অ-বিজেপি দল শাসিত রাজ্যগুলোতে এবং বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে সিবিআই-ইডি-আয়কর দপ্তরের অভিযান যখন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে, এবং বিরোধী দলগুলোকে দুর্নীতির প্রতিভূ বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা নরেন্দ্র মোদী চালিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই মধ্যপ্রদেশে রাজ্য সরকারকে জড়িয়ে দুর্নীতির এক বড় ঘটনার উন্মোচন ঘটল। মধ্যপ্রদেশে শাসন ক্ষমতায় এখন বিজেপি এবং যে নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তর এই দুর্নীতির কেন্দ্রে রয়েছে বলে অভিযোগ, সেই দপ্তরের দায়িত্বে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান। মধ্যপ্রদেশ সরকার নারী ও শিশুদের পুষ্টি সাধনের লক্ষ্যে একটা প্রকল্প চালায় যার নাম হল ‘টেক হোম রেশন’ যা হল বিনামূল্যে রেশন সরবরাহ। সম্প্রতি ঐ রাজ্যের অডিটর জেনারেলের পেশ করা ৩৬ পাতার গোপন রিপোর্টের একটা কপি ফাঁস হয়ে সংবাদ মাধ্যমে চলে আসে এবং রিপোর্টে ঐ রেশন প্রকল্পকে ধরে শত-শত কোটি টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্পের সুবিধা প্রাপকদের সংখ্যাকে বাড়িয়ে দেখানো, রেশন পরিবহণের প্রমাণ হিসাবে জাল নথি পেশ করা, রেশন বিলির পরিমাণকে প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে বেশি করে দেখানো — বিভিন্ন স্তরেই দুর্নীতির অকাট্য সাক্ষ্য বহন করছে রাজ্যের অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেলের রিপোর্ট।
এই রেশন প্রকল্পের সুবিধা পায় তিন বর্গের শিশু ও নারীরা — ৬ মাস থেকে ৩ বছরের শিশুরা, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও স্তন্যদায়ী মায়েরা এবং স্কুলের পড়া ছেড়ে দেওয়া ১১ থেকে ১৪ বছরের কিশোরীরা। সব মিলিয়ে প্রকল্পে নথিভুক্তদের সংখ্যা ৪৯.৫৮ লক্ষ — শিশু ৩৪.৬৯ লক্ষ, বয়স্ক নারী ১৪.২৫ লক্ষ এবং পড়া ছেড়ে দেওয়া কিশোরী ০.৬৪ লক্ষ। অডিটর এদের ২৪ শতাংশ বা ১২ লক্ষকে নিয়ে তদন্ত চালানোর উল্লেখ করেছেন এবং তাতেই দুর্নীতির ঐ বহর ধরা পড়ে। রিপোর্টে জানানো হয়েছে — স্কুলশিক্ষা দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী স্কুলে পড়া ছেড়ে দেওয়া কিশোরীর সংখ্যা ২০১৮-১৯ বর্ষে ছিল ৯ হাজার। কিন্তু নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তরের দেওয়া হিসাব অনুসারে ঐ কিশোরীদের সংখ্যা হল ৩৬.০৮ লক্ষ! কিসের ভিত্তিতে এই সংখ্যায় পৌঁছানো হল তা দফতর জানাতে পারেনি, কেননা, এরজন্য কোনো সমীক্ষাই করা হয়নি। অডিটর জেনারেলের রিপোর্টে আরো জানানো হয়েছে, রাজ্যের ৮টি জেলার ৪৯টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে স্কুলে পড়া ছেড়ে দেওয়া কিশোরী নথিভুক্ত হয়েছিল ৩ জন। কিন্তু নারী ও শিশু কল্যাণ দফতর নথিভুক্ত কিশোরীদের সংখ্যাটাকে ৬৩,৭৪৮ বলে দেখায় এবং ২০১৮ থেকে ২০২১’র মধ্যে ২৯,১০৪ জনকে রেশন সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে জানায়। সহায়তা প্রাপকদের সংখ্যাকে যত বেশি করা যাবে, রেশন সরবরাহের পরিমাণ পাল্লা দিয়ে বাড়বে এবং বেড়ে চলবে টাকা নয়ছয়ের খেলা!
শিশু, নারী ও কিশোরীদের যে রেশন সরবরাহ করা হয় তা উৎপাদনের জন্য রাজ্যে ৬টা কারখানা আছে — বাদি, ধর, মাণ্ডলা, রেওয়া, সাগর ও শিবপুরি এলাকায়। এই কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা যত এবং যে পরিমাণ উৎপাদনের অনুমতি তাদের রয়েছে উৎপাদন দেখানো হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এই কারখানাগুলো থেকে রেশন সরবরাহ দেখানো হয়েছে ৮২১ মেট্রিক টন যেটা তাদের উৎপাদন ক্ষমতার অনেকটাই অতিরিক্ত। কারখানাগুলোতে যত কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়েছে এবং তারজন্যে যে বিদ্যুৎ খরচ হয়েছে তার ভিত্তিতে কতটা রেশন উৎপন্ন হওয়া সম্ভব তার একটা পরিমাণও বার করা গেছে। এই দুয়ের ব্যবধান, অর্থাৎ, যতটা উৎপাদন সম্ভব তার চেয়ে অতিরিক্ত দেখানোর পরিমাণের মূল্য হল একেবারে ৫৮ কোটি টাকা!
