প্রতিবেদন
ঋণের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আদানির ব্যবসা সাম্রাজ্য
Adani's business empire

নরেন্দ্র মোদীর সবচেয়ে কাছের পুঁজিপতি গৌতম আদানির সম্পদ বৃদ্ধি ও বিশ্বের ধনীদের তালিকায় সর্বোচ্চদের সঙ্গে তার প্রতিযোগিতা এখন এক বড় খবর। গত ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি স্বল্প সময়ের জন্য দ্বিতীয় ধনীতম ব্যক্তির মর্যাদা অর্জন করেন, পরে সম্পদের কিছু সংকোচন ঘটায় ধনী তালিকায় তাঁর স্থান দু’ধাপ নেমে আসে এবং সেপ্টেম্বরের শেষে তার সম্পদের পরিমাণ ১২৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ানোয় বিশ্বের ধনী তালিকায় তার স্থান এখন চতুর্থ। তার আগে রয়েছেন মার্কিন পুঁজিপতি ইলেক্ট্রিক গাড়ি টেলসার নির্মাতা কোম্পানির সিইও এলন মাস্ক (সম্পদের পরিমাণ ২৪০ বিলিয়ন ডলার), আর এক মার্কিন উদ্যোগপতি ও বৈদ্যুতিন বাণিজ্য সংস্থা অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বোজেস (সম্পদের পরিমাণ ১৩৮ বিলিয়ন ডলার) এবং ফরাসি ধনকুবের বার্নার্ড আরনল্ট (সম্পদের পরিমাণ ১২৯ বিলিয়ন ডলার)। এই সমস্ত গোষ্ঠীর মালিকানাধীন গোষ্ঠীগুলোর শেয়ার মূল্যের ওঠা-নামার জন্য সম্পদের পরিমাণে এবং ফলত ধনী তালিকায় স্থানের পরিবর্তন ঘটে। তবে, সম্পদ বৃদ্ধির দিক থেকে গৌতম আদানির উত্থান আক্ষরিক অর্থেই চোখ ধাঁধানো এবং এত অল্প সময়ে সম্পদের ঐ পরিমাণ বৃদ্ধি অন্য কোনো পুঁজিপতির ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা যায়নি। আর, গৌতম আদানির সম্পদ বৃদ্ধি ও বিশ্বের ধনী তালিকায় তাঁর স্থান নিয়ে মিডিয়ায় যতটা চর্চা হয়, সম্পদের ঐ বিপুল বৃদ্ধি যে চলতি ব্যবসার ভিত্তিকে কেন্দ্র করে সম্পন্ন হয়নি, তার প্রায় সবটাই যে ঋণ চালিত, সেই আলোচনায় মিডিয়ার তেমন আগ্ৰহ দেখা যায় না।

পড়তে-পড়তে কলেজ ছেড়ে দেওয়া গৌতম আদানি তাঁর ব্যবসা শুরু করেন ১৯৮৮ সালে, পণ্য কেনা-বেচার এক সংস্থা হিসাবে। নরেন্দ্র মোদী ২০০১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তাঁর ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে, গুজরাটের প্রশাসনিক শীর্ষে মোদীর অধিষ্ঠানের সঙ্গে আদানির বাণিজ্য বৃদ্ধির ধারাও অব্যাহত হয়। আর মোদী ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বাণিজ্য ক্ষেত্রে আদানির উত্থান ও সম্পদের বৃদ্ধি আক্ষরিক অর্থেই অভাবনীয় ধারায় ঘটতে থাকে। বিশ্বের বিলিয়োনেয়ার তালিকায় গৌতম আদানির স্থান প্রথমবারের মতো ঘটে ২০০৮ সালে, তখন তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯.৩ বিলিয়ন ডলার। তারপর ১৪ বছরে তাঁর সম্পদের বৃদ্ধি ঘটেছে প্রায় ১৪ গুণ। কোভিড শুরুর আগে ২০২০’র জানুয়ারিতে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার (এক বিলিয়ন হল ১০০ কোটি, আর ১ ডলার ভারতীয় মুদ্রায় এখন মোটামুটি ৮২ টাকা), কোভিড কালেও তাঁর সম্পদ বৃদ্ধিতে কোনো ছেদ পড়েনি। হ্যাঁ, কোভিড কালেও! বিশ্বব্যাঙ্কের অতি সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, করোনা কালে ৬.৫ কোটি ভারতীয় দারিদ্র সীমার নীচে তলিয়ে গেছেন। অর্থাৎ, কোভিড জীবিকার উৎসে বিপর্যয় ঘটানোয় দেশের জনগণের একটা অংশ যখন অবর্ণনীয় দুরবস্থায় পড়েছেন, তখনও আদানির সম্পদ বৃদ্ধি অপ্রতিহত ধারায় এগিয়ে গেছে। ২০২১ সালে তাঁর সম্পদের বৃদ্ধি ঘটে ৪৯ বিলিয়ন ডলার (সপ্তাহে প্রায় ৬,০০০ কোটি টাকা), আর এবছর, অর্থাৎ, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে তাঁর সম্পদের বৃদ্ধি ঘটে একেবারে হতবাক করে দেওয়ার মতো ৬০.৯ বিলিয়ন ডলার। সম্পদের পরিমাণের দিক থেকে তিনি এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মুকেশ আম্বানিকে টপকে যান, এপ্রিলে ঢোকেন বিশ্বের শতকোটি বিলিয়োনেয়ার তালিকায় আর এখনতো বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের মধ্যে চতুর্থ। এই বৃদ্ধি অভাবনীয় এবং বিশ্বের অন্য কোনো উদ্যোগপতির ক্ষেত্রে তা ঘটতে দেখা যায়নি।

