‘সত্য সংবাদ পরিবেশন জরুরি। আর সেই সংবাদ তাঁর বিরুদ্ধে হলেও তিনি মনে কিছু করবেন না। কিন্তু সম্মানহানি যেন না করা হয়।’ বলতে চাইলেন, বিচার যেন নিরপেক্ষ হয়, এক পক্ষের না হয়। প্রসঙ্গত আরও বললেন – ’মিডিয়া ট্রায়াল যেন না হয়।’ এই কথাগুলো হাইকোর্টের বিচারপতিদের সাথে এক সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতে শোনা গেল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে।
এই বিপদ অতি বাস্তব ক্রমবর্ধমান যে, কেন্দ্রের মোদী সরকার ন্যায় বিচারের সবকিছুকে বিধ্বস্ত করার অভিযান চালাচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও উদ্যোগ থেকে শুরু করে বিরোধী দল পরিচালিত সরকারকে সন্ত্রস্ত, দমন ও কোণঠাসা করতে উন্মত্ত অভিযানে নেমেছে। তার জন্য তুলছে ছদ্মবেশী আহ্বান, প্রতারণাপূর্ণ শ্লোগান, আর আগ্রাসী উন্মাদনা; আর কিছু তকমা লাগিয়ে দিয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-ইডি-সিবিআইকে স্বেচ্ছাচারীভাবে ব্যবহার করছে, বিচারব্যবস্থাকেও পক্ষপাতমূলক ভাবে প্রভাবিত করে চলছে। ন্যায়ের ভারতশাসন চলছে না, তাকে প্রতিস্থাপিত করে চলছে অন্যায় – অঘোষিত ফ্যাসিবাদী শাসন। যার মাথায় আরএসএস-বিজেপি চক্র, আর মুখ মোদী।
পক্ষান্তরে, এরাজ্যেও যে ন্যায়ের প্রশ্নে ভন্ডামী সহ এক ধরনের দমন-নিয়ন্ত্রণের রাজ চলছে এটাও নির্মম বাস্তব। টিএমসি আমলে কিছু জরুরি অস্থায়ী উপশমের প্রকল্প চালু হয়েছে বটে, তা সত্ত্বেও মমতা সরকারকে ‘জনকল্যাণকর’ বা ‘স্বস্তিকর’ সরকার হিসেবে গণ্য করার উপায় নেই। কারণ তার আশু অনুদান প্রকল্পের পরিচিতিকে ছাপিয়ে গেছে দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের অপশাসন। মুখ্যমন্ত্রী আজ তাঁর নিজের ও সহ মন্ত্রী-নেতাদের সম্মানহানি না করার আবেদন করছে, হুঙ্কারও দিচ্ছেন! কিন্তু টিএমসি আমলের গোড়া থেকেই দুর্নীতিতে জড়ানোর অভিযোগ উঠে আসছে! সারদা ছোপ খাওয়া যে ঘোষমশাই আজ তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র, তাঁকে একসময়ে ‘যত দোষী’ দাগিয়ে সাময়িক বরখাস্ত করে গারদ পোরা হয়েছিল, বন্দীদশা থেকে তিনি অভিযোগের আঙ্গুল তুলছিলেন সারদার দুর্নীতি থেকে সবচেয়ে সুবিধাভোগীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই অভিযোগকারীকে আবার পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গোপন বোঝাপড়ায় দলের মুখপাত্রের পদে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর তিনিও বেশ সন্ধি মেনে চলছেন! কিন্তু তা বলে কি ঘোষবাবুর বা মুখ্যমন্ত্রীর সম্মান উদ্ধার হয়ে গেছে? না। বরং দলের দুর্নীতিগ্রস্ত পরিচিতি আরও বহুবিচিত্রতায় বহুগুণ বেড়েছে! শিক্ষাক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার নিয়োগ-দুর্নীতি তার এক চূড়ান্ত অমনবিক নিষ্ঠুর নিদর্শন। তৃণমূল দল ও সরকারের কখনই সততা-নৈতিকতা দেখানোর সাহস হয়নি নিজেদের পরিচ্ছন্ন প্রমাণ দিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনও তদন্ত কমিশন বসানোর। বরং এরকম যেকোনো অভিযোগ ও দাবিকে ‘চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র’ বলে নস্যাৎ ও দমন করার রাস্তা নেওয়া হয়েছে। এই পরিণতি আজ উপরন্তু খাল কেটে উচ্চ আদালতের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোর দুর্নীতি তদন্ত অভিযান ডেকে নিয়ে এসেছে। আর এই ছুতোয় কেন্দ্রের মোদী সরকার ও বিজেপি মিলে বাংলার বুকে আবার গেরুয়া ক্ষমতার রাজনীতির বাজার গরম করার সুযোগ পাচ্ছে।
বাংলায় দুর্নীতির সাথে বেলাগাম হয়েছে শাসকের সন্ত্রাস। রাজনৈতিক ও সরকারি সন্ত্রাস। ক্ষমতায় আসার গোড়া থেকেই কোনও বিরোধিতাকে সহ্য না করার ধমকি দেওয়া শুরু হয়। তারপর ক্রমশ ভূয়ো এনকাউন্টার, ইউএপিএ-র বেড়ী পরানো, পাইকারীহারে গ্রেপ্তার, বিনাবিচারে বন্দী করে রাখা, সাপের মাথায় লাঠি মারার মতো হুঙ্কার দেওয়া, রাতের অন্ধকারে বাড়িতে পুলিশী হানা, হেফাজতে তুলে নিয়ে এসে থার্ডডিগ্রী অত্যাচার, বন্দী অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় তিলে তিলে হত্যা করা, থানায় ডেপুটেশন দিতে গেলে ধরে বেঁধে রাতভর আটকে রেখে মার, হেফাজতে নারীর শারীরিক-মানসিক নিগ্রহ, ধর্ষণ, কখনও পুলিশী অত্যাচার চলে উত্তরপ্রদেশ মডেলে, চলে মিথ্যা সাজানো মামলার হেনস্থা-হয়রানি, রেখে দেওয়া হয়েছে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম সময়কালের মামলাও, চালানো হয় ভোট সন্ত্রাস, বিরোধীপক্ষকে মনোনয়ন বা ভোট দিতে না দেওয়া, পুলিশ-প্রশাসন ঘেরা সভামঞ্চ থেকে শোনানো হয় বিরোধিতার দুঃসাহসকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার নিদান, চলে ভোট লুঠ, শাসক ক্ষমতার পেশীশক্তিতে সব ক্ষমতার দখল নেওয়া, পঞ্চায়েতী সন্ত্রাস, সহজে অনুমোদন মেলে না শান্তিপূর্ণ সভা-মিছিলের, রয়েছে ক্যাম্পাস সন্ত্রাস, ট্রেড ইউনিয়ন সন্ত্রাস – সন্ত্রাসের প্রায় সমস্ত প্রকরণ চলে আসছে তৃণমূল শাসনে। এমনকি বিরোধী বামপক্ষের লোকেদের থিয়েটার-সিনেমা মঞ্চস্থ করার প্রেক্ষাগৃহ পর্যন্ত মেলে না, ব্রাত্য করে রাখা হয়। তৃণমূলী রাজনৈতিক গুন্ডামী-সন্ত্রাস চালানোর আজকের হাতিয়ার হল ‘অনুব্রত মডেল’। বিরোধিতাকে দমন করতে চলে আইনের শাসনের বদলে শাসকের আইন, শাসকের ট্রায়াল। সুতরাং কোন মুখে তৃণমূল নিজের কলঙ্কিত মুখ ঢাকবে!