বিরাট বিরাট ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে দ্বিচক্রযানে গোটা শহর জুড়ে নতুন প্রজন্মের এক তরুণ বাহিনীকে দিবারাত্র ছুটে বেড়ানোর দৃশ্য আজ শহর-শহরতলীর নাগরিকদের চোখে সয়ে গেছে। আড়ালে চলে যাচ্ছে এই বিপুল সংখ্যক নামহীন-পরিচয়হীন আধুনিক ‘রানার’ গিগ শ্রমিকদের দৈনন্দিন যন্ত্রণাবিদ্ধ যাপনের কাহিনী। ভারতের ক্রম প্রসারমান গিগ-প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত এই নতুন প্রজন্ম এক নতুন ধরনের শ্রম সম্পর্ক সামনে এনেছে, যা নিয়ে এই প্রথম নীতি আয়োগ, কেন্দ্রীয় সরকারের থিংক ট্যাঙ্ক, সম্প্রতি এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, ‘ইন্ডিয়াস্ বুমিং গিগ অ্যান্ড প্ল্যাটফর্ম ইকনমি, পলিসি ব্রিফ’, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে ২০২০-২১ সালে গিগ শ্রমিকদের সংখ্যা ৭৭ লক্ষ থেকে বেড়ে ২০২৯-৩০ সালে ২.৩৫ কোটিতে পৌঁছাবে। বর্তমানে যে গিগ শ্রমিকরা গোটা শ্রমশক্তির ১.৫ শতাংশ, আগামী ২০৩০এ তা পৌঁছাবে ৪.১ শতাংশে, যা অর্থনীতির সমস্ত ক্ষেত্রে প্রসার লাভ করবে। এই অর্থনীতিতে দ্রুতই স্থান করে নিচ্ছেন মহিলা ও বিশেষভাবে সক্ষম মানুষেরা। তবে, যত দিন যাচ্ছে, ততই কমছে উচ্চস্তরের দক্ষতাসম্পন্ন কাজের ধরন — বর্তমানে ৪৭ শতাংশ কাজ রয়েছে মাঝারি দক্ষতাসম্পন্ন স্তরের, আর ২২ শতাংশ ও ৩১ শতাংশ কাজ হচ্ছে যথাক্রমে অতি-দক্ষতাসম্পন্ন ও নীচু স্তরের দক্ষতাসম্পন্ন কাজের ধরনের মধ্যে।
কিন্তু, ভারতের শ্রমবাজার বিচিত্র সমস্যা সামনে নিয়ে এলো। গত মার্চ মাসে, সিএমআইই দেখায়, দেশের শ্রমবাজারে শ্রমশক্তির হার যা ছিল, তা এপ্রিলে প্রায় ৮১ লক্ষ বৃদ্ধি পেল — যা তাদের দাবি অনুযায়ী, সাম্প্রতিককালে একমাসে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি! সিএমআইই’র মতে এই বৃদ্ধি হয়েছে সম্ভবত এই কারণে যে, শ্রমবাজারে যে শক্তিটা আগে যোগদান করেনি, তারা এপ্রিল মাসে ফিরে এসে যোগ দিয়েছে। কিন্তু, গিগ অর্থনীতির বাজার অতিরিক্ত এই নতুন শক্তিটার একটা অংশকে স্থান করে দিতে না পারায়, অর্থনীতির এই নতুন ক্ষেত্রটি শ্রমশক্তির সংকটে সম্মুখীন। দেখা গেল সুইগি, জোমাটো কর্মীর অভাবে কয়েকটা রাজ্যে কিছু কিছু এলাকায় তাদের ব্যবসা সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে। ইতিমধ্যে মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ ও বেঙ্গালুরুতে লোকের অভাবে এই সংস্থাগুলো বেশ কিছু অপারেশন গুটিয়ে নিয়েছে। স্বল্প মজুরি, ক্রমে বেড়ে চলা জ্বালানির দাম, আর তারসাথে ইন্সেনটিভ না বাড়ানোর পেছনে নিয়োগকর্তার অনীহার কারণে এই ক্ষেত্রে কর্মীরা আকর্ষণ হারাচ্ছে।
