ডোল বা খয়রাতির বিরুদ্ধে প্রচার ভারতীয় জনতা পার্টির অন্যতম প্রিয় অস্ত্র। কেবল তাই নয়, ভর্তুকি ও খয়রাতি উভয়ের বিরুদ্ধেই বিজেপি খড়্গহস্ত। ভারতীয় জনতা পার্টির সমর্থক সদস্যরা প্রত্যক্ষ কর দেননা এটা কোনো সমীক্ষা ছাড়াই বলা যেতে পারে, কিন্তু পার্টির প্রচার-প্রোপাগান্ডায় করের টাকায় ভর্তুকি বা খয়রাতি দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রবল জনমত তৈরি করা হয়ে থাকে, সেই জনমতের প্রভাব এমন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, যে প্রাপক ভর্তুকি বা খয়রাতি নিচ্ছেন ভেবে লজ্জা পেতে পারেন, তিনি যেন পরগাছা। সেই প্রচারের মাধ্যমে খয়রাতির বিষয়টিকে এতটাই আপাত গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা গেছে যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ২০১৩ সালের সুব্রহ্মনিয়াম বালাজি বনাম তামিলনাড়ু রাজ্য সরকারের মামলায় দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনার জন্য ৩ জন বিচারকের বেঞ্চের সামনে পেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পূর্বোক্ত মামলায় সর্বোচ্চ আদালতের রায় ছিল যে, নির্বাচনের সময়ে, জয়ী হলে বিবিধ আর্থিক সুবিধা বা ভোগ্যপণ্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দুর্নীতি হিসেবে সাব্যস্ত হবে না। ওই রায় পুনর্বিবেচনা করা হবে।
মূলত, প্রধানমন্ত্রী মোদীর দেশের রাজনীতির শব্দভান্ডারে নবতম সংযোজন ‘রেউড়ি সংস্কৃতি’র তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মোদীজির মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। ঘুঁটি যথাবিহিত সাজানো হয়েছিল, বিজেপির একজন কর্মকর্তা শীর্ষ আদালতে খয়রাতি বা ‘ফ্রিবি’র বিরুদ্ধে মামলা ঠুকলেন। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ সেই মামলা শুনলেন, মন্তব্য করলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য শুনতে চাইলেন, ভর্তুকি ও ‘ফ্রিবি’র মধ্যে পার্থক্য টানার জন্য কোনো কমিটি করা যায় কিনা তা নিয়ে কথা বললেন ও সবশেষে তিনজন বিচারকের বেঞ্চের কাছে মামলাটি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
মোদীজির ‘রেউড়ি’ ভাষণের আগেই এব্যাপারে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক একধাপ অগ্রসর হয়েছিল। জুন মাসের ব্যাঙ্কের বুলেটিনে, ‘রাজ্যের আর্থিক ঝুঁকি বিশ্লেষণ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে ভরতুকি (সাবসিডি) ও খয়রাতি (ফ্রিবি)র মধ্যে তফাৎ করতে চেষ্টা করে বলে যে, দু’টির মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ নেই, তবুও ভর্তুকি বলতে বোঝায় যা অর্থনৈতিক লাভ দেয় যেমন গণবন্টন, কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের জন্য সহায়তা। অন্যদিকে ফ্রিবি বলতে বোঝায়, বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, পরিবহণ, জল, কৃষিঋণ মকুব ইত্যাদি। একইসঙ্গে ওই নিবন্ধে রাজ্যগুলির ২০২২-২৩ সালের বাজেটে অনুরূপ ফ্রিবির উপরে খরচার তথ্য সঙ্কলন করা হয়। চিন্তার বিষয় হল, যে সমস্ত প্রকল্পগুলিকে ওই ফ্রিবির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেগুলির বেশিরভাগই কৃষক, শিশু, মহিলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের অগ্রগতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে যে, কী ধরনের অর্থনীতির ভাবনা ওই নিবন্ধে প্রতিফলিত হচ্ছে, কল্যাণমূলক অর্থনীতি না পরিপূর্ণ মুক্ত অর্থনীতি?