আটটি জেলার রেশন প্রাপ্তি ও সরবরাহ নিয়ে তদন্ত করা হয়েছে এবং তাতে দেখা গেছে, ঐ জেলাগুলোর শিশু উন্নয়ন প্রকল্পের অফিসাররা পেয়েছেন ৯৭,০০০ মেট্রিক টন রেশন, কিন্তু সরবরাহ করেছেন ৮৬,০০০ মেট্রিক টন। বাকি ১১,০০০ মেট্রিক টন রেশন কোথায় গেল? গুদামে সেগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং হারিয়ে যাওয়া এই রেশনের মূল্য ৬২.৭২ কোটি টাকা। এই রেশন প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন অতিরিক্ত মুখ্যসচিব অশোক সাহা। প্রাপ্ত রেশনের পরিমাণ ও সরবরাহের মধ্যে ১১,০০০ মেট্রিক টনের এই ব্যবধানকে তিনি ‘কেরানির লেখার ভুল’ বলে অভিহিত করেছেন। হারিয়ে যাওয়া রেশনের এরচেয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা আর কি হতে পারে!
এছাড়া, ছ’টা কারখানা থেকে পাঠানো রেশন পরিবহনকারী গাড়িগুলোর নথি পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে সেগুলোর মাল পরিবহণের ক্ষমতা নেই। অডিটর জেনারেলের রিপোর্ট বলছে, “গাড়িগুলোর তথ্যভিত্তি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, যে ট্রাকগুলো ব্যবহার করা হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে সেগুলো আসলে নথিভুক্ত রয়েছে মোটর সাইকেল, মোটর গাড়ি, অটো বা ট্যাঙ্কার হিসাবে, অথবা সেগুলো ছিল অস্তিত্বহীন ট্রাক।” যে সমস্ত চালানে রেশন পাঠানো হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেক চালান জাল বলেও প্রমাণিত হয়েছে!
মধ্যপ্রদেশের এই রেশন দুর্নীতির সঙ্গে অবিভক্ত বিহারে ঘটা পশুখাদ্য কলেঙ্কারির বেশ কিছু ক্ষেত্রে মিল রয়েছে। ঐ দুর্নীতিতে স্কুটার পুলিশ ভ্যান, ট্যাঙ্কারে গরু-মোষ বহন করা হয়েছে বলে দেখানো হয়েছিল। রেশন কেলেঙ্কারিতেও মোটর সাইকেল, মোটর গাড়ি, ট্যাঙ্কারকে রেশনের পরিবাহক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পশুখাদ্য কলেঙ্কারির মতো রেশন কেলেঙ্কারিতেও কোটি-কোটি টাকার মাল সরবরাহ দেখাতে জাল চালান ব্যবহার করা হয়েছে। পশুখাদ্য দুর্নীতিতে সিবিআই আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালু যাদব কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বলে শিবরাজ সিং চৌহান কি সিবিআই-ইডি’র ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবেন? নরেন্দ্র মোদী জমানায় কেন্দ্রে এবং বিজেপি শাসিত রাজ্যসমূহে দুর্নীতিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হলেও একেবারে চেপে রাখা যায়নি। সুপ্রিম কোর্টের প্রজ্ঞায় রাফাল যুদ্ধ বিমান ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের আওতার বাইরেই থেকেছে, এমনকি, এই বিষয়ে ফ্রান্সে নতুন তথ্যের উন্মোচনও সুপ্রিম কোর্টের কাছে গুরুত্ব পায়নি; হাজার-হাজার কোটি টাকার ব্যাঙ্ক লুটেরারা অবাধে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারলেও বিজেপি তার দায় নিজেদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করেছে; পিএম কেয়ার ফাণ্ডের অর্থের ব্যবহারও প্রশ্নহীন থাকেনি; ইলেক্টোরাল বণ্ডের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থের মধ্যেও দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক থাকার আওয়াজ জোরালো হয়ে উঠেছে; উত্তরপ্রদেশ-হরিয়ানা-কর্নাটকের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্য থেকে সরকারি স্তরে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও সেগুলো তদন্তের আওতায় আসার গুরুত্ব পায়নি; মধ্যপ্রদেশের রেশন দুর্নীতির পরিণতিও কি একই হবে? করদাতাদের টাকাকে নয়ছয় করা এবং যাদের কল্যাণে রেশন প্রকল্প চালানো, তাদের বঞ্চনার শিকার করে তোলাটা কল্যাণ প্রকল্পকে প্রহসনে পরিণত করা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এই দুর্নীতির তদন্ত সিবিআই’এর হাতে তুলে দিতে হবে এবং তদন্তকে প্রভাবশালীর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার জন্য শিবরাজ সিং চৌহানকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হবে।