সম্পাদকীয়
“জয় করো এই তামসীরে”
this Tamsir

বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত তিনটে রিপোর্ট রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। সেই রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে শহরাঞ্চলের তুলনায় ভারতের গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র লাফ দিয়ে বেড়েছে চারগুণ, যেখানে দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ বসবাস করেন। আর এই রিপোর্টগুলো আবার দেখিয়ে দিল, স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে যে অমৃতকালের গন্তব্যে মোদীর ভারত এগিয়ে চলেছে তার প্রকৃত স্বরূপ কী? রিপোর্টগুলো থেকে প্রমাণিত, বহু ঢাক পেটানো দারিদ্র দূরীকরণের কর্মসূচি শুধু মন্থরই হয়নি, বরং তা অতিমারীর সময়কালে আরও সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে।

বিশ্ব ক্ষুধা সূচক দেখাল, ১২১টি দেশের মধ্যে ভারত এ’বছর ছ’ধাপ নীচে নেমে ১০৭এ এসে দাঁড়িয়েছে। আর, ২৯.১ ক্ষুধা সূচকের স্কোর নিয়ে ভারত গুরুতর খাদ্য সংকটের দেশগুলোর সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে নিল। ভারতের বেশ কয়েক ধাপ নীচে নেমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণই হল ভারতের শিশু ‘ওয়েস্টিং’ হার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি, ১৯.৩ শতাংশ, যার অর্থ, আমাদের দেশে শিশুদের ওজন তাদের উচ্চতার তুলনায় সবচেয়ে কম! শিশুদের অপুষ্ঠি বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের এক অন্যতম প্রধান মানদণ্ড। আর, মোট চারটের মধ্যে তিনটিই হল শিশুদের অপুষ্ঠি সংক্রান্ত বিষয়ক। ক্ষুধা সূচকের এই হার প্রমাণ করে পুষ্টিকর খাদ্য ক্রয় করার সামর্থ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নেই। সুষম আহারের জন্য যে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করা দরকার তা, বিপুল সংখ্যক মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুল্যতে এই অপুষ্ঠি জনিত সমস্যা আরও গুরুতর। ওই রাজ্যগুলো এমনকি ডিম খাওয়ার উপরও নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করায় মিড-ডে-মিলে বহু স্কুলে ডিম বন্ধ হয়ে যায়, ফলে গরিব শিশুরা পুষ্টিকর খাদ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই সমস্যার সাথে যুক্ত হল গ্রামীণ দারিদ্র, যা শহরাঞ্চলের তুলনায় চারগুণ বেশি!

আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাঙ্ক — ‘পভার্টি অ্যান্ড শেয়ার্ড প্রসপারিটি’। এই রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, অতিমারী ও ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে নতুন করে ৭ কোটি মানুষকে ঠেলে নামিয়েছে চূড়ান্ত দারিদ্রসীমার নীচে। আর, তীব্র আর্থিক সংকোচনের দরুণ ভারত সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। যদিও রিপোর্ট জানিয়েছে, ২০২০’র দারিদ্র সংক্রান্ত সম্পূর্ণ তথ্য এখনও চূড়ান্ত হয়নি, তবে প্রাথমিক তথ্য দেখায় দেশব্যাপী ৫.৬ কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্রের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। এটাই প্রমাণ করে, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প ও বহু বিজ্ঞাপিত নিখরচায় খাদ্য সরবরাহের সরকারি দাবি আখেরে অতিমারীর সময় সাধারণ মানুষের বিরাট দুর্দশাকে বিন্দুমাত্র লাঘব করতে পারেনি।

দেশের গ্রামাঞ্চলে যখন এতো গভীর আর্থিক দুর্দশা, তখন নিদেন পক্ষে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে গ্রামীণ মানুষদের কাজ দিয়ে এই সংকট মোচনে কিছুটা উপশম ঘটানো যেত। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য থেকেই দেখা যাচ্ছে, চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ছ’মাসে (এপ্রিল-অক্টোবর ২০২২) প্রায় ১.৫ কোটি কর্মপ্রত্যাশী কাজের আবেদন জানানো সত্ত্বেও কাজ পাননি। বলা ভালো, তাঁদের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এমনকি ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২, এই দু’বছরে অতিমারীর প্রবল ঢেউ’এর মধ্যেও এবং কাজের বিরাট চাহিদা থাকা সত্ত্বেও কাজ প্রত্যাখ্যানের হার ছিল অস্বাভাবিক হারে বেশি। ২০২০-২১-এ প্রথম লকডাউনের ফলে সমস্ত কাজকর্ম যখন থমকে দাঁড়ায়, দু’পয়সা আয় করার জন্য সকলেই যখন হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছিলেন, তখন ১৩.৩ কোটি মানুষ ১০০ দিনের কাজের জন্য নাম তোলেন। কিন্তু দেখা গেল, ১১.২ কোটি কর্মপ্রত্যাশীকে কাজ দিয়ে ২.১ কোটি মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়া হল। ২০২১-২২’র দ্বিতীয় অতিমারীর মারাত্মক পর্বেও ১.৭৩ কোটি মানুষকে কাজ না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

এদিকে, ইউএনডিপি এবং অক্সফোর্ড পভার্টি অ্যান্ড হিউমান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ’এর তৈরি করা ‘গ্লোবাল মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইন্ডেক্স ২০২২’ দুটো পর্যায়ে দারিদ্র হ্রাসের একটা তুলনামূলক পার্থক্য টেনেছে। এই দু’টো পর্ব হল — ২০০৫-০৬ এবং ২০১৫-১৬। প্রথম পর্বে দারিদ্র হ্রাস পাওয়ার হার দ্বিতীয় পর্বের তুলনায় অনেকটাই বেশি। তাই, দ্বিতীয় পর্বে, যা মোদী জমানাকে সূচিত করে, দারিদ্র কমার হার মন্থর হতে হতে ২২.৮ কোটি দরিদ্র জনসংখ্যায় এসে দাঁড়ায়, যা গোটা বিশ্বে সর্বাধিক! নির্মম বিরোধাভাস এটাই, গত কয়েক বছর রেকর্ড ফলন হওয়া সত্ত্বেও শহরের তুলনায় ভারতের গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র প্রায় চারগুণ বেশি।

কর্পোরেট স্বার্থে দেশের গোটা কৃষি-ব্যবস্থাকে পরিচালিত করতে গিয়ে দেশের সুবিপুল জনসংখ্যার সর্বনাশ ডেকে আনল মোদী সরকার। সমগ্র কৃষি ক্ষেত্রকে ডোবাল নিকশ কালো আঁধারে। প্রায় বছরব্যাপী ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন মোদী সরকারকে কিছুটা পেছনে ঠেলতে সক্ষম হয়।

এই গভীর তমসাকে ছিন্ন ভিন্ন করার লক্ষ্যেই আজ এগিয়ে আসতে হবে।

খণ্ড-29
সংখ্যা-41