কৃষকের স্বাধীনতা,গণতন্ত্র ও অধিকারের দাবি তুলে ধরে সংগঠিত হল সারা ভারত কিষাণ মহাসভার নবম রাজ্য সম্মেলন। ৩০ আগস্ট লাঙল চিহ্ন সম্বলিত লাল পতাকায় সুসজ্জিত কৃষ্ণনগর রবীন্দ্র ভবনে এই সম্মেলন স্থলের নামকরণ করা হয়েছিল খাদ্য আন্দোলনের শহীদ আনন্দ হাইতের নামে, নদীয়ার বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনের নেতা বিমান বিশ্বাস সভাগৃহ ও সুবিমল সেনগুপ্ত নামাঙ্কিত মঞ্চে।
“কোম্পানিরাজ হঠাও” স্লোগান সামনে রেখে সম্মেলনের প্রস্তাবনায় বলা হয় কৃষি সংকটের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে কৃষকদের দুর্বার আন্দোলন শাসকদের মোক্ষম জবাব দিয়েছে, এ পথেই এগিয়ে যেতে হবে।
এ রাজ্যে অসমাপ্ত ভূমিসংস্কারের পরবর্তীতে ক্ষুদ্র কৃষক অর্থনীতির বিকাশে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই, বরং শুরু হয়েছে এক উল্টোযাত্রা। দলে দলে বর্গাদার পাট্টাদাররা উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। জমির প্রজাস্বত্বের একটা বড়ো ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে৷ কৃষি জমিতে চুক্তিচাষের প্রবণতা বেড়ে চলেছে। কৃষি উৎপাদনে অবদান তাদের থাকে বড় আকারে, অথচ এই গরিব চুক্তি-চাষিদের স্বার্থ রক্ষায় বা তাদের সরকারি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার প্রশ্নে সরকারের কোনো দায় রাখছে না। কয়েকটি জেলায় এদের সংগঠিত করে আন্দোলনে উদ্যোগ নেওয়ার অভিজ্ঞতার চর্চা সম্মেলনে উঠে আসে। জোরের সাথে ওঠে এদের সরকারি তালিকায় অন্তর্ভুক্তির দাবি।
কৃষকের ফসলের দামে লুঠের কারবার সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে শাসকদলের মদতপুষ্ট সিন্ডিকেট দালালরা, যাদের টিকি বাঁধা রয়েছে কোম্পানির কাছে। এর সাথে যোগ হয়েছে জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, চাষাবাদের ধরনে পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত তীব্র সংকট। কৃষি উৎপাদনের খরচ সীমাহীন বেড়ে চলেছে, অথচ কৃষকরা ফসলের লাভজনক দাম পাচ্ছে না। যেমন প্রতি কুইন্টাল ধানে ৬০০-৭০০ টাকা চলে যাচ্ছে ধানকল মালিক, দালাল, শাসকদলের মাতব্বরদের পকেটে! কৃষক আন্দোলনের যুক্ত মঞ্চের পক্ষ থেকে এ রাজ্যে কৃষি পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণে একটি আইন তৈরির দাবি জানানো হয়েছিল। এজন্য খসড়া বিল তৈরি করে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু রাজ্য সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। এই বিষয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তোলার গুরুত্ব সম্মেলনে উঠে আসে।
এ রাজ্যে ধানের পরই প্রধান অর্থকরী ফসল আলু। এছাড়া নানাবিধ সব্জি, যার চাষাবাদ সম্প্রতি বেড়ে চলেছে, রাজ্য সরকার এ সমস্ত ফসলের সরকারি দর নির্ধারণ, সরকারের পক্ষ থেকে কেনা এবং ন্যায্যমূল্যের দোকানের মাধ্যমে বিক্রি করার উদ্যোগ নিতে পারত। এ জন্য ‘সুফল বাংলা’ নামে সরকারি প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সেটাকে ক্রমশ প্রায় উঠিয়েই দেওয়া হয়েছে। সংরক্ষণের অভাবে, পরিবহণের কারণে প্রায় ৪০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়ে চলেছে। এ জন্য ব্লকে ব্লকে কিষাণ মান্ডি বা নিয়ন্ত্রিত বাজার তৈরি করা ও বহুমুখী হিমঘর স্থাপন করার কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু তার কোনো সরকারি প্রচেষ্টাই নেই। এই সমস্ত ইস্যু নিয়ে জেলায় জেলায় কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ ও কিষাণ মহাসভার উদ্যোগে বেশ কিছু প্রচার ও আলোড়ন মূলক কর্মসূচির প্রসঙ্গ সম্মেলনে উঠে আসে।
