লখিমপুর খেরি জেলা, উত্তর-প্রদেশের রাজধানী লখনোউ শহরের থেকে ১৪০ কিমি দূরের একটি গ্রাম। বিগত কয়েক বছরে লখিমপুর খেরির নাম সংবাদমাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যমের আলোচনায় উঠে এসেছে। কৃষি বিল রদ করার দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকদের উপর গাড়ি চালিয়ে খুন, ২০২০ সালের আগস্টে শিশুদের ধর্ষন ও খুনের ঘটনায় বারবারই প্রকট হয়েছে মৌলবাদী যোগী আদিত্যনাথের হিন্দুত্ববাদী নৈরাজ্যের ছবি। গত ১৪ সেপ্টেম্বর, দুই দলিত নাবালিকা মেয়ের ঝুলন্ত মৃতদেহ মেলে লখিমপুর জেলাতেই। ময়নাতদন্তের ফলে জানা যায়, মেরে ফেলার আগে, দুই বোনের উপর চলেছে যৌন নির্যাতন। ঠিক দুই বছর আগে, ১৪ সেপ্টেম্বরে হাথরাসে ১৯ বছরের এক দলিত তরুণীকে গন-ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছিল। উচ্চ-বর্ণের অপরাধীদের আড়াল করতে হাথরাসের নির্যাতিতার মা-বাবাকে কার্যত বন্দী করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল নির্যাততার মৃতদেহ। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে, উত্তর-প্রদেশের বিধান-সভা নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন, গৌতম বুদ্ধ নগর জেলার জেওয়ার গ্রামে বন্দুকের নলের মুখে গন-ধর্ষণ করা হয় একটি দলিত মেয়েকে। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে, ওই রাজ্যের গোন্ডা জেলা থেকে উদ্ধার হয় ১৭ বছর বয়সী এক দলিত মেয়ের মৃতদেহ। লখিমপুর খেরিতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক গন-ধর্ষণ ও খুন নিছক সমাপতন নয় বরং যোগীর রাজত্বে সযত্নে লালিত ধর্ষণ-সংস্কৃতি ও ব্রাহ্মণ্যবাদের ধারাবাহিকতার প্রমাণ।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো, ২০২১-এর তথ্য অনুযায়ী দেশে দলিত ও আদিবাসী মানুষদের উপর নির্যাতনের ঘটনা ক্রমবর্ধমান। এই নির্যাতনের পরিসংখ্যানে দেশের শীর্ষে রয়েছে উত্তর-প্রদেশ রাজ্য। ভারতে দলিত ও নিপীড়িত জাতি, বর্গের মানুষের উপর হওয়া নির্যাতনের ২৫.৮২ শতাংশ ঘটে উত্তর-প্রদেশে। ২০১৯-২০২০ সালে দলিত মেয়েদের উপর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে ৩.৪ শতাংশ। কিন্তু দলিত-অধিকার আন্দোলনের কর্মী ও আইনজীবীদের মতানুযায়ী বাস্তবের ছবিটা অনেকগুণ ভয়াবহ। আর্থ-সামাজিক সিঁড়িতে দলিত মেয়েদের ঠাঁই হয় সবার নিচে। জাতি ও লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে দ্বৈত শোষণের শিকার হন তারা। একদিকে উত্তর-প্রদেশে মেয়েদের উপর হওয়া অপরাধের চার্জশিটের সংখ্যা কমছে অন্যদিকে লিঙ্গ-ভিত্তিক নির্যাতনের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আসছে উত্তর-প্রদেশ রাজ্য থেকে।
চূড়ান্ত কপট বিজেপির বিজেপির নেতা, মন্ত্রী ও বাছাই করা দালাল গোদী মিডিয়ার প্রতিনিধিরা লখিমপুরে সদ্য ঘটে যাওয়া গণ-ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের মৃত্যুদন্ডের দাবি করছে। অথচ, হাথরাসের নির্যাতনের খবর করার জন্য কেরালার সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানসহ তিনজন সাংবাদিক দেশ-দ্রোহিতার অভিযোগে আজও জেলে বন্দী। হিন্দুত্ববাদের এই হিংস্র দ্বিচারিতার ধারাতেই বিলকিস বানোর গণ-ধর্ষণে দোষী স্যবস্ত হওয়ার পরেও বেকসুর খালাস করা হলো ১৪ জন ‘সংস্কারী’ উচ্চ-বর্ণের ধর্ষকদের। এভাবেই, জাত, ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণী দেখে ধর্ষকদের বাছ-বিচারের ঘৃণ্য রাজনীতি চলছে। সামাজিক বৈষম্য ও শোষনের সংস্কৃতিকে সুরক্ষিত রেখে মদত দেওয়া হচ্ছে ধর্ষণে। নিপীড়িত মেয়েদের ন্যায় ও সমানাধিকারের লড়াইকে দুরমুশ করার জন্য চক্রান্ত চলছে অবিরত। ফ্যাসিবাদী শোষনের বহুমুখী জোটকে প্রতিহত করতে চাই নিপীড়িত মানুষের জোট। লখিমপুর খেরির মৃত নাবালিকা দুই দলিত মেয়ে, এই বাস্তবিক প্রয়োজনের কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়।