রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে শাসক দলের মন্ত্রী ও নেতাদের কি নিজেদের মালিক বলে মনে হয়? টেলিকম মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণো গত ২৭ জুলাই বিএসএনএল’এর জন্য ১.৬৪ লক্ষ কোটি টাকার পুনরুজ্জীবন প্যাকেজ ঘোষণা করার কয়েক দিন পরই বৈঠকে বসলেন বিএসএনএল পরিচালকদের সঙ্গে। সেই বৈঠকে তিনি বললেন, বিএসএনএল কর্মীদের ‘সরকারি চালচলন’ ছেড়ে ভালো করে কাজ করতে হবে, আর যারা কাজ করতে অস্বীকার করবে তাদের ভিআরএস নিতে বাধ্য করা হবে। (কেউ এখানে প্রশ্ন তুলতেই পারেন, মন্ত্রী যে ‘সরকারি চালচলন’এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন, সরকারে থেকে সেই চালচলনের ভাগীদার কি তিনি নিজেও নন?) এরপর বিজেপির কর্নাটকের সাংসদ অনন্ত হেগড়ে বিএসএনএল কর্মীদের দেশদ্রোহী পর্যন্ত বললেন। বিএসএনএল কর্মীদের উদ্দেশে বলা তাঁর কয়েকটা কথা ছিল এরকম — “আপনারা শুধু সরকারি কর্মীই নন, আপনারা দেশদ্রোহীও বটে”। বিএসএনএল’এর আজকের দুরবস্থার জন্য তার কর্মীদের দায়ী করার, তাদের বলির পাঁঠা বানানোর যে প্রয়াস টেলিকম মন্ত্রী এবং বিজেপি সাংসদ চালালেন তা যে প্রকৃত সত্যের পরিপন্থী সেটা দেখানোর চেষ্টাই আমরা এখানে করব। আর তাঁরা তাঁদের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে যে মনোভাব প্রকাশ করলেন তা শ্রমিক সম্পর্কে মালিকের মনোভাবের অনুরূপ। যখন ইচ্ছা কর্মীদের অপমান করার, তাদের কর্মচ্যুত করার যে অধিকার মালিকের থাকে। এখান খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, অশ্বিনী বৈষ্ণো ও অনন্ত হেগড়ে কি বিএসএনএল’কে ঘিরে মোদী সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত নন? বিএসএনএল আজ যে দুর্বিপাকগ্ৰস্ত, চিররুগ্ন অবস্থায়, তার পিছনে মোদী সরকারের ভূমিকাই কি নির্ধারক হয়নি? বিএসএনএল আজও যে ৪জি পরিষেবা চালু করতে পারলনা, সেটা কি বিএসএনএল’এর ওপর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায্য সরকারি নির্দেশেরই পরিণাম নয়? অনন্ত হেগড়ে আমাদের আরও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, সরকার বিএসএনএল’কে অর্থ ও প্রযুক্তি দিয়েছে। বিএসএনএল কর্মী ইউনিয়নের কথায় এটা সত্যের অপলাপ ছাড়া অন্য কিছু নয়। সরকার ২০১৯ সালে বিএসএনএল’এর জন্য যে পুনরুজ্জীবন প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল তার থেকে শুধু বিএসএনএল’এর ৭৯,০০০ কর্মীদের ভিআরএস প্রদানই সম্ভব হয়েছিল। আর সে সময় বিএসএনএল’কে দেওয়া ৪জি স্পেকট্রামের ভিত্তিতে বিএসএনএল ২০২০ সালের মার্চ মাসে ৪জি পরিষেবা চালুর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার লক্ষ্যে ৯,০০০ কোটি টাকার টেন্ডার ডাকল। এরপরই দেখা গেল টেলিকম ইকুইপমেন্ট এন্ড সার্ভিসেস প্রমোশন কাউন্সিল (টিইপিসি) সংস্থা বিএসএনএল’এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছে যে, বিএসএনএল ‘ভারতে নির্মাণ কর’ নীতি লঙ্ঘন করছে। তারপরই বিএসএনএল’এর ৪জি পরিষেবা চালুর আকাঙ্খা শিকেয় উঠল, মোদী সরকার বিএসএনএল’এর টেন্ডার বাতিল করে দিল। ‘ভারতে নির্মাণ কর’ নীতি অনুসরণের কোনো দায় যখন জিও, এয়ারটেল, ভোডাফোনের মতো বেসরকারি টেলি সংস্থার ছিলনা, তখন এই নীতিকে মানা ও তার প্রয়োগের দায়ভার বর্তালো শুধু বিএসএনএল’এর ওপরই।
বিএসএনএল কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পি অভিমন্যু তখন বলেছিলেন, “সব বেসরকারি টেলি সংস্থাই যখন আন্তর্জাতিক বিক্রেতাদের কাছ থেকে বিশ্বমানের ৪জি যন্ত্রপাতি কিনছে, তখন দেশীয় বিক্রেতাদের থেকে যন্ত্রপাতি কিনতে শুধু বিএসএনএল’কেই বাধ্য করা হবে কেন? ভারতীয় বিক্রেতাদের নির্ভরযোগ্য ৪জি প্রযুক্তি নেই। তাছাড়া, বড় আকারের নেটওয়ার্ক সামলানোর অভিজ্ঞতাও তাদের নেই। আর তাই ভারতীয় বিক্রেতাদের কাছ থেকে ৪জি যন্ত্রপাতি কিনতে বিএসএনএল’কে বাধ্য করাটা টেলি পরিষেবা দায়ী বেসরকারি সংস্থাগুলোর সাপেক্ষে বিএসএনএল’কে সমমানের ক্রীড়াক্ষেত্র প্রদানে অস্বীকার করা। বিএসএনএল ইউনিয়নের মতে, টিইপিসি একটা ক্রীড়নক ছাড়া অন্য কিছু নয়, ৪জি যন্ত্রপাতি সংগ্ৰহ থেকে বিএসএনএল’কে আটকানোর জন্য কায়েমি স্বার্থগুলো যাকে ব্যবহার করছে।” আমরা অতএব দেখতে পাচ্ছি, রিলায়েন্স জিও, এয়ারটেল, ভোডাফোন আইডিয়ার মতো বেসরকারি টেলি সংস্থাগুলো যখন অবাধে নোকিয়া, এরিকসন, স্যামসাং’এর মতো আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে উন্নত মানের যন্ত্রপাতি কিনে ৪জি পরিষেবা চালিয়ে যাচ্ছে, বিএসএনএল’কে তখন অনির্ভরযোগ্য দেশীয় বিক্রেতার ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য করা হচ্ছে। টিইপিসি’কে দিয়ে যে কাঁটা ২০১৯ সালে বিএসএনএল’এর পথে বিছোনো হয়েছিল তা আজও ছড়িয়ে রয়েছে। অশ্বিনী বৈষ্ণো এবং অনন্ত হেগড়ে কি বিএসএনএল’কে আটকে রাখার এই আখ্যান সম্পর্কে সত্যিই অবহিত নন?
