(পেরিয়ারের জন্মদিন ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর। এই দিনটিকে মনে রেখে সেপ্টেম্বর মাসের দু’টি সংখ্যা জুড়ে আমরা পেরিয়ার সম্পর্কিত এই নিবন্ধটি প্রকাশ করছি। এটি দ্বিতীয় পর্ব। – সম্পাদকমণ্ডলী)
রামাস্বামীর রাজনৈতিক জীবনে আমরা বারবার বাঁক বদল লক্ষ্য করি। যে ব্রিটিশ সরকারের শাসন নিয়ে এক সময় রামাস্বামীর বিশেষ কোনো মাথাব্যথাই ছিল না, পরবর্তীকালে আমরা দেখি এই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তিনি জেলে গেছেন। আবার ১৯২৫’র পর লক্ষ্য করা গেল এই সময় তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রচার কিছুটা হ্রাস করেন এবং আবার নিম্নবর্গীয়দের সংরক্ষণ এবং দ্রাবিড় জাতির উপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে মনোনিবেশ করেন। এরপরেই আত্মমর্যাদা লীগের মধ্যে ভাঙ্গন দেখা যায় এবং ১৯৩৫’র নভেম্বরে যে জাস্টিস পার্টির সঙ্গে একসময় তার যথেষ্ট মতবিরোধ তৈরি হয়েছিল সেই জাস্টিস পার্টির তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। জাস্টিস পার্টির সহায়তায় ১৯৩৫’র পয়লা জুন তিনি প্রকাশ করলেন ‘ভিদুথালাই’ বা স্বাধীনতা নামে একটি তামিল সাপ্তাহিক পত্রিকা, যা পরে দৈনিক সংবাদপত্র রূপে প্রকাশিত হতে থাকে। এই পত্রিকাই পরবর্তীকালে দ্রাবিড় জাতির মধ্যে পৃথক স্বাধীন দ্রাবিড়নাড়ুর বীজ রোপন করেছিল। ১৯৩৫এ রামাস্বামী দ্রাবিড় জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা সামনে নিয়ে আসতে লাগলেন। বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হলেন আর্য অপেক্ষা দ্রাবিড়রা অনেক পুরনো এবং সাংস্কৃতিকভাবে অনেক উন্নত একটি জাতিসত্তা এবং তামিল ভাষা ভারতীয় ভূখণ্ডের একটি প্রাচীন ভাষা। ১৯৩৭’র জুলাইয়ে মাদ্রাজ প্রদেশে কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসে। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তামিল ব্রাহ্মণ শ্রী রাজাগোপালচারী। ক্ষমতায় এসেই তিনি প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রমে হিন্দি ভাষাকে বাধ্যতামূলক করার সার্কুলার জারি করেন। সারা দক্ষিণ ভারত এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং এই ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে রামাস্বামী তার বিরোধী শক্তিগুলোকেও তার আন্দোলনে শামিল করতে সমর্থ হন। এই আন্দোলনের তীব্রতা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় এবং সমস্ত তামিল জনগণ যেভাবে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে তাতে কংগ্রেস সরকার পিছু হটে হিন্দিকে একটি ঐচ্ছিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেন। এই আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। প্রসঙ্গত ১৯৩৮ ডিসেম্বরে রামাস্বামী জেলে থাকার সময়ই তামিলনাড়ুর প্রগ্রেসিভ ওমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে তার প্রতি সম্মান জানিয়ে তাকে ‘পেরিয়ার’ বলে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। ‘পেরিয়ার’ শব্দটির অর্থ ‘মহামানব’। হিন্দি ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিবাদ পৃথক দ্রাবিড়নাড়ুর বিষয়টিকেও সামনে এনে দেয়। ১৯৩৭ “তামিলনাড়ু তামিলদের জন্য” এই স্লোগান তামিলদের জাত্যাভিমানকে জাগিয়ে তুলেছিল। ১৯৩৭-এ জাস্টিস পার্টির উদ্যোগে ভেলোরে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে পৃথক অঞ্চল সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। এই সময়ের পর থেকে আমরা দেখছি রামাস্বামী সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের থেকে জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক আন্দোলনকে বেশি গুরুত্বপূর্ণবলে মনে করেছিলেন। এই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল, রামাস্বামী মনে করেছিলেন ব্রিটিশদের পক্ষে থাকলে দ্রাবিড়নাড়ু আদায় করা সহজ হবে। এরপর যখন ক্রিপস মিশন ভারতে আসে তিনি কমিটির প্রধান স্ট্যান্ড ফর স্ট্যান্ডফোর্ডক্রিপস’এর কাছে পৃথক ও স্বাধীন দ্রাবিড়নাড়ুর দাবি পেশের জন্য প্রতিনিধি পাঠান। