ভারতীয় ব্যাঙ্কক্ষেত্রের সংকটগ্ৰস্ততার পিছনে অন্যতম বড় কারণ হয়ে রয়েছে ব্যাড লোন বা অপরিশোধিত ঋণ। একটু ঘুরিয়ে বা অন্য ভাষায় একেই বলা হয় ‘নন পারফর্মিং অ্যাসেট’ (এনপিএ) বা বাংলায় ‘অনুৎপাদক সম্পদ’। ব্যাঙ্কের আর্থিক স্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে তোলা এই অপরিশোধিত ঋণ বা অনুৎপাদক সম্পদের ব্যাপকতর অংশেরই ভাগীদার হল বড়-বড় কর্পোরেট সংস্থা। চাষীদের ও ছোটো-মাঝারি ব্যাবসায়ী সংস্থার নেওয়া ঋণও কখনও কখনও অপরিশোধিত থেকে যায়। তবে, সমগ্ৰ অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণে তার ভাগ সামান্যই এবং ব্যাঙ্কের কাছে তা উদ্বেগের কারণ হয় না। কিন্তু কালক্রমে — কর্পোরেট আধিপত্যের নয়া-উদারবাদী যুগে এবং বিশেষভাবে স্যাঙাতি পুঁজিবাদের মোদী জমানায় — ব্যাঙ্কসমূহের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ যেমন বিপুলতর আকার নেয়, অপরিশোধিত ঋণের বহরও ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে। আর এটাও এখানে উল্লেখ্য যে, কর্পোরেট সংস্থাগুলো যে সমস্ত ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধে কোনো আগ্ৰহ দেখায় না (সব সময় অক্ষমতা থেকে নয়, অনেক ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সুপরিকল্পিতভাবে), তার ব্যাপক সংখ্যাধিকই রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্ক, এবং ঋণ অপরিশোধের আঁচ বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর গায়ে তেমন লাগে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলোতে অপরিশোধিত ঋণের আখ্যানের অবতারণা এইজন্যই যে, মোদী জমানায় এর ধারাবাহিকতায় কোনো ছেদ নেই, এবং সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের চতুর্থ বৃহত্তম ব্যাঙ্ক কানাড়া ব্যাঙ্কের খাতা থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ মুছে দেওয়ার বৃত্তান্ত সামনে এসেছে। এবং মোদী জমানায় কর্পোরেট সংস্থাগুলো ঋণ পরিশোধে কতটা অনীহা হয়ে উঠেছে, এই উন্মোচন তাকেও নির্দেশিত করছে।
সজাগ নাগরিক মঞ্চ নামে সংস্থার প্রেসিডেন্ট বিবেক ভেলাঙ্কার তথ্যের অধিকার আইনের অধীনে কানাড়া ব্যাঙ্কের কাছ থেকে জানতে চান — গত এক দশকে বড়-বড় কর্পোরেট সংস্থার নেওয়া কত ঋণ ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে। এর উত্তরে ব্যাঙ্ক তাঁকে জানায়, ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ বর্ষ পর্যন্ত কানাড়া ব্যাঙ্ক তাদের খাতা থেকে মুছেছে ১,২৯,০৮৮ কোটি টাকার ঋণ। কী বিপুল পরিমাণ এই অঙ্ক, এবং এই এক দশকের তিন বছর বাদে বাকি সাত বছরই মোদী জমানার! কিন্তু কারা সেই কর্পোরেট সংস্থা যাদের প্রত্যেকে কানাড়া ব্যাঙ্ক থেকে ১০০ কোটি টাকারও বেশি ঋণ নিয়ে শোধ করেনি, যাদের নাম বিবেক ভেলাঙ্কার জানতে চেয়েছিলেন? অতিকায় এই অঙ্কের ঋণকে অপরিশোধিত রেখে ব্যাঙ্ককে তাদের খাতা থেকে মুছতে বাধ্য করাটা ব্যাঙ্ক অর্থের নির্ভেজাল লুট ছাড়া আর কিছু নয় এবং এটাও যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক যে ব্যাঙ্কও ঐ কর্পোরেটদের নাম প্রকাশে অনাগ্ৰহী। তথ্য প্রদানের সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক অফিসার জানিয়েছেন, তথ্যের অধিকার আইনের ৮(১)(জে) ধারা ব্যক্তিগত পরিসরের তথ্যের প্রকাশকে মঞ্জুর করেনা। অর্থাৎ, বড় আকারের ঋণ-খেলাপি কর্পোরেটদের নাম প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু এটা কি প্রকৃতই আইনের বাধা, নাকি, আইনকে ছুতো করে ঋণ পরিশোধে অনিচ্ছুক কর্পোরেটদের নাম প্রকাশে ব্যাঙ্ক কতৃপক্ষের অনীহা। বিবেক ভেলাঙ্কার প্রশ্ন তুলেছেন, “কোনো সাধারণ ঋণ গ্ৰহীতা ঋণ-খেলাপি হলে ঐ ব্যাঙ্কই খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তার নাম এবং অন্যান্য তথ্য বিশদে প্রকাশ করে। ওরা তাহলে ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ না করার ধারাকে ছুতো করে বড় ঋণ-খেলাপিদের নাম আড়াল করতে চাইছে কেন? সাধারণ ঋণ গ্ৰহীতাদের