আর, সম্ভবত এই কারণে নীতি আয়োগ এই শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কর্মীদের জন্য কল্যাণকর কিছু প্রকল্প নিতে সুপারিশ করেছে। নিরাপত্তাহীন এই কাজে ঠিক সময়ে মজুরি না পাওয়া, কর্মক্ষেত্রে নানা ঝুঁকি, শ্রমিক-নিয়োগকর্তার মধ্যে অস্পষ্ট শ্রম সম্পর্ক, প্ল্যাটফর্ম কর্মীদের ‘স্বাধীন কন্ট্রাকটর’এর জামা পরিয়ে নানা আইনি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা প্রভৃতি সমস্যাগুলো নীতি আয়োগ’এর এই রিপোর্টে থাকলেও তার সমাধানের পথ বাৎলানো হয়নি। আর সবচেয়ে বড় কথা, এই রিপোর্ট তৈরি করার প্রক্রিয়ায় একজন গিগ-প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকের কাছে গিয়ে সরাসরি তাদের সমস্যা জানা বোঝার কোনও প্রচেষ্টাই নেয়নি নীতি আয়োগ।
এই রিপোর্ট বরং বলেছে, কাজের ধরনের এই ‘প্ল্যাটফর্মকরণের’ ফলস্বরূপ নতুন এক বর্গের কর্মী — প্ল্যাটফর্ম কর্মী — আত্মপ্রকাশ করেছে, “যারা সাবেক ইনফর্মাল-ফর্মাল শ্রমের বিদ্যমান পরিসরের বাইরে”। আর, এই বলে অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে ‘শ্রমিক’ সংজ্ঞার বাইরেই পাঠিয়ে দিল ক্রমে সম্প্রসারনশীল এই নতুন অর্থনীতির সাথে যুক্ত কর্মীবাহিনীকে। নীতি আয়োগের উপদেশ, “একটা উপযুক্ত কাঠামো ভারতের দরকার, যা এইসমস্ত প্ল্যাটফর্ম যে নমনীয়তা বা ফ্লেক্সিবিলিটি নিয়ে এসেছে তারসাথে মানানসই সামাজিক সুরক্ষা যাতে কর্মীদের সে দিতে পারে”। আর, সেই সুরক্ষার মধ্যে তাদের প্রস্তাব, সবেতন মেডিকেল ছুটি, স্বাস্থ্যখাতে সুরক্ষার জন্য বিমা, পেশাগত ও কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত বিমা, অবসরকালীন ভাতা বা পেনশনের ব্যবস্থা। পাশাপাশি, অত্যন্ত কম মজুরিতে যে তারা কাজ করেন লম্বা সময় জুড়ে তা স্বীকার করে ‘ইন্সেনটিভ’ (পাঠকরা খেয়াল করবেন, ন্যূনতম মজুরির বিষয়টা ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করা হয়নি) বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এই কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের অভিযোগ নিরসনের জন্য কোনও ব্যবস্থার সুপারিশ এই রিপোর্টে নেই। নানা ধরনের চৌর্যবৃত্তি ও অস্বচ্ছ অন্যায্য ব্যবসায়িক পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে চলা এই সংস্থাগুলো কর্মীদের হরেক পদ্ধতিতে শোষণ করে।
কিছুদিন আগে দেখা গেল, বেঙ্গালুরুতে একটি শহরে একটা এলাকায় জোমাটো অ্যালগোরিদম’এর কারচুপি করে কর্মীদের কাজের নির্ধারিত সীমানা হঠাৎ বাড়িয়ে দিল। কর্মীদের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কাজ করার যে প্রচলিত নিয়ম ছিল, তারা হঠাৎ দেখলেন, অর্ডার আসছে ৪০ কিলোমিটার দূর থেকে। অর্থাৎ, তাদের ৪০ কিমি দূরে গিয়ে অর্ডার নেওয়া ও ডেলিভারি দিতে হচ্ছে। তীব্র প্রতিবাদ ও ঝটিকায় কাজ বন্ধ করার পর কর্তৃপক্ষ পিছু হটে।
এই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রটিকে আর্থিক অনুদানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কর ছাড়, স্টার্টআপ’দের জন্য যে সরকারি অনুদান বরাদ্দ রয়েছে, তা সেই সংস্থাগুলোকে দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে, যারা এক-তৃতীয়াংশ মহিলা ও বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের নিয়োগ করেছে।
