প্রতিবেদন
সাফুরা জারগরের বঞ্চনার পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা
Safura Zargar's deprivation

স্বাধীনতা ৭৫ দিবসে মোদী উবাচ :
মহিলাদের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন একুশ শতকের ভারত-বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ

সাফুরা জারগরকে নিশ্চয় মনে আছে। মোদী সরকারের বানানো সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দেশের নানা অংশেই যে জোরালো প্রতিবাদ উঠেছিল, রাজধানী দিল্লীতে সেই প্রতিবাদের পুরোভাগে ছিলেন সাফুরা জারগর। তারপর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটানো হল এবং দাঙ্গার তদন্তে কারচুপি ঘটিয়ে আরও অনেকের সঙ্গে সাফুরাকেও মিথ্যাভাবে ফাঁসিয়ে ইউএপিএ লাগিয়ে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছিল ঐ বছরের এপ্রিলে। তিনি তখন অন্তঃসত্ত্বা এবং সেই অবস্থাতেই কয়েক মাস জেলে কাটাতে হয়েছিল। সেই সাফুরা এখন আবার সংবাদের শিরোনামে এলেন তাঁর প্রতি জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বৈরী মনোভাব প্রসূত বৈষম্যের কারণে। সাফুরা সমাজতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণার জন্য জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে গবেষণার কাজ শেষ না হওয়ায় তিনি থিসিস জমা করতে পারেননি, এবং তা করার জন্য আর একটু সময় চান। সেই সময় তাঁকে দেওয়া হলনা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিভুক্ত গবেষক হিসাবে তাঁর নাম বাতিল করে দেওয়া হল।

প্রশ্নটা এখন অতএব হল — গবেষণা কাজ শেষ করার জন্য সাফুরাকে আর একটু সময় দেওয়া কি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে সম্ভব ছিল না? পাঁচটা সিমেস্টারের সময়কালের মধ্যে গবেষণার কাজ সমাপ্ত করার কথা। কিন্তু কোভিডের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে অন্যান্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে গবেষণা কাজও ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়েছিল। এবং সেই কারণে ইউজিসি ‘কোভিড এক্সটেনশন’ বা কোভিডের কারণে অতিরিক্ত কয়েকটা সিমেস্টারের সময় দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছিল। কিন্তু সাফুরার জন্য একটা সিমেস্টার বা ছ’মাসের মেয়াদ বৃদ্ধির পর আর সময় বাড়ানো হল না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৬ আগস্ট বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানালো — যাঁর অধীনে সাফুরা গবেষণা করছিলেন, সেই কুলবিন্দার কাউর জানিয়েছেন যে, গবেষণা কাজে তাঁর ‘অগ্ৰগতি অসন্তোষজনক’। এছাড়া, গবেষণার নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার আগে সাফুরা নারী স্কলার হিসাবে সময় বৃদ্ধির আবেদন জানাননি।

