পুজোয় কেটলি আর ভাঁড় জোগাড় করে চা বিক্রির পরামর্শ দিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বেচতে বললেন গরম তেলেভাজাও। কচুরিপানার ব্যাগ, শালপাতার থালা, কাশফুলের বালিশও তৈরি করে বেচার পরামর্শ দিলেন। বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত না হয়ে খড়্গপুরে শিল্পতালুকের সভামঞ্চ থেকে চাকরির নিয়োগপত্র প্রদানের যে সরকারি অনুষ্ঠান ছিল, সেখান থেকেই তিনি এই কথাগুলি বললেন। ইতিমধ্যে, কিছুদিন আগে, “উৎকর্ষ বাংলা”র বহু ঢাক পেটানো কর্মসূচিতে রাজ্যের কারিগরি শিক্ষায় কৃতি ছাত্রছাত্রীদের হাতে ‘চাকরির নিয়োগপত্র’ তুলে দেওয়ার উদ্যোগ শুরু করে রাজ্য সরকার। কিন্তু যে সমস্ত কর্মপ্রত্যাশী বিরাট আশা নিয়ে সেখানে হাজির হন তারা পরে বুঝলেন ওই নিয়োগপত্রটিই ভুয়ো! অনেকেই আবার এই ভুয়ো কাগজটি পান সময়সীমা পার হওয়ার পর। চাকরির ‘নিয়োগপত্র’ নামক আদতে যেটি তারা হাতে পান, সেটা ছিল প্রশিক্ষণের "অফার লেটার"। তবে, এখানেই গল্পের নটে গাছটি মুড়োলে হয়ত তবু মানরক্ষা হতো। কিন্তু দেখা গেল, গুজরাতের সুরেন্দ্রনগরে যে ফানফার্স্ট গ্লোবাল স্কিলার্স-এর সহযোগিতায় সুজুকি মোটর সংস্থায় দু’বছরের জন্য ‘ভেহিক্যাল টেকনিশিয়ান’ হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা ওই অফার লেটারে বলা হয়েছে, সেই সংস্থার অধিকর্তাই জানিয়েছেন যে ওই চিঠিটাও ভুয়ো।
ইতিমধ্যে, প্রকাশিত কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান উন্মোচন করল আরেকটি তথ্য। দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে লগ্নি বাস্তবায়নের অঙ্কে প্রথম দশটি রাজ্যের মধ্যেও ঠাঁই হল না পশ্চিমবঙ্গের। তুমুল ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে অঢেল টাকা অকাতরে খরচের মাধ্যমে মমতা সরকার যে বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলন সংগঠিত করে রাজ্যে অজস্র নতুন বিনিয়োগের আশ্বাস দিয়েছিলেন, তা আজ ডাহা মিথ্যে হিসাবেই প্রমাণিত হল। দেখা যাচ্ছে, ২০২২-এর জুলাই পর্যন্ত এ রাজ্যে বিনিয়োগ হয়েছে গোটা দেশের মোট বিনিয়োগের মাত্র ০.৯ শতাংশ!
সর্বাঙ্গে নিয়োগ কেলেঙ্কারি, দুর্নীতির হাজারো কেচ্ছার দগদগে ক্ষত আজ রাজ্যের তৃণমূল সরকারের প্রধান চরিত্র লক্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক মাস আগে, রাজ্যের রাজকোষ থেকে অঢেল টাকা খরচ করে, দেশের নানা প্রান্তের শিল্পমহল ও কর্পোরেট ঘরানাকে আমন্ত্রিত করে অনুষ্ঠিত রাজসূয় যজ্ঞটা যে স্রেফ ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়, তা আবার প্রমাণিত হল। শিল্প কর্পোরেট মহলকে মোদী সরকার অকাতরে কর ছাড় ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও দেখা গেল নতুন শিল্প বিনিয়োগ হচ্ছে না, কারণ চলতে থাকা চরম আর্থিক সংকটের জন্য আমজনতা বিশেষ কেনাকাটা করছে না। তাই, নতুন বিনিয়োগে তারা মোটেই আগ্রহী নয়। আর, নতুন শিল্প ও কর্মসংস্থানের প্রশ্নে আমাদের রাজ্য যে কোন তিমিরে তলিয়ে গেছে, তা নতুন করে উল্লেখ করার আর প্রয়োজন নেই। নানা কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি, অসদুপায়ে অর্থ উপার্জন করতে রাজ্যের যুবসমাজকে উৎসাহিত করে চলেছে রাজ্য সরকার। নানান আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে জেল-বন্দি অনুব্রতকে বীরের মর্যাদা দিয়ে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান বুঝিয়ে দিলেন রাজ্যের শাসনতন্ত্র আজ কোন অতল অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত।
বামেদের “চোর ধরো, জেল ভরো” স্লোগান আজ বিজেপি আত্মসাৎ করে নিজেদের কোণঠাসা অবস্থাকে প্রাসঙ্গিক করার মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। দু’দিনে ৩ কোটি টাকা খরচ করে বিজেপি বিলাসবহুল বেদিক ভিলেজে “চিন্তন” শিবিরের পর ১১ কোটি ৭ লক্ষ টাকা খরচ করল তাদের নবান্ন অভিযানের অলীক কুনাট্যের পেছনে। কিন্তু রাজ্যবাসীর দৈনন্দিন জীবনে নেমে আসা চরম আর্থিক, সামাজিক সংকট, আন্দোলনরত কর্মপ্রত্যাশীদের নিয়োগ, মজুরি বৃদ্ধি প্রভৃতি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দাবিগুলো আজ ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে অবহেলার পুরু চাদরের নিচে।
আপাদমস্তক দুর্নীতির জালে জড়িয়ে পড়া দল, সরকার ও তার তাবড় তাবড় নেতাদের বাঁচাতে মমতা এবার মোদীকে তোয়াজ করার রাস্তা বেছে নিল। নির্মম, নৃশংস ফ্যাসিবাদী শক্তি, যারা আজ দেশের রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতিটি স্তম্ভকে অর্থহীন করে সংবিধানের একান্ত মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে, সেই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান কর্ণধার সম্পর্কে স্তুতি, ফ্যাসিবাদী শক্তিকে “বিভাজিত” করার মূঢ় আত্মঘাতী কৌশল এই রাজ্যে ফ্যাসিবাদের উত্থানের প্রশস্থ রাজপথ তৈরি করে দিচ্ছে। বিজেপির বিরুদ্ধে যে গণরায়কে সম্বল করে মমতা ফের রাজ্য ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন, সেই রায়কে আজ দু’পায়ে মাড়িয়ে চরম জনবিরোধী এই শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে বামপন্থীদেরই পথে নেমে দেখাতে হবে বিকল্প পথের ঠিকানা।