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাস্টিস পার্টির সঙ্গে রামাস্বামীর মতবিরোধ শুরু হয় এবং সিএন আন্নাদুরাই জাস্টিস পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই বিতর্কিত পরিস্থিতিতেই ১৯৪৪’র জুলাইয়ে রামাস্বামীর নেতৃত্বে সালেমে জাস্টিস পার্টি ও আত্মমর্যাদা আন্দোলনের যৌথ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং জাস্টিস পার্টির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় দ্রাবিড় কাজাগম বা দ্রাবিড় সমিতি। এই সময়টা রামাস্বামীর পক্ষে একদমই অনুকূল ছিল না। নানান রকম অভিযোগে তিনি জর্জরিত হচ্ছিলেন। তারমধ্যেই তিনি পৃথক দ্রাবিড়নাড়ুর দাবিতে এগিয়ে যান। এবং ভারত রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন একটি স্বাধীন সার্বভৌম দ্রাবিড় প্রজাতন্ত্রের দাবি তামিল জনগণের সামনে হাজির করেন। দ্রাবিড় জাতিসত্তার মুক্তি আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে রামাস্বামী দ্রাবিড় কাজাঘামের সকল সদস্যকে কালো জামা পড়তে উৎসাহিত করেন কিন্তু এটা নিয়েও শুরু হয় বিতর্ক এরপর তিনি ১৯৪৭’র ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনকে বয়কট করার ডাক দেন এবং বলেন এই স্বাধীনতা তামিলদের জন্য নয়। তামিলদের কাছে এটা একটা অশুভ দিবস। এই স্বাধীনতা আর কিছুই নয় আসলে ব্রিটিশদের হাত থেকে ব্রাহ্মণ ও বেনিয়াদের হাতে শাসন ক্ষমতার হস্তান্তর। তথাকথিত স্বাধীন ভারতে রামাস্বামী তামিল আব্রাহ্মণদের মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। এই সময় মাদ্রাজ হাইকোর্ট একটি রায়ে তামিলনাড়ুতে তপশিলি জাত ও জাতির জন্য যে সংরক্ষণ চালু ছিল তা সংবিধানের পরিপন্থী বলে ঘোষণা করে। এর বিরুদ্ধে রামাস্বামী ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং কংগ্রেস ১৮ জুন ১৯৫১ সালে সংবিধানে প্রথম সংশোধন করে তপশিলভূক্ত জাত-জাতির জন্য সরকারি শিক্ষা চাকরি ও অন্যান্য পদে সংরক্ষণ পুনর্বহাল করে। এ’ভাবে স্বাধীন ভারতের প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলনে পেরিয়ার রামাস্বামী সফল হন। এই সময় ১৯৫৫ অক্টোবরে ভারতের রাজ্যগুলোর সীমানা নির্ধারণের জন্য বিচারপতি ফজল আলীর নেতৃত্বে তৈরি হয় রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন। দক্ষিণের রাজ্যগুলো নিয়ে দক্ষিণপ্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা নেয় কংগ্রেস। পেরিয়ার রামাস্বামী সরাসরি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন, কিন্তু তার সেই দাবি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় না। এই সময়েই দ্রাবিড় কাজাগামের স্বাধীন দ্রাবিড়নাড়ুর দাবি ভাষা-ভিত্তিক রাজ্য তামিলনাড়ুর দিকে ঘুরে যায়। ১৯৫৭ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর কংগ্রেস বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসে। এই সময় পেরিয়ার রামাস্বামী জাতপাত অস্পৃশ্যতা উৎখাতের লক্ষ্যে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রকাশ্যেই জাতপাত প্রকাশ করে এই ধরনের সমস্ত চিহ্ন বর্জন করার আহ্বান জানান। ব্রাহ্মণদের পৈতে পড়ার বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। প্রকাশ্য জনসমাবেশে বলতে থাকেন জাতপাতের বিনাশের প্রথম পদক্ষেপ হলো সেই সমস্ত চিহ্নগুলো ছুঁড়ে ফেলা যা একজনের জাত প্রকাশ করে। এই আন্দোলনের জন্য সমস্ত রকম আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং একমাত্র তাহলেই আগামী প্রজন্ম জাতপাত ব্যবস্থার অশুভ কবল থেকে মুক্ত হতে পারবে। কংগ্রেস সেই সময় দ্রাবিড় কাজাগমকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে। কংগ্রেসের এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে রামাস্বামী সারা