ক্ষেত্রে ‘ব্যক্তিগত তথ্য আড়াল’এর ধারা প্রযুক্ত হয় না কেন?” ব্যাঙ্ক অর্থের কর্পোরেট লুটেরাদের পরিচয় দেশ জানতে চায় এবং ঋণ পরিশোধ না করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানার অধিকারও দেশের জনগণের রয়েছে। এই কর্পোরেট ঋণ গ্ৰহীতাদের অধিকাংশই শাসক দল ঘনিষ্ঠ (বিজয় মাল্য, ললিত মোদী, নীরব মোদী, মেহুল চোকসিদের কথা ভারতের জনগণের এত তারাতারি বিস্মৃত হওয়ার কোনো কারণ নেই) এবং এই অনুমানও অমূলক নয় যে, ব্যাঙ্ক ঋণের মাধ্যমে লুট করা টাকার একটা অংশ ইলেক্টোরাল বণ্ডের মাধ্যমে শাসক দলের তহবিলে পৌঁছে যায়। এই কর্পোরেট লুটেরাদের নাম প্রকাশ তাই অতি সঙ্গত এক দাবি।
অর্থনীতিতে ব্যাঙ্ক ঋণের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং অগ্ৰাধিকারের বিবেচনায় সেই ঋণের বণ্টন হলে তা অর্থনীতির বৃদ্ধি ও বিস্তারের সঙ্গে কর্মসংস্থানেরও উন্নতি ঘটাতে পারে। কিন্তু যে ক্ষেত্রে কাজের সংস্থান বেশি হয়, সেই কৃষি এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের ক্ষুদ্র-মাঝারি উৎপাদক ও ব্যবসায়ী সংস্থাগুলোর কাছে ব্যাঙ্ক ঋণ পৌঁছোয় সামান্যই। ব্যাঙ্ক ঋণের সিংহভাগই কব্জা করে কর্পোরেট সংস্থাগুলো যাদের অনেকেরই ঋণকে উৎপাদনের কাজে লাগানোর চেয়ে লুটের মাল করে তোলাতেই আগ্ৰহ থাকে বেশি। নরেন্দ্র মোদী জমানায় স্যাঙাতি পুঁজিবাদের সুবিধায় ঋণ পরিশোধের পুনর্বিন্যাস নামক একটা ব্যবস্থাও সক্রিয় হয় — যাতে ঋণ পরিশোধের সময়কালকেই শুধু বিলম্বিত করা হয়না, পরিশোধযোগ্য সুদের পরিমাণকেও হ্রাস করা হয়। এছাড়া, শাসক ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতিদের ঋণ-খেলাপি হয়ে থাকাটাও যে এই জমানায় প্রভূত প্রশ্রয় পায় তার অবিসংবাদিতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। ফলে, ব্যাঙ্ক সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে, আর এই সংকটকেই আবার ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের অজুহাত করে তুলছেন নরেন্দ্র মোদী-নির্মলা সীতারামনরা। এইভাবে, ব্যাঙ্কের সংকট তৈরির জন্য যারা দায়ী, সেই কর্পোরেটদের হাতেই ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার নকশা ছকা হচ্ছে।
পরিসংখ্যানের বিচারে এনপিএ বা অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ এখন আগের তুলনায় কিছুটা ভালো — ২০২২’র মার্চে এনপিএ’র পরিমাণ ছিল ৫.৯৭ লক্ষ কোটি টাকা (২০১৯ এবং ২০২১’র মার্চে যা ছিল যথাক্রমে ৭.৪০ ও ৬.১৭ লক্ষ কোটি টাকা) এবং এনপিএ নেমে এসেছে মোট প্রদত্ত ঋণের ৬ শতাংশের নীচে। এটা কি ঋণ পরিশোধের প্রতি কর্পোরেটদের অধিকতর দায়িত্বশীল হওয়ার পরিচয়কে দেখায়? বিষয়টা তা কিন্তু নয়। ব্যাঙ্কের খাতায় ঋণের ছবি আজ যদি কিছুটা সন্তোষজনক দেখায় তবে তার পিছনে ব্যাঙ্কের খাতা থেকে ঋণ মুছে দেওয়ারও একটা ভূমিকা রয়েছে। ঋণ মুছে দিয়ে ঋণের পরিমাণকে খাতায় কম করে তোলাটাই ঋণের আয়তনে তুলনামূলক উৎকৃষ্টতা এনেছে। দীনেশ উন্নিকৃষ্ণণ মানি কন্ট্রোল ডট কম ওয়েবসাইটে তোলা এক নিবন্ধে বলেছেন, “এখন পর্যন্ত এনপিএ’র পরিসংখ্যানে যে উন্নতি দেখা যাচ্ছে তাতে সহায়ক হয়েছে বড় আকারের ঋণ মুছে দেওয়া, ঋণের প্রকৃত পুনরুদ্ধার নয়।” ব্যাঙ্কগুলো ২০১০ থেকে ২০২০’র মধ্যে ৮,৮৩,১৬৮ কোটি টাকার ঋণ তাদের খাতা থেকে মুছেছে, যার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলোর ভাগ ছিল ৬,৬৭,৩৪৮ কোটি টাকা বা মুছে দেওয়া ঋণের ৭৬ শতাংশ। নরেন্দ্র মোদীর পরিভাষায় এটাকে কি ‘রেউড়ি সংস্কৃতি’ বলা যাবে না? মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলোর রিক্ত হয়ে ওঠার বিনিময়ে কর্পোরেটদের অর্থপুষ্টির এই আখ্যান ‘খয়রাতি’র আখ্যায় অভিহিত হতে পারবে না? নয়া-উদারবাদী জমানার শুরু থেকে গোটা রাষ্ট্রটাকেই যে কর্পোরেট লুটের বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে, সেই ধারাকে পাল্টানোটা আজ আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব অর্জন করেছে।
– জয়দীপ মিত্র