তরুণ প্রজন্মের প্রাধান্য রয়েছে এই গিগ-প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতিতে। গত চার বছরে তরুণ কর্মীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে আটগুণ। এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৪০ শতাংশ গিগ শ্রমিকদের বয়স ১৬-২৩ বছরের মধ্যে।
একটি সংস্থা ফ্লারিশ ভেঞ্চুরি গিগ-প্ল্যাটফর্ম কর্মীদের উপর কোভিডকালীন পর্বে কী প্রভাব পড়েছে তার একটা সমীক্ষা চালায়। সেখানে তারা দেখিয়েছেন, কোভিডের থাবায় এই অর্থনীতির সাথে যুক্ত ৮৭ শতাংশ কর্মীর আয় কমে গেছে, তারা আয় করছেন বড়জোর মাসে ১৫ হাজার টাকা। ৮১ শতাংশ কর্মীর আয় অনেকটাই তলিয়ে গেছে। এমনিতেই ভারতের শ্রমবাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত কমে এসেছে, এই ক্ষেত্রেও তার প্রবল ছাপ রয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে চলা এই জগতে মহিলাদের অংশগ্রহণ অনেক কমে যাচ্ছে এই প্রযুক্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য।
এখনও পর্যন্ত গিগ-প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের আইনি স্টেটাস অস্পষ্ট, ধোঁয়াশায় ভরা। মোদীর তৈরি করা কোড অন সোশ্যাল সিকিউরিটি, ২০২০তে এদের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেও ভুলভাবে সংজ্ঞায়িত করায় তারা সমস্ত ধরনের শ্রম আইনেরই বাইরে থেকে গেলেন। গিগ-প্ল্যাটফর্ম কর্মীদের কোড এইভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে — “গিগ শ্রমিক হলেন এমনই এক ব্যক্তি, যারা সাবেক শ্রমিক-নিয়োগকর্তার সম্পর্কের বাইরে গিয়ে একধরনের কাজের সাথে যুক্ত যারা সেখান থেকে কিছু উপার্জন করেন।” একইভাবে, ‘প্ল্যাটফর্ম’ কাজকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে “কর্মী-নিয়োগকারী সাবেক সম্পর্কের বাইরে অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে কিছু নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে যারা পরিষেবা দিয়ে থাকেন”।
আজ দুনিয়া জুড়েই লড়াই করে গিগ-প্ল্যাটফর্ম কর্মীরা ‘শ্রমিক’ হিসাবে নিজেদের স্বীকৃতি আদায় করে নিতে সচেষ্ট। ইউরোপের বেশ কিছু দেশের আদালত গিগ শ্রমিকদের সপক্ষে এমন কিছু রায় দিয়েছেন যা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যুক্তরাজ্যের শীর্ষ আদালত এই মর্মে রায় দিয়েছে এতদিন “স্বাধীন কন্ট্রাকটরের জামা পরিয়ে” গিগ কর্মীদের যেভাবে দেখানো হচ্ছিল তা অন্যায্য। এদের মধ্যে স্পষ্টতই রয়েছে শ্রমিক-নিয়োগকর্তার সম্পর্ক। অর্থাৎ, তারা শ্রমিক। তারা শ্রমিকদের সমস্ত অধিকার, ন্যূনতম মজুরি, সবেতন ছুটি প্রভৃতি পাবেন। স্পেন এই প্রথম আইন পাশ করে কৃত্রিম মেধাকে নিয়ন্ত্রিত করল, গিগ শ্রমিকদের ‘শ্রমিক’ হিসাবে ঘোষণা করল। ফ্রান্সও সেই পথেই হাঁটল। আর, ভারত উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করল।
এই নতুন আত্মপ্রকাশমান সামাজিক স্তরকে সংগঠিত করার উদ্যোগ শুরু হয়েছে গোটা দেশ জুড়ে, বিভিন্ন সংগঠন মঞ্চ গঠন করে। আমাদেরও এই প্রশ্নে উদ্যোগ নিতে হবে।
- অতনু চক্রবর্তী