এ বছর পাট চাষিরা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে চাষ করেছে। বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে পাট ভেজানোর জল না থাকায় পাটের গুণমান এবং দাম নেমে গেছে। এ বছর অনেক বেশি পরিমাণ জমিতে পাটচাষ হলেও উৎপাদন মার খেয়েছে। এ প্রশ্নে সরকার চাষিদের কোনোরকম সহায়তা করেনি। গ্রামীণ জলাশয়গুলিতে সরকারি উদ্যোগে পাম্পের জল সরবরাহ করে পাট ভেজানোর ব্যবস্থা করার দাবিতে জেলা ও ব্লক দপ্তরে ডেপুটেশন দেওয়া হয়, কিন্তু সরকার উপেক্ষা করে। বাজারে পাটের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে বড় ব্যাবসায়ীরা। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার হাত গুটিয়ে বসে আছে। পাটের এমএসপি হওয়া উচিত ৮ হাজার টাকা কুইন্টাল, অথচ কেন্দ্রীয় সরকারি ঘোষণা হল ৪ হাজার ৭০০ টাকা! এই প্রশ্নে আন্দোলন গড়ে তোলার কর্মসূচি সম্মেলন গ্রহণ করে।
রাজ্য সরকার সমবায়ের মাধ্যমে স্বল্প দামে সার বীজ সরবরাহ করে বিশেষত গরিব-মাঝারি চাষিদের কিছুটা সুরাহা করতে পারে, কিন্তু এ সমস্ত কিছু এখন বন্ধ। পুঁজিবাদী চাষে প্রয়োজনীয় উপাদান হল পুঁজি। এ প্রশ্নে সমবায় একটা ভুমিকা নিতে পারতো। কিন্তু কৃষি সমবায়গুলির কোন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নেই, সীমাহীন দুর্নীতির আখরা হয়ে উঠেছে। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে এ রাজ্যে কোটি কোটি টাকার সমবায় দুর্নীতি ধরা পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সারের চোরাকারবার চলছে প্রকাশ্যে। খোলা বাজারে এমআরপি বা বস্তার উপর ছাপানো দামের থেকে ২০০/২৫০ টাকা বেশি দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে। সরকারি মদতেই এসব ঘটে চলেছে। সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণে তৃণমূল সরকারের আদৌ কোন পরিকল্পনা নেই। ভূপৃষ্ঠ সেচ – নদী থেকে জল উত্তোলন প্রকল্পগুলি অর্ধেক বন্ধ। বিগত ১০ বছরে সেচের নতুন কোনো প্রকল্প হয়নি। এ বছর ক্যানেলের জল সরবরাহ না করার ফলে বেশ কিছু এলাকায় বোরো চাষ মার খেয়েছে। জলাধারগুলি সংস্কারের কোনো ব্যবস্থা নেই। কৃষি ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ মাশুলে ভর্তুকির দাবি দীর্ঘদিন ধরে তুলে ধরা হলেও সরকার তাতে কোনো সাড়া দিচ্ছে না। অথচ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সরকার কৃষিক্ষেত্রে বিদ্যুতে ভর্তুকির ব্যবস্থা করেছে। এ সমস্ত প্রশ্নে ব্লকে ব্লকে প্রশাসনের কাছে বিক্ষোভ ডেপুটেশন ও এলাকায় এলাকায় প্রচার কর্মসূচিতে ভালো সাড়া পাওয়ার কথা সম্মেলনে উঠে আসে।
কৃষকের আয়বৃদ্ধির যে কল্পকথা সরকার প্রচার করে চলেছে তার বাস্তবতা নিয়ে সম্মেলনে পর্যালোচনা করে বলা হয় কৃষি পরিবারগুলির মোট আয়ের কতটা চাষাবাদ থেকে আসছে? আর কতটাই বা পারিবারিক শ্রমের মাধ্যমে নানাবিধ পশুপালন থেকে আসছে? কিংবা পরিযায়ী হিসাবে ভিন্ন রাজ্যে বা দেশে কাজ করতে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের আয় থেকে আসছে! সাদা চোখে বিষয়টা বিবেচনা করলে সহজেই বোঝা যায় চাষাবাদে আদৌ লাভ হচ্ছে না। কৃষি কাজে নিয়োজিত অত্যধিক মাত্রায় পারিবারিক শ্রমশক্তির দাম কোনোরকমে উঠছে বলা যেতে পারে। “কৃষক বন্ধু” নামে যে যৎসামান্য পরিমান খয়রাতি সাহায্য চাষিদের দেওয়া হচ্ছে সেটা তাদের লোকসান বা বঞ্চনাকে আদৌ পূরণ করতে পারছে না বরং প্রকারান্তরে এটা প্রমাণিত হয় যে সরকার চাষির লোকসানকে একপ্রকার মান্যতা দিতে বাধ্য হচ্ছে।
