অবিবাহিত নারী সমাজের ১ শতাংশ। এদের বেশিরভাগকেই যৌন সন্ত্রাসের নানান রূপের সাথে মোকাবিলা করতে হয়। কখনো হেরেও যায়। ফলশ্রুতিতে অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ।

২০১৫-তে ভারতে ১.৫৬ কোটি মহিলার গর্ভপাত করা হয়েছে। এর ৭৮ শতাংশ অর্থাৎ ১.২৩ কোটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আওতায়ই আসেনি, জানাচ্ছে ল্যানসেট পত্রিকা। এর সমর্থন পাওয়া যায় জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সার্ভে থেকে। এখানে বলা হচ্ছে গর্ভপাত হয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে ২১ শতাংশ, বাড়িতে ২৬.২ শতাংশ আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে (বৈধ স্থান কিনা স্পষ্ট নয়) ৫২.৮ শতাংশ। এই সার্ভে থেকে জানা যাচ্ছে যে গর্ভপাতের ৫৩ শতাংশ স্বীকৃত ডাক্তার দ্বারা করা হয়। বাকি সব সহায়ক নার্স, মিডওয়াইফ বা দাইদের দ্বারা সম্পন্ন হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর তার ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে জানাচ্ছে মোট গর্ভপাতের ৫৬ শতাংশই অসুরক্ষিত। আসলে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হলে গর্ভপাত কমেনা বরং বাড়ে অসুরক্ষিত অস্বাস্থ্যকর বিপজ্জনক গর্ভপাত। ভারতে এই বিপজ্জনক গর্ভপাত থেকে মৃত্যুর হার মোট মাতৃত্বকালীন মৃত্যুর ৪৭ শতাংশ। তাহলে এই মেয়েরা সংবিধানের ২১ ধারা যেখানে ‘জীবন’এর অধিকার ঘোষিত আছে তা থেকে বঞ্চিত হল না? আইনকে আরও মুক্ত হতে হবে।

এই সংযোজন ভারতীয় গর্ভপাত আইনটিকে এখনও সম্পূর্ণ করতে পারেনি। এলজিবিটিকিউ ও নাবালিকারা এখনও এই অধিকারের বাইরে আছে।

অবিবাহিতা বা একক নারীকে গর্ভপাত আইনের শর্ত মানতে হবে। কেনো? এই মুহূর্তে পৃথিবীর ৭৩টি দেশ যখন শর্তহীনভাবে গর্ভপাতের অধিকার ভোগ করছে। সেই দেশগুলির কয়েকটি তো ঘরের পাশেই। যেমন নেপাল, চীন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, উজবেকিস্তান, তাজাকিস্তান, ভিয়েতনাম ইত্যাদি। তারা এই নতুন সংযোজনকে পুরুষতান্ত্রিক ও ক্ষতিগ্রস্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা হয়েছে বলে মনে করছেন। গর্ভস্থ সন্তানের বয়স ২৪ সপ্তাহের বেশি হয়ে গেলে মেডিকেল বোর্ডের মতামত ও অস্ত্রপচারে ২ জন ডাক্তারের উপস্থিতি — এই বাধ্যকতাই বা কেনো? কারণ ভারতে ডাক্তারের অভাব আছে। ভারতের ৬৬ শতাংশ মানুষ যখন গ্রামে বাস করে তখন সেখানে ৭০ শতাংশ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের অভাব। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে মেডিকেল বোর্ডে থাকতে হবে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, রেডিওলজিস্ট ও সোনোলজিস্টকেও। এত ডাক্তার কোথায় ভারতে? তাছাড়া অস্বাভাবিক শিশুর ক্ষেত্রে বয়সের কোনো সীমা টানা যায় না। তবুও সেক্ষেত্রে মেডিকেল বোর্ড বসাতে হবে কেনো? একটি স্বাভাবিক শিশু জন্মের পূর্ব মুহূর্তেও গর্ভের ভিতরে মারা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে মেডিকেল বোর্ড ছাড়াই অস্ত্রপচার করা হয়। এক্লামশিয়া এমন একটি গর্ভজনিত অসুখ যেখানে শিশুকে মা’র শরীর থেকে বের না করলে মায়ের মৃত্যুর সমুহ সম্ভাবনা। সেখানেও বোর্ড ছাড়াই এমনকি জুনিয়র ডাক্তারাই শিশুর প্রসব করাচ্ছে। বাকি রইল আর্থ-সামাজিক বিষয়। ধরা যাক একটি মেয়ে গর্ভবতী হল। তার আরও দু’টো ভাই বোন আছে। মা সবজি বিক্রি করে, বাবা অটো চালায়। এখন যদি তার গর্ভপাত না করে সন্তান হয়, বাচ্চাটিকে সে কীভাবে মানুষ করবে? কেউ কি মেয়েটিকে ভালোবাসবে? বিয়ে করবে? ভাইবোনদের ভবিষ্যৎ কী হবে?

শিশুটির ভবিষ্যৎই বা কী হবে? বাকি জীবনটা তো নরক হয়ে যাবে মেয়েটির। তার থেকে ভালো নয় কি গর্ভপাত করা? এরজন্য বোর্ডের খুব কি প্রয়োজন? কিন্তু একটা ব্যাপার অবশ্যই ভাববার। সেটা হল নিরাপদ গর্ভপাত। বিশেষ ক্ষেত্র যেমন নাবালিকা বা মহিলার কোনো জটিল অসুখে বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হবে।

নিরাপদ গর্ভপাতের লক্ষ্যে হু এই ২০২২ সালে তার নির্দেশিকার যে আপডেট প্রকাশ করেছে তারও লক্ষ্য আইনি চিকিৎসা ও পুলিশি বিষয়গুলো যতদূর পারা যায় সরল করে অতি দ্রুত গর্ভপাত করা। অনেক দেশ তো আইন উঠিয়েই দিয়েছে। হু আরও বলেছে, এক্ষেত্রে শুধু চিকিৎসাগতভাবে নিরাপদ হলেই হবে না, যে মেয়েরা গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার প্রতি যথেষ্ট সম্মান দেখানো, কোনো রকম অপবাদ না দেওয়া ও প্রয়োজনীয় গর্ভপাতের পিল, তথ্য ইত্যাদি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। সব মিলিয়ে এক বিস্তারিত প্যাকেজ ব্যবস্থার সুপারিশ করেছে হু। যারমধ্যে পড়বে যৌনতা বিষয়ে শিক্ষা, জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী সরবরাহ, গর্ভপাত করার জটিলতামুক্ত নীতি ও নিরাপদ গর্ভপাত পরিষেবার বিস্তার।

অনেকে বলতে পারেন এরফলে গর্ভপাতে তথা যৌনকর্মে উৎসাহিত করা হচ্ছে। হু’এর পর্যবেক্ষণকেই দেখা যাক। হু বলছে যে, যেসব দেশে গর্ভপাতের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেখানে ১০টির মধ্যে মাত্র একটিই নিরাপদ গর্ভপাত হয়েছে। আর যেখানে কোনো আইনি বাধা নেই সেখানে ১০টির মধ্যে ৯টিই নিরাপদে হয়েছে। এটা গর্ভপাতকে প্রশ্রয় দেওয়া নয়, সুরক্ষার অধিকারকে প্রসারিত করা। আর যারা এখনও গর্ভপাতের অধিকারকে খর্ব করার পক্ষে, তারা মার্কিন মুলুকে একবার উঁকি দিয়ে দেখতে পারেন।

- অশনি সাংকৃত্যায়ন

খণ্ড-29
সংখ্যা-39