স্পট লাইটের আলোয় থাকতে, প্রচার আর চর্চায় ভাসতে তিনি বড্ড পছন্দ করেন। জাঁকজমক আড়ম্বরও তার বিশেষ প্রিয় — কথায়, কাজে, সাজে! আর হবেই বা না কেন! আধুনিক ‘রাজা-রাজড়া’রা যে তার প্রাণসখা! এ হেন তিনি যে তার বাহাত্তরের জন্মদিনটিতেও একেবারে নিজস্ব ঢং-এ আত্মপ্রচারের ঢাকে কাঠি দেবেন-সে আর বিচিত্র কী! যা তিনি বরাবর করে থাকেন। যেমন, এই ‘দুর্ভাগা’ দেশে, তার আগে আর কেউ আসেনি যে দেশটাকে এক কদম এগিয়ে দেবে! তার পাদস্পর্শেই তো দেশের ‘অহল্যার শাপমুক্তি’ হল, ইত্যাদি ইত্যাদি। তো এবারের চমকটা একেবারে অন্যরকম। হিংস্র এবং ক্ষিপ্রতম ৮টি চিতা শাবককে (১৯৫২ সালে যে চিতাকে তৎকালীন সরকার ‘অবলুপ্ত’ ঘোষণা করেছিল) সাতটি দশক পরে ভারতের জঙ্গলে ফিরিয়ে দিলেন! সেই রাজকীয় অতিথিরা নামিবিয়ার জঙ্গল থেকে ‘অ্যাকশন অ্যাভিয়েশন’-এর বিশেষ বোয়িং ৭৪৭ চার্টার্ড জাম্বো জেটে চড়ে ৩০ ঘন্টার ধকল সয়ে ‘মঙ্গলমতো’ এসে পৌঁছানোর পর বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী তাদের মধ্যপ্রদেশের কুনো জাতীয় অরণ্যে ছেড়ে দিয়ে তার রাজকীয় জন্মদিন পালন করলেন!
ধন্দ লাগছে তার একটা কথায়। বলেছেন — বন্যপ্রাণী ও ব্যবসা এক খাতেই বইতে পারে। অর্থাৎ মূল লক্ষ্য পর্যটন ব্যবসা, বন্যপ্রাণীর সমৃদ্ধি ও জঙ্গলের ভারসাম্য নয়! ওটা নেহাত কথার কথা! সত্যিই তো, এই বিভ্রম কেন, যেখানে ভারতীয় অরণ্যকে বনবহির্ভূত ব্যবহারের নিরঙ্কুশ অধিকার কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য বন সংরক্ষণ বিধি-২০২২ আনা হয়েছে? শেষ পর্যন্ত চিতাশুদ্ধু বনটা প্রাণসখাদের হাতে তুলে দেবেন না তো? যাক সে কথা।
আসল কথা হল, তিনি ভুলে গেলেন যে, দেশবাসীর এখন দরকার ভাতের, রুটির, রুজির-চিতার নয়! কারণ তার সরকারের ‘জনগণকে শোষণ করে কর্পোরেট তোষণ’ নীতির সৌজন্যে মানুষ আজ কর্মহীন, অন্নহীন। আকাশ ছোঁওয়া মূল্যবৃদ্ধির চাপে জনজীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। গত ৪৫ বছরে বেকারত্বের সর্বোচ্চ হারে যুবসমাজ উদভ্রান্ত।
তিনি আমজনতাকে ঠিক চেনেন না, তাই তাদের প্রয়োজনটাও ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। যতই তিনি বলুন ‘আমি তোমাদেরই লোক’ — আসলে তিনি বিলাস-বৈভবের গজদন্তমিনারবাসী। অপরিচ্ছন্ন গরিব গুরবো মানুষগুলোর সংস্পর্শ তিনি এড়িয়েই চলেন। শুধু নির্বাচনী প্রচারের সময় তিনি একদা ‘চায়ে-ওয়ালা’! স্বভাব অভিনেতা তো! তিনি ‘উৎপেতে’ সাংবাদিকদেরও বিরক্তিভরে এড়িয়ে চলেন। তার অতি বড় শত্রুও এমন অপবাদ দেবে না যে তিনি কোন জাতীয় বিপর্যয়ে মুক্তকচ্ছ হয়ে দুর্গতদের পাশে ছুটে গেছেন কিংবা কোনদিন কোন সাংবাদিক বৈঠক ডেকেছেন, সরকারের খামতি স্বীকার করেছেন। সেই সময়টা তিনি ‘মৌনীবাবা’ হয়ে থাকেন। দেশে উচ্চবর্ণের হাতে দলিত, আদিবাসী নাবালিকা ধর্ষণ ও খুনে, দলিত বালক হত্যায় তিনি আশ্চর্য নীরব থাকেন। দুর্জনেরা অবশ্য বলে বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের সামনে তার এই বাকসংযম হারিয়ে তিনি নাকি বড় উচ্ছল হয়ে পড়েন! প্রোটোকল ভেঙেই। যাক সে কথা। আসলে দেশের মানুষ বলতে তিনি বোঝেন আদানি, আম্বানি, মেহুলভাইদের। তাদের জন্যে ‘আচ্ছে দিন’ তো এনে দিয়েছেন!
