প্রসঙ্গ ইউক্রেইন : ন্যাটো এবং ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার প্রত্যাবর্তন
the return of Francis Fukuyama

– ফিল হ্যার্স

১৯৮৯-৯১ সালে বার্লিন দেওয়ালের পতন ও স্তালিনবাদী রাষ্ট্রগুলির ধ্বসের পর ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ ঘোষণা করে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা আন্তর্জাতিক খ্যাতির শীর্ষে চলে আসেন। ইতিহাসের সমাপ্তি মানে ফুকুয়ামা বোঝাতে চেয়েছিলেন, পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী সামাজিক ব্যবস্থা ও মতাদর্শের মধ্যেকার সংঘাতের সমাপ্তি। এবং উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের বিজয় যা ক্রমাগত আধিপত্যকারী ব্যবস্থা হিসেবে উঠে আসবে।

১৯৬০’র পর থেকে কার্ল পপারের মতো দক্ষিণপন্থী দার্শনিকেরা অভিযোগ তোলেন যে মার্ক্সবাদ ও বামপন্থী ‘ইতিহাসবাদ’ সমাজ বিকাশের গতির মধ্যে অন্তর্নিহিত এক অন্তিম অবস্থা বা শেষ সীমার কথা বলে যা হল সমাজতন্ত্র। ফুকুয়ামা তাঁর নিজস্ব ইতিহাসবাদ সামনে আনলেন, একেবারে বিদ্যমান বাস্তব এক ইতিহাসবাদ, যেখানে মানব ইতিহাসের শেষ সীমা হল যতটা সম্ভব ত্রুটিমুক্ত উদার গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ।

১৯৮৯ সালের পর এই থিসিস ভেঙে পড়ল। ইসলামিজমের উদ্ভব, ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ, চীনের উত্থান এবং অতি-দক্ষিণপন্থী জনমোহিনী আন্দোলনের জমানার(ক্রিপিং ক্যাপিটালিজম) উত্থান দেখিয়ে দিল যে, উদার গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ সুদূরপরাহত; উদার গণতন্ত্র বহুবিধ শত্রুর আক্রমণের সম্মুখীন, হোয়াইট হাউসের জনমোহিনী ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারের আক্রমণ তার মধ্যে কম কিছু না।

এখন ফুকুয়ামা বলতে চাইছেন, এইসব দুর্ভাগ্যজনক খিঁটমিটের পর ইতিহাস আবার নিজের ট্র্যাকে পড়েছে। ‘আমেরিকান পারপাস’ নামক ম্যাগাজিনে একটি নিবন্ধে দুইটি পয়েন্টে আলোচনা করে তিনি তাঁর এই নতুন তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। একটা হল, ইউক্রেইন যুদ্ধ ও তার সম্ভাব্য নাটকীয় প্রভাব সম্পর্কে এক আনুমানিক মূল্যায়ন। দ্বিতীয়টি হল, কীভাবে বিশ্ব ইতিহাস এবারে উদার গণতন্ত্রের অভিমুখে ঘুরে যাবে তার এক সামগ্রিক বিশ্লেষণ।

যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে ফুকুয়ামা বলছেন যে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন ও রুশ আর্মি আটকে গেছে। এগোতেও পারছে না, পিছোতেও পারছে না। এটা হল অবশ্যম্ভাবি পরাজয়ের পূর্বলক্ষণ, এবং খুব দ্রুতই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। যুদ্ধের ফলাফল প্রসঙ্গে ফুকুয়ামার এই দাবির বিষয়ে চূড়ান্ত অভিমত দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ যুদ্ধ সম্পর্কে খবরাখবর যা আসছে তার বেশিরভাগটাই আসলে প্রচার; সরাসরি পেন্টাগন বা ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রক থেকে সংবাদ মাধ্যমে ছড়ানো প্রচার।

