অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক নিতাই বসু তাঁর বই ‘অশীতিপর চোখে ফিরে দেখা কমিউনিস্ট জীবন’ বইতে একটা অসাধারণ ঘটনার উল্লেখ করেছেন। নিতাই বসু তখন বঙ্গবাসী কলেজে পড়ছেন। ভিয়েতনাম মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে নিতাই বসু সহ একদল ছাত্র ১৪৪ ধারা ভেঙে আটক হলেন। পরেরদিন দেখা গেল ছাত্রদের সমর্থনে আদালতে মামলা লড়ছেন বঙ্গবাসী কলেজেরই তৎকালীন কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ল্যাডলীমোহন মিত্র। আদালত রায় দিল ৫০ টাকা করে জরিমানা দিলে সবাই ছাড়া পাবে। কিন্তু ছাত্ররা অস্বীকার করলো; তারা কোনও ভুল করেনি, সুতরাং জরিমানা দেবে না; তারা জেলেই থাকবে। তৎকালীন বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যক্ষ প্রশান্ত বসু তখন মাথাপিছু ৫০ টাকা করে দিয়ে ছাত্রদের ছাড়িয়ে আনতে বললেন ল্যাডলীমোহনকে। ছাত্ররা যখন জানতে পারলো যে অধ্যক্ষ এই কাজ করেছেন, তারা একযোগে অধ্যক্ষকে বললো “আপনি আমাদের ছাড়ালেন কেন? আমরা তো দোষ করিনি, আমরা কেন টাকা দেবো?” সেদিন চমৎকার একটা উত্তর দিয়েছিলেন প্রশান্ত বসু — “তোমরা তো জরিমানা দাওনি। কলেজ টাকা দিয়েছে। কলেজে ছাত্ররা না এলে কলেজের তো কষ্ট হয়, তাই কলেজ তোমাদের ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে”। আজকে এসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার এই স্বাধিকারকে, তার এই মননকে লাটে তোলার পসার সাজিয়ে বসে আছে। ছাত্রছাত্রীরা না এলে কলেজের আর এখন দুঃখ হয় না। এখন দেশজুড়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ এখন ব্যস্ত শাসকদের তোয়াজ করতে। আর ছাত্রছাত্রীরা ক্রমাগত ব্রাত্য হচ্ছেন শিক্ষাঙ্গন থেকে।
সাম্প্রতিক কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাবলী আরও একবার তার প্রমাণ দিল। ছাত্রছাত্রীদের বর্তমানে যে অনলাইন পরীক্ষার দাবির আন্দোলন, সেই দাবি নিয়ে সমাজ কার্যত বিভক্ত। এই দাবি নিয়ে প্রভূত বিতর্কের অবকাশ আছে। কিন্তু সেই বিতর্কের সমাধান কি পুলিশ দিয়ে হবে! এটাই কি জেএনইউ থেকে বিশ্বভারতী হয়ে সিইউ দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে! কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসাবে আন্দোলন করতে গিয়ে একই অভিজ্ঞতা আছে, ছাত্রছাত্রীরা তাদের দাবিদাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের ভিতরে জানাতে পারবে না। মূল ফাটকের বাইরে তাদের থাকতে হয়; আর তৎপরবর্তীতে মঞ্চে অবতীর্ণ হন উর্দিধারিরা, বাকিটা সবাই জানেন। এই ট্র্যাডিশনকেই প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে দেশজুড়ে তামাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেই প্রশ্ন — বিশ্ববিদ্যালয় কার? ছাত্রছাত্রীদের ছাড়া কি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও অস্তিত্ব আছে? নাকি শাসক-কর্তৃপক্ষ আর তাঁবেদারদের রঙ্গমঞ্চ হয়ে উঠবে শিক্ষাঙ্গন! ‘আইডিয়া অব ইউনিভার্সিটি’ নিয়ে এই চর্চা আজ দেশজুড়ে।