তৃণমূলনেত্রীর নিদান, ‘কেষ্ট বেরিয়ে এলে “বীরের সম্বর্ধনা” দিতে হবে।’ কেষ্ট এখন হাজতে। গুজরাটে বিলকিস বানোর ধর্ষক ও খুনীরা জেল থেকে খালাস পেয়ে বেরিয়ে এলে তাদের বিজেপির নেতাদের নির্দেশে ‘বরণ’ করা হয় ফুলমালা দিয়ে, মিষ্টি বিলিয়ে, হিন্দুত্বের দাপট বুঝিয়ে দিতেই। এই দুই মনোভাবের মধ্যে লক্ষ্যণীয়ভাবে ধরা পড়ে এক বিচিত্র সাদৃশ্য, যদিও প্রতিতুলনায় তফাতও কিছু আছে। গুজরাটের খালাস প্রাপ্তরা ছিল যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত, হিন্দুত্ববাদের পক্ষভুক্ত, দু'দশক আগে হিন্দু সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদীদের দ্বারা সংগঠিত গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা চলাকালীন বিলকিস বানোর গণধর্ষক ও তার পরিবারের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা’দের খুনেবাহিনী। পক্ষান্তরে, এরাজ্যের তৃণমূলী ‘কেষ্ট’ এখন জেলখানায় বিচারাধীন, প্রচুর দুর্নীতি-কেলেঙ্কারীর অপরাধে জড়িত থাকা সন্দেহে। তার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গুণ্ডাবাহিনী আছে, এবং তার বিরুদ্ধে খুন-খারাবির অভিযোগও কম নয়। মাঝে দেখা গেল আরেক কান্ড — মঙ্গলকোটে এক দশক আগে দলবদ্ধভাবে খুন করার এক মামলায় ‘সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে’ সদলবলে ‘বেকসুর’ খালাস হয়ে গেলেন ‘কেষ্ট’! তিনি যে শাসক তৃণমূলের যাবতীয় অনৈতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক দুর্বৃত্তায়নে ও ক্ষমতা কায়েমে অশেষ গুণধর! এই কারণেই তিনি দলনেত্রীর এতো কাছের, তাঁকে কেন্দ্র করে মুখ্যমন্ত্রী এতো বেপরোয়া। মাস কয়েক আগে সংঘটিত হয় ঘরে লুকিয়ে থাকা লোকজনকে পুড়িয়ে মারার বগটুই ঘটনা, সেই ঘটনাক্রমেও নাম জড়ায় ‘কেষ্ট’র। তা ধামাচাপা দিতে মুখ্যমন্ত্রী অগত্যা বাধ্য হন কিছু ক্ষতিপূরণের ডালি হাতে ঘটনাস্থলে যেতে, সঙ্গে সেই ‘কেষ্ট’। গুজরাটের বদমায়েশদের জন্য রয়েছে শাসক বিজেপির খুল্লামখুল্লা মদত। এখানে ‘কেষ্ট’দের জন্য রয়েছে শাসক টিএমসির অপর্যাপ্ত ইন্ধন, নির্লজ্জ ওকালতি। এই ‘কেষ্ট’ পরিঘটনা মনে পড়ায় পাঁচ দশক আগেকার আরেক ‘কেষ্ট’ পরিঘটনাকে — ‘ফাটাকেষ্ট’ — যে কিনা কুখ্যাত হয়েছিল কলকাতায় বিপ্লবী যুব ও তরুণদের হত্যাভিযান চালিয়ে, তদানীন্তন কংগ্রেসী সিদ্ধার্থ রায়ের খুনে জমানায়। মমতা ব্যানার্জী কংগ্রেস ত্যাগ করে তৃণমূল কংগ্রেস বানালেও, গণআন্দোলন করে ক্ষমতায় এলেও, বরাবর মুখ্য প্রশাসক হিসাবে সিদ্ধার্থ রায়কে গুরু মেনে এসেছেন, এখনও ধ্যানজ্ঞানে মানেন, সম্ভবত সেখান থেকেও বেপরোয়াপ্রবণ হয়ে চলার রসদ পান ‘কেষ্ট’বাহিনী লালনে। সত্তর দশকে কাশীপুর-বরানগর গণহত্যা সংঘটিত করতে বাহানা করা হয়েছিল যে কংগ্রেসী নেতা নিহত হওয়ার ঘটনাকে, তার স্মরণ কর্মসূচি পালন করে মমতার দল। গত একদশকের বেশি সময় ধরে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি যোগে অপশাসন চালাচ্ছে মমতা সরকার। তারই অঙ্গ হল তাদের আজকের রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, তার জন্যই সরকার-বহির্ভূত দমনযন্ত্র কায়েমে তৃণমূলের এতো ‘কেষ্ট’প্রবণ হওয়ার ধারা। তৃণমূলের ভিতরেও স্বার্থ সংঘাতের জেরে খুনোখুনি লেগে থাকে। অন্যদিকে তৃণমূলের বিরুদ্ধাচরণ করা আনিস খানের অস্বাভাবিক মৃত্যুরহস্যের আজও কোন কিনারা হল না, যার সাথে সন্দেহে জড়িয়ে রয়েছে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ অফিসার ও এলাকার তৃণমূলের দাদাগিরি চালানো নেতাদের ভূমিকা। ঐ কেসের প্রধান সাক্ষী আনিসের এক ভাইয়ের ওপর আক্রমণ হল, যার সূত্র এখনও অধরা, থানা বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছে না, সন্দেহের আঙ্গুল উঠছে তৃণমূলের দিকেই।
তৃণমূলের এই অপশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র, জীবন-জীবিকার অধিকার ও দাবি আদায়ের দৈনন্দিন সংগ্রাম গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরী। বামপন্থী শক্তি পারে এই কঠিন চ্যালেঞ্জ নিতে। কিন্তু সেই চেষ্টায় এখনও বড় মাত্রায় দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতেই হবে, আরও চিন্তাশীল পরিকল্পিত তৎপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ-উদ্যোগ-গণউদ্যোগ, সক্রিয়তা ও গতিময়তার ধারায় রাজ্য রাজনীতিতে বামেদের হয়ে উঠতে হবে প্রধান বিরোধীপক্ষ।
কোনও অবস্থাতেই বিজেপির বিপদ বেড়ে চলার বিরুদ্ধতায় শিথিল হলে চলবে না। আর যেন ‘বিজেমূল তত্ত্বে’র ভূত চেপে না বসে। ওরা পশ্চিমবঙ্গে একুশের নির্বাচনে ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। কিন্তু হাল ছাড়ার নয়। তাই রাস্তা নিচ্ছে গণউন্মাদনা সৃষ্টি করে রাজ্য রাজনীতিতে চর্চায় থাকতে। নবান্ন অভিযানের নামে যা করল তাতে আন্দোলনের নামে বস্তুত হিংসাত্মক নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসের ফ্যাসিস্ট প্রকল্পেরই এক মহড়া দিল।