আদানির সম্পদের এই বৃদ্ধির পিছনে কারণ মূলত দুটো — তাঁর গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যের বৃদ্ধি এবং নানান ব্যবসার অধিগ্ৰহণ ও নতুন-নতুন ক্ষেত্রে সম্প্রসারণ। কোনো কোনো শেয়ার মূল্যের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি ঘটেছে ১০০০ শতাংশের বেশি, যথা আদানি গ্ৰীন ও আদানি টোটাল গ্যাস; আবার ১৪০০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি ঘটেছে আদানি এন্টারপ্রাইজেসের ক্ষেত্রে। বিশেষজ্ঞরা কিন্তু মনে করছেন, কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক ফলাফলের সঙ্গে শেয়ার মূল্যের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির তেমন সম্পর্ক নেই। আদানি পরিবারের হাতেই কোম্পানিগুলোর তিন-চতুর্থাংশ শেয়ার রয়েছে। এছাড়া, এমন কিছু বিদেশি সংস্থা থেকে বিনিয়োগ এসেছে যেগুলোর স্বচ্ছতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। মরিশাসের পোর্ট লুইসে একই ঠিকানায় অবস্থিত দেখানো কয়েকটি সংস্থাকে আদানির কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করতে দেখা গেছে এবং ঐ সংস্থাগুলোর কোনো ওয়েবসাইটও নেই। এই বিনিয়োগগুলো যথেষ্ট সন্দেহজনক বলেই প্রতিপন্ন হয়েছে। পরিবারের হাতে শেয়ারের কেন্দ্রীভবনের ওপর ভিত্তি করে এবং অস্বচ্ছ ও সন্দেহজনক বিনিয়োগের মাধ্যমে সুকৌশলে শেয়ার মূল্যকে চড়ানোর সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। তবে, ২০২১ ও ২০২২ সালে বৃদ্ধির অন্যতম মূল কারণ হল নতুন-নতুন সংস্থার অধিগ্ৰহণ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্প্রসারণ। আদানি সাম্প্রতিক সময়ে যে সমস্ত ক্ষেত্রে তাঁর ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন তা হল — কয়লা, সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, সিমেন্ট, অ্যালুমিনিয়াম পরিশোধন, পেট্রোকেমিক্যালস, গ্যাস, ডাটা সেন্টার, সৌরবিদ্যুৎ, হাইওয়ে, প্রভৃতি। সম্প্রতি তাঁর অধিগৃহীত সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে অম্বুজা সিমেন্ট ও এসিসি, ছত্তিশগড়ের তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প ডিবি পাওয়ার, পশ্চিমবাংলায় তাজপুর সমুদ্রবন্দর তিনি নির্মাণ করবেন বলেও জানা গেছে, মিডিয়া ক্ষেত্রে এনডি টিভির অধিগ্ৰহণও তিনি সম্পন্ন করেছেন। বিদেশেও কিছু সংস্থা অধিগ্ৰহণেতিনি ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন, যারমধ্যে ইজরায়েলের হাইফা বন্দরও রয়েছে।

ব্যবসা থেকে অর্জিত লাভের বিনিয়োগের মাধ্যমে আদানির এই বৃদ্ধি ঘটেনি, বৃদ্ধির এই ফুলে-ফেঁপে ওঠার পিছনে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলোর হাত উজাড় করা ঋণ। আদানি এক-একটা সংস্থা অধিগ্ৰহণ করেছেন, আর প্রধানমন্ত্রীর অতি ঘনিষ্ঠ উদ্যোগপতির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠা হাজার-হাজার কোটি টাকার ঋণ মুক্ত হস্তে দিতে একটুও দ্বিধা করেনি সরকারি ব্যাঙ্কগুলো। গত পাঁচ বছরে আদানির ঋণের পরিমাণ ১ ট্রিলিয়ন টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২.২ ট্রিলিয়ন টাকা (১ ট্রিলিয়ন = ১ লক্ষ কোটি)। অর্থাৎ, আদানি গোষ্ঠির ঋণের পরিমাণ এখন ২ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। সম্প্রতি কিছু সংস্থা অধিগ্ৰহণ ও প্রকল্প নির্মাণের জন্য আদানির নেওয়া ঋণ হল এই রকম।