দ্বিতীয়ত, বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক সংঘাতকে ফুকুয়ামা “উদার গণতন্ত্র বনাম তার স্বৈরতান্ত্রিক শত্রুর” সংঘাত হিসেবে সুস্পষ্ট প্রকাশিত হতে দেখছেন। এই স্বৈরতান্ত্রিক শত্রুর তালিকায়, বলাই বাহুল্য, অন্তর্ভুক্ত আছে দক্ষিণপন্থী জনমোহিনী রাশিয়া এবং বহুদিনের পুরনো প্রধান শত্রু চীন। যারা যারা এতদিন পুটিনের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে বা তাঁর প্রশংসা করেছে — মূলত অতি দক্ষিণপন্থী মানুষেরা — তাদের সকলের এবার মানসম্মান বাঁচানোই দায় হবে এবং কর্তৃত্ব ধাক্কার মুখে পড়বে। এঁদের মধ্যে আছেন ইতালির মাতিও সালভানি, হাঙ্গেরির ভিক্টর ওরবান, ফ্রান্সের মারিঁ লা পেন (ফুকুয়ামা অবশ্য ব্রিটেনের নাইজেল ফারাগের নামটাও নিতে পারতেন)।

দক্ষিণপন্থী অনলাইন জার্নালে পরপর একগুচ্ছ সাক্ষাৎকারে ফুকুয়ামা বলেন, ইউক্রেইনের ওপর আগ্রাসন এক “নৈতিক স্পষ্টতা” তৈরি করেছে। এটা উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এডভান্টেজকে দেখিয়ে দিচ্ছে যা কি না “স্বৈরতান্ত্রিক নয়, একনায়কতন্ত্র নয়, জনগণকে হত্যা করে না, এবং তা তার প্রতিবেশি দেশে আগ্রাসন চালায় না”। বলাই বাহুল্য এই তত্ত্বের অন্তর্নিহিত মিথ্যাচার খুবই প্রকট। কিন্তু পশ্চিমা দেশে ও তার বাইরেও যে বিরাটাকার প্রচারণা চলছে তার কেন্দ্রে আছে এই তত্ত্ব।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সঙ্গীসাথিদের শুরু করা ডজন কয়েক যুদ্ধ যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে — কোরিয়া ও ভিয়েতনামে প্রত্যক্ষভাবে, আর আফগানিস্তান, নিকারাগুয়া ও এল সালভাদরে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র যুগিয়ে নিজে পেছন থেকে যুদ্ধ চালিয়ে — তা বেমালুম ভুলে যাওয়া হল। এ বড় অদ্ভুত ব্যাপার। ইরাক ও আফগানিস্তান তো ঘটেছে বিগত ২০ বছরের মধ্যেই। ২০০৭-৮ এর পতন ও তা থেকে উদ্ভূত কৃচ্ছসাধন চাপিয়ে দেওয়া এবং তাকে ঘিরে উথালপাতাল, যার মধ্যে ২০১০’র আরব বসন্তও পড়বে, যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট প্রকাশ করল সেটাও এই তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।

ফুকুয়ামার তত্ত্বে এটাই কেন্দ্রীয় দুর্বলতা। এই তত্ত্বে কেবলমাত্র শাসনের বাহ্যিক ধরনকেই হিসেবের মধ্যে আনা হয়েছে। কিন্তু তার ভেতরের যেসব অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রশ্ন উদার গণতন্ত্রকে অচলাবস্থায় এনে ফেলেছে সেগুলিকে আর আলোচনায় আনা হয়নি।

২০০৭-৮ সালের পর থেকে ফ্যাসিবাদ ও চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী কর্তৃত্ববাদের ভয়াবহ উত্থান ঘটেছে উদার গণতন্ত্রের অভ্যন্তর থেকেই, বাইরে তৈরি হওয়া কোনও চাপের ফলে নয়। জীবন-জীবিকার মানের তীব্র অধঃপতনের ফলে যে চরম হতাশার জন্ম হয় তা জনতাকে চরমপন্থী রাজনীতি সমর্থনের দিকে ঠেলে দেয়। বামেদের পরাজিত ও দুর্বল হয়ে যাওয়া আর অতি দক্ষিণপন্থীদের প্রতি পুঁজিপতি শাসকশ্রেণির একাংশের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে অতি দক্ষিণপন্থীরা শ্রমজীবীদের সবচেয়ে পশ্চাদপদ অংশের কাছে ও মধ্যবিত্তদের কাছে আবেদন রাখে অভিবাসন-বিরোধী জাতিবাদের ভিত্তিতে।