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বেশ কিছু রাজ্যের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। রাজ্যগুলির ফ্রিবি দেওয়া নিয়ে, বা ঋণ-জিএসডিপি (মোট রাজ্যের আভ্যন্তরীণ উৎপাদন) অনুপাত নিয়ে। রাজ্যগুলি ১ লক্ষ কোটি টাকার উপরে অনুরূপ খয়রাতিতে ব্যয় করছে। ফলে রাজ্যগুলির স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে পড়ছে। কিন্তু গত ৫ বছরে যে ১০ লক্ষ কোটি টাকার উপরে ঋণ মকুব করেছে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলি সেটা খুব বিবেচ্য নয়। কেবলমাত্র ১০ জন বৃহৎ ঋণখেলাপির খেলাপের পরিমাণ ৩৭ হাজার কোটি টাকার বেশি যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মেহুলভাইও রয়েছে, যার খেলাপ ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি।
কথায় বলে যার নাম চালভাজা তারই নাম মুড়ি। তেমনি ভরতুকি, খয়রাতি, সাবসিডি বা ফ্রিবি এগুলির মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ করা যায়না। যেটা বলা যায় সেটা হল, নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কোনটা কাঙ্খিত, কোনটা অনাবশ্যক, এটুকুই। তথাপি, নব উদারনীতির চরম ভারতীয় প্রবক্তা বিজেপি প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম দিয়ে এমন ধারণা সৃষ্টিতে খানিকটা সক্ষম হয়েছে যে, ভর্তুকি ও খয়রাতি বিষয়টিই অর্থনীতির পক্ষে বিষ। এরাজ্যের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকতো এরাজ্যের সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকায় খয়রাতিকে নিম্নস্তরের ভারসাম্যের ফাঁদ হিসেবেই চিহ্নিত করলেন। লেখার ধরণ দেখে মনে হয় তিনি বিজেপি সমর্থক। ওদিকে তার প্রিয় দল দেশে তুমুল অর্থনৈতিক বৃদ্ধির রাস্তায় হাঁটছেন বলে প্রচার করছে, আর বিদগ্ধ অধ্যাপক নিম্নস্তরের ভারসাম্যের ফাঁদ (লো লেভেল ইকুইলিব্রিয়াম ট্র্যাপ)-এর গল্প ফাঁদছেন।
ভর্তুকি বা খয়রাতি তদর্থে আয় বা সম্পদ পুনর্বন্টনের একটি উপায়, সাধারণত ধনীর আয় বা সম্পদের উপর কর বসিয়ে তা সকলের মধ্যে (ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে) বেঁটে দিলেও আয়ের পুনর্বন্টন হয়, ধনীর আয় বা সম্পদ কমে, গরিবের বাড়ে। যেমন সকলের জন্য গণবন্টনে খাদ্যশস্য যথেষ্ট পরিমাণে দিলে কালোবাজারে শস্য বিক্রির কোনো অবকাশ থাকে না। কেননা, সকলেই সেই শস্য যথেষ্ট পরিমাণে পায় বলে কেনার লোক থাকবে না। অন্যদিকে যে ধনী মানুষটির ওই সাধারণের জন্য খাদ্যশস্য ভক্ষণের ইচ্ছে থাকবে না তিনি বাজার থেকে ‘উৎকৃষ্ট’ মানের শস্য কিনতেই পারেন। কিন্তু সরকার তা না করে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য গণবন্টন বা রেশনের বন্দোবস্ত করায়, ওই বন্টনের আওতা থেকে অনেকে বাদ চলে যায় যাদের সস্তায় শস্যের প্রয়োজন রয়েছে, তাঁরা কালোবাজার থেকে ওই শস্য কেনেন। নির্দিষ্ট আয়ের উপরের লোকেদের গণবন্টনের আওতা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য সরকার কম রাজস্বের বা রাজস্বকে অন্য প্রয়োজনীয় খাতে ব্যবহারের যুক্তি দেখায়। আদতে সরকার ও শাসক দল তাদের পৃষ্ঠপোষক ধনী কর্পোরেট বা ব্যক্তিদের