কোথাও হুমকি, কোথাও হামলা, কোথাও অবজ্ঞা, কোথাও বা একটু সহমর্মিতা — এসব কিছু সাথে নিয়েই গত আগস্ট মাস থেকে মিড-ডে-মিল রন্ধনকর্মীরা রাজ্যের বিভিন্ন ব্লকে বিক্ষোভ-ডেপুটেশনে সামিল হচ্ছেন। গত ৭-৮ জুলাই কলকাতায় বিক্ষোভ অবস্থানের মধ্যে দিয়ে রন্ধনকর্মীরা রাজ্যবাসীর কাছে একথা তুলে ধরেছেন যে — কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই সরকারই গরীবের শিক্ষার প্রতি চরম অবহেলার নীতি নিয়ে চলেছেন। মিড-ডে-মিলের বরাদ্দ কমিয়ে গোটা প্রকল্পকেই দায়সাড়া করছেন। যারফলে, বহু সংগ্রামে অর্জিত শিক্ষার অধিকার আইন, ২০০৯ আজ সরকারীভাবেই লঙ্ঘিত। স্কুলছুট বেড়ে যাওয়া, বাল্যবিবাহ, শিশু শ্রমিক সবই এরফল। দেশের কিছু রাজ্য সরকার নিজস্ব তহবিল ব্যয়ে কিছুটা দায়িত্ব নিলেও পশ্চিমবঙ্গ সম্পূর্ণ উদাসীন। রাজ্য সরকার আর্থিক অভাবের কথা বললেও, কর্মীদের দাবিকেই তারা অস্বীকার করছে। সরকারের হামলাকারী কর্মীরা বলছে, “অনেক দিয়েছে, আর কত দেবে?” কিন্তু, একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে গত ১০ বছর কর্মীরা একই ভাতায় কাজ করছেন।
গত ২০ বছর কাজ করেও আজও কর্মীদের অনিয়মত ভাতা, ছাঁটাইয়ের হুমকি, অমর্যাদা, ভবিষ্যত সুরক্ষাহীন কাজ করে যেতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যের প্রায় ২.৫ লক্ষ কর্মী আজ আলোড়িত।
পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধনকর্মী (মিড-ডে-মিল) ইউনিয়ন কর্মীদের এই ন্যায়সঙ্গত বিক্ষোভকে তীব্র আন্দোলনের রূপ দিতে রাজ্য-জেলা শ্রম দফতরে দাবি তুলে ধরছে। একই সাথে ব্লকে ব্লকে ব্যাপক বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে। মূলত: রন্ধনকর্মীদের পরিচয় পত্র, উৎসবকালিন অনুদান, ভাতা বৃদ্ধি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট মাধ্যমে ভাতা দেওয়া, শ্রম দফতরের উদ্যোগে রন্ধনকর্মী কল্যাণ বোর্ড গঠন — এই দাবিগুলি নিয়েই হুগলী জেলার পোলবা-দাদপুর, পান্ডুয়ায় কর্মীরা বিক্ষোভে সামিল হন, হাওড়া জেলার বাগনানে স্মারকলিপি দেন। কলকাতা জেলার কর্মীরা জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদে দাবি পেশ করেন। নদীয়া জেলার হরিণঘাটা ব্লকের কর্মীরা সাধারণ সভায় মিলিত হয়ে স্মারকলিপি প্রদানের প্রস্তুতি নেন।
উত্তর ২৪ পরগণা জেলার হাবরা-১ , হাবরা-২, দেগঙ্গা, বারাসত-২, গাইঘাটা প্রভৃতি ব্লকের রন্ধনকর্মীরা সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে দলে দলে ব্লকগুলিতে বিক্ষোভে সামিল হন। ব্লকস্তরে বিডিওদের পক্ষ থেকে সমস্ত দাবি পূরণের আশ্বাস না মিললেও, পরিচয় পত্র, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট মাধ্যমে ভাতা দেওয়ার বিষয়ে সচেষ্ট হবার আশ্বাস পাওয়া যায়। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ এআইসিসিটিইউ’র উদ্যোগে উত্তর ২৪ পরগণা জেলা যুগ্ম-শ্রম কমিশনারের কাছে গণস্মারকলিপি প্রদান হয়। তিনি দাবির প্রতি সহমত হয়ে রাজ্যস্তরে এই প্রকল্প কর্মীদের জন্য কল্যাণ বোর্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা করে, নিজ অর্থ ব্যয়ে দূরদূরান্ত থেকে কর্মীরা ব্লকগুলিতে জমায়েত হচ্ছেন। গ্রাম-শহরের প্রান্তিক কর্মীদের এই সংগ্রামী মেজাজ আন্দোলনকে আরো দীর্ঘ ও জোরদার করে তুলবে। আসন্ন উৎসব শেষে জেলায় জেলায় বিক্ষোভের মধ্যে দিয়ে রাজ্যজুড়ে এক ব্যাপক গণবিক্ষোভে সামিল হওয়ার জন্য কর্মীরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ’লড়াইটা যেমন ভাতা বৃদ্ধি, শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি, ভবিষ্যত সুরক্ষার লড়াই, তেমনি গরীবের শিক্ষা বাঁচানোর লড়াইও বটে। তাই, এই লড়াইকে বাংলার সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের লড়াইতে পরিণত করার আহ্বান এই বিক্ষোভসভাগুলি থেকে রাখা হচ্ছে।
২০ সেপ্টেম্বর কলকাতা জেলা রন্ধনকর্মী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কলকাতা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের চেয়ারপার্সন কার্তিক চন্দ্র মান্নার কাছে এক স্মারকলিপি পেশ করা হয় — তাতে রন্ধনকর্মীদের মজুরি বৃদ্ধি, পরিচয়পত্র প্রদান, উৎসবকালীন ভাতা এবং ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ভাতা প্রদান সহ বিভিন্ন দাবি জানানো হয়।