ইউক্রেইনে পুটিনের পরাজয় কীভাবে এক নতুন গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের ফুল ফোটাবে সে বিষয়ে ফুকুয়ামার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবে ইউক্রেইন যুদ্ধে ন্যাটোর প্রচারণার সাথে খাপেখাপ মিলে যায় : পূর্ব ইউরোপে অস্ত্র ও সৈন্য ঢেলে দেওয়া হচ্ছে “গণতন্ত্র রক্ষা করতে”। এটা মতাদর্শগত ধোঁয়াশার জাল ছড়ানো ও পশ্চিমা জনমত উসকে দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়, যার আড়ালে ব্যাপক সামরিকিকরণের নতুন ঢেউ তোলার প্রস্তুতি চলছে।

অনেক রাজনীতিবিদ ও অনেক মিডিয়া ইউক্রেইনে “আরও শক্তিশালী অস্ত্র” প্রেরণের দাবি তুলছে যা রাশিয়া ও ন্যাটো বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের দ্বার খুলে দেবে। এই যুদ্ধ প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেইনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রক্ষা করার যুদ্ধ। কিন্তু এই প্রকৃত উদ্দেশ্য ছাপিয়ে কখন যে তা অন্য রূপ নেবে তা জানতে পারবেন না (ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘মিশন ক্রিপ’)। এই বিপদের জোরালো সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। এ’কথা পরিষ্কার যে ডানপন্থী রাজনীতির অনেকে এই যুদ্ধকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এক প্রক্সি যুদ্ধে পরিণত করতে চায়, সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে।

ইউক্রেইনে যুদ্ধ বন্ধ করার লক্ষ্য তাঁদের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসল লক্ষ্য রাশিয়ার চরম সামরিক পরাজয়, তাতে ইউক্রেইনের জনতাকে যত মূল্যই দিতে হোক না কেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে রাশিয়ার ওপর যে ‘স্যাংশন’ চাপানো হয়েছে তা সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের ভেতরের সংঘাতের অঙ্গ হিসেবে রাশিয়ার অর্থনীতিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত নকশা। এই স্যাংশনরাজ রাশিয়ার জনতাকে বিপুল দারিদ্র্য ও দুর্দশায় ফেলবে। অর্থাৎ গুণাগার তো দিতেই হবে এবং তা রাশিয়ার জনতার মূল্যেই দিতে হবে। ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি দেখিয়েছেন যে ‘স্যাংশন’ যদি চাপাতে হয়ও তাহলে এই বিরাট ক্ষতি এড়িয়ে নির্দিষ্টভাবে কেবলমাত্র ধনকুবের গোষ্ঠিগুলিকে নিশানা করে আনা যেতে পারে যে ধনকুবের গোষ্ঠিগুলিকে রাশিয়ান আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সুরক্ষিত রাখে।

রাশিয়ার অর্থনীতিকে ধ্বংস করার জন্য এইভাবে উঠেপড়ে লাগাটা বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির ফাটলগুলি স্পষ্ট করে দেয় যা বর্তমানে প্রাধান্য করছে। এটা মোটেই উদার গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্রের সংঘাত নয়, বরং প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যেকার সংঘাত। যে সংঘাতে জড়িয়ে আছে রাশিয়া, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমন এক যুদ্ধ যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন এমনকি অস্ট্রেলিয়াকেও বিশ্বাস করে নিজের শিবিরে রাখতে পারে এবং অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন বহু ফ্রন্টে বহুভাবে হাত মেলায়।

গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের মতাদর্শ ফেরি করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির ওপর ভরসা রাখছে। আবার একইসঙ্গে তাদের স্বাধীন বৈদেশিক ও প্রতিরক্ষা নীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যকেও ক্রমাগত নাকচ করে চলছে। পুটিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিরাট সহযোগিতা করে দিয়েছে ন্যাটোকে পুনরায় শক্তিশালী করে নিতে এবং তার মাধ্যমে পশ্চিমে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক একাধিপত্য নিশ্চিত করতে।

গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের মতাদর্শ খুব শক্তিশালী কারণ এ’কথা স্পষ্টতই সত্য যে পুটিনের রাশিয়া ও শি জিনপিঙের চীন বাস্তবে কঠোর একয়ায়কতন্ত্র যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা নির্মমভাবে দমন করা হয়। এই রাষ্ট্রগুলিতে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সমালোচনা করার তেমন কোনও পরিসর নাই যতটা আমেরিকা বা ইউরোপে আছে। পশ্চিমে আছে পাহাড় প্রমাণ জাতিবাদ, সহিংসতা, নারীবিদ্বেষ এবং পশ্চিমের যথাস্থিতি বজায় রাখতে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলিতে নিজেদের দারিদ্র্য অংশত চালান করা, অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করা, নৃশংস বোমা বর্ষণ, আক্রমণ — এক কথায় সাম্রাজ্যবাদের শিকার বানানো।

পশ্চিমের বিপুল অংশের জনতার কাছে সাম্রাজ্যবাদী হিংস্রতা ও শোষণকে লুকিয়ে রাখা হয় নিউজ বুলেটিনের ঠুলি আর বিনোদনের চশমা পরিয়ে। আউট অব সাইট, আউট অব মাইণ্ড। ইয়েমেনের নাগরিকদের ওপর নৃশংস বোমা ও তাতে ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ ভূমিকার কথা আর কতজনই বা জানে। কার্যত সমগ্র ব্রিটিশ নিউজ মিডিয়া ফুকুয়ামা-ন্যাটো মতাদর্শের পেছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এমনকি সামাজিক ও পরিবেশ সংক্রান্ত প্রশ্নে ৠাডিক্যাল প্রবণতা রাখে যারা সেইসব নিউজ মিডিয়াও। এইভাবেই, যুদ্ধের মতো ক্রুশিয়াল প্রশ্নে, লিবারালিজম নিজ নিজ সাম্রাজ্যবাদের সাথে এক লাইনে খাড়া হয়ে যায়। ফিল ওক্স তাঁর সুন্দর গানটির মাধ্যমে এই বিষয়টি তুলে ধরেন, “লাভ মি, আই অ্যাম এ লিবারাল : হোয়েন ইট কামস টু টাইমস লাইক কোরিয়া, দেয়ার ইজ নো ওয়ান রেড, হোয়াইট অ্যান্ড ব্লু”।

টাইমস রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফুকুয়ামা দক্ষিণপন্থী বিদেশ নীতির প্রবক্তাদের পৃষ্ঠপোষণা করে বলেন যে, উদারনীতির শেষ যুদ্ধ চলবে চীনের সাথে। পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো বিপুল অস্ত্র ও সেনা ঢেলে দিলেও পশ্চিমা দেশগুলির বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি হার্ডওয়ারের বৃহত্তম কাঠামো, প্রধানত নৌবাহিনীর, গড়ে তোলা হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে নিশানায় রেখেই।

স্বৈরতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদী উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মধ্যে বিশ্বসংঘাত, যেখানে পশ্চিমা দেশগুলি গণতন্ত্রের প্রতিনিধি — ফুকুয়ামার এই বুনিয়াদি তাত্ত্বিক অবস্থানের মহড়া প্রাক্তন ট্রটস্কিপন্থী ব্রিটিশ ভাষ্যকার পল মেসন আগেই একবার দিয়েছেন। মেসন ইউক্রেইনে ন্যাটোর দ্বিধাহীন সামরিক হস্তক্ষেপ দাবি করেন। তিনি বলেন, “সবরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব বিসর্জন দিয়ে ব্রিটেনকে অবশ্যই সামরিক খরচ আরও বাড়াতে হবে”। উদাহরণ হিসেবে, তিনি অভিযোগ তোলেন, বরিস জনসন সরকার তো “কেবলমাত্র” ৪৮টি এফ-৩৫ স্টিলথ ফাইটার নিয়োগ করেছে বহু বিলিয়ন খরচের বিনিময়ে। মেসন এমনকি লেবার ফ্রন্ট বেঞ্চে অধিকতর অস্ত্র বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নে স্বচ্ছতার অভাব নিয়েও চিৎকার করেন। মেসনের বিচারে, স্বৈরতন্ত্রের হাত থেকে নিস্তার পাবার তাড়নায় জনতার মধ্যে প্রো-ন্যটো প্রো-ইইউ সংস্কৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সে কারণেই পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো আছে। জনগণের মধ্যে এই ব্যাপ্ত চেতনা সম্পর্কে মেসনের বিশ্লেষনের মধ্যে নিশ্চয়ই খানিক সত্য আছে। কিন্তু ন্যটো পূর্ব ইউরোপে মোটেই কোনও স্বার্থশূন্য দয়ার সাগর হয়ে উপস্থিত নেই। আছে প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যবাদী দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধবাজ অগ্রবাহিনী হিসেবে।