উপরে কর না চাপানোর জন্যই এমনটা করে থাকে। আর তারজন্য ভর্তুকি বা খয়রাতির বিরুদ্ধে ক্রমাগত জনমত তৈরি করে থাকে, সেই জনমত গড়ার কাজে শীর্ষ আদালতকেও টেনে আনা হল। আজ খয়রাতির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বন্ধ করা গেলে কাল আদালতের মাধ্যমে শিক্ষা স্বাস্থ্য গণবন্টন সর্বত্র ভর্তুকিও বন্ধ করা যাবে, বন্ধ করা যাবে কৃষিতে সার ভর্তুকি, কৃষকদের ও নিম্ন বিদ্যুত উপভোক্তাদের বিদ্যুতে ভর্তুকি। বন্ধ করা হবে বিনামূল্যে পানীয় জলের সুবিধে, কন্যাশ্রী বা সবুজসাথীর মতো প্রকল্প।
অনেকেই লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে বিত্তবান পরিবারের মহিলাদের টাকা নেওয়ার কথা বলে উপহাস করেন, তাদের মাথায় থাকে না বিত্তবানরা পেলেও ওই প্রকল্পে বিপুল সংখ্যক মহিলার কাছে ওই মাসিক ৫০০ বা ১,০০০ টাকা কতটা কাঙ্খিত! যেখানে দাবি হওয়া উচিত ওই খয়রাতির পরিমাণ আরো বাড়ানোর জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা, সেখানে প্রকল্পটিকেই নিন্দামন্দ করার অর্থ হয় না। বিজেপির যে কর্মকর্তা খয়রাতি বন্ধের জন্য মামলা করেছেন তিনি উদাহরণ হিসেবে ১০০ দিনের কাজের উল্লেখ করে বলেছেন যে, ওই প্রকল্পে কোনো কাজ হয় না, শ্রমিকরা আড্ডা মারে বা মোবাইলে খেলতে থাকে, ফলে টাকা নষ্ট হয় ও কাজের অভ্যেস চলে যায়। বোঝাই যাচ্ছে যে ১০০ দিনের কাজও বিজেপি তুলে দিতে চাইছে। খয়রাতি কাজের স্পৃহাকে নষ্ট করে বলে যে যুক্তি দেওয়া হয়, সেটিও অবান্তর। যদি সরকার সকলের জন্য উচিত পারিশ্রমিকে কাজের বন্দোবস্ত করতে পারে তাহলে তো ওই মাসিক ৫০০ টাকার খয়রাতি দেওয়ার বা নেওয়ার প্রশ্নই থাকে না। সকলের জন্য কাজ, অন্যথায় যথোচিত বেকার ভাতা তো দাবি হওয়া উচিত। যে বিজেপি সরকার ক্রমাগত বেকারি বাড়াচ্ছে তারাই আবার খয়রাতি বন্ধ করার বন্দোবস্ত করে কর্মহীনদের আরো ফ্যাসাদে ফেলতে চাইছে।
খয়রাতি বা ভর্তুকির অর্থ সংস্থানে সরকারগুলির উপর কত চাপ পড়ে এবং দেশ ও রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্য তাতে কত বিপন্ন হয় ভেবে যে সমস্ত গুণীজন চিন্তামগ্ন তাদের জ্ঞাতার্থে জানানো যেতে পারে, কেবল বিবিধ করছাড়ের মধ্য দিয়ে ২০১৯-২০ সালে কোম্পানিগুলিকে ১,৮৪,০০০ কোটি টাকার সুবিধে (খয়রাতি!) দেওয়া হয়েছিল। যারা কোম্পানির মালিকরা মেধা ও শ্রমের দ্বারা মুনাফা করে বলে কর বাড়ানোর বিরুদ্ধে, তাদের জানা উচিত বেশিরভাগ কোম্পানির মালিকরাই পূর্বপুরুষের সম্পত্তির উপরে ভর করে মুনাফা করে। বাণিজ্য শুরু করার ক্ষেত্রে সমান সুবিধে (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) বজায় রাখতে তাদের উচিত পূর্বপুরুষের অগাধ সম্পত্তির উপর কর দেওয়া। ধনীদের উচিত বার্ষিক সম্পদ কর দেওয়া। ১ শতাংশ সর্বোচ্চ ধনীর সম্পদে ২ শতাংশ হারে কর বসালে বছরে ৭.৫ লক্ষ কোটি টাকা পাওয়া যেতে পারে। যদি পূর্বপুরুষের থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তির উপরে কর বসানো হয়, তাহলেও প্রায় ২০ লক্ষ কোটি টাকা পাওয়া যেতে পারে। এইসব কর বসানো নিয়ে শীর্ষ আদালতে মামলা, সরকারের বক্তব্য ও আদালতের বেঞ্চ কবে গঠিত হয় সেটাই দেখার।
- অমিত দাশগুপ্ত