৬৮ দিন কারাগারে কাটিয়ে আহমেদাবাদের সবরমতি কারাগার থেকে বেরিয়ে এলেন তিস্তা শেতলবাদ, গত ৩ সেপ্টেম্বর। তিস্তা ও আর বি শ্রীকুমার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন গুজরাট ২০০২ গণহত্যাকাণ্ডের শিকারদের ন্যায়বিচারের জন্য সক্রিয় থাকায়। এই গ্রেপ্তারি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়া আর কিছু ছিল না। তাঁকে জেল থেকে ছাড়া হল সুপ্রিম কোর্ট অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করার পর। জামিনের মূল আবেদনটি অবশ্য গুজরাট হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায়।
এই বছরের জুন মাসে সুপ্রিম কোর্ট তিস্তা শেতলবাদকে প্রতিশোধমূলকভাবে দণ্ডিত করার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিল। গুজরাট’০২ গণহত্যাকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও অন্যান্যদের অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে জাকিয়া জাফরি ও তিস্তা শেতলবাদ যে মামলা চালাচ্ছিলেন তাকে খারিজ করে দিয়ে উল্টে সুপ্রিম কোর্ট, আক্ষরিক অর্থেই, তিস্তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক বিচারের পথ তৈরি করে। ন্যায়বিচারের জন্য নিরলস প্রচেষ্টায় তিস্তাদের চালানো মোদী অ্যান্ড কোং’এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মামলাকে বিদ্বেষপূর্ণ বলে অভিহিত করে সুপ্রিম কোর্ট নিদান দেয় যে, যে সকল ব্যক্তি “বিচার প্রক্রিয়াকে এইভাবে অপব্যবহারের সাথে জড়িত, তাদের কাঠগড়ায় তুলতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।”
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের একদিনের মধ্যে, তিস্তা, আর বি শ্রীকুমার এবং সঞ্জীব ভাটের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, জালিয়াতি, মিথ্যা প্রমাণ দাখিল ইত্যাদি অভিযোগে এনে একটি ফৌজদারি মামলা নথিভুক্ত করা হয় এবং গুজরাট এন্টি-টেররিস্ট স্কোয়াড তৎক্ষণাৎ তিস্তাকে তুলে নিয়ে যায়। তাঁর মুম্বাইয়ের বাড়ি থেকে তাঁকে আহমেদাবাদে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট প্রথমে তাঁকে পুলিশ হেফাজতে রাখেন এবং তারপর বিচার বিভাগীয় হেফাজতে পাঠান। দায়রা আদালত ৩০ জুলাই তিস্তার জামিনের আবেদন খারিজ করে দেয়। এরপর তিস্তা গুজরাট হাইকোর্টে যান। ৩ আগস্ট গুজরাট হাইকোর্টের সামনে যখন তাঁর বিষয়টি আসে, তখন নোটিশ জারি করা হয় এবং দেড়মাস পর, ১৯ সেপ্টেম্বর দিনটি, শুনানির দিন হিসেবে ধার্য করা হয়। এরপরই তিস্তা সুপ্রিম কোর্টে যান। সুপ্রিম কোর্ট তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করে গত ২ সেপ্টেম্বর।
তিস্তা এই অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে কিছুটা স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার পেয়েছেন। একে স্বাগত। তিস্তার জন্য তা অনেকটা স্বস্তি। এবং মোদী-শাহের ঘৃণা ও মিথ্যা, প্রতিহিংসা ও ভীতি প্রদর্শনের শাসনের বিরুদ্ধে ন্যায় ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে সকল যোদ্ধার জন্যই এটা একটা বিজয়। কিন্তু আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে ভারতে ক্রমাগত বেড়ে চলা রাজনৈতিক বন্দীসংখ্যার নিরিখে বিচার করলে এই আপাত স্বস্তিকে কেবলমাত্র এক ব্যতিক্রম হিসাবেই চিহ্নিত করা চলে। বিকে-১৫ (ভীমা কোরেগাঁওয়ের ১৫ বন্দী), সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের কর্মী, দলিত বুদ্ধিজীবী, আদিবাসী আন্দোলনের কর্মী, মুসলিম কর্মী, সাংবাদিক — এঁরা সকলেই বিজেপি-আরএসএস’এর প্রতিহিংসার রাজনীতির লক্ষ্যবস্তু হয়ে বছরের পর বছর জেলে বন্দী। ভিন্নমতের কণ্ঠকে এভাবে অনির্দিষ্টকাল আটকে রাখা ফ্যাসিবাদের ভারতীয় ব্র্যান্ডের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠছে। এই সকল বন্দীদের মুক্তির লড়াই গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের লড়াইয়ের অপরিহার্য অঙ্গ।
এদিকে, গত ৩০ আগস্ট, সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুরলি মনোহর যোশী, উমা ভারতী, সাধ্বী ঋতম্বরা এবং উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সংঘ পরিবারের কিছু নেতাদের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সাথে সম্পর্কিত যে অবমাননা মামলা চলছিল তা বন্ধ করে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের এই বেঞ্চ প্রশ্ন তুলেছে, “মরা ঘোড়াকে চাবুক মেরে কী লাভ”! এবং একই সাথে আবার এ’কথাও স্বীকার করেছে যে, মামলাটি আগেই ফয়সালা না হওয়াটা ‘দুর্ভাগ্যজনক’; সুপ্রিম কোর্টের একটি বৃহত্তর বেঞ্চ যেহেতু অযোধ্যা বিষয়ে একটি রায় ইতিপূর্বেই দিয়ে দিয়েছে তাই “এখন এই বিষয়ে আর কিছু টিঁকে নেই”।