স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিপদের মুখে পড়তে পারে বা ইতিমধ্যেই সেরকম শাসনের মধ্যে আছে এমন জনতার মনে পশ্চিমী চেতনা থাকার প্রশ্নটা নতুন কিছু নয়। তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে গণতন্ত্রের দাবিতে প্রতিবাদরত ছাত্রছাত্রীদের সমস্ত সংগ্রামী বামপন্থীরাই সমর্থন করেছিল, এবং তাঁদের অনেকেই ইন্টারন্যাশনাল গানটি গাইছিলেন। কিন্তু অন্য অনেকে আবার স্ট্যাচু অব লিবার্টির আদলে মূর্তিও বানিয়েছিল। আরও স্পষ্ট হয়, ১৯৮৯ সালে দুই জার্মানি এক হওয়ার দাবিতে পূর্ব জার্মানির লিপজিগ ও অন্যান্য শহরে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পশ্চিম পক্ষীয়, ইইউ পক্ষীয়, ন্যাটো পক্ষীয় মতাদর্শের জঙ্গি প্রিতিনিধিরা বিশাল সংখ্যায় ছিল, সম্পূর্ণ প্রাধান্যকারী অবস্থায় না থাকলেও ছিল। পশ্চিম জার্মানির শত শত ডানপন্থীরাও প্রতিবাদী মিছিলগুলিতে অংশ নিয়েছিল।

যখন ডেভ পেকার্সিও এবং আমি পশ্চিম জার্মানির সোশালিস্টদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে তাঁরা কেন প্রতিবাদী মিছিলগুলিতে অংশ নিয়ে এক ঐক্যবদ্ধ সমাজতান্ত্রিক জার্মানির শ্লোগান ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারলেন না, তখন তাঁরা সকলে একটাই জবাব দিয়েছিলেন, “সম্ভবই ছিল না, পাগল না কি, আমাদের ওরা জাস্ট ধোলাই দিত”। অথচ একটি নতুন ফোরামের মাধ্যমে আন্দোলন শুরু হয়েছিল যেখানে সোশালিস্ট ও চার্চের বিক্ষুব্ধরা অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারপর তা প্রান্তিক হয়ে যায় পশ্চিম জার্মানির সাথে ঐক্য, গণতন্ত্র ও ভোগ্য পণ্যের সম্মিলিত আকাঙ্খায় তৈরি হওয়া একের পর এক বিপুল জনজোয়ারের ঢেউয়ে।

ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ফলশ্রুতিতে পূর্ব জার্মানির অধিকাংশ মানুষ যা পেয়েছিল তা হল বেকারত্ব এবং সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা, শিশুশিক্ষালয় ও অন্যান্য সামাজিক কল্যাণ প্রকল্পগুলির ধ্বসে পড়া। যেসব উৎসাহী তরুণ তরুণী পশ্চিম জার্মানিতে চলে যেতে পেরেছিল কেবল তারাই স্বল্প সময়ের জন্য বা পরবর্তী আরও কিছুদিন খানিকটা উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের সন্ধান পেয়েছিল।

প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলেছিল সেই ঠাণ্ডা যুদ্ধের মতাদর্শছিল সেই অর্থে গণতন্ত্র বনাম কর্তৃত্ববাদী কমিউনিজমের দ্বন্দ্ব। এবং ১৯৬০’র মধ্যভাগ পর্যন্ত এই মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা ছিল সত্যিই খুব কঠিন। এই মতাদর্শ ভেঙে পড়েছিল পরমাণু অস্ত্রের চাপ, কিউবায় মার্কিন মিসাইল সংকট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আন্দোলন এবং সর্বোপরি ভিয়েতনাম যুদ্ধে নাগরিকদের ওপর সংঘটিত গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে।

১৯৫০-৬০ সালের পরমাণু বোমা নিরস্ত্রীকরণ অভিযানের প্রভাবে ন্যাটোর প্রতি ঐকমত্য ভেঙে দিয়েছিল। এবং এইভাবে ভেঙে পড়েছিল সিআইএ’র সাংস্কৃতিক মুখপত্র ‘এনকাউন্টার’ প্রচারিত ডানপক্ষীয় মার্কিন লিবারালিজম।