সম্মেলনের শুরুতে পতাকা উত্তোলন করে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন এআইকেএম সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাজারাম সিং। তিনি বলেন, কৃষিকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিয়ে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আইনে বদল এনে ভারতবর্ষকে একটি ক্ষুধার সাম্রাজ্যে পরিণত করার লক্ষ্যে আনা নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রতিরোধ সংগ্রাম একটি সফলতা। পরবর্তীতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত আইন থেকে শুরু করে চাল, গম সহ আরো ৪টি শস্য থেকে ইথানল বানানোর ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া, নয়া বিদ্যুৎ আইন, লখিমপুর খেরী কৃষক হত্যাকান্ডের বিচার এ সমস্ত প্রশ্নে মোদী সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে আরো সংগঠিতভাবে আন্দোলনের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। কৃষকরা ফ্যাসিস্ট সরকারকে উচিত শিক্ষা দেবে। পশ্চিমবাংলা সহ বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা – যেখানে এমএসপির দাবিতে সংগ্রামের সম্ভাবনা রয়েছে সেখানেই আমাদের কৃষক আন্দোলনের পরিকল্পনা নেওয়া ও নেতৃত্ব দেওয়ার প্রয়াস চালাতে হবে। সর্বোপরি মোদী সরকার জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে কৃষক-জনগণের সম্মতির দিকটি বাতিল করে দিতে চাইছে যা নজরুল-চারু-রবীন্দ্রনাথের মাটি বাংলার বুকে কখনোই মেনে নেওয়া যায় না, এমনকি পশ্চিমবঙ্গ সরকারও এটা করতে চাইলে তা চলতে দেওয়া যাবে না।
স্বাক্ষরকারী নাগরিকদের পক্ষ থেকে সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন কৃষ্ণনগরের মানবাধিকার কর্মী তাপস চক্রবর্তী। সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ নেতা বাসুদেব বসু, এ্যাপোয়ার ইন্দ্রাণী দত্ত, আয়ারলার বাবলু ব্যানার্জী, উপস্থিত ছিলেন আরওয়াইএ-র রণজয় সেনগুপ্ত, আইসার শুভাশীষ, সায়ন্তন প্রমুখ। বিভিন্ন কৃষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে বার্তা পাঠান, কিষাণ সভার পক্ষ থেকে বার্তা পাঠান অমল হালদার।
সম্মেলনে রাজ্যের ১৭টি জেলা থেকে ২৩০ জন প্রতিনিধি ও ৫০ জন গণ-আন্দোলনের কর্মী পর্যবেক্ষক রূপে অংশগ্রহণ করেন। বিগত দিনে দিল্লীর বুকে কিষাণ আন্দোলনের সংহতিতে এবং এ রাজ্যের দাবিগুলি যুক্ত করে প্রচার, পথ অবরোধ, সমাবেশ প্রভৃতি সংগঠিত হয়। এ বিষয়ে বক্তব্য রাাখেন সংগঠনের সহসভাপতি কার্তিক পাল। সম্মেলন থেকে তিনটি আশু কর্মসূচি গৃহীত হয়। আগামী ২৩-২৪ সেপ্টেম্বর বিহারে এআইকেএম এর জাতীয় সম্মেলনের নির্ধারিত কাজগুলি সম্পন্ন করা। ইতিমধ্যে রাজ্যে ৪০ হাজারের কিছু বেশি গণ সদস্য সংগ্রহ হয়েছে, আরও ১০ হাজার সদস্য সংগ্রহের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, ব্লকে ব্লকে কমিটি কাঠামো তৈরি করা, আসন্ন আয়ারলার জাতীয় সম্মেলনকে সফল করে তোলার কাজে সহযোগিতা করা, গ্রামে গ্রামে আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রস্তুতি গড়ে তোলা, আন্দোলন ও প্রচারমূলক কর্মসূচি নেওয়া, সর্বোপরি, গ্রামসংসদ সভা ডেকে পঞ্চায়েতকে হিসাব ও জবাবদিহি করতে হবে এই দাবি তোলা।
