বাংলাদেশ বললেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির হয়ত মনে পড়ে শামসুর রহমান, আল মাহমুদ কিংবা নির্মলেন্দু গুণের কবিতা, হয়ত মনে পড়ে চিত্র পরিচালক তারিক মাসুদ কিংবা মরশেদুল ইসলামের নাম, মনে পড়তে পারে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বেলাল চৌধুরী কিংবা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারদের চট্টগ্রামের কথা। এসবতো আছেই, কিন্তু এই প্রথমবার বাংলাদেশে গিয়ে মন জুড়িয়ে দিল সেখানকার মানুষজনেরা, তাদের মেহেমানি, আন্তরিকতা আর উষ্ণ ব্যবহার। দেশের কথাতো শেষ পর্যন্ত সেই দেশের মানুষদেরই কথা। এপার বাংলায় বসে শুনতে থাকা উড়ে আসা কথা পেড়িয়ে গিয়ে দেখলাম ভাষা, সংস্কৃতির অভিন্নতা, এক অদৃশ্য নৈকট্য যা কখনও কখনও দৃশ্যের তৃপ্তি দেয়।
সীমান্তবর্তী বাগেরহাট হয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের বাংলাদেশ ভ্রমণ। নিবেদিতা আমার এক সহকর্মীর ভাইঝি, দশম শ্রেণীর ছাত্রী, বাগেরহাট জেলার সাবোখালী গ্রামে বাস। বাংলাদেশে গিয়ে প্রথমে ওদের বাড়িতেই উঠেছিলাম, বাস থেকে নেমে ইজি বাইকে (আমাদের এখানকার টোটো) চেপে দুপাশে অসংখ্য পুকুর, বিল আর তার পাড়ের গোলপাতা গাছের ছায়া মাড়িয়ে যখন ওদের বাড়ি পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যে নামছে। ইজি বাইক থেকে নামতেই আমার বয়স্ক জামাইবাবুর হাতটা চেপে ধরল, যেন কত দিনের পরিচিত, “ব্যাগগুলান আমারে দাও” বলে দিদির হাত ধরে পিছল উঠোন পার হয়ে নিয়ে গেলো ঘরে। পরের দিন ভোরে যখন ওর সাথে গ্রাম ঘুরতে বেরিয়েছি, পথে যার সাথেই দেখা হয় আমাকে দেখিয়ে বলে, “ইন্ডিয়া থেকে আমার জ্যাঠা আইসে”। কে বলবে চব্বিশ ঘন্টা আগেও ও আমায় চিনতো না!
গোটা গ্রামের মানুষ দেখা করতে এসেছিল আমাদের সাথে, এদেশ আর ওদেশের কথা চলছিল, তৃপ্তি বৌদি সবার জন্য নিয়ে আসছিল চিতৈপিঠে। ঢাকার আলম ভাইয়ের আতিথেয়তাও একই রকম। আলম ভাই ঢাকা নিবাসী, আমার এক সহকর্মীর মাসতুতো ভাই। যাওয়ার দু’দিন আগে ফোনে আলাপ করেছিলাম, আমাদের ঢাকা এবং কক্সবাজারের থাকার হোটেল, ঘোরার জন্য গাড়ি সমস্ত কিছুই ঠিক করে রেখেছিলেন উনি। ব্যবসায়ী মানুষ, ব্যস্ততার মধ্যেও দিনে বহুবার ফোন করে আমাদের সুবিধে অসুবিধের খোঁজ নিতেন। একদিন রাতে এসে নিয়ে গেলেন নৈশ আহারে, আমরা চারজনই স্বল্পাহারী কিন্তু আলমভাই সেসব শুনবে কেন, সে এটা সেটা দিয়ে যাবার জন্য বলতেই থাকে। বলা হয়নি, আমরা চারজন মানে আমি, আমার স্ত্রী, দিদি এবং জামাইবাবু শ্যামলদা। শ্যামলদা দেশভাগের পর বাহান্ন সালে ভারতে চলে যায়, বাবা ছিলেন ও দেশের একটি স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক, সেই স্কুলেই শ্যামলদার ক্লাস ফোর অবধি পড়াশুনা। সেই স্কুল খোঁজার গল্পটিও চমকপ্রদ। গ্রামের নাম আর কিছু আবছা স্মৃতি সম্বল করে বেরিয়েছিলাম সেই জায়গার খোঁজে। যে গাড়িতে গেছি তার ড্রাইভার জুয়েলেরও যেন বাড়িটি খুঁজে পাওয়া খুব দরকার, একে তাকে জিজ্ঞেস করে চলেছে। অবশেষে