রাজ্যজুড়ে গান্ধীমূর্তি ভাঙার ডাক দেন। উত্তেজনা বাড়তে থাকলে তামিলনাড়ু সরকার পেরিয়ার রামাস্বামীকে গ্রেফতার করে। জেল থেকে বেরোবার পরও আবার পেরিয়ার সমস্ত শক্তি দিয়ে কংগ্রেসের জাত ব্যবস্থা রক্ষার বিরুদ্ধে নানান কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এবং মনুস্মৃতি ও ভারত রাষ্ট্রের সংবিধান জ্বালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং আবার গ্রেপ্তার হন। জীবনের শেষ দিকে এসেও আমরা দেখি পেরিয়ার রামাস্বামী তার যুক্তিবাদী নিরিশ্বরবাদী প্রচার কাজ চালিয়ে গেছেন। ১৯৭০এ তার বয়স যখন ৯০’র বেশি তখন তিনি তামিল ভাষায় একটি দ্বি-মাসিক পত্রিকা ‘উন্ময়’ বা সত্য প্রকাশ করেন এবং তারসঙ্গে তৈরি করেন রেশনালিস্ট ফোরাম নামে একটি সামাজিক সংগঠন।
যেকোনো যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ এই সংগঠনের সদস্য হতে পারতেন। ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭৩ চেন্নাইয়ের সমাজে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূরীকরণ নিয়ে একটি সভায় উপস্থিত ছিলেন ৯৪ বছরের পেরিয়ার ই ভি রামাস্বামী। এই সভায়ও তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন আমাদের ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্রের পরিবর্তন করতে হবে। এটাই ছিল তার শেষ বক্তৃতা। এই সভায় মাত্র কয়েক মিনিট কথা বলার পরেই তার বুকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হয়। ২০ ডিসেম্বর ১৯৭৩ তাকে চেন্নাই মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। এবং তারপর ভেলোর সিএমসি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। ২৪ ডিসেম্বর সকাল সাতটা বাইশ মিনিটে ৯৪ বছর বয়সে রামাস্বামী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ চিন্তকদের মধ্যে পেরিয়ার ছিলেন এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম। তার সমসাময়িক সময়ে প্রায় কেউই এভাবে জাতপাতের বৈষম্য, ভারতীয় সমাজের স্তরবিশিষ্ট কাঠামো, সমস্ত রকম কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এত স্পষ্ট ভাষায় মতামত ব্যক্ত করেননি। পেরিয়ার তার সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়েছিলেন। নারী মুক্তি, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, দেবদাসী প্রথা ইত্যাদি সম্পর্কেও তার স্পষ্ট বৈপ্লবিক মতামত ছিল। সর্বোপরি ধর্মের বিরুদ্ধে নাস্তিকতার স্বপক্ষে এত স্পষ্ট অবস্থান এই সময়ে আমরা আর কোনও রাজনৈতিক বা সামাজিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে খুব একটা দেখতে পাই না। এখানেই পেরিয়ার রামাস্বামীর মৌলিকত্ব। তামিলনাড়ুতে বাল্যবিবাহ, বিধবা বিবাহ সম্পর্কে তার চিন্তাভাবনা আমাদের তার পূর্বসূরী বিদ্যাসাগরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই সময়ে ভারতবর্ষের রাষ্ট্র ও সমাজ সবকিছুর হিন্দুত্ববাদী বিনির্মাণ চলছে। দলিত শিশুকে শুধুমাত্র জল ছোঁয়ার অপরাধে স্রেফ মরে যেতে হচ্ছে। ধর্মীয় বিভাজন দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। ফ্যাসিবাদী কায়দায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস জারি করে অন্যস্বর অবদমিত করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে পেরিয়ার’এর মতামত শাসক শক্তির কাছে স্পষ্টতই একটা চ্যালেঞ্জ। সেইজন্যেই হিন্দুত্ববাদী শক্তির তাকে নিয়ে এত অস্বস্তি। মৃত্যুর ৫০ বছর পরেও তার স্ট্যাচুতে কালি লেপন করা হচ্ছে আর ঠিক এখানেই পেরিয়ারের প্রাসঙ্গিকতা। এই সর্বাত্মক নেতিবাচক শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের প্রয়োজন শক্তিশালী বৈপ্লবিক বিকল্প চিন্তা কাঠামো। সেই কাঠামো নির্মাণের জন্য রামাস্বামী পেরিয়ারের উপর নতুন করে আলোকপাত করা সারা দেশেই অত্যন্ত জরুরি। বিন্ধ্য পর্বতের বাধা টপকে তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে সমগ্র দেশে।
(সমাপ্ত)
- সুমনা সেনগুপ