বিগত দিনে বিভিন্ন জেলায় কৃষক ও গ্রামীণ মেহনতিদের দাবিতে নানাবিধ আন্দোলন ও প্রচার কর্মসূচির কথা সম্মেলনে উঠে আসে। যথা, রাস্তায় ফসল ফেলে পথ অবরোধ, পঞ্চায়েত ঘেরাও, ফসলের দাম নিয়ে কৃষকদের মধ্যে জনশুনানি, কৃষি দপ্তরে বিক্ষোভ ডেপুটেশনের ফলে সারের কালোবাজারী বন্ধ করতে বাধ্য করা, আদিবাসী জনগণের জমির অধিকারের দাবিতে এলাকায় গরিব মানুষকে সামিল করা, উচ্ছেদের বিরুদ্ধে পুনর্বাসনের দাবিতে আইন অমান্য, রাস্তা অবরোধ, বনের জমি থেকে উচ্ছেদ রুখে দিয়ে সরকারী প্রকল্পের অধিকার আদায় ইত্যাদি ইতিবাচক উদ্যোগগুলি নিয়ে পর্যালোচনা ও বিতর্ক সম্মেলনকে প্রাণবন্ত করে তোলে। জেলা ও ব্লকে সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলা ও সচল রাখার প্রশ্ন দুর্বলতা, আরও বেশি সংখ্যক কৃষকদের জমায়েত করা, আলোড়নমূলক কর্মসূচি নেওয়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে ঘাটতির প্রসঙ্গ উঠে আসে। বাড়ি বাড়ি গণসংযোগ অভিযানে মানুষের ভালো সাড়া পাওয়া গেছে বলে সকলেই বলেন। ১২ দফা দাবিসনদ গৃহীত হয়। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন নীতীশ রায়, বাবুনি মজুমদার। পরিশেষে ৫৮ জনের রাজ্য কাউন্সিল ও ২৭ জনের রাজ্য কমিটি নির্বাচিত হয়। নবনির্বাচিত রাজ্য সভাপতি হন অন্নদা প্রসাদ ভট্টাচার্য, রাজ্য সম্পাদক জয়তু দেশমুখ ৷
দেশের অন্নদাতা কৃষকেরা পাঞ্জাবের মাটিতে কিম্বা দিল্লী সীমান্তে, হরিয়ানা ও মিরাট-বুলন্দশহরে জীবন বাজি রেখে লড়াই চালিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে নাকখত দিতে বাধ্য করেছেন। সেই লড়াইয়ের ঝাঁঝ পশ্চিমবাংলার মাটিতে এখনও তীব্র হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ক্ষোভের বারুদ বাংলার ক্ষেতে-খামারেও যে মজুত হয়ে চলেছে তারই কিছু ঝলক দেখা গেল কৃষ্ণনগরে এআইকেএম’এর সদ্য সমাপ্ত রাজ্য সম্মেলনে। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত প্রতিনিধিরা উগড়ে দিলেন তাঁদের রোষের কথা, চিহ্নিত করলেন আগামী লড়াইয়ের দাবি ও সম্ভাবনাকে।
নদীয়ার এক বর্ষীয়ান কৃষক নেতা বললেন, “পলাশী চিনিকলটি দীর্ঘ প্রায় দশ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। খৈতান গোষ্ঠী মিল চালাবে বলে হাজার হাজার বিঘা সরকারি জমি নিজেদের হেফাজতে নিয়েছিল। এক সময় ওই সমস্ত জমিতে বহু কৃষক আখ চাষ করে মিলে সাপ্লাই করত। খৈতান গোষ্ঠী পালিয়ে যাওয়ায় বহু শ্রমিক যেমন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তেমনি কৃষকদের উচ্ছেদ করে শাসকদলের মদতে কৃষি জমিতে বিল্ডিং ও রিসর্ট তৈরি হচ্ছে।” তাঁর প্রস্তাব, হয় ওই জমিতে চিনি কল আবার চালু করতে হবে নতুবা হাজার হাজার বিঘা সরকারি জমিতে অন্যান্য কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন করা হোক।
নদীয়ারই আর এক কৃষক বলেন, “চরমহৎপুর এলাকায় এক সময় পার্টি ও কৃষক সমিতি নদীচরের ৪০০ বিঘা জমি উদ্ধার করে গরিবদের বসতি স্থাপন করেছিলেন ও ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করেছিলেন। বাম আমলেই ওই জমি গ্রাস করার জন্য মাফিয়ারা সক্রিয় হয়। তৃণমূল আমলে তারা বসতি উচ্ছেদ করে দেয়। ভূমিহীন কৃষকদের চাষ করা জমির ধান তারা কেটে নিতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। একজন কৃষক শহীদ হন। ওই জমি পুনরুদ্ধার ও গরিব কৃষকদের নামে রেকর্ড করানোর আইনি লড়াই চললেও জমি মাফিয়াদের তাড়িয়ে দিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য এআইকেএম-কে দৃঢ়পণ উদ্যোগ নিতে হবে।”
