ধর্মীয় উগ্রতার পূর্ণগ্রাসে ভারত — উদাসীন বিশ্ব
India in the grip of religious fanaticism

( দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’এর ১৭ অক্টোবর ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত বর্তমান নিবন্ধে লেখকের এক বিশেষ উদ্বেগ ধরা পড়েছে ফ্যাসিস্ট মোদী সরকার-অনুমোদিত মুসলিম পীড়ন নিয়ে বিশ্বের প্রভাবশালী মহলের নীরবতায়। বিষয়টি আমাদের কাছে চর্চাযোগ্য মনে হওয়ায় পাঠকদের কাছে তার অনুবাদ তুলে ধরা হল। শিরোনাম আমাদের — সম্পাদকমণ্ডলী )

গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্ট একটা মামলা গ্রহণ করেছিল যেটা একটা বড় রাজনৈতিক বিতর্ক হয়ে উঠল: হিজাব! গত ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণের রাজ্য কর্ণাটক ক্লাসরুমে মেয়েদের হিজাব পরে ঢোকা নিষিদ্ধ করেছিল — স্বভাবতই এতে মুসলিমরা রুষ্ট এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা উল্লসিত হয়েছিল। শেষোক্তরা (হিন্দুত্ববাদীরা) রাজ্যের এই পদক্ষেপকে, ভারতে তাদের ধারাবাহিক মুসলিম-বিরোধী প্রচার অভিযানের আরেকটি সাফল্য হিসেবেই দেখেছিল।

শেষ পর্যন্ত আদালতের সিদ্ধান্ত দেখিয়ে দিল, ঠিক কীভাবে ভারতের ধর্মীয় দৃশ্যপটের মেরুকরণ ঘটে গেল। প্যানেলের এক বিচারপতি ঘোষণা করলেন মাথায় কাপড় দেওয়াটা ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার; আরেকজন মূলত সমস্যাটি খারিজ করলেন এই বলে যে হিজাব ইসলামে ‘অত্যাবশ্যক’ নয়।

কিন্তু ভারতীয় মুসলিমরা, যেন সমস্যাটা আদপে নেই এমনটা মানবেন কী করে! ভারতে মুসলিম মেয়েরা লড়ছে — ঠিক যেভাবে ইরানে তাদের সহযোদ্ধারা — তাদের নিজেদের শর্তে নিজেদের পছন্দমতো পোশাক পরার এবং বাঁচার মৌলিক অধিকারের জন্য।

এই ধরনের লাঞ্ছনা, নিগ্রহ যে অবিরাম ঘটেই চলেছে, তা আর অস্বীকার করা যাচ্ছে না, যদিও আন্তর্জাতিক মহলে কিছু মানুষ ব্যাপারটা উপেক্ষা করেই চলেছেন। ভারতের রাস্তায় আজ হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা তরোয়াল আস্ফালন করে চলেছে, মসজিদের বাইরে প্ররোচনামূলক শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে মুসলিমদের উপর দলবদ্ধ আক্রমণের ভিডিও শেয়ার এখন নেহাত মামুলি ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলিম ছাত্রছাত্রী এবং আন্দোলনকারীরা দেখেছেন, যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই প্রশাসন কর্তৃপক্ষ কীভাবে তাদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে — স্রেফ অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার প্রতিশোধ হিসেবে। সংবাদ সংস্থার স্ক্রোল থেকে সম্প্রতি জানা যাচ্ছে, বহু মুসলিম ‘ক্রমবর্ধমান সংখ্যাগুরুবাদের’ জন্য ভারত ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

ঠিক এই মাসেই, ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর নিশানা করে আক্রমণের একের পর এক ঘটনা ঘটেছে।

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে, বিদার শহরে এক উচ্ছৃঙ্খল জনতা অভব্যের মতো জোর করে এক ঐতিহ্যবাহী মসজিদে ঢুকে হিন্দুদের কোনও অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে থাকে। এরপর একটি উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ভিডিও ভাইরাল হয় যেখানে দেখা যাচ্ছে ল্যাম্পপোস্টে কয়েকজন মুসলিম পুরুষকে বেঁধে রাখা হয়েছে; তারা নাকি একটি হিন্দু উৎসবে অনধিকার প্রবেশ করে বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল। সাদা পোশাকে পুলিশই নাকি যখন ওদের মারধর করছিল, উল্লসিত জনতা জাতীয়তাবাদী শ্লোগান দিতে দিতে নাচানাচি করছিল। গত মাসে একই রকম আরেকটি ঘটনায় একদল মানুষ অতি দক্ষিণপন্থী বজরঙ দলের সঙ্গে একজোট হয়ে মুসলিম ছেলেদের প্রচণ্ড মারধর করে কারণ তারা নাকি হিন্দুদের নবরাত্রি উৎসবে যোগ দিয়ে হিন্দু মেয়েদের ফুঁসলানোর চেষ্টা করছিল।