তাই তিনি খোঁজ রাখেননি — অপরিকল্পিত চার ঘন্টার নোটিশের লকডাউনে কত অন্তঃসত্ত্বা, শিশুকে তিনি শ’ শ’ মাইল হাঁটতে বাধ্য করেছিলেন; পথ চলার নাছোড় ক্লান্তিতে রেললাইনে ঘুমিয়ে পড়া শ্রমিকদের ছিন্নভিন্ন দেহগুলোর পাশে তাদের পরম যত্নের রুটিগুলো রক্তে ভিজে পড়েছিল; অক্সিজেনের অভাবে কতজন হতভাগ্যের প্রাণ গিয়েছিল; কীভাবে উপযুক্ত সৎকারের সম্মানটুকু না দিয়ে হাজার হাজার লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। খবর রাখেননি, কত শিশু অনাথ হয়েছিল, কীভাবেই বা তারা বেঁচে আছে। একটা প্রজন্ম কৈশোরের প্রাপ্য শিক্ষা থেকে কীভাবে বঞ্চিত হল যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব শুধু তাদের নয়, দেশকেও বইতে হবে। তেমনই জানার দরকার মনে করেননি শিক্ষিত বেকার যারা সরকারি দপ্তর, ব্যাঙ্ক, রেল, বিমা, প্রতিরক্ষাশিল্প, সেনাবাহিনীতে চাকরির আশা নিয়ে এগিয়েছিল, তাঁর কর্পোরেট তোষণে কীভাবে তাদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল! তিনি খবর রাখেন না কত ছেলেমেয়ে মিড-ডে-মিল-এর আশায় খালি পেটে স্কুলে চলে আসে। (কয়েক দিন আগে লাভপুরের এক স্কুলে ১৭ জন ছাত্রী প্রার্থনার লাইনে একে একে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক জানান ওরা প্রত্যেকে রক্তাল্পতায় ভুগছে। মিড-ডে-মিলের খাবার খাবে বলে বাড়ি থেকে কেউ খেয়ে আসেনি, আসে না। ওরা এত দুর্বল যে একজনকে সংজ্ঞা হারাতে দেখে বাকিরাও অসুস্থ হয়ে পড়ে।)
২০৩০-এর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার দিবাস্বপ্নে মশগুল তিনি ভাবার দরকারই মনে করেননি কীভাবে তার সরকারের ভ্রান্ত আর্থিক নীতি করোনাকালে গরিবকে আরও গরিব আর ধনীকে আরও ধনী করে ফারাকটা আসমান জমিন করে তুলেছে। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ এক বিরাট জুমলা হয়ে তাকেই ব্যঙ্গ করছে! ভারতে যখন ৮৪% পরিবারের আয় কমে গেছে, বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দ ৬% ও ১০% কমিয়ে দেওয়া হয়েছে তখন ধনকুবেরের তালিকায় আরও ৪০ জনের নাম যুক্ত হয়েছে! দেশের ধনীতম ৯৮ জনের সম্পত্তির পরিমাণ দেশের দরিদ্রতম সাড়ে ৫৫ কোটি মানুষের সম্পদের সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের ১% মানুষের হাতে ৫৮% সম্পদ জমা হয়েছে! তিনি ভেবেও দেখেননি ৯৮ জন ধনকুবেরের সম্পত্তির ওপর মাত্র ৪% কর বসালে ১৭ বছর মিড-ডে-মিল প্রকল্প মসৃণভাবে চালিয়ে নেওয়া যেত। আরও ১% কর বসালে স্কুল শিক্ষা চমৎকার এগিয়ে যেত। কেন্দ্রীয় ও রাজ্যসরকাগুলো চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা ও জলসরবরাহের জন্য যা ব্যয় করে (মোট ২০৮১৬৬ কোটি টাকা) তা শুধু মুকেশ আম্বানির ব্যক্তিগত সম্পত্তির থেকেও কম! দেশে মূলত বেকারত্ব ও আর্থিক কারণে অবসাদে আত্মহত্যা বেড়েছে ৭.১৭% এবং দিনমজুরদের মধ্যেই সেই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে (২০২০-২১-এ)। এই ‘অশ্লীল’ বৈষম্য যে অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে, তা কি তার অজানা?