যিনি মুশকিল আসান হিসেবে হাজির হলেন, একটা ওষুধের দোকানের মালিক সেই বিনয়বাবু এবং ভীড় করে আসা গ্রামের মানুষদের সহায়তায় খুঁজে পাওয়া গেলো ভিটে এবং স্কুলটিও। পুকুরের এক পাড়ে নাকি ছিল হিন্দুদের ঘর, অপর পাড়ে মুসলিমদের। সত্তর বছর পর দুই পাড়ের যাদের মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি করা হয়েছিল সেই মানুষগুলোই আর নেই, তৎকালীন ভিন্ন পাড়ের দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ মানুষগুলো খুঁজে দেয় ছেড়ে যাওয়া ভিটের সন্ধান। স্কুলে পৌঁছোলে বর্তমান প্রধান শিক্ষক হাত ধরে নিয়ে গেলেন তাঁর ঘরে, বহুক্ষণ ধরে আলাপচারিতা চললো, ইতিমধ্যে বিনয়বাবু ফোন করে স্ত্রীকে রাঁধতে বলে দিয়েছিলেন, লাউয়ের তরকারি, মাছের ঝোল দিয়ে ওনার বাড়িতেই মধ্যাহ্নভোজ সারা হল। বাহান্ন সালে যিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন তারই ছেলে ছিল ’৬৯ সালের গণআন্দোলনের তিন শদীদের অন্যতম শহীদ আসাদ। সাদিক রহমান জানান, তিনি ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) পার্টির প্রার্থীসভ্য, মৃত্যুর পরে তাকে মরণোত্তর সদস্যপদ দেওয়া হয়। যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে শুয়ে আছে আসাদ, সেই মাটিতে সেই স্বপ্ন আজওতো কেউ বুনে চলে!
খুব মনে পড়ছে কক্সবাজারের সেই বাচ্চা তিনটে ছেলেমেয়ের কথা, ওরা ঝিনুকের তৈরি জিনিস বিক্রি করছিল, ওদের একজন আমার বৌকে সুন্দর একটা ঝিনুকের হার দিয়ে বললো, “আপু এটা তোমার জন্য, এটার জন্য কোনো পয়সা দিতে হবে না!” মনে পড়ছে ঢাকায় আমাদের সফরসঙ্গী নাসিমের কথা, রামকৃষ্ণ মিশন থেকে প্রসাদ কিনে এনে গাড়ি চালাতে চালাতে প্লাস্টিক ছিড়ে তা আমাদের খাওয়ায়, নিজেও খায়। নাসিমের গাড়ির ব্লুটুথের সাথে ইউটিউবের সংযোগ ঘটিয়ে ওর ফরমায়েশিতে এপার আর ওপার বাংলার শিল্পীদের গলায় গান শুনতে শুনতে আমরা দোয়েল চত্বর, পুরান পল্টন, শাহবাগ, রমনায় ঘুরেছি, শুনেছি শাহ আব্দুল করিমের নিজের গলায় গাওয়া “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম” গানটি! আলমগীর ভাইয়ের কথাও বলি, চট্টগ্রামের এক ইজি বাইক চালক, এক মুখ দাড়ি, গোঁফ কামানো, সূর্য সেনের কথা জিজ্ঞেস করায়, বললো “জানি না”। তারপর যখন অস্ত্রাগার দখলের গল্প করলাম, বললো, “লেখাপড়া তো করিনি, অনেক কিছুই জানি না”, বললাম আজকের দিনেই প্রীতিলতা শহিদের মৃত্যুবরণ করেছিল, সব শুনে সে নিয়ে চললো ইউরোপিয়ান ক্লাবে, প্রীতিলতার আবক্ষ মূর্তির সামনে আমাদের সবার ছবি তুলে দিল, নিয়ে গেল ডাঃ খাস্তগীর সরকারি গার্লস স্কুলে, এই স্কুলেই প্রীতিলতা এবং কল্পনা দত্ত সহপাঠী ছিল। প্রধান শিক্ষিকা শ্রীমতি শাহাদা আখতার স্কুলের এক কর্মচারীকে আমাদের স্কুলটি ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য বলে দিলেন, পরে এক তরুণ শিক্ষক যোগ দিলেন আমাদের সাথে। একটি দেওয়ালে দেখি কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও মৈত্রেয়ী দেবীকে নিয়ে এক ছাত্রীর আঁকা ও লেখা টানানো।