উগ্রবাদীরা অবশ্যই নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করছে, আর কেন করছে সেটা অনুমান করা মোটেই কঠিন নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার ক্ষমতার তুঙ্গে রয়েছেন। স্বাধীন মিডিয়ার বিরুদ্ধে তার খড়্গহস্ত হয়ে ওঠা এবং ভারতের সমস্ত প্রতিষ্ঠানে তার ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)র ক্রমবর্ধমান আধিপত্য এই আমূল পরিবর্তনের উগ্র প্রক্রিয়াকে প্রত্যাঘাত হানার সামাজিক ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলছে।

তার পার্টি সদস্যরা ইতিমধ্যে এই আগুনে ইন্ধন যুগিয়ে চলেছেন। বিজেপি’র এক বর্তমান সাংসদ প্রজ্ঞা ঠাকুর সম্প্রতি বলে ফেললেন — মুসলিমদের হিন্দু উৎসবে ঢুকতে দেওয়া উচিত নয়! শ্রীমতী ঠাকুর এক মসজিদের কাছে বোমা বিস্ফোরণের এক ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বিচারাধীন, যে ঘটনায় ছ’জনের মৃত্যু হয়েছিল। আট বছর জেলে কাটিয়ে জামিন পেয়ে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। আরেকজন বিজেপি বিধায়ক সম্প্রতি মুসলিমদের ব্যবসাকে ‘সম্পূর্ণ বয়কটের’ ডাক দিয়েছিলেন, সোল্লাসে জনতা প্রবল করতালি দিয়ে তাকে সমর্থন করেছিল।

যেসব ভারতীয়ের সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অনুগামী আছে তাদের অন্যতম, মোদী। কিন্তু তিনি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করতে বা তাদের বিরুদ্ধে হিংসা বন্ধ করার জন্য কোন আহ্বান জানাননি। অথবা তার সাংসদ-বিধায়কদের কখনও সেইসব ভাষণের জন্য প্রকাশ্যে কড়া নিন্দা করেননি যেগুলো ভারতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে আরও ইন্ধন যোগাচ্ছে।

আর একই সময়ে, বহির্বিশ্বের ভারতীয় মুসলিম বা অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়ানোর কোনও ইচ্ছা আছে বলেও মনে হচ্ছে না। বিশ্ব নেতারা আপাতভাবে চীন ও রাশিয়াকে মোকাবিলার উদ্দেশ্যে ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারটিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। তারা বুঝতে পারছেন না যে তাদের এই ‘স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সুবিধাজনক অজ্ঞতা’ ভারতে ২,২০০ লক্ষ ভারতীয় মুসলমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র-অনুমোদিত হিংসাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক হিংসা যা নাকি ভারতে সৃষ্ট, তার হাত যে কত লম্বা তার জ্বলন্ত উদাহরণ সম্প্রতি ব্রিটেন তুলে ধরেছে। গত মাসে লিসেস্টার শহরে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসা প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ে। একটি বিবিসি-অনুসন্ধানে ধরা পড়ে যে ভুল খবর থেকে এই হিংসা জ্বলে উঠেছিল, সেই ফুলকিটা কিন্তু সৃষ্টি হয়েছিল ভারতে সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট থেকে! এই বিচ্যুতিগুলো মার্কিন মুলুকে বর্তমান : আগস্টে নিউ জার্সিতে ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময়ে অত্যন্ত বিতর্কিতভাবে একটি নির্মাণ সরঞ্জামকে দেখানো হচ্ছিল যা ভারতে মুসলিমদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া বুলডোজারের সদৃশ।

ভারতে বেড়ে ওঠা ঘৃণা ও বিভাজন তার সীমান্তেই যে থেমে থাকবে না সেটাই মনে করিয়ে দেওয়ার বার্তা এটা। এই মাসে প্রকাশিত হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’এর এক বিবৃতিতে ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। মোদী সরকার তবুও মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সমস্ত সমালোচনাকে সরকারের দুর্নাম করার অপচেষ্টা বলে কঠিন বিদ্রূপ করেছে।

ভারতে ক্রমবর্ধমান অন্যায়ের মুখে দাঁড়িয়ে বিশ্বের এই নীরবতা আমাকে প্রাচীন ঈজিপ্টের এক প্রবাদ মনে পড়িয়ে দিল, “হে ফারাও, কে তোমাকে এমন অত্যাচারী শাসক করে তুলল?” সে উত্তর দিল “কেউ আমাকে থামায়নি”।

ভারতের এই ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক উগ্রতাকে বিশ্ব ক্রমাগত উপেক্ষা করে চলেছে।    

- রাণা আইয়ুব
(অনুবাদক : জয়ন্তী দাশগুপ্ত)

খণ্ড-29
সংখ্যা-41