পূর্ব বর্ধমান ও ঝাড়গ্রামের একাধিক প্রতিনিধি নদী ও খাল সংস্কারের গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, “মজা নদীগুলি জরুরিভিত্তিতে সংস্কার করলে নদীগুলির নাব্যতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে বর্ষায় বন্যা পরিস্থিতির হাত থেকে গ্রামগুলিকে যেমন বাঁচানো যাবে তেমনি খরার সময় সেচের ব্যবস্থাও সহজ হবে।” তাঁরা নির্দিষ্ট দাবি তোলেন, “অবিলম্বে অচল আরএলআই-এর পাম্পগুলিকে সচল করার জন্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে”।
বাঁকুড়া ও দার্জিলিং’এর প্রতিনিধিরা ফরেস্ট ল্যান্ডে (বনের জমি) যেসব আদিবাসীরা দীর্ঘদিন চাষ আবাদ করছেন তাদের উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র বন্ধ করে, তাদের পাট্টা দেওয়ার জন্য সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা রাজ্য সরকার কর্তৃক সস্তায় সার ও বীজ সরবরাহের দাবিও তুলে ধরেন।
মুর্শিদাবাদের এক প্রতিনিধি জানান, “আদানি গোষ্ঠী বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের বরাত পেয়েছে। এজন্য ফরাক্কা এলাকায় অতি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুতের টাওয়ার বসানো হচ্ছে। বহু গাছ কাটা পড়ছে। অনেককে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। আম, লিচু, ফলের বাগান সহ উদ্যান চাষ এই এলাকায় বিপর্যস্ত হচ্ছে।” এভাবে ওই এলাকায় কৃষক ও কৃষিজীবী মানুষের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার গুরুত্ব তিনি তুলে ধরেন।
হুগলীর এক গরিব আদিবাসী কৃষক চুক্তি চাষিদের সরকারি স্বীকৃতির দাবি জানালেন। তিনি বললেন, “ভূমিহীন গরিব চাষি জমির মালিকের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসল দেওয়ার শর্তে জমি ঠিকায় চাষ করেন। জমির মালিক একদিকে গরিবের কাছ থেকে ‘ভূমি খাজনা’ আদায় করে অন্যদিকে সরকারের ঘর থেকে ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের টাকা থেকে শুরু করে কৃষি ঋণের সুযোগ — সবই ভোগ করেন। সুতরাং গরিব ঠিকা চাষিকেও কৃষক হিসেবে নথিভুক্ত করে সরকারি ঋণ ও অর্থ সাহায্যের সুযোগ দিতে হবে।”
পূর্ব মেদিনীপুরের এক মৎস্যচাষি বলেন, “সরকার মৎস্যজীবীদের জন্য নানা সাহায্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার লক্ষ লক্ষ মৎস্যচাষির এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না।” তিনি বলেন, “মৎস্যচাষিদের সস্তায় ঋণদান সহ একপ্রস্থ দাবিতে এআইকেএম’এর বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন”।
সবশেষে নদীয়ার এক প্রতিনিধি বলেন, “করতে হবে নয়, আমরা করেছি। তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমরা লাগাতার রুখে দাঁড়িয়েছি।” তুমুল হর্ষধ্বনির মাঝে তিনি ঘোষণা করেন, “গায়ের জোরে একদিন টিএমসি যে পঞ্চায়েতের দখল নিয়েছিল, এবার কৃষকদের মিলিত প্রতিরোধের ফলে সেই পঞ্চায়েত আবার লড়াকু জনগণ পুনরুদ্ধার করবে।” বলা বাহুল্য, এই প্রত্যয়ই ছিল সম্মেলনের সার নির্যাস।
- মুকুল কুমার