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফাটক ভিতর থেকে লোহার পাত দিয়ে অনির্দিষ্টকালীন বন্ধ করা হয়েছে। কার ইচ্ছায়, কার পরামর্শে তা আমাদের মতো নিন্দুকেরা জানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বুনিয়াদি অবধারণাকে নস্যাৎ করে এই ছক দেশজুড়েই চলছে। ছাত্রছাত্রী ব্যতিরেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান — এক কল্পনাতীত কাঁঠালের আমসত্ব ছাড়া কিছুই নয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমাগত হয়ে উঠছে জেলখানার প্রতিরূপ। পরিচয়পত্র দেখিয়ে তবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার অনুমতি মিলবে, এই ফরমান আদতে কি একটা নির্দিষ্ট অংশের সুবিধার্থেই বলবৎ করা হচ্ছে! ভাবুন তো মা-বাবা যদি তাঁদের জাতক-জাতিকার ওপর এহেন ফরমান আরোপ করে যে বাড়িতে ঢোকার সময় জন্ম পরিচয়পত্র দেখানো আবশ্যিক! সেটা কি বাঞ্ছনীয় হবে! বিশ্ববিদ্যালয়কে ধারণ করে থাকে যে ছাত্রছাত্রীরা তাদের ওপর প্রতিনিয়ত ফরমান আরোপ করা কি আদতে মগজে কার্ফু জারির প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করারই ছক নয়! আলোচনা-বিতর্ক-ঋজুতার পাঠের উন্মুক্ত তপোবন হবে বিশ্ববিদ্যালয়, এটাই তো কাম্য ছিলো। শুধুমাত্র পাঠ্যবই আর ঝুরি ঝুরি নাম্বারের ইঁদুর দৌড়ের আস্তাকুঁড় হবে না সেটা! যৌথতা আর মানুষ হওয়ার পাঠই হবে পাথেয়; অথচ শুধুই বিচ্ছিন্ন করো, একাকিত্বকে বিজ্ঞাপিত করো আর মোসাহেবির মুন্সিয়ানা দেখাও, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবধারণাকে চুরমার করার এই প্রকল্পকে আজকের দিনে খারিজ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রশান্ত বসু-ল্যাডলীমোহনদের ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করাটা আজ সময়ের দাবি। নাহলে আগামী প্রজন্মের কাছে চির অপরাধী হয়ে যাবো আমরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্রাধিকার ছাত্রছাত্রীদের, তাদের ঠিক ভুলের ইঁটের গাঁথনিতেই তৈরি প্রকাণ্ড ওই ভবনগুলো, তাদের জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নয় তাদের পুলিশের লাঠির মুখে ঠেলে দেওয়া! এই সহজ সত্যটা যত দ্রুত আমরা আয়ত্ব করতে পারবো, সমাজটা বেঁচে যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয় বহুত্বের ধারক-বাহক। অথচ আজ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছে একমুখী-এককেন্দ্রিক শাসক সংস্কৃতির ভারে ন্যুব্জ। এই ন্যুব্জতাই তার প্রসারতাকে করেছে খণ্ডিত, অবদমিত। আজ সে বহুমতকে সহ্য করতে রাজী নয়, ভিন্নমতে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছে। ক্ষমতার আস্ফালনের হাতিয়ার হয়ে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘদিন ছাত্রসংসদ নির্বাচন না করে একদলীয় একাধিপত্য ক্যাম্পাস গণতান্ত্রিকতার নির্যাসকে ধ্বংস করতে উন্মুখ। এই পরিবেশ আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। আদৌ বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে আর এদেশে! নাকি সবটাই হয়ে উঠবে শাসকের মগজধোলাই যন্ত্র! নয়া জাতীয় শিক্ষানীতিও এই লক্ষেই প্রকল্পিত হয়েছে। শাসক সংস্কৃতির বিপ্রতীপে তাই প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বুনিয়াদি অবধারণাকে তুলে ধরা। ‘দেবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবেনা ফিরে’ — জ্ঞানচর্চা ও চর্যার এই আদানপ্রদানের ভিত্তি দৃঢ় হোক। যৌথ অংশগ্রহণেই স্বার্থক হবে শিক্ষাঙ্গনের গণতান্ত্রিক পরিসর। বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠুক কবিগুরুর সেই অমোঘ আহ্বাণের বাস্তবায়ন —
“চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি”।
– নীলাশীষ বসু