দেশভাগ অনেক কিছুই ছিনিয়ে নিয়েছে, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ও পরে কমিউনিস্ট আন্দোলনে এমএল গ্ৰুপে যোগ দেওয়া আমার মামা চিকিৎসার কারণে এদেশে আসায় তবু আগে দেখা হয়েছিল কিন্তু এই পঞ্চান্ন বছরে এসে প্রথম দেখা পেলাম আমার মামাতো দিদির, প্রথম দেখা হলো আমার দুই বৌদি ও ভাইপোদের সাথে। বুঝেছি দেশভাগ অনেক কিছু কেড়ে নিতেও পারেনি। আলমগীর ভাই হৃদরোগের চিকিৎসা করাতে চেন্নাই যেতে চান, নাসিমের খুব ইচ্ছে দিল্লী, আগ্রা আর আজমীর শরিফে যাওয়ার, দুই সম্প্রদায়ের বহু আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই উপমহাদেশে। নাসিম আর আলমগীর ভাইকে আমার ফোন নম্বর দিয়ে এসেছি, এপারে এলে যোগাযোগ করার জন্য।
ঢাকার কুট্টিদের রসিকতা তো আমরা শুনেছি কিন্তু কুষ্টিয়ার কুলফি বিক্রেতাই বা কম যায় কিসে, শিলাইদহ কুঠিবাড়ি দেখে যখন বের হচ্ছি, লাইন দিয়ে বসে থাকা কুলফি বিক্রেতাদের একজন বললেন, “খেয়ে যান, নইলে রবি ঠাকুরকে কি জবাব দেবো, উনিতো রাগ করবেন!”
ভুল হয়ে গেছে বিলকুল, অনেক কিছু ভাগ হয়ে গেলেও শুধু নজরুলই নন, ভাগ করা যায়নি অনেককেই। অনেক স্কুলের দেওয়ালে তাই আরও অনেকের সাথে রবীন্দ্র-নজরুল-মধু কবি আর সুকান্তের ছবি। নজরুলের সমাধির পাশে সমাধি দেখতে আসা মাস কমিউনিকেশনের তিন স্টুডেন্ট সামসুর, কানিজ ফাতেমা বৃষ্টি আর মিমি রেকর্ড করে নেয় শ্যামলদার কথা, ওদের অনুরোধে ঋতা গায় রবীন্দ্র সংগীত। শহিদ মিনারেও দুই বন্ধু অনীক আর ওহিদুলের সাথে আমরা একসাথে গেয়েছি “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি”!
টিএসএ চত্বরে এসে মনে হয়, আরে এতো আমাদের কলেজ স্ট্রিট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরও মনে হয় চেনা চেনা। দেওয়ালে কোনো এক ছাত্র সংগঠনের দেওয়াল লেখা — বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, তার পাশেই লেখা শাঁখের সুর আজানে যাচ্ছে মিশে, ধর্মান্ধ তোমার লালসা মিটবে কিসে। লালন সাঁইয়ের দেশে সংগীতের রাগের নামে মজনু ভাই তার ছেলের নাম ইমন রাখাতে আশ্চর্য হইনি, অবাক হই না যখন সে ছেলে বলে, “এখানে আমরা মিলেমিশে থাকি, আমরা রুখে দেবো যারা আমাদের ভাঙতে চায়!”
চিত্রা, আড়িয়াল খাঁ, মধুমতির বয়ে চলা, আকাশে দোয়েল আর শঙ্খচিল, রিকশাচালক, চায়ের দোকানের আড্ডা, বোরখা পড়া কিংবা না পড়া মেয়ের দল, শ্যামল সবুজ ধানক্ষেতে দুই বাংলাকে আলাদা করারতো আর জো থাকে না।
ফেরার পথে বেনাপোল সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে যখন লাইনে দাঁড়িয়ে, তখন দু’দিকে সীমান্ত রক্ষীদের কুচকাওয়াজ চলছে, আর তারমধ্যেই চলছে দু’দিকে যাতায়াতের জনস্রোত। মনে মনে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা বলে উঠি — “আমরা যেন বাংলাদেশের চোখের দুটি তারা/মাঝখানে নাক উঁচিয়ে আছে, থাকুক গে পাহারা/দুয়োরে খিল, টান দিয়ে তাই খুলে দিলাম জানলা/ওপারে যে বাংলাদেশ, এপারেও সেই বাংলা।”
- ভিয়েত