বেসরকারি সংস্থাগুলোর ৪জি পরিষেবা দিতে থাকা এবং বিএসএনএল’কে ২জি’র মধ্যে আটকে রাখার ফল যা অনিবার্য ছিল তাই হল — বিএসএনএল’এর গ্ৰাহক ভিত্তি কমতে থাকল, রাজস্বের ক্রমান্বয়ী ক্ষয়ে সে চলে গেল ক্ষতির গ্ৰাসে। কয়েক বছর আগে ফিরে তাকালে দেখা যাবে ২০০৫ সালে টেলি বাজারে বিএসএনএল’এর অংশ ছিল ২১ শতাংশ, এয়ারটেল’এর ছিল বিএসএনএল’এর প্রায় সমান অংশ এবং রিলায়েন্স কমিউনিকেশন’এর অংশ ছিল এরচেয়ে সামান্য বেশি। কিন্তু বিএসএনএল’কে পশ্চাদবর্তী অবস্থানে ফেলে রাখায় গ্ৰাহকরা বিএসএনএল’এর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে থাকলেন। একটা হিসেব বলছে, গত পাঁচ বছরে উন্নত পরিষেবা পেতে বিএসএনএল ছেড়ে বেসরকারি সংস্থাগুলোর দিকে ঝুঁকেছেন প্রায় দু’কোটি গ্ৰাহক এবং আজকের এই ২০২২ সালে টেলি বাজারে বিএসএনএল’এর অংশ মাত্র ১০ শতাংশ। জানানো হয়েছিল, এবছরের ১৫ আগস্ট বিএসএনএল ৪জি পরিষেবা শুরু করতে পারবে। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে, এবছরেও তা হবে না, সামনের বছর হতে পারে। কারণ, ৪জি পরিষেবা শুরুর জন্য যে যন্ত্রপাতি প্রয়োজন তা এখনও সংগ্ৰহ হয়নি এবং যে দেশীয় বিক্রেতা টিসিএস বিএসএনএল’কে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে, সব যন্ত্রপাতির জোগাড় তারাও করে উঠতে পারেনি। পরিস্থিতির এমনই পরিহাস, বেসরকারি সংস্থাগুলো যখন ৫জি পরিষেবা চালু করার মুখে, তখনও বিএসএনএল’কে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে দেশীয় বিক্রেতার মুখের দিকে — কখন তাদের অনুগ্ৰহে বিএসএনএল’এর পক্ষে ৪জি পরিষেবা চালু করা সম্ভব হবে। এই ৪জি পরিষেবা শুরুর বিলম্বের কারণেই উন্নত টেলি পরিষেবা ক্ষেত্রে প্রভাব সৃষ্টির সুযোগ থেকে বিএসএনএল লাগাতার বঞ্চিত হয়ে চলেছে।
ভারতে ৪জি পরিষেবা চালু হয় ২০১২ সালে, ফলে, পুরো একটা দশক বিএসএনএল’কে বৈষম্যে জর্জরিত করে পিছিয়ে রাখা হল। এবং তা করা হল টেলিকম বাজারে বেসরকারি সংস্থাগুলোর কর্তৃত্বকে সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যেই। বিএসএনএল’এর প্রতি প্রবল আক্রোশ থেকে অনন্ত হেগড়ে বলেছেন, “বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে আমরা একে (বিএসএনএল’কে) শেষ করে দিচ্ছি এবং বেসরকারি খেলোয়াড়দের তার স্থান দখল করতে দিচ্ছি”। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার প্রতি এই বৈর অভিপ্রায়, বেসরকারি সংস্থার স্বার্থ সিদ্ধির এই আকুলতাই বিএসএনএল’কে ঠেলে দিয়েছে বিপন্নতার অতলে, ফেলে রেখেছে জীবন্মৃত অবস্থায়। কিন্তু এটাই কি বিএসএনএল’এর অমোঘ নিয়তি হবে? টেলিকম বাজারে প্রবল উপস্থিতি থেকে তার আজকের এই নগন্য অস্তিত্বকেই কি আমরা মেনে নেব? রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের এই সংস্থাকে নিঃশেষ করে দেওয়ার দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধেই আমাদের বরং আওয়াজ ওঠাতে হবে — পুনরুজ্জীবন প্যাকেজের প্রতি সরকারকে আন্তরিক হতে হবে; বিএসএনএল’এর বিরুদ্ধে চালানো বৈষম্য ও বঞ্চনার ইতি ঘটিয়ে বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমান সুযোগ বিএসএনএল’কেও দিতে হবে। আর সেটা করলে বিএসএনএল নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে লোকসানের ধারাকে অতিক্রম করে মুনাফার পথে অবশ্যই ফিরে আসতে পারবে।
- জয়দীপ মিত্র