ইদানীং বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে তাকে ‘নারীশক্তি’র জয়গান গাইতে শোনা যাচ্ছে। জন্মদিনেও। আসলে কয়েকটি রাজ্যে বিগত বিধানসভা নির্বাচনে মহিলা ভোটাররা বিপুল সংখ্যায় বিজেপি’কে বিমুখ করেছিলেন সেটা যেমন মাথাব্যথা, তেমনি সমান নাগরিকত্ব ও কৃষক আন্দোলনে মহিলারা বুঝিয়ে ছেড়েছেন ‘নারীশক্তি’ কাকে বলে। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন তো অনেক দূরের কথা, তার সরকার নারীর নিরাপত্তা কতটা সুনিশ্চিত করতে পেরেছে?
গোটা দেশে নারী নির্যাতন ক্রমবর্ধমান। ২০২০-২০২১-এর মধ্যে নারীর প্রতি অপরাধ বেড়েছে ১৫.৩%। দিল্লিতে বেড়েছে ৪০%। ঐ সময়ে দিল্লিতে প্রতিদিন গড়ে ২ জন নাবালিকা ধর্ষিতা হয়েছে। দিল্লি তার সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পুলিশের আওতায়। নির্যাতনের শীর্ষে রয়েছে উত্তরপ্রদেশে।
ধর্ষণে শীর্ষে আছে রাজস্থান। তার পর বিজেপি-শাসিত মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ। গোটা দেশে গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনায় মাত্র ০.১% -এর ক্ষেত্রে ৪৯৮এ ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। অর্থাৎ বহু ঘটনাই প্রশাসনে নথিভুক্ত হয় না।
সমাজে যে তীব্র লিঙ্গ বৈষম্য রয়েছে তা নারী-পুরুষের আয়-বৈষম্যের জন্য ৯৮% দায়ী। সম্প্রতি অক্সফ্যাম রিপোর্ট ২০২২ সে কথাই বলেছে। শিক্ষাগত সমান যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও সামাজিক কুসংস্কার ও চাকরিদাতার সংকীর্ণ মনোভাবের শিকার হন চাকরি প্রার্থী মহিলারা। এই বৈষম্য দূর করতে তার সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
নারীর ক্ষমতায়নের জন্য চাই নারীর স্বাধীন স্বচ্ছ দৃঢ় যুক্তিবোধ যা তাকে অন্যায়ের প্রতিবাদে এগিয়ে দেবে। অথচ তার সরকার তো স্বাধীন চিন্তার, সমাজমনস্ক প্রতিবাদী নারীদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলে জেলে আটকে রেখে কণ্ঠরোধ করতে চায়! সমান নাগরিকত্ব আন্দোলনে, ভীমা কোরেগাঁও মামলায়, জাকিয়া জাফরির মামলায় তার হাতে নাতে প্রমাণ আছে। তাহলে ঐ ‘নারীশক্তির বন্দনা’ তথা ‘ক্ষমতায়ন’টাও আরেকটা জুমলা?
তিনি মূল্যবোধ তথা পরম্পরার কথাও বলেছেন। ভারত সেই মূল্যবোধেই বিশ্বাস করে যা সহস্র বছরের প্রাচীন বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে পরম যত্নে লালন করে এসেছে। আধুনিক ভারত সেই পরম্পরাকেই বরণ করতে চায় যাকে তার সংবিধান ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। যা জাত পাতের ঊর্ধ্বে অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য এবং বিজ্ঞাননির্ভর সমাজ প্রগতিতে বিশ্বাসী। যা মনে করে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’!
মোদী এবং তার আরএসএস-বিজেপি'র মূল্যবোধ ও পরম্পরার ধারণা আধুনিক ভারত খারিজ করে।
পরিসংখ্যান: অক্সফ্যাম রিপোর্ট ২০২২
এন সি আর বি রিপোর্ট ২০২২
– জয়ন্তী দাশগুপ্ত