ঔপনিবেশিকতা ও দাসত্বের প্রতীকের বিরুদ্ধে ঊর্দ্ধে উড়ুক আমাদের পতাকা
Against the Symbol of Colonialism and Slavery

৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইন্ডিয়া গেটের নব উদঘাটিত ‘কর্তব‍্যপথে’ ভাষণ দিয়ে বললেন যে, ‘রাজপথ’ (ইংরেজি কিংসওয়ের অনুবাদ) ছিল দাসত্বের প্রতীক। একইভাবে, গত সপ্তাহে ‘আইএনএস বিক্রান্ত’ উদ্বোধনের সময় মোদী ভারতীয় নৌবাহিনীর নতুন পতাকা উন্মোচিত করলেন এতদিনকার সেন্ট জর্জ ক্রস চিহ্নটি তুলে দিয়ে পতাকায় নতুন প্রতীক বসিয়ে। এই ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে জানানো হয় যে ভারতের ঔপনিবেশিক অতীত থেকে সরে আসতেই এই পরিবর্তন।

রাজপথের নাম বদলে কর্তব‍্যপথ করে দেওয়ার দিনই অবশ‍্য মোদী সরকার ঔপনিবেশিকতা ও দাসত্বের প্রতীকের বিরুদ্ধে তার কর্তব‍্যের সব দায়দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলল। সরকারি বিবৃতিতে বলা হল যে ১১ সেপ্টেম্বর সারাদিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে “প্রয়াত সম্ভ্রান্ত ব‍্যক্তির সম্মানে”। এখানে প্রয়াত সম্ভ্রান্ত ব‍্যক্তিটি হলেন ব্রিটেন ও উত্তর আয়ারল‍্যান্ডের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, এবং তাঁর অধিষ্ঠিত পদটি হল দুনিয়াজুড়ে শত শত বছরের ঔপনিবেশিক শোষণের, দাসত্বের আর লুন্ঠনের প্রতীক।

দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৫৩ সালে রানী হন। তিনি ছিলেন ব্রিটেনের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় পদে থাকা রাজতান্ত্রিক প্রধান বা মনার্ক। তিনি নিছক ঔপনিবেশিক যুগের অবশেষ রূপে ছিলেন না, বরং ১৯৫০ ও ৬০’র দশকে ব্রিটেন যখন দুনিয়ার দেশে দেশে উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনগুলিকে নৃশংসভাবে দমন করছিল তখন সেই ঔপনিবেশিকতার এক সক্রিয় কর্ত্রী ছিলেন তিনি।

ভারতে ১৮৫৭-র বিপ্লবীদের গণহত‍্যা, বাংলার দুর্ভিক্ষ, জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত‍্যা, ভগৎ সিংহ ও অন‍্যান‍্য বিপ্লবীদের ফাঁসি, ভারত ছাড়ো আন্দোলন সহ সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর দমনপীড়ন ইত‍্যাদি হল ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের দ্বারা সংগঠিত মূল মূল ঔপনিবেশিক অপরাধের কতিপয় উদাহরণ। অর্থনীতিবিদ উৎসা পট্টনায়ক হিসেব কষে দেখিয়েছেন যে ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সালের সময়পর্বে ব্রিটেন ভারত থেকে ৪৫ ট্রিলিয়ন পাউন্ড চুরি করেছে।

এই রাজতন্ত্রকেই তো বরাবর এগিয়ে নিয়ে গেছেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, কোনোরকম অনুশোচনা, ক্ষতিপূরণ বা ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়াই। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক জাতীয় পতাকাকে কীভাবে আমরা উপনিবেশিকতাবাদের সেই কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের সম্মানে অর্ধনমিত করতে পারি?

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের জোয়াল থেকে ভারত নিজেকে মুক্ত করার পরেও দুনিয়াজুড়ে আরও পাঁচ দশক ধরে অনেক দেশকে স্বাধীনতার লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজত্বের হিংস্র অত‍্যাচার ও গণহত‍্যা মোকাবিলা করে। নিজের রাজত্বকালে উনি ১৯৫০’র কেনিয়ার মাউ মাউ স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করার কাজ তদারকি করেছেন যেখানে বহু সহস্র মানুষকে হত‍্যা করা হয়েছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ বিশ হাজারের ওপর মাউ মাউ সদস‍্যকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করে হত‍্যা করে এবং এক বিপুল সংখ‍্যক মানুষকে কনসেনট্রেশন ক‍্যাম্পে পাঠায়। এইসব ক‍্যাম্পের ধর্ষণ ও বীভৎস অত‍্যাচারের শিকারদের মধ‍্যে যারা বেঁচে আছেন তাঁরা এখনও সুবিচারের জন‍্য লড়ে যাচ্ছেন।

রাণীর ভাবমূর্তি শ্বেতস্বচ্ছ রাখার এবং ঔপনিবেশিক অপরাধ থেকে তাঁকে বিযুক্ত দেখাতে আধুনিক ব্রিটেনের ‘খুঁটি’ হিসেবে প্রতীয়মান করার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চলেছে। কিন্তু ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সিংহাসনে (সেখানে যিনিই অধিষ্ঠিত থাকুন না কেন) যে রক্ত লেগে আছে, যে রক্ত বছরের পর বছর ধরে দুনিয়া জুড়ে ঔপনিবেশিক হত‍্যা গণহত‍্যার মধ‍্য দিয়ে জমা হয়েছে, তা অত সহজে ধূয়ে ফেলা যাবে না।

এখন আমরা স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালন করছি (‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’) ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে গৌরবময় সংগ্রামের প্রতি সম্মানে ও শ্রদ্ধায়। মোদী সরকার যেমনটা করবে বলছে সেভাবে আমাদের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার অর্থ আমাদের সেই স্বাধীনতা সংগ্রামকে অপমান করা, ঔপনিবেশিক শাসনের শেকল ছিঁড়ে দেশকে মুক্ত করতে যারা রক্ত দিয়েছেন সেইসব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চূড়ান্ত অপমান করা। এটা করার মাধ‍্যমে মোদী সরকার ঔপনিবেশিক শাসকের বিশ্বস্ত অনুগত সেবক হিসেবে নিজের চেহারাটা আরেকবার প্রকাশ করে দিল, ভগৎ সিং ‘ভূরে আংরেজ’ বলে চিহ্নিত করে যে বিষয়ে অনেক আগেই আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন।

- ১৩ সেপ্টেম্বর এম এল আপডেট থেকে

খণ্ড-29
সংখ্যা-36