অতএব, তাঁর নথিভুক্তি বাতিল করা হবে বলে ৮ এপ্রিল ই’মেলে তাঁকে যা জানানো হয়েছিল, কর্তৃপক্ষ সেই পথেই গেলেন। সাফুরা জারগরের প্রতি এই প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব দেখানো ও এমফিল ডিগ্ৰি লাভ থেকে তাকে বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে জামিয়া মিলিয়া ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে এবং শিক্ষাক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত বহু বিদ্বজ্জনও কর্তৃপক্ষের নেওয়া পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন। এর জবাবে জামিয়া মিলিয়া কর্তৃপক্ষ সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের শেষে এক বিবৃতিতে জানায় যে, তাঁরা ‘মানবতার’ খাতিরে সাফুরাকে একটা সুযোগ দিয়েছিলেন যেটা সাফুরা গ্ৰহণ করেননি — “কোভিডের জন্য সময় সম্প্রসারণ কালে ও তারপরেও তাঁকে নারী স্কলার হিসাবে সময় সম্প্রসারণের আবেদন করতে বলা হয়েছিল যাতে সে তার গবেষণা শেষ করে সেটা জমা করতে পারে। কিন্তু সে সুপারভাইজার ও আরএসি’র (রেজিস্ট্রেশন আপিল কমিটি) এই পরামর্শে কান দেয়নি এবং নির্ধারিত সর্বোচ্চ সময়ের মধ্যে নারী স্কলার হিসাবে আবেদন জমা করেনি।” কর্তৃপক্ষের এই বিবৃতি কিন্তু তাদের দুরভিসন্ধিকে আড়াল করতে পারবে না। কর্তৃপক্ষ এই ধরনের কথাবার্তা বলছেন বলে সাফুরা ৩১ আগস্ট এক ওয়েব সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “সময় সম্প্রসারণের আমার আবেদনকে আট মাস ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং এখনও পর্যন্ত আমাকে সুস্পষ্টরূপে কিছু জানানো হয়নি।… ২০২১’র ডিসেম্বরে আমি কোভিডের জন্য সময় বাড়ানোর আর একটা আবেদন জমা দিই, যেটার সময় মাত্র দু’মাস বাড়িয়ে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা হয়।… ওরা যে অজুহাতগুলো দিচ্ছে, আমি মনে করি তার পিছনে ওরা চায় আমি আমার নথিভুক্তিকে বাতিল করে গবেষণার কাজ ছেড়ে দিই।” যে কর্তৃপক্ষ সময় সম্প্রসারণের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে লোক-দেখানো ভড়ং করে মাত্র দু’মাস সময় সম্প্রসারণ করেন, দীর্ঘ আট মাস ধরে আবেদনকে ঝুলিয়ে রাখেন, ‘মানবিকতার’ অনুসারী হওয়ার তাঁদের বচন এক কপট আখ্যান বলেই প্রতিভাত হচ্ছে।

সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে যে ছাপে সাফুরার পরিচিতিকে দাগানো হল, তাকে স্থায়ী করে রাখাটাই এই জমানার নিয়ম হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার যে বৈশিষ্ট্য আজকের কেন্দ্রীয় শাসকদের ট্রেড মার্ক হয়ে উঠেছে, জামিয়া কর্তৃপক্ষও নিজেদের তার অংশিদার করে তুলেছেন। নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি জমানায় কোনো প্রতিষ্ঠানেরই যেমন নিরপেক্ষতার লেশমাত্র নেই, জামিয়া কর্তৃপক্ষও সেই ধারারই অনুসারী মাত্র। ফলে, সাফুরাদের হতে হয় বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। এই জমানায় নারীদের প্রতিদিনই যে বেইজ্জতি, মর্যাদা হানি, লাঞ্ছনা, ন্যায়বিচারের বঞ্চনার মুখে পড়তে হচ্ছে তা নারী শক্তির বাস্তবায়নের নরেন্দ্র মোদীর প্রতিশ্রুতিকে উপহাস করে চলেছে। নারী শক্তির আত্মঘোষণায় রাষ্ট্রের সহায়তা বর্জিত হয়ে, নরেন্দ্র মোদীর ছলনাকে অতিক্রম করে নারীদের নিজেদেরই আত্মপ্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যেতে হচ্ছে। দিল্লী দাঙ্গার তদন্তে সাফুরা জারগরদের স্বীকারোক্তি বলে যে রিপোর্টে পুলিশ তাদের সই করতে বলেছিল, লক্ষণীয় সাহসিকতার সাক্ষর রেখে সাফুরা জারগর, দেবাঙ্গনা কলিতা ও নাতাশা নারোয়াল তাতে লিখেছিলেন, “সই করতে অস্বীকার করছি”। এমফিল সম্পূর্ণ করা থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরও সাফুরা আজ বলছেন, “ওরা আমার মন ভাঙলেও মনোবলকে ভাঙতে পারবে না”। সাফুরা জারগরের নির্ভীকতা ও আত্মপ্রত্যয়কে সেলাম!

খণ্ড-29
সংখ্যা-36