মাহসা আমিনি, ২২ বছর বয়সী ইরানি তরুণীর মৃত্যু হয়েছে ইরানের ‘নীতি পুলিশ’-দের নির্ধারিত পোশাক-বিধি উপেক্ষা করার অপরাধে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর, তেহরান যাওয়ার পথে ইরানের ‘নীতি-পুলিশ’রা আটক করে মাহসাকে। ইরানের মেয়েদের জন্য মৌলবাদী রাষ্ট্রের ঠিক করে দেওয়া পোশাক-বিধির পাঠ পড়াতে ও গুরুত্ব বোঝাতে তৈরি হয়েছে কুখ্যাত ডিটেনশন সেন্টার ‘ভোযারা’। আটক করার পর, মাহসাকে নিয়ে আসা হয় এই ডিটেনশন ক্যাম্পে। শালীনতার শিক্ষা হিসাবে মাহসার উপর চলে অকথ্য অত্যাচার। ১৬ সেপ্টেম্বর, মাহসা মারা যান। তার শরীরে আঘাতের দাগ স্পষ্ট। মারের চোটে, শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষত-বিক্ষত। ইরানের পুলিশ বলছে, মাহসা মারা গেছেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে।
১৯৭৯ সালে ইরানে ক্ষমতায় আসার পর ইসলামপন্থী মৌলবাদীরা কঠোর ‘পোশাক-বিধি’ জারি করেছে সেই দেশের মেয়েদের উপর। ইরানের মেয়েরা সেই সময় থেকেই রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া পোশাক বিধির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছেন। ১২ জুলাই দিনটিকে ইরানের মৌলবাদী রাষ্ট্র-শক্তি ‘হিজাব ও সতীত্ব’ রক্ষার জাতীয় দিবস নামে পালন করে। এই বছর, ১২ জুলাই, ইরানের বিভিন্ন জায়গায়, জন-সমক্ষে সমবেত হয়ে মেয়েরা হিজাব খুলে প্রতিবাদ জানায় চুড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক নীতি-পুলিশের বিরুদ্ধে। এর ফলে তাদের উপর নেমে এসেছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। এককথায়, এই প্রতিবাদী মেয়েদের ‘উইচ-হান্ট’ করে কঠোর শাস্তির মুখে ঠেলে দিয়েছে ইরানের সরকার।
মাহসার মৃত্যুর নিন্দা ও প্রতিবাদ বিশ্ব-জুড়ে চলছে। অনেকে বলছেন, “হিজাব কারোর পছন্দ হতে পারে না, মাহসার মৃত্যুই তার প্রমাণ”। না জনাব। বরং মানসার মৃত্যু দেখিয়ে দেয় মেয়েদের শরীর ও পোশাকের উপর বিধি-বিধান চাপানোর ভয়াবহতা। ঠিক যেভাবে, আমাদের দেশে, মেয়েদের হিজাব না পরার ফতোয়া চাপিয়ে দিচ্ছে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র ও তাদের দোসর প্রতিষ্ঠানগুলি, একইভাবে ইরানের মৌলবাদী শাসকরা ঠিক করে দিচ্ছে মেয়েদের পোশাকবিধি। হিজাব জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যতটা অপরাধ ঠিক ততটাই অপরাধ হিজাব পরার অধিকার কেড়ে নেওয়া। কারণ উভয় ক্ষেত্রেই, মেয়েদের শরীরের উপর হস্তক্ষেপ করছে রাষ্ট্র ও সমাজ।
আসলে, মেয়েদের স্বাধীনতাকে ভয় পান অনেকেই। এমনকি বিভিন্ন প্রগতিশীল মহিলা সমিতির আলাপ-আলোচনাতে, লিঙ্গসাম্যের আন্দোলনের পরিসরেও মেয়েদের স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে “স্বেচ্ছাচারিতার” আশংকা প্রকাশ করতে দেখা যায় আন্দোলনের কর্মীদের। মেয়েদের বিশৃঙ্খলতায় চরাচর ভেসে যাওয়ার ভয়ে স্বাধীনতার সীমানা টানতে বসেন সমাজের মাতব্বরেরা। কখনো শালীনতা, কখনো রুচি, কখনো ভদ্রতা, কখনো পরিবারের সম্মানের নামে ব্যাক্তি মানুষের স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারের মাঝে সীমা টানে সমষ্টি, সমাজ, রাষ্ট্র। এই সীমারেখার কোপে, আজও কত মেয়ে কাজ থেকে বাড়ি ফিরতে দেরী হলে বরের হাতে অকথ্য মার খায়। পাড়ার দাদাদের টোন-টিটিকিরির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মেয়ের স্পর্ধা দেখে পাড়ায় রটে – ‘এ মেয়ে বড়োই স্বেচ্ছাচারী’। সিগারেট খেলে শুনতে হয় সাবধানবাণী – ‘প্রজননের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে কিন্তু!’। ঠিক যতটা সীমা পর্যন্ত স্বাধীনতায় আঘাত লাগে না পারিবারিক মূল্যবোধে, টলে না পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো, আঁচড় পড়ে না জাতি-দম্ভে, ঠিক যতটা ফুলে-ফেঁপে ওঠে শাসকশ্রেণীর আচার, রুচি ও ভদ্রতার সংজ্ঞা – ঠিক সেইখানেই নির্ধারিত হয়ে যায় স্বাধীনতার সীমারেখা। দেশ, কাল, সময়, স্থান ভেদে এই সীমারেখা তৈরি করে নীতি-পুলিশরা।
মাহসার মৃত্যুর প্রতিবাদ করতে হলে, পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা আর নীতি-পুলিশিকে হারাতে হলে, মেয়েদের পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসাবে ভাবতে শিখুন। মেয়েদের ব্যাক্তি স্বাধীনতাকে সম্মান করা খুব সহজ,
– সম্প্রীতি মুখার্জী