ইউক্রেইনের আত্মরক্ষা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষ গ্রহণ থেকে বিচ্যুত হয়ে মেসনের বক্তব্য চীন ও রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের প্রতি পক্ষপাতিত্বে পর্যবসিত হয়। এই অবস্থান বামপন্থীদের ওপর বিপুল চাপ তৈরি করতে চলেছে, ব্রিটেনে এবং সারা পৃথিবিতেই। যখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে সংঘর্ষ হয় তখন আসল ‘উৎপীড়ক’ চিহ্নিত করা সত্যিই খুব চাপের হয়ে পড়ে, বিশেষত সেই উৎপীড়ক যদি কারও নিজের সাম্রাজ্যবাদকে লড়াই দেয়।

অগণতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে “গণতান্ত্রিক” সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে সমর্থন দেওয়ার বিপদের দুটি দিক আছে। প্রথমত, এটা বিদ্যমান উদারনৈতিক পুঁজিবাদকে সুন্দর করে দেখায়, যেখানে বাস্তবে গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর চরম হামলা চলে এবং সকলের অজান্তে ফ্যাসিবাদের মাথা চাড়া দেওয়ার চাপ তৈরি হয়। ফুকুয়ামার বক্তব্য অসংগতির দোষে দুষ্ট হয় যখন তিনি বলেন যে, পুটিনের পতন অটোমেটিকালি ব্রাজিলের জাইর বোলসোনারো বা ইতালিতে মাত্তিও সালভানির লেগা পার্টির মতো কর্তৃত্ববাদী ডানপন্থীদেরও বিপদে ফেলবে। স্বল্প সময়ের হিসেবে এরকম হতেও পারে। কিন্তু যদি ২০২৪’র মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাব্লিকানরা জেতে, যার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, এবং যদি সেই ট্রাম্পই তাদের প্রার্থি হয়, তাহলে অতি-ডানপন্থী পপুলিস্টদের মতাদর্শগত পরাজয় খুবই স্বল্পস্থায়ি হবে। যাই ঘটুক না কেন, এটা একটুও স্পষ্ট নয় যে হাঙ্গেরিতে ওরবানের সমর্থকেরা বা ইটালিতে সালভানির সমর্থকেরা পুটিনের রাশিয়ার সাথে কোনও সম্পর্ক খুঁজে পাবে কেন।

দ্বিতীয়ত, উদারনৈতিক পুঁজিবাদকে ব্যাক করা মানে ২০০৭-৮ থেকে এর যে সংকট চলছে তাকে উপেক্ষা করা। এই সংকট দ্রুতই আরও এক আর্থিক অতিমন্দার দিকে এগোচ্ছে এবং তা আবার কর্তৃত্ববাদী ডানপন্থাকে শক্তিশালী করবে; এবং একই সাথে, আমাদের আশা, শক্তিশালী করবে বিপ্লবী বামপন্থাকেও। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, ফুকুয়ামা টাইপের অবস্থানে মেসনের পতন মার্ক্সবাদী বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীর বুনিয়াদি অবস্থানকেই বর্জন করার সামিল।

ইউক্রেইনের যুদ্ধ জাতীয় আত্মরক্ষার যুদ্ধ। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ক্রমশই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির সংঘাতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। ইউক্রেইনকে ডিফেন্ড করাটা যেন ন্যাটোর পক্ষ নিয়ে নেওয়া না হয়, অথবা তা যেন বামপন্থী দিশা থেকে ন্যাটোর সমালোচনা চালানো বন্ধ করা না হয়ে যায়, বা ইউরোপে ন্যাটোর আরও সামরিকিকরণের যুক্তি হয়ে না দাঁড়ায়।

‘লিঙ্কস ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল ফর সোশ্যালিস্ট রিনিউয়াল’ ম্যাগাজিনে জুন ২০২২ প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: মলয় তেওয়ারি। মতামত লেখকের। অরিজিনাল লেখাটি অনলাইনে পাওয়া যাবে –
https://internationalviewpoint.org/spip.php?article7681

খণ্ড-29
সংখ্যা-35