গোটা বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। অন্যদিকে, দিনের পর দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে খাদ্য পণ্যের দাম। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে তা ক্রমেই চলে যাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি। এই মূল্যবৃদ্ধি বিশ্ব খাদ্যবাজারে ফাটকাবাজিকে যেমন উৎসাহিত করছে, তেমনিই হাতে গোনা কয়েকটি খাদ্যপণ্য সরবরাহকারী কোম্পানি বিপুল মুনাফা আদায় করে নিল এই কয়েকমাসে।
বিশ্বের চারটি বৃহত্তম খাদ্য সরবরাহকারী সংস্থা বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব খাদ্য-বাজারটিকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। নিজেদের পকেটে পুড়েছে বিপুল মুনাফা। ২০২৪’র মধ্যে জোগানকে ছাপিয়ে যাবে চাহিদা, আর সেই আবহে আরও বেশি মুনাফা কামানোর রাস্তা তৈরি হচ্ছে।
রাষ্ট্রসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন’এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এবছরেই খাদ্যশস্যের দাম কুড়ি শতাংশের বেশি ইতিমধ্যেই ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় ৩৪.৫ কোটি মানুষ চরম খাদ্য সংকটের কবলে! যা, কোভিডকালকেও ছাপিয়ে গেছে। কোভিডকালে খাদ্য সংকটের কবলে পড়েন ১৩.৫ কোটি মানুষ।
চারটে কোম্পানি এই আন্তর্জাতিক খাদ্য বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে — আর্চার ড্যানিয়েলস্ মিডল্যান্ড কোম্পানি, বাঞ্জ, কার্গিল ও ড্রেফাস — সংক্ষেপে এবিসিডি। এরাই বিশ্বের ৭০-৯০ শতাংশ খাদ্যশস্যের বাজারকে কব্জা করে রেখেছে। এনার্জি বা শক্তির বাজারের তুলনায় খাদ্যপণ্যের বাজার অনেক বেশি কেন্দ্রীভূত ও অস্বচ্ছ নিয়ম পদ্ধতিতে চলে। এখানে ফাটকাবাজির মাধ্যমে বিপুল মুনাফা কামানোর অনেক রাস্তাই খোলা রয়েছে। এবছরের জুন মাসে আন্তর্জাতিক খাদ্য পণ্যের দাম গতবছরের তুলনায় বেড়েছে ১৩ শতাংশ হারে!
কার্গিল’এর মুনাফা (এবছরের ৩১ মে পর্যন্ত) বেড়েছে ২৩ শতাংশ — ১৬৫ বিলিয়ন ডলার কামিয়ে সে রেকর্ড করেছে। আর, আর্চার ড্যানিয়েলস্ মিডল্যান্ড কোং এবছরের দ্বিতীয় অর্ধে যা লাভ করেছে, তা এখন পর্যন্ত তার ইতিহাসে সর্বোচ্চ! এবছরের দ্বিতীয় অর্ধে বাঞ্জ’এর মুনাফা বেড়েছে ১৭ শতাংশ, ড্রেফাস’এর মুনাফা ২০২১-এ তার আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ৮০ শতাংশেরও বেশি।
ইতিমধ্যে অক্সফাম’এর মতো আরও কিছু সংস্থা এই সমস্ত খাদ্য সরবরাহকারী সংস্থাগুলোর উপর কর বসানোর প্রস্তাব রেখেছে। প্রস্তাব আসছে, সংশ্লিষ্ট সরকারগুলো খাদ্যশস্যের দামের উপর একটা নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দিক। এই কতিপয় সংস্থাগুলো বীজ-সার-আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে গোটা ব্যবস্থারই আজ নিয়ন্ত্রক।
কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোর এই ফাটকাবাজির পাশাপাশি রয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, প্রতিকূল ভূ- প্রাকৃতিক পরিবেশ, যা খাদ্য উৎপাদনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
আমাদের দেশেও গাঙ্গেয় উপত্যকা জুড়েই বৃষ্টির অভাবে কৃষি সংকট দুয়ারে কড়া নাড়ছে। কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের হিসাব অনুযায়ী আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ৪৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়নি, মোট চাষের এলাকা গতবছরের চেয়ে কমেছে ১২ শতাংশ।
বিপুল সংখ্যক ভারতবাসীকে অনাহারে অর্ধাহারে অপুষ্ঠিতে রেখে পালিত হচ্ছে ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব!’ গতমাসে রাষ্ট্রসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন’এর (এফএও) রিপোর্টবেআব্রু করল বিশ্বজোড়া খাদ্য-সংকটের ভয়াবহ দিক, চরম বৈষম্যের নির্মম বাস্তবতা। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, ৯৭ কোটি ভারতীয় বা দেশের ৭১ শতাংশ জনসংখ্যা আজ এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে যে তাঁদের পুষ্টিকর খাদ্য কেনার আর্থিক ক্ষমতা নেই — এশিয়ায় এই সংখ্যাটি হল ৪৩.৫ শতাংশ আর আফ্রিকায় ৮০ শতাংশ। ওই রিপোর্ট জানিয়েছে, ভারতে দৈনিক মাথাপিছু পুষ্টিকর খাদ্য কেনার মূল্য ২৩৫ টাকা, যার অর্থ হল চার-পাঁচজনের পরিবারের জন্য তা হবে মাসে ৭,৬০০ টাকা।
এফসিআই’এর গুদামে উপচে পড়া খাদ্য নষ্ট হচ্ছে। এদিকে, আমাদের দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ খাদ্যশস্য কেনার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছেন, খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির ফাঁসে ছটফট করছেন।
এই না হলে স্বাধীনতার অমৃতকাল!!
- অতনু চক্রবর্তী