এইভাবে জোর করে মামলা বন্ধ করে দেওয়া ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতির নিরিখে ধোপে টেকে না এবং অযোধ্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আগের রায়ের নিরিখেও দাঁড়ায় না। প্রথমত, সুপ্রিম কোর্টের মনে রাখা উচিত যে অযোধ্যা রায়ে তারা বলেছিল, বাবরি মসজিদ ধ্বংস আইনের শাসনের একটি গুরুতর লঙ্ঘন। দ্বিতীয়ত, বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার আগেই এই অবমাননা আবেদনটি দাখিল করা হয়েছিল এবং তখন এই মামলা মুলতুবি রেখে সুপ্রিম কোর্ট গুরুগম্ভীর আশ্বাস দিয়েছিল যে, প্রাচীন ওই সৌধগুলি সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের এই আশ্বাসবাণীর পরও, অবমাননার অভিযোগ আনা আবেদনটি মুলতুবি থাকাকালীনই, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে সুপ্রিম কোর্ট তার ২৪.১০.১৯৯৪ তারিখের রায়ে উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং’কে আদালতের আদেশ অমান্য করার জন্য অবমাননার দোষে দোষী সাব্যস্তও করে। এই রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলে, উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এবং তার আধিকারিকদের বিরুদ্ধে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২’র ঘটনার সাথে সম্পর্কিত অবমাননার মামলার প্রক্রিয়া স্বতঃপ্রণোদিতভাবে শুরু করা হয়েছে এবং সেগুলি স্বাধীনভাবে ফয়সালা করা হবে। এই অবমাননার পিটিশনটি, যা ‘স্বাধীনভাবে ফয়সালা’ করার কথা ছিল, পরবর্তীতে ২০০০ সালে স্থগিত হওয়ার আগে, শুনানির জন্য একবারও তালিকাভুক্ত করা হয়নি। আর এখন তো মামলাটি পুরোপুরি বন্ধই করে দেওয়া হল।
একই দিনে, সুপ্রিম কোর্টের অন্য একটি বেঞ্চ ২০০২ গুজরাট গণহত্যাকাণ্ড উদ্ভূত সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে মন্তব্য করে যে ওগুলো সময়ের সাথে সাথে ‘অকার্যকর’ হয়ে পড়েছে। বিচারাধীন মামলাগুলির মধ্যে রয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দায়ের করা স্থানান্তরের আবেদন, দাঙ্গার শিকারদের বিশেষ ছুটির আবেদন এবং ২০০৩-০৪ সালে ‘সিটিজেনস ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস’ এনজিও’র দায়ের করা রিট পিটিশন, গুজরাট পুলিশের কাছ থেকে সিবিআই’এর কাছে তদন্ত হস্তান্তর করার আবেদন জানিয়ে। ঘটনাচক্রে সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছিল। দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের ‘আধুনিক নীরো’ বলে অভিহিত করেছিল। সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছিল যে, নিষ্পাপ শিশু এবং অসহায় নারীদের পুড়িয়ে মারার সময় এই আধুনিক নীরোরা অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল এবং “সম্ভবত চিন্তা করছিল কীভাবে অপরাধীদের বাঁচানো যায় বা সুরক্ষিত রাখা যায়”। সেই সুপ্রিম কোর্ট যে এখন এই দুটি বিষয়েরই কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল তা আদালতের বুনিয়াদি দায়িত্ব পরিত্যাগ করারই ন্যাক্কারজনক ভূমিকা প্রকাশ করে।
বেশ কয়েক বছর আগে, ২০০৪ সালে, প্রফেসর কে বালাগোপাল দেশবাসীকে সতর্ক করে বলেছিলেন যে, “ডানপন্থী বাহিনী ক্ষমতা দখলের জন্য চক্রান্ত করছে”, এবং তারা আদালতকেও যথেষ্ট পরিমাণে দখল করেছে। তারপর থেকে অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে এবং এখন আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর সরাসরি আক্রমণের সাক্ষী, বিশেষ করে নিয়োগের ক্ষেত্রে। এবং এরফলে বিচার বিভাগের রূপান্তর ঘটেছে। আইনি পণ্ডিত গৌতম ভাটিয়া এই রূপান্তরকে ‘নির্বাহী আদালত’ বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ নিছক কার্যনির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তের অধীনস্থই নয়, বরং আদালতকে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হচ্ছে যা নিজেই “কার্যনির্বাহীর মতাদর্শের ধোঁয়াশা ছড়িয়ে দেবে, এবং বিশ্বের কাছে সেই মতাদর্শকে বিচারিকভাবে ঘোষিত সত্যের ঝলক হিসাবে প্রতিভাত করবে”। গণতন্ত্র টিঁকিয়ে রাখতে হলে আদালতের এই বিপর্যয়কর প্রবণতাকে উল্টোদিকে ঘোরাতে হবে এবং গণতন্ত্র রক্ষা করতে বিচার বিভাগের কার্যধারা ও সিদ্ধান্তগুলিকে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করে চলতে হবে।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২)