গঙ্গা হাইওয়ে প্রকল্পের জন্য ১০,২৩৮ কোটি টাকা (মীরাট থেকে প্রয়াগরাজ পর্যন্ত বিস্তৃত এক্সপ্রেসওয়ে); তামা পরিশোধন ব্যবসার জন্য ৬,০৭১ কোটি টাকা; নভি মুম্বইয়ে বিমানবন্দর তৈরির জন্য ১২,৭৭০ কোটি টাকা; অম্বুজা সিমেন্ট অধিগ্ৰহণের জন্য ৪১,০০০ কোটি টাকা; ছত্তিশগড়ে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ৮৭৯ মিলিয়ন ডলার, যা ভারতীয় মুদ্রায় ৭,০০০ কোটি টাকারও বেশি। এছাড়া, অন্যান্য প্রকল্পের জন্য আরও ঋণ রয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জে আদানির যে সাতটা সংস্থা নথিবদ্ধ রয়েছে তারমধ্যে ছটির ঋণের পরিমাণ এই রকম।

Adani's business

সূত্র: হাও আদানি ক্রিয়েটেড এন এম্পায়ার অন এ পাইল অব ডেট, ৫ পয়সে ডট কম

আদানিদের ব্যালান্স শিট জানাচ্ছে, ২০২২’র মার্চে তাদের ব্যাঙ্ক ও ক্যাশ ব্যালান্স ছিল মাত্র ২৬,৯৮৯ কোটি টাকা। এসত্ত্বেও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলো হাত উজাড় করে তাকে ঋণ দিয়েছে, তার প্রাপ্ত ঋণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলোর অবদান ৯৫ শতাংশ, যারমধ্যে এসবিআই’এর অংশ আবার হল ৩০ শতাংশ। এক বছরে নীট ঋণের যে প্রায় ৫৪,০০০ কোটি টাকা বা ৪২ শতাংশের বৃদ্ধি, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলো তাদের ঋণহস্তকে লাগামহীন করা ছাড়া সেটা সম্ভব ছিল না।

গৌতম আদানি ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হওয়ার সঙ্গে এইভাবে হয়ে উঠেছেন সবচেয়ে ঋণী ব্যক্তি, এবং তার মতো ঋণের দায় থাকা উদ্যোগপতি বিশ্বে খুঁজে পাওয়াও ভার। আগ্ৰাসী ধারায় নিজের ব্যবসা সাম্রাজ্য গড়তে গিয়ে যে ঋণভার আদানি নিজের কাঁধে চাপালেন, তাকে সামলানো কি তার পক্ষে সম্ভব হবে? এক-আধ হাজার কোটি নয়, একেবারে দু’লক্ষ কোটি টাকার বেশি ঋণ পরিশোধ সামর্থ্যের সংকুলান কি তাঁর ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলো থেকে হতে পারবে? নাকি, এই বিশাল ঋণ তারজন্য এক ঋণফাঁদ তৈরি করবে যার থেকে বেরিয়ে আসাটা দুঃসাধ্য হবে? আদানির ঋণ পরিস্থিতি এই প্রশ্নগুলোকে সঙ্গতভাবেই তুলে আনছে। আদানির ব্যবসা সাম্রাজ্যের বিস্তার একদিকে যেমন তার হাতে দেশের সম্পদের বিপুল মাত্রায় কেন্দ্রীভবন ঘটিয়েছে ও ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে রাষ্ট্র ও মোদী সরকারের মদতপুষ্ট এই গোষ্ঠী হিন্দুত্ববাদ তথা ফ্যাসিবাদের সক্রিয় দোসরেও পরিণত হচ্ছে। গৌতম আদানির পর ভারতের দ্বিতীয় এবং বিশ্বের একাদশ ধনী ব্যক্তির নাম হল মুকেশ আম্বানি। এই স্যাঙাতি কর্পোরেট মডেল যখন মোদী সরকারের কাছে অর্থনীতির এক বড় অবলম্বন হয়ে উঠছে, দেশের অর্থনীতির চেহারা তখন একেবারেই বিবর্ণ — রিজার্ভব্যাঙ্ক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জিডিপি বৃদ্ধির পূর্বাভাসকে ক্রমান্বয়ে হ্রাস করে চলেছে, দারিদ্র-বেকারি-অপুষ্টি বাড়ছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসমূহের মূল্যস্ফীতি কোনো বাঁধ মানছে না, খাদ্য নিরাপত্তাকে শিকেয় তোলা হচ্ছে। সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক দুরবস্থা এতটাই সঙ্গিন যে আরএসএস’কেও দারিদ্র ও বেকারি নিয়ে কপট উদ্বেগ প্রকাশ করতে হচ্ছে। অতএব, দেশের অর্থনৈতিক অধোগতি এবং ফ্যাসিবাদের মোকাবিলায় আদানি-আম্বানি কর্পোরেট রাজের মূলোচ্ছেদ যে একান্ত আবশ্যক তার উল্লেখ বোধকরি নিষ্প্রোয়জন।

– জয়ন্ত মিত্র

খণ্ড-29
সংখ্যা-39