প্রতিবেদন
মুনলাইটিং-এর বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা প্রসঙ্গে
against moonlighting

লেখার শুরুতে আসুন জেনে নিই, ‘মুনলাইটিং’ কী! একটি সংস্থায় নিয়মিত স্থায়ী কাজ করার পরের ফাঁকা সময় অন্য কোনও সংস্থায় অস্থায়ী কাজ করাকে কর্পোরেট ভাষায় বলা হয় মুনলাইটিং। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মীরা অনেকেই এই পদ্ধতিতে একইসাথে দুটো কোম্পানিতে কাজ করছেন। অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে অতি দ্রুত এই পদ্ধতির বিস্তার ঘটেছে। বর্তমানে কর্মসংস্থাগুলো থেকে মুনলাইটিং নিয়ে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ ফ্রিল্যান্সিং’এর গল্প ফুরোলো, নটে গাছটি মুড়োলো। ধরা যাক, পাঁচজনের পরিবারে আপনিই একমাত্র রোজগেরে। আপনার মাইনের টাকায় টেনেটুনে গোটা সংসার চলে। আর সেই সংসারের দোসরের নাম অভাব। আপনি ভাবছেন অভাবের দরুন ছুটির দিনে বা অফিসের পর অন্য কোনও প্রোজেক্টে কাজ করে, বাড়তি দু’ঘণ্টা খেটে দু’চার পয়সা ঘরে আনবেন? সে’গুড়ে বালি! তাতেও মালিকপক্ষ নারাজ।

সম্প্রতি উইপ্রো কোম্পানির মালিক ঋষদ প্রেমজি প্রায় ৩০০ জন শ্রমিককে মুনলাইটিং’এর অভিযোগে রাতারাতি ছাঁটাই করেছেন। ইনফোসিস’এর পক্ষ থেকে কর্মীদের প্রতি কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ইনফোসিস’এ কাজ করাকালীন অন্য কোনও সংস্থায় কাজ করা যাবেনা। এতে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের সম্ভাবনা থাকে। মুনলাইটিং’এর পদ্ধতিকে আইবিএম বলেছে অনৈতিক। কারণ মুনলাইটিং কালচারে কোম্পানির সাথে প্রতারণা করা কর্মীদের পক্ষে সহজ। সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখে ইনফোসিস’এর পক্ষ থেকে মেইল পাঠিয়ে কর্মীদের সতর্ক করা হয়, যদি কেউ ইনফোসিস বাদে দ্বিতীয় কোনও সংস্থার সাথে যুক্ত থাকে, তাহলে তাকে ইনফোসিস থেকে বরখাস্ত করা হবে। দেশের সর্ববৃহৎ আইটি সংস্থা টাটা কন্সালটেন্সি সার্ভিস মুনলাইটিং নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। টেক মাহিন্দ্রার পক্ষ থেকেও আনন্দ মাহিন্দ্রা মুনলাইটিং পদ্ধতির বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন৷

কর্পোরেট সংস্থার বেশিরভাগ মালিকেরা মনে করেন, মুনলাইটিং পদ্ধতি অনুসরণ করলে কর্মীদের শ্রমশক্তি, কর্মদক্ষতা ও উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাবে। সুতরাং, একইসঙ্গে একাধিক সংস্থায় কাজ করার অধিকার পাবে না শ্রমিকেরা। অন্যদিকে, কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্বে আর্থিক মন্দা এক ভয়ানক রূপ নিয়েছে। ফলত তথপ্রযুক্তি সংস্থাগুলিতেও তার প্রভাব পড়েছে। ভারতে ১২ হাজারের বেশি আইটি কর্মী কাজ হারিয়েছেন। আমেরিকায় সংখ্যাটা প্রায় এর দ্বিগুণ। ইতিমধ্যেই ভারতে ওলা, বাইজু’স, বেদান্ত, আনঅ্যাকাডেমির মতো সংস্থাগুলোতে নিয়োগ কমানো হয়েছে। বিনা নোটিসে কাজ হারিয়েছেন লক্ষ লক্ষ যুব। দেশের যুবক-যুবতীরা বাধ্য হয়ে পড়াশোনা মাঝপথে স্থগিত করে গিগ ওয়ার্কারে পরিণত হয়েছে। কর্পোরেট সংস্থাগুলোতে কর্মীদের আট ঘণ্টার বদলে দশ-বারো ঘণ্টা ধরে কাজ করানো হয়। যার ফলে দিনের পর দিন শ্রমিকের স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে। জোম্যাটো, সুইগির ডেলিভারি দিতে গিয়ে দুর্ঘটনায় আহত, এমনকি মৃত্যুর খবরও প্রায়শই আমাদের কাছে পৌঁছোয়। অর্থাৎ বলাবাহুল্য, দেশের তরুণ প্রজন্ম এভাবেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে।

সংগঠিত ক্ষেত্রগুলোব্যয় কমাতে স্থায়ী শ্রমিক নেওয়া কমাচ্ছে। পাশাপাশি, অসংগঠিত ক্ষেত্রে অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অস্থায়ী শ্রমিকদের স্বল্পমূল্যের শ্রমে বড় বড় সংস্থাগুলো চললেও তাদের শ্রমিকের স্বীকৃতিটুকু দেওয়া হয় না। সুরক্ষা ও আইনি অধিকার তো দূরস্থ!

মোদী জামানায় ভারত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ বেকারত্বের রেকর্ড গড়েছে। নতুন শ্রম আইন কর্পোরেটদের ঠোঁটে হাসি এনে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ট্রেড ইউনিয়নগুলো একজোট হয়ে শ্রমিকের ন্যায্য দাবিসমূহ সুনিশ্চিত করতে নয়া শ্রম আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন জারি রেখেছে। মুনলাইটিং পদ্ধতিতে শ্রমিকেরা স্বেচ্ছায় একাধিক সংস্থায় কাজ করে না। পেটের দায়ে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে তারা বাধ্য হয়৷ দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও মুদ্রাস্ফীতি তার অন্যতম কারণ। শ্রমিকের নূন্যতম চাহিদা পূরণে ব্যর্থ কর্পোরেট সংস্থার মালিকেরা যেভাবে কর্মী ছাঁটাই করছে, সেই ঘটনা মধ্যযুগীয় বর্বরতার সুস্পষ্ট উদাহরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। এ যেন এক নতুন দাসপ্রথার উত্থান!

পরিশেষে বলা যায়, এই সুবিধাভোগী পুঁজিপতিদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে এখনও সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে আগামীদিনে শ্রমিক শ্রেণীর ভবিষ্যৎ কালের গভীরে তলিয়ে যাবে। কৃষক-শ্রমিকেরা দেশের সম্পদ। তাদের ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে ঠেলতে থাকলে এরপর দেশ চালাবে কারা? নতুন প্রজন্মের প্রশ্নের মুখে পড়ে আপনি-আমি কী জবাব দেব, ভেবেছেন?

- ত্রিয়াশা

